Friday, April 23, 2010
সরে দাঁড়ানোর পথ পেলেন না হাফিজ
সরে দাঁড়ানোর পথ পেলেন না হাফিজ
হামলার অভিযোগ বিএনপির ॥ আওয়ামী লীগ বলছে আহতরা হাফিজের বাড়িতে কেন
মামুন-অর-রশিদ/হাসিব রহমান, লালমোহন থেকে ॥ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কাঁধে রাইফেল রেখে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছিলেন মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন। ভোলা-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থী শাওনের পক্ষে গণজোয়ার দেখে। মুখ রক্ষার চেষ্টা করছেন হাফিজ কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে ভোলায় জোটের সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহানের বাসায় কেন্দ্রীয় নেতা সেলিমা রহমান, আব্দুল্লাহ আল নোমানের উপস্থিতি ও কেন্দ্রীয় নির্দেশনার কারণে বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ২৪ এপ্রিলের নির্বাচনে তিনি অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, এর আগে গত বুধবার নির্বাচন সাত দিন পেছানোর দাবি এবং এই দাবি না মানলে চেয়ারপার্সনের সঙ্গে মতবিনিময় করে তিনি নির্বাচনে থাকা-না থাকার বিষয় সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানান। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিভিন্ন কেন্দ্রে স্থানীয়দের পরিবর্তে দূরদূরান্ত থেকে আগত দলীয় কর্মীদের এজেন্ড করার কথা জানান। এদিকে আওয়ামী লীগ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, নির্বাচন কেন্দ্রে গোলযোগ সৃষ্টি এবং নির্বাচন ভুল করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লৰ্যে বহিরাগতদের পোলিং এজেন্ট করতে চান হাফিজ উদ্দিন। কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় এই পথ খোলা রাখতে চান তিনি বলে অভিযোগ আওয়ামী লীগের। শেষ পর্যন্ত দু'পক্ষের অংশগ্রহণেই নির্বাচন হচ্ছে।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকেই হাফিজ উদ্দিন নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের পায়ে পায়ে দোষ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি প্রতিদিন দলীয় নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে হামলা-মামলার অভিযোগ করেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার এই আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই শ' ছাড়িয়ে তিন শ'তে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেন। তাঁর বাড়িতে একজন লোক শোয়া ছিল যার শরীরে কোন জখমের চিহ্ন ছিল না। হাফিজ উদ্দিন প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলছেন। নির্বাচনী প্রচারের শেষ মুহূর্তে এসে দু'প্রার্থী যেখানে ব্যাপক জনসংযোগে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল, কিন্তু দু'পৰই ব্যস্ত ছিল সংবাদ সম্মেলনে। বিকাল সাড়ে তিনটায় শাহবাজ কলেজ মাঠে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন। বিকাল চারটায় নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন।
মেজর হাফিজ উদ্দিন এই আসন থেকে আটবার নির্বাচন করেন। এরমধ্যে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। বাকি ছ'টি নির্বাচনে কখনও জাতীয় পার্টি, কখনও বিএনপি, স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচন করেন। এক এগারোর প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তিনি খালেদা-তারেককে ছেড়ে রাতারাতি সংস্কারপন্থী হয়ে যান। এমনকি নতুন দল করে সেই দলের মহাসচিব হয়ে বসেন। বেগম জিয়া মুক্তির পর তিনি আবার নিজেকে বিএনপিতে ভেড়াতে সক্ষম হন। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮'র নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থী মেজর (অব) জসীমের কাছে ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। অবসরে যাওয়ার তিন বছর পার হওয়ার আগেই নির্বাচনে অংশ নেয়ায় আইনভঙ্গের কারণে নির্বাচন কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে।
নতুন এই উপ-নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে হাফিজ খুবই আশাবাদী ছিলেন। হাফিজের ধারণা ছিল, ছয়বারের এমপি এবং এবার মেজর জসীমের ১৩ হাজার ভোটে হারলেও উপনির্বাচনে শাওনকে হারানো কোন ব্যাপার হবে না। কিন্তু বাংলা সিনেমার নবাগত মুখের মতো শাওন সর্বত্র বাজিমাত করে ফেলে। সরকার এ ব্যাপারে নীরব থাকলেও দল হিসাবে আওয়ামী লীগ তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে শাওনের সমর্থনে নামে। এতে মাথা খারাপ হয়ে যায় মেজর হাফিজের। তখন কি বলছেন, বলছেন না, আর স্বীকার করছেন, অস্বীকার করছেন কোন কিছুর হিসাব রাখতে পারছে না হাফিজ। সিইসির সঙ্গে বৈঠকে সকল সাংবাদিকের সামনে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরদিনই বলেছেন, 'সিইসি আমার কোন কথাই রাখেননি। আবার বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে সাতদিন নির্বাচন পেছানোর দাবি তুলে বলেন, অন্যথায় দলীয় চেয়ারপার্সনের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিবেন তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন কিন। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে তিন বেমালুম অস্বীকার করে বলেন, সাতদিন সময় বাড়িয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের কথা বলেছি। নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে কিছু বলিনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা ঢাকায় নাকি বলেছেন, লালমোহন-তজুমদ্দিনে আড়াই শ' লোক আহত হওয়ার অভিযোগ সত্য নয় জানিয়ে হাফিজ উদ্দিন বলেন, তাহলে কাদস্বিনীকে কি মরিয়াই প্রমাণ করতে হবে।
এলাকার মানুষের অভিযোগ, হাফিজ এতদিন 'মৌমাছি বাহিনী', 'মার্শাল বাহিনী', 'হকিস্টিক বাহিনীকে', কাজে লাগিয়ে এমপি হতেন। এবারের নির্বাচনে এসব বাহিনী কাজে না লাগাতে পারায় তিনি নির্বাচন বর্জনের নানা পথ খুঁজছেন। তবে নির্বাচনে যাতে গণ্ডগোল হয় এবং সেটি ইস্যু করে নির্বাচন পণ্ড করার ষড়যন্ত্র এখনও তাদের হাতে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অমান্য করে এখনও পর্যন্ত বহিরাগত শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আব্দুল্লাহ আল নোমান, শাম্মী আখতারসহ অসংখ্য বহিরাগতের মেজর হাফিজের বাড়িতে অবস্থান করছেন। বৃহস্পতিবার সকালে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহানের বাসভবনে নির্বাচন ভণ্ডুলের নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়। সেখানেই বহিরাগতদের পোলিং এজেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ বাড়িতেই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনী এলাকায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয় হাফিজ ইব্রাহিম। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর মৌমাছি বাহিনীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়টি কোন ক্রমেই স্বীকার করছে না হাফিজ উদ্দিন। হাফিজ ইব্রাহিম পূর্বনির্ধারিত বিশাল সমাবেশ বাদ দিয়ে মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশের আয়োজন করে। এতে তেমন লোক সমাগম চোখে পড়েনি।
আওয়ামী লীগের সাংবাদিক সম্মেলন : ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমন্বয়ক, উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ এমপি বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনী এজেন্টের নামে শত শত বাহিরাগত লোক এখানে এনেছে। যারা ভোলা সদরের লোক এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মী। তোফায়েলের প্রশ্ন_আমরা যদি ৮৭ জন এমপি দিয়ে এজেন্ট করি? কিন্তু আমরা স্থানীয়দের দিয়ে এজেন্ট করছি। বিএনপির মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন তারা ইস্যু করতে চায়। তারা বহিরাগত এনে নৈরাজ্য করতে চায়।
তোফায়েল আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকালে ভোলার লালমোহন শাহাবাজপুর কলেজ মাঠে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সাংবাদিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির নেতারা ঢাকায় বসে প্রেস ব্রিফিং করে বলে, তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। মাথায় পট্টি বেঁধে বাসায় এনেছে। কিন্তু জুডিশিয়াল তদন্ত টিমের সামনে তারা একজনকেও হাজির করতে পারেনি। তারা মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। আমাদের যে সব নেতা নির্বাচনী প্রচারণায় এসেছে তারা আজ বৃহস্পতিবার চলে যাবে। এমনকি পাশের উপজেলার এমপি জ্যাকবও নির্বাচনের দিন থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের সামনে অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নির্বাচন করতে যে সিদ্ধান্ত দু'প্রার্থীর সামনে নেয়া হয়েছে তা হাফিজ এখন মানছে না। হাফিজ এখন নতুন ষড়যন্ত্র করছে। তাই নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব করছে। কিন্তু এটা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফ বলেন, এলাকায় কোন লোক তাদের ভোটার নয়। তাই বাইরে থেকে এজেন্ট এনেছে। তারা নির্বাচন বিতর্কিত করতে চেষ্টা করছে। তারা ঢাকায় বসে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়। তারা কোন ইস্যু না পেয়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে নির্বাচন বানচাল করতে চায়। দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য। জাতি তাদের ভণ্ডামি বুঝে গেছে। নির্বাচনে হেরে যাবার ভয়ে তারা নিত্য নতুন মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁরানোর পথ খুঁজছে। আওয়ামী নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন_ তোফায়েল আহমেদ, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম, ওমর ফারুক চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, লিয়াকত শিকদার, বলরাম পোদ্দার, খলিলুর রহমান।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, তিনি পাঁচ বার এখান থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন অথচ এখন এজেন্ট দিতে পারছেন না_ কেন? তাহলে তিনি জনগণের বিরুদ্ধে এমন কিছু করেছেন যাতে কেউ তাঁর এজেন্ট হতে চায় না। নির্বাচন বিতর্কিত করার জন্য তিনি যে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্র করছেন এ বিষয়ে আজ আর কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। বক্তারা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য তারা এখন ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। বহিরাগতদের ব্যাপারে হাফিজ উদ্দিনই প্রথম প্রশ্ন তুলেছেন, এখন নিজেই বহিরাগতদের পৰে বলছেন, সত্যিই বিচিত্র চরিত্রের লোক সে।
বিএনপির সাংবাদিক সম্মেলন : বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকালে তাঁর লালমোহন বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এবার পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, রেবের পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। মিডিয়াতে তাঁর কথা যথাযথভাবে প্রচার করা হয় না। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য তিনি ৭ দিন নির্বাচন পিছানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু মিডিয়া তা ভুল প্রচার করেছে। তাঁর অভিযোগ_ আওয়ামী লীগ ২/১টি ছাড়া সব মিডিয়াকে ম্যানেজ করেছে।
হাফিজ বলেছেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের আহত করার সেঞ্চুরি হবে এক দিনেই। আমার বাড়িতে রগকাটা, মাথা ফাটা আহতরা এখনও রয়েছে। এখনও কি সিইসির সন্দেহ দূর হবে না। এখানে প্রচুর অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী ঘুরে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক, ভোটারদের হুমকি দিচ্ছে, যাতে ভোট দিতে না যায়। ভোট কেন্দ্রে গেলে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়া হবে। আগামী ৩ বছর এলাকায় শান্তিতে থাকতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে অত্যাধুনিক গাড়িতে করে এখানে সন্ত্রাসীরা এসেছে। তারা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভোটারদের হুমকি দিচ্ছে।
হাফিজ বলেন, তাঁর বাসায় এখন ৮ জন আহত দলীয় কর্মী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তিনি এ সময় উল্লেখ করেন, বদরপুর আলতাব মেম্বারের বাড়িতে হামলা হয়েছে। ৪/৫টি বাড়ি লুট হয়েছে। র্যাবকে জানানো হলেও তারা যায়নি। রিটার্নিং অফিসার না বললে, র্যাব যাবে না। তালতলা বাজারে বিএনপির কর্মী মাহাবুবুর রহমানসহ ৬/৭ জনকে আহত করেছে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। তজুমদ্দিন উপজেলার চাচড়া ইউনিয়নে মাইকিং করে বিএনপির নেতাকর্মীদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। লালমোহনের ধলিগরনগর ছাত্রদল নেতা মিঠুকে আটকে রেখেছিল। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। জনতা বাজারে মৌলভী নুরুল হক, জহির, আয়শাকে মারধর ও কুপিয়ে আহত করেছে। লালমোহন ইউনিয়নে বিএনপি কর্মী মজিবকে ধান ক্ষেতে নিয়ে পায়ের রগ কর্তন করেছে। এমন কি তার মাকেও কুপিয়েছে।
হাফিজ আরও অভিযোগ করেন, আমার দলের নেতাকর্মীদের ওপর প্রতিপক্ষ দলের সন্ত্রাসীরা শুধু হামলাই করছে না। তারা এখন পুলিশ দিয়ে বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। দলের শীর্ষ নেতাকর্মীদেরকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করেছে। তিনি নির্বাচন বর্জন করার কথা নাকোচ করে বলেন, আমার কি মাথা খারাপ, আমি নির্বাচন বয়কট করব। আমি এখানে ৬ বার এমপি হয়েছি।
সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি আইনকানুন সব জানি। যে সব এলাকায় ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছে ওই এলাাকয় অন্য উপজেলার লোক দিয়ে পোলিং এজেন্ট করা হবে। এ সময় সংসদ সদস্য এ্যানি বলেন, প্রয়োজনে আমরা এমপিরা, বিএনপি নেতৃবৃন্দ এজেন্ট হব। ভোটের দিন ২০ জন জাতীয় নেতা, এমপি থাকার জন্য নির্বাচন কমিশনে জানিয়েছি। তারা দেখবে এলাকার চিত্র।
হাফিজ বলেন, আহতের সংখ্যা ২৫০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এক দিনেই আহতের সেঞ্চুরি হয়েছে। এত কিছুর পরও সিইসির না কি সন্দেহ যায়নি। কোন নেতাকর্মীর মৃত্যু না হলে তিনি বিশ্বাস করবেন না।
সাংবাদিক সম্মেলন চলাকালে বলা হয়, এইমাত্র একজন বিএনপির কর্মীকে আহত অবস্থায় তাঁর বাড়িতে আনা হয়েছে। ওই সময় সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, মিডিয়াতে বিএনপির নিউজ প্রচার ঠিকমতো হয় না। এ সময় খুব কর্কশ ভাষায় হাফিজ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে এ সময় উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান, শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু এমপি, নিলুফার চৌধুরী মনি এমপি, শামীমা আক্তার এমপি, রাশেদা বেগম হীরা এমপি, বিলকিস জাহান এমপি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবুন নবী সোহেল, কৃষক দলের সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদু, সাবেক এমপি সিরিন প্রমুখ।
বিএনপি বিকালে লালমোহন শহরে শেষ নির্বাচনী মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকেই হাফিজ উদ্দিন নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের পায়ে পায়ে দোষ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি প্রতিদিন দলীয় নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে হামলা-মামলার অভিযোগ করেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার এই আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই শ' ছাড়িয়ে তিন শ'তে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেন। তাঁর বাড়িতে একজন লোক শোয়া ছিল যার শরীরে কোন জখমের চিহ্ন ছিল না। হাফিজ উদ্দিন প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলছেন। নির্বাচনী প্রচারের শেষ মুহূর্তে এসে দু'প্রার্থী যেখানে ব্যাপক জনসংযোগে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল, কিন্তু দু'পৰই ব্যস্ত ছিল সংবাদ সম্মেলনে। বিকাল সাড়ে তিনটায় শাহবাজ কলেজ মাঠে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন। বিকাল চারটায় নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন।
মেজর হাফিজ উদ্দিন এই আসন থেকে আটবার নির্বাচন করেন। এরমধ্যে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। বাকি ছ'টি নির্বাচনে কখনও জাতীয় পার্টি, কখনও বিএনপি, স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচন করেন। এক এগারোর প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তিনি খালেদা-তারেককে ছেড়ে রাতারাতি সংস্কারপন্থী হয়ে যান। এমনকি নতুন দল করে সেই দলের মহাসচিব হয়ে বসেন। বেগম জিয়া মুক্তির পর তিনি আবার নিজেকে বিএনপিতে ভেড়াতে সক্ষম হন। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮'র নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থী মেজর (অব) জসীমের কাছে ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। অবসরে যাওয়ার তিন বছর পার হওয়ার আগেই নির্বাচনে অংশ নেয়ায় আইনভঙ্গের কারণে নির্বাচন কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে।
নতুন এই উপ-নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে হাফিজ খুবই আশাবাদী ছিলেন। হাফিজের ধারণা ছিল, ছয়বারের এমপি এবং এবার মেজর জসীমের ১৩ হাজার ভোটে হারলেও উপনির্বাচনে শাওনকে হারানো কোন ব্যাপার হবে না। কিন্তু বাংলা সিনেমার নবাগত মুখের মতো শাওন সর্বত্র বাজিমাত করে ফেলে। সরকার এ ব্যাপারে নীরব থাকলেও দল হিসাবে আওয়ামী লীগ তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে শাওনের সমর্থনে নামে। এতে মাথা খারাপ হয়ে যায় মেজর হাফিজের। তখন কি বলছেন, বলছেন না, আর স্বীকার করছেন, অস্বীকার করছেন কোন কিছুর হিসাব রাখতে পারছে না হাফিজ। সিইসির সঙ্গে বৈঠকে সকল সাংবাদিকের সামনে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরদিনই বলেছেন, 'সিইসি আমার কোন কথাই রাখেননি। আবার বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে সাতদিন নির্বাচন পেছানোর দাবি তুলে বলেন, অন্যথায় দলীয় চেয়ারপার্সনের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিবেন তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন কিন। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকালে সংবাদ সম্মেলনে তিন বেমালুম অস্বীকার করে বলেন, সাতদিন সময় বাড়িয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের কথা বলেছি। নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে কিছু বলিনি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা ঢাকায় নাকি বলেছেন, লালমোহন-তজুমদ্দিনে আড়াই শ' লোক আহত হওয়ার অভিযোগ সত্য নয় জানিয়ে হাফিজ উদ্দিন বলেন, তাহলে কাদস্বিনীকে কি মরিয়াই প্রমাণ করতে হবে।
এলাকার মানুষের অভিযোগ, হাফিজ এতদিন 'মৌমাছি বাহিনী', 'মার্শাল বাহিনী', 'হকিস্টিক বাহিনীকে', কাজে লাগিয়ে এমপি হতেন। এবারের নির্বাচনে এসব বাহিনী কাজে না লাগাতে পারায় তিনি নির্বাচন বর্জনের নানা পথ খুঁজছেন। তবে নির্বাচনে যাতে গণ্ডগোল হয় এবং সেটি ইস্যু করে নির্বাচন পণ্ড করার ষড়যন্ত্র এখনও তাদের হাতে রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অমান্য করে এখনও পর্যন্ত বহিরাগত শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আব্দুল্লাহ আল নোমান, শাম্মী আখতারসহ অসংখ্য বহিরাগতের মেজর হাফিজের বাড়িতে অবস্থান করছেন। বৃহস্পতিবার সকালে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহানের বাসভবনে নির্বাচন ভণ্ডুলের নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়। সেখানেই বহিরাগতদের পোলিং এজেন্ট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ বাড়িতেই নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনী এলাকায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয় হাফিজ ইব্রাহিম। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর মৌমাছি বাহিনীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়টি কোন ক্রমেই স্বীকার করছে না হাফিজ উদ্দিন। হাফিজ ইব্রাহিম পূর্বনির্ধারিত বিশাল সমাবেশ বাদ দিয়ে মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশের আয়োজন করে। এতে তেমন লোক সমাগম চোখে পড়েনি।
আওয়ামী লীগের সাংবাদিক সম্মেলন : ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমন্বয়ক, উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ এমপি বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনী এজেন্টের নামে শত শত বাহিরাগত লোক এখানে এনেছে। যারা ভোলা সদরের লোক এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মী। তোফায়েলের প্রশ্ন_আমরা যদি ৮৭ জন এমপি দিয়ে এজেন্ট করি? কিন্তু আমরা স্থানীয়দের দিয়ে এজেন্ট করছি। বিএনপির মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন তারা ইস্যু করতে চায়। তারা বহিরাগত এনে নৈরাজ্য করতে চায়।
তোফায়েল আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকালে ভোলার লালমোহন শাহাবাজপুর কলেজ মাঠে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সাংবাদিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির নেতারা ঢাকায় বসে প্রেস ব্রিফিং করে বলে, তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। মাথায় পট্টি বেঁধে বাসায় এনেছে। কিন্তু জুডিশিয়াল তদন্ত টিমের সামনে তারা একজনকেও হাজির করতে পারেনি। তারা মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। আমাদের যে সব নেতা নির্বাচনী প্রচারণায় এসেছে তারা আজ বৃহস্পতিবার চলে যাবে। এমনকি পাশের উপজেলার এমপি জ্যাকবও নির্বাচনের দিন থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের সামনে অবাধ, শান্তিপূর্ণ, নির্বাচন করতে যে সিদ্ধান্ত দু'প্রার্থীর সামনে নেয়া হয়েছে তা হাফিজ এখন মানছে না। হাফিজ এখন নতুন ষড়যন্ত্র করছে। তাই নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব করছে। কিন্তু এটা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফ বলেন, এলাকায় কোন লোক তাদের ভোটার নয়। তাই বাইরে থেকে এজেন্ট এনেছে। তারা নির্বাচন বিতর্কিত করতে চেষ্টা করছে। তারা ঢাকায় বসে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়। তারা কোন ইস্যু না পেয়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে নির্বাচন বানচাল করতে চায়। দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য। জাতি তাদের ভণ্ডামি বুঝে গেছে। নির্বাচনে হেরে যাবার ভয়ে তারা নিত্য নতুন মিথ্যা অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁরানোর পথ খুঁজছে। আওয়ামী নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন_ তোফায়েল আহমেদ, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম, ওমর ফারুক চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, লিয়াকত শিকদার, বলরাম পোদ্দার, খলিলুর রহমান।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, তিনি পাঁচ বার এখান থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন অথচ এখন এজেন্ট দিতে পারছেন না_ কেন? তাহলে তিনি জনগণের বিরুদ্ধে এমন কিছু করেছেন যাতে কেউ তাঁর এজেন্ট হতে চায় না। নির্বাচন বিতর্কিত করার জন্য তিনি যে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্র করছেন এ বিষয়ে আজ আর কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। বক্তারা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য তারা এখন ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। বহিরাগতদের ব্যাপারে হাফিজ উদ্দিনই প্রথম প্রশ্ন তুলেছেন, এখন নিজেই বহিরাগতদের পৰে বলছেন, সত্যিই বিচিত্র চরিত্রের লোক সে।
বিএনপির সাংবাদিক সম্মেলন : বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার বিকালে তাঁর লালমোহন বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এবার পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, রেবের পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। মিডিয়াতে তাঁর কথা যথাযথভাবে প্রচার করা হয় না। অস্ত্র উদ্ধারের জন্য তিনি ৭ দিন নির্বাচন পিছানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু মিডিয়া তা ভুল প্রচার করেছে। তাঁর অভিযোগ_ আওয়ামী লীগ ২/১টি ছাড়া সব মিডিয়াকে ম্যানেজ করেছে।
হাফিজ বলেছেন, বিএনপির নেতাকর্মীদের আহত করার সেঞ্চুরি হবে এক দিনেই। আমার বাড়িতে রগকাটা, মাথা ফাটা আহতরা এখনও রয়েছে। এখনও কি সিইসির সন্দেহ দূর হবে না। এখানে প্রচুর অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী ঘুরে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক, ভোটারদের হুমকি দিচ্ছে, যাতে ভোট দিতে না যায়। ভোট কেন্দ্রে গেলে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়া হবে। আগামী ৩ বছর এলাকায় শান্তিতে থাকতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে অত্যাধুনিক গাড়িতে করে এখানে সন্ত্রাসীরা এসেছে। তারা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভোটারদের হুমকি দিচ্ছে।
হাফিজ বলেন, তাঁর বাসায় এখন ৮ জন আহত দলীয় কর্মী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তিনি এ সময় উল্লেখ করেন, বদরপুর আলতাব মেম্বারের বাড়িতে হামলা হয়েছে। ৪/৫টি বাড়ি লুট হয়েছে। র্যাবকে জানানো হলেও তারা যায়নি। রিটার্নিং অফিসার না বললে, র্যাব যাবে না। তালতলা বাজারে বিএনপির কর্মী মাহাবুবুর রহমানসহ ৬/৭ জনকে আহত করেছে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। তজুমদ্দিন উপজেলার চাচড়া ইউনিয়নে মাইকিং করে বিএনপির নেতাকর্মীদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। লালমোহনের ধলিগরনগর ছাত্রদল নেতা মিঠুকে আটকে রেখেছিল। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। জনতা বাজারে মৌলভী নুরুল হক, জহির, আয়শাকে মারধর ও কুপিয়ে আহত করেছে। লালমোহন ইউনিয়নে বিএনপি কর্মী মজিবকে ধান ক্ষেতে নিয়ে পায়ের রগ কর্তন করেছে। এমন কি তার মাকেও কুপিয়েছে।
হাফিজ আরও অভিযোগ করেন, আমার দলের নেতাকর্মীদের ওপর প্রতিপক্ষ দলের সন্ত্রাসীরা শুধু হামলাই করছে না। তারা এখন পুলিশ দিয়ে বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। দলের শীর্ষ নেতাকর্মীদেরকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করেছে। তিনি নির্বাচন বর্জন করার কথা নাকোচ করে বলেন, আমার কি মাথা খারাপ, আমি নির্বাচন বয়কট করব। আমি এখানে ৬ বার এমপি হয়েছি।
সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি আইনকানুন সব জানি। যে সব এলাকায় ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছে ওই এলাাকয় অন্য উপজেলার লোক দিয়ে পোলিং এজেন্ট করা হবে। এ সময় সংসদ সদস্য এ্যানি বলেন, প্রয়োজনে আমরা এমপিরা, বিএনপি নেতৃবৃন্দ এজেন্ট হব। ভোটের দিন ২০ জন জাতীয় নেতা, এমপি থাকার জন্য নির্বাচন কমিশনে জানিয়েছি। তারা দেখবে এলাকার চিত্র।
হাফিজ বলেন, আহতের সংখ্যা ২৫০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এক দিনেই আহতের সেঞ্চুরি হয়েছে। এত কিছুর পরও সিইসির না কি সন্দেহ যায়নি। কোন নেতাকর্মীর মৃত্যু না হলে তিনি বিশ্বাস করবেন না।
সাংবাদিক সম্মেলন চলাকালে বলা হয়, এইমাত্র একজন বিএনপির কর্মীকে আহত অবস্থায় তাঁর বাড়িতে আনা হয়েছে। ওই সময় সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, মিডিয়াতে বিএনপির নিউজ প্রচার ঠিকমতো হয় না। এ সময় খুব কর্কশ ভাষায় হাফিজ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে এ সময় উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমান, শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু এমপি, নিলুফার চৌধুরী মনি এমপি, শামীমা আক্তার এমপি, রাশেদা বেগম হীরা এমপি, বিলকিস জাহান এমপি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবুন নবী সোহেল, কৃষক দলের সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদু, সাবেক এমপি সিরিন প্রমুখ।
বিএনপি বিকালে লালমোহন শহরে শেষ নির্বাচনী মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরম্নদ্ধে প্রতিপক্ষের বহুমাত্রিক চক্রান্ত
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরম্নদ্ধে প্রতিপক্ষের বহুমাত্রিক চক্রান্ত
শাহরিয়ার কবির
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২-এর জানুয়ারিতে আমরা যখন প্রথম সংগঠিতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করি তখনই '৭১-এর ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী আমাদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ এনেছে আমরা নাকি ভারতের দালাল, ঠিক যেমনটি তারা বলত '৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগকে। জামায়াত আরও বলেছে_ যুদ্ধাপরাধী বলে দেশে নাকি কেউ নেই, জামায়াতের কেউ নাকি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, বঙ্গবন্ধু নাকি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন ইত্যাদি।
গত দেড় যুগেরও অধিককাল জামায়াতের '৭১-এর ভূমিকা আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরেছি, তৃণমূল থেকে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন যাবতীয় দুষ্কর্মের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছি, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি, কর্মশালা-শোভাযাত্রা, সমাবেশ প্রভৃতির আয়োজন করেছি; জামায়াতীদের এলাকায় পাঠাগার স্থাপন করেছি এবং এভাবেই জামায়াতের প্রকৃত চেহারা দেশবাসী, বিশেষভাবে তরম্নণ প্রজন্মের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের এসব তৎপরতা শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের প্রত্যনত্ম অঞ্চল অবধি বিসত্মৃত। একই সঙ্গে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি'র তৎপরতা বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ১২টি দেশে আমাদের শাখা রয়েছে।
আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে জামায়াত যেসব অপপ্রচার করেছে, যেসব প্রশ্ন তুলেছে_ দেশবাসী যে তা প্রত্যাখ্যান করেছে তার প্রমাণ হচ্ছে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে, শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে খালেদা-নিজামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের। গত নির্বাচনে জামায়াতের একজন যুদ্ধাপরাধীও নির্বাচিত হতে পারেনি, অথচ এর আগের নির্বাচনে বিএনপির বদৌলতে জামায়াতের ডজনখানেক যুদ্ধাপরাধী জাতীয় সংসদের আসন কলঙ্কিত করেছে, যাদের দু'জনকে খালেদা জিয়া মন্ত্রী পর্যনত্ম বানিয়েছিলেন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মহাজোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রানত্মে উপনীত হয়েছে। এ বিজয়ের জন্য আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়েছে, বহু চড়াই-উৎরাই পেরম্নতে হয়েছে। আন্দোলনের নেতাকমর্ীদের হত্যা, নির্যাতন, চাকরিচু্যতি, মিথ্যা মামলাসহ বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামাল থেকে আরম্ভ করে বিচারপতি কেএম সোবহান পর্যনত্ম বহু নেতাকে আমরা হারিয়েছি, তারপরও এ আন্দোলন থেমে থাকেনি। সত্যকে কখনও প্রতিহত করা যায় না। কিছু সময়ের জন্য মিথ্যার কালো মেঘ সত্যকে আচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু সত্য সব সময় আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়।
২০০৯ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার যখন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখন থেকে '৭১-এর ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, পায়ের তলার মাটিতে ধস নেমেছে। গত এক বছরে জামায়াতের বহু কমর্ী দলত্যাগ ও দেশত্যাগ করেছে। ধ্বংস অনিবার্য জেনে জামায়াত এখন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত তাদের দেশী-বিদেশী মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে বঙ্গবন্ধুর সরকার কতর্ৃক প্রণীত 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন ১৯৭৩' অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইবু্যনালে। এ আইনে অপরাধের সংজ্ঞা, বিচার পদ্ধতি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও শাসত্মি সম্পর্কে সবই বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, জাপান ও ফিলিপিন্সসহ বহু দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এসব ট্রাইবু্যনালে কখনও চিরাচরিত সাক্ষ্য আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার বিচার সম্ভব নয় বলেই জার্মানির নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় নুরেমবার্গের বিশেষ আদালতে বিশেষ নীতি ও বিধান প্রণীত হয়েছিল। বাংলাদেশের '৭৩-এর আইন অতীতের এসব নীতি ও বিধানের নির্যাস গ্রহণ করে ঋদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের আগে পৃথিবীর কোন দেশ মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ, শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা বিচারের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নিজস্ব আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি।
নুরেমবার্গ বা টোকিও ট্রাইবু্যনালের জন্য প্রণীত নীতি ও বিধানের চেয়ে বাংলাদেশের 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন' যে অনেক উন্নতমানের এ কথা আনত্মর্জাতিক অঙ্গনের বহু খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের সেরা আইনজ্ঞরাসহ নুরেমবার্গ ট্রাইবু্যনালের সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরা এবং ভারতের দু'জন শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞ এ আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন যেটি আমাদের সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বিঘি্নত করার জন্য জামায়াত ও বিএনপির আইনজীবীরা '৭৩-এর আইন সম্পর্কে, অপরাধের সংজ্ঞা সম্পর্কে অদ্ভুত সব প্রশ্ন তুলেছেন। সমপ্রতি তাঁরা বলছেন, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ক্ষমতায় এসে এখন বলছে মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধের বিচার করবে। তাঁরা বিভিন্ন সেমিনারে বা গণমাধ্যমে এমনভাবে বিষয়টি উত্থাপন করছেন যেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। '৭৩-এর আইনে এসব অপরাধের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা এতদসংক্রানত্ম যাবতীয় আনত্মর্জাতিক আইনসম্মত। আমাদের আইনজ্ঞরা '৭৩-এর আইনে যেভাবে এসব অপরাধের সংজ্ঞা দিয়েছেন তার সঙ্গে প্রচুর মিল রয়েছে ২০০২ সালে গৃহীত রোমের আনত্মর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনের।
বাংলাদেশে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি' গত ১৮ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে। '৭৩-এর আইনে 'যুদ্ধাপরাধ', 'মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'গণহত্যা' প্রভৃতির পৃথক সংজ্ঞা দেয়া আছে। তবে সাধারণভাবে আমরা বলি যুদ্ধাপরাধ, অর্থাৎ যুদ্ধাকালীন সময়ে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগি্নসংযোগ, অপহরণ ও লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধ। বাংলাদেশে 'রাজাকার' বলতে শুধু মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াত কতর্ৃক গঠিত রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের বোঝায় না; সকল স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সামপ্রদায়িক ব্যক্তিকেই এ দেশে রাজাকার বলা হয়। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের একটি টেলিভিশন সিরিয়ালে 'তুই রাজাকার' বলে এটিকে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদীদের সমার্থক শব্দে পরিণত করা হয়েছে। একইভাবে 'যুদ্ধাপরাধী' বলতে আমরা '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ ঘাতক, দালাল, রাজাকার, আলবদর সবাইকে বুঝি।
জামায়াতের নেতারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে গত কয়েক বছর ধরে যেসব প্রলাপোক্তি করছেন তাতে বার বার সেই বাংলা প্রবাদটির কথা মনে হয় 'ঠাকুরঘরে কে? আমি কলা খাই না!' জামায়াতের নেতারা একবার বলেন, '৭১-এ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের কোন ঘটনা ঘটেনি। আবার বলেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধ করেনি। কখনও বলেন, জামায়াতকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হচ্ছে। কখনও বলেন, ইসলাম ধ্বংসের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে এবং এটা ভারতের ষড়যন্ত্র। জামায়াত যেমন '৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলেছে; তাদের পাকিসত্মানী প্রভুরা '৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যনত্ম বাঙালীর সকল আন্দোলন-সংগ্রামকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলেছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি এসব বিশ্বাস করত তাহলে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কিংবা ২০০৯-এর ভোটযুদ্ধে পাকিসত্মান এবং তাদের এদেশীয় খেদমতগারদের এত শোচনীয় পরাজয় ঘটত না।
জামায়াতপ্রধান মতিউর রহমান নিজামী সমপ্রতি জামায়াতের জেলা আমিরদের এক সমাবেশে বলেছেন, জামায়াতের নেতারা '৭১-এ যুদ্ধাপরাধ করেননি, তারা শুধু পাকিসত্মানের অখ-তা রক্ষার জন্য কাজ করেছেন। নিজামীর এলাকার ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদশর্ীরা আমাকে বলেছেন পাকিসত্মান রক্ষার জন্য তিনি '৭১-এ কীভাবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে হত্যা-নির্যাতন-লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যার কিছু অংশ আমার প্রামাণ্যচিত্র 'যুদ্ধাপরাধ ৭১'-এ বিধৃত হয়েছে। ট্রাইবু্যনালই বলবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজামীদের পাকিসত্মান রক্ষার তৎপরতা কোন্ ধরনের অপরাধ।
জামায়াতের কোন নেতা যদি '৭১-এ কোন অপরাধ না করে থাকেন তাহলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা কেন করছেন? কেন বলছেন বিচার আরম্ভ হলে এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে, দেশ অচল করে দেয়া হবে? তারা যদি সত্যিকার অর্থেই কোন অপরাধ না করে থাকেন তাদের উচিত এ বিচারকে স্বাগত জানানো। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাসত্মি দেয়ার সাধ্য কোন আদালতের নেই। নবগঠিত আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন, আদালতের রায় তাদের পছন্দ না হলে সুপ্রীমকোর্টে তারা আপীল করতে পারবেন। বিচার ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা প্রত্যক্ষ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যবেক্ষক আসবেন। এদের সামনে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে কীভাবে অপরাধী সাব্যসত্ম করে শাসত্মি দেয়া হবে এটা আমাদের বোধগম্যের অতীত।
হালে জামায়াতের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বিএনপি। দুই দল কোরাসে বলছে, সরকার বিদু্যত-পানি-গ্যাসের সমস্যার সমাধান না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। বিদু্যত, পানি, গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধ কোথায় আমরা জানি না। তাদের কথা শুনে মনে হতে পারে পিডিবি, ওয়াসা বা তিতাস গ্যাস বুঝি তাদের কাজ বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে ব্যসত্ম হয়ে পড়েছে! নাকি আনত্মর্জাতিক ট্রাইবু্যনালের বিচারক ও আইনজীবীরা এতদিন বিদু্যত, পানি, গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন! আমজনতার কাছে বিদু্যত যেমন জরম্নরী, বিচারও জরম্নরী। যে ট্রাইবু্যনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বিদু্যত, পানি ও গ্যাসসহ জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের নয়। তবে পিডিবি বা ওয়াসায় যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কেউ থাকতেই পারেন। তারা জামায়াতের অনত্মর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বিদু্যত, পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন কিনা এটা তদনত্ম করে দেখা দরকার।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াত তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের সহযোগিতা পাচ্ছে। বিভিন্ন আনত্মর্জাতিক ফোরামে পাকিসত্মান বলছে, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যরা বাংলাদেশে কোন গণহত্যা, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ করেনি, বরং বাঙালীরা পাকিসত্মানীদের, বিশেষভাবে অবাঙালী বিহারীদের হত্যা করেছে। এসব কাজে ক্ষেত্রবিশেষে পাকিসত্মান কোথাও বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রবাসী ভারতীয়দেরও ব্যবহার করেছে। শর্মিলা বসু নামে জনৈক আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয়, বছর দুই আগে লিখেছেন, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যদের দ্বারা বাঙালী নারী নির্যাতনের অভিযোগ নাকি নির্জলা মিথ্যা, বরং বাঙালীরা যে অবাঙালী নারীদের নির্যাতন করেছে তার নাকি অনেক প্রমাণ আছে। সরকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা দুই লাখ, বেসরকারী হিসেবে চার লাখেরও বেশি। এ দাবি কোন বাঙালীর নয়, অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ভেডিসের, যিনি '৭২-এর জানুয়ারিতে রেডক্রসের চিকিৎসক দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য। তাদের দল প্রথম তিন মাসে দেড় লাখ নারীর গর্ভপাত করেছিল। লন্ডনে ফিরে গিয়ে ডা. ডেভিস বলেছিলেন, '৭১-এ নির্যাতিত নারীর সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। অথচ গবেষক শর্মিলা বসু তাদের একজনকেও নাকি খুঁজে পাননি!
সমপ্রতি ইউরোপ ও আমেরিকা সফরের সময় দেখেছি জামায়াতীদের প্ররোচনায়, নাকি পাকিসত্মানীদের অর্থের বিনিময়ে (!) আইনজীবীদের একটি আনত্মর্জাতিক সংগঠন 'ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন' ধুয়া তুলেছে_ '৭৩-এর আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না। তারা এ আইনের অনেক সংশোধনীর প্রসত্মাব করেছে। আমাদের ট্রাইবু্যনালে তিনজন বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 'আইবিএ' বলছে, ট্রাইবু্যনালের বিচারপতি নাকি অভিযুক্তের পছন্দের হতে হবে এবং তিনজন বিচারপতি একমত না হলে নাকি রায় দেয়া যাবে না। পৃথিবীর কোন্ দেশে এমন অসম্ভব, উদ্ভট বিচারব্যবস্থা আছে আমাদের জানা নেই, তবে 'আইবিএ' এবং তাদের তল্পিবাহকদের মতে এসব সংশোধনী না করা হলে এ বিচার নাকি তাদের গ্রহণযোগ্য হবে না। 'আইবিএ'র সুপারিশ আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে গুরম্নত্ব পাবে না। কারণ উকিলরা সব সময় মক্কেলের স্বার্থই দেখবে। যুদ্ধাপরাধীরা যদি আইবিএ-র মক্কেল হয় তাহলে এমন উদ্ভট দাবি তারা করতে পারে বৈকি। বিষয়টি উলেস্নখ করছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে জামায়াত এবং তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের বহুমাত্রিক তৎপরতা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা প্রদানের জন্য। তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, আমেরিকান কংগ্রেসে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায়। ধর্ণা দিচ্ছে জাতিসংঘের সামনে, হুমকি দিচ্ছে সৌদি আরবে কর্মরত বাঙালী শ্রমিকদের ফেরত পাঠাবার; দেশের ভেতরে নাশকতামূলক কাজের জন্য সংগঠিত করছে জঙ্গী মৌলবাদীদের। জামায়াত এবং তাদের প্রভুদের এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। জাতিকে মুক্ত করতে হবে দীর্ঘ চার দশকের বিচারহীনতার অভিশাপ থেকে।
২২ এপ্রিল, ২০১০
গত দেড় যুগেরও অধিককাল জামায়াতের '৭১-এর ভূমিকা আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরেছি, তৃণমূল থেকে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন যাবতীয় দুষ্কর্মের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছি, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি, কর্মশালা-শোভাযাত্রা, সমাবেশ প্রভৃতির আয়োজন করেছি; জামায়াতীদের এলাকায় পাঠাগার স্থাপন করেছি এবং এভাবেই জামায়াতের প্রকৃত চেহারা দেশবাসী, বিশেষভাবে তরম্নণ প্রজন্মের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের এসব তৎপরতা শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের প্রত্যনত্ম অঞ্চল অবধি বিসত্মৃত। একই সঙ্গে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি'র তৎপরতা বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ১২টি দেশে আমাদের শাখা রয়েছে।
আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে জামায়াত যেসব অপপ্রচার করেছে, যেসব প্রশ্ন তুলেছে_ দেশবাসী যে তা প্রত্যাখ্যান করেছে তার প্রমাণ হচ্ছে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে, শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে খালেদা-নিজামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের। গত নির্বাচনে জামায়াতের একজন যুদ্ধাপরাধীও নির্বাচিত হতে পারেনি, অথচ এর আগের নির্বাচনে বিএনপির বদৌলতে জামায়াতের ডজনখানেক যুদ্ধাপরাধী জাতীয় সংসদের আসন কলঙ্কিত করেছে, যাদের দু'জনকে খালেদা জিয়া মন্ত্রী পর্যনত্ম বানিয়েছিলেন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মহাজোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রানত্মে উপনীত হয়েছে। এ বিজয়ের জন্য আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়েছে, বহু চড়াই-উৎরাই পেরম্নতে হয়েছে। আন্দোলনের নেতাকমর্ীদের হত্যা, নির্যাতন, চাকরিচু্যতি, মিথ্যা মামলাসহ বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামাল থেকে আরম্ভ করে বিচারপতি কেএম সোবহান পর্যনত্ম বহু নেতাকে আমরা হারিয়েছি, তারপরও এ আন্দোলন থেমে থাকেনি। সত্যকে কখনও প্রতিহত করা যায় না। কিছু সময়ের জন্য মিথ্যার কালো মেঘ সত্যকে আচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু সত্য সব সময় আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়।
২০০৯ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার যখন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখন থেকে '৭১-এর ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, পায়ের তলার মাটিতে ধস নেমেছে। গত এক বছরে জামায়াতের বহু কমর্ী দলত্যাগ ও দেশত্যাগ করেছে। ধ্বংস অনিবার্য জেনে জামায়াত এখন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত তাদের দেশী-বিদেশী মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে বঙ্গবন্ধুর সরকার কতর্ৃক প্রণীত 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন ১৯৭৩' অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইবু্যনালে। এ আইনে অপরাধের সংজ্ঞা, বিচার পদ্ধতি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও শাসত্মি সম্পর্কে সবই বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, জাপান ও ফিলিপিন্সসহ বহু দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এসব ট্রাইবু্যনালে কখনও চিরাচরিত সাক্ষ্য আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার বিচার সম্ভব নয় বলেই জার্মানির নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় নুরেমবার্গের বিশেষ আদালতে বিশেষ নীতি ও বিধান প্রণীত হয়েছিল। বাংলাদেশের '৭৩-এর আইন অতীতের এসব নীতি ও বিধানের নির্যাস গ্রহণ করে ঋদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের আগে পৃথিবীর কোন দেশ মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ, শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা বিচারের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নিজস্ব আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি।
নুরেমবার্গ বা টোকিও ট্রাইবু্যনালের জন্য প্রণীত নীতি ও বিধানের চেয়ে বাংলাদেশের 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন' যে অনেক উন্নতমানের এ কথা আনত্মর্জাতিক অঙ্গনের বহু খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের সেরা আইনজ্ঞরাসহ নুরেমবার্গ ট্রাইবু্যনালের সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরা এবং ভারতের দু'জন শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞ এ আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন যেটি আমাদের সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বিঘি্নত করার জন্য জামায়াত ও বিএনপির আইনজীবীরা '৭৩-এর আইন সম্পর্কে, অপরাধের সংজ্ঞা সম্পর্কে অদ্ভুত সব প্রশ্ন তুলেছেন। সমপ্রতি তাঁরা বলছেন, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ক্ষমতায় এসে এখন বলছে মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধের বিচার করবে। তাঁরা বিভিন্ন সেমিনারে বা গণমাধ্যমে এমনভাবে বিষয়টি উত্থাপন করছেন যেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। '৭৩-এর আইনে এসব অপরাধের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা এতদসংক্রানত্ম যাবতীয় আনত্মর্জাতিক আইনসম্মত। আমাদের আইনজ্ঞরা '৭৩-এর আইনে যেভাবে এসব অপরাধের সংজ্ঞা দিয়েছেন তার সঙ্গে প্রচুর মিল রয়েছে ২০০২ সালে গৃহীত রোমের আনত্মর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনের।
বাংলাদেশে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি' গত ১৮ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে। '৭৩-এর আইনে 'যুদ্ধাপরাধ', 'মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'গণহত্যা' প্রভৃতির পৃথক সংজ্ঞা দেয়া আছে। তবে সাধারণভাবে আমরা বলি যুদ্ধাপরাধ, অর্থাৎ যুদ্ধাকালীন সময়ে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগি্নসংযোগ, অপহরণ ও লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধ। বাংলাদেশে 'রাজাকার' বলতে শুধু মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াত কতর্ৃক গঠিত রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের বোঝায় না; সকল স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সামপ্রদায়িক ব্যক্তিকেই এ দেশে রাজাকার বলা হয়। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের একটি টেলিভিশন সিরিয়ালে 'তুই রাজাকার' বলে এটিকে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদীদের সমার্থক শব্দে পরিণত করা হয়েছে। একইভাবে 'যুদ্ধাপরাধী' বলতে আমরা '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ ঘাতক, দালাল, রাজাকার, আলবদর সবাইকে বুঝি।
জামায়াতের নেতারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে গত কয়েক বছর ধরে যেসব প্রলাপোক্তি করছেন তাতে বার বার সেই বাংলা প্রবাদটির কথা মনে হয় 'ঠাকুরঘরে কে? আমি কলা খাই না!' জামায়াতের নেতারা একবার বলেন, '৭১-এ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের কোন ঘটনা ঘটেনি। আবার বলেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধ করেনি। কখনও বলেন, জামায়াতকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হচ্ছে। কখনও বলেন, ইসলাম ধ্বংসের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে এবং এটা ভারতের ষড়যন্ত্র। জামায়াত যেমন '৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলেছে; তাদের পাকিসত্মানী প্রভুরা '৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যনত্ম বাঙালীর সকল আন্দোলন-সংগ্রামকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলেছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি এসব বিশ্বাস করত তাহলে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কিংবা ২০০৯-এর ভোটযুদ্ধে পাকিসত্মান এবং তাদের এদেশীয় খেদমতগারদের এত শোচনীয় পরাজয় ঘটত না।
জামায়াতপ্রধান মতিউর রহমান নিজামী সমপ্রতি জামায়াতের জেলা আমিরদের এক সমাবেশে বলেছেন, জামায়াতের নেতারা '৭১-এ যুদ্ধাপরাধ করেননি, তারা শুধু পাকিসত্মানের অখ-তা রক্ষার জন্য কাজ করেছেন। নিজামীর এলাকার ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদশর্ীরা আমাকে বলেছেন পাকিসত্মান রক্ষার জন্য তিনি '৭১-এ কীভাবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে হত্যা-নির্যাতন-লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যার কিছু অংশ আমার প্রামাণ্যচিত্র 'যুদ্ধাপরাধ ৭১'-এ বিধৃত হয়েছে। ট্রাইবু্যনালই বলবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজামীদের পাকিসত্মান রক্ষার তৎপরতা কোন্ ধরনের অপরাধ।
জামায়াতের কোন নেতা যদি '৭১-এ কোন অপরাধ না করে থাকেন তাহলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা কেন করছেন? কেন বলছেন বিচার আরম্ভ হলে এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে, দেশ অচল করে দেয়া হবে? তারা যদি সত্যিকার অর্থেই কোন অপরাধ না করে থাকেন তাদের উচিত এ বিচারকে স্বাগত জানানো। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাসত্মি দেয়ার সাধ্য কোন আদালতের নেই। নবগঠিত আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন, আদালতের রায় তাদের পছন্দ না হলে সুপ্রীমকোর্টে তারা আপীল করতে পারবেন। বিচার ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা প্রত্যক্ষ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যবেক্ষক আসবেন। এদের সামনে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে কীভাবে অপরাধী সাব্যসত্ম করে শাসত্মি দেয়া হবে এটা আমাদের বোধগম্যের অতীত।
হালে জামায়াতের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বিএনপি। দুই দল কোরাসে বলছে, সরকার বিদু্যত-পানি-গ্যাসের সমস্যার সমাধান না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। বিদু্যত, পানি, গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধ কোথায় আমরা জানি না। তাদের কথা শুনে মনে হতে পারে পিডিবি, ওয়াসা বা তিতাস গ্যাস বুঝি তাদের কাজ বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে ব্যসত্ম হয়ে পড়েছে! নাকি আনত্মর্জাতিক ট্রাইবু্যনালের বিচারক ও আইনজীবীরা এতদিন বিদু্যত, পানি, গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন! আমজনতার কাছে বিদু্যত যেমন জরম্নরী, বিচারও জরম্নরী। যে ট্রাইবু্যনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বিদু্যত, পানি ও গ্যাসসহ জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের নয়। তবে পিডিবি বা ওয়াসায় যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কেউ থাকতেই পারেন। তারা জামায়াতের অনত্মর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বিদু্যত, পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন কিনা এটা তদনত্ম করে দেখা দরকার।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াত তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের সহযোগিতা পাচ্ছে। বিভিন্ন আনত্মর্জাতিক ফোরামে পাকিসত্মান বলছে, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যরা বাংলাদেশে কোন গণহত্যা, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ করেনি, বরং বাঙালীরা পাকিসত্মানীদের, বিশেষভাবে অবাঙালী বিহারীদের হত্যা করেছে। এসব কাজে ক্ষেত্রবিশেষে পাকিসত্মান কোথাও বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রবাসী ভারতীয়দেরও ব্যবহার করেছে। শর্মিলা বসু নামে জনৈক আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয়, বছর দুই আগে লিখেছেন, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যদের দ্বারা বাঙালী নারী নির্যাতনের অভিযোগ নাকি নির্জলা মিথ্যা, বরং বাঙালীরা যে অবাঙালী নারীদের নির্যাতন করেছে তার নাকি অনেক প্রমাণ আছে। সরকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা দুই লাখ, বেসরকারী হিসেবে চার লাখেরও বেশি। এ দাবি কোন বাঙালীর নয়, অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ভেডিসের, যিনি '৭২-এর জানুয়ারিতে রেডক্রসের চিকিৎসক দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য। তাদের দল প্রথম তিন মাসে দেড় লাখ নারীর গর্ভপাত করেছিল। লন্ডনে ফিরে গিয়ে ডা. ডেভিস বলেছিলেন, '৭১-এ নির্যাতিত নারীর সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। অথচ গবেষক শর্মিলা বসু তাদের একজনকেও নাকি খুঁজে পাননি!
সমপ্রতি ইউরোপ ও আমেরিকা সফরের সময় দেখেছি জামায়াতীদের প্ররোচনায়, নাকি পাকিসত্মানীদের অর্থের বিনিময়ে (!) আইনজীবীদের একটি আনত্মর্জাতিক সংগঠন 'ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন' ধুয়া তুলেছে_ '৭৩-এর আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না। তারা এ আইনের অনেক সংশোধনীর প্রসত্মাব করেছে। আমাদের ট্রাইবু্যনালে তিনজন বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 'আইবিএ' বলছে, ট্রাইবু্যনালের বিচারপতি নাকি অভিযুক্তের পছন্দের হতে হবে এবং তিনজন বিচারপতি একমত না হলে নাকি রায় দেয়া যাবে না। পৃথিবীর কোন্ দেশে এমন অসম্ভব, উদ্ভট বিচারব্যবস্থা আছে আমাদের জানা নেই, তবে 'আইবিএ' এবং তাদের তল্পিবাহকদের মতে এসব সংশোধনী না করা হলে এ বিচার নাকি তাদের গ্রহণযোগ্য হবে না। 'আইবিএ'র সুপারিশ আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে গুরম্নত্ব পাবে না। কারণ উকিলরা সব সময় মক্কেলের স্বার্থই দেখবে। যুদ্ধাপরাধীরা যদি আইবিএ-র মক্কেল হয় তাহলে এমন উদ্ভট দাবি তারা করতে পারে বৈকি। বিষয়টি উলেস্নখ করছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে জামায়াত এবং তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের বহুমাত্রিক তৎপরতা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা প্রদানের জন্য। তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, আমেরিকান কংগ্রেসে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায়। ধর্ণা দিচ্ছে জাতিসংঘের সামনে, হুমকি দিচ্ছে সৌদি আরবে কর্মরত বাঙালী শ্রমিকদের ফেরত পাঠাবার; দেশের ভেতরে নাশকতামূলক কাজের জন্য সংগঠিত করছে জঙ্গী মৌলবাদীদের। জামায়াত এবং তাদের প্রভুদের এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। জাতিকে মুক্ত করতে হবে দীর্ঘ চার দশকের বিচারহীনতার অভিশাপ থেকে।
২২ এপ্রিল, ২০১০
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু_ এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু_ এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা
মোঃ এনায়েত হোসেন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের নিয়ে পূর্ববঙ্গ সরকারের সচিবালয় ঘেরাও করেন। পুলিশ ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং শেখ মুজিবসহ ৬৫ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ১৯ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার চুক্তি করেন এবং আটক ছাত্রদের মুক্তি দেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের একটি শোভাযাত্রা নিয়ে আইন পরিষদের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পূর্ব বাংলার মানুষ ও ছাত্রসমাজের ওপর মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতনের মাত্রা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠন করা হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে তিনি কারামুক্ত হন। তখন বাংলায় দুর্ভিক্ষ চলছে। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকা আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা-মিছিল বের করে। পুলিশ রমনা গেটের কাছে মিছিলের নেতা মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। এবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় দু'বছর আটক রাখা হয়।
পূর্ব বাংলার দুর্ভিক্ষ, লবণ সঙ্কট (১৯৫১), দাঙ্গা, রাজনৈতিক নির্যাতন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থতার ফলে মুসলিম লীগ সরকার জনপ্রিয়তা হারায়। দেশের এ সঙ্কটময় মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ঘোষণা করলেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।" আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগ এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। মুজিব তখন কারাগারে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মুজিব ও বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদ কারাগারে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনশন শুরু করেন। তিনি জেলে থাকাকালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ শহীদ হন। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়। ১৯৫৩ সালে মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য পূর্ববাংলার গ্রামগ্রঞ্জে প্রচারণা চালান। যুক্তফ্রন্ট এ নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে এবং শেখ মুজিব মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে পরাজিত করে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সমবায়, কৃষি ও বন বিভাগের মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র শেরে বাংলার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনে। তদানীন্তন গবর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার ফলে ৩১ মে ১৯৫৪ কেন্দ্রীয় সরকার একে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৫ সালের ৩ জুন পূর্ব বাংলা থেকে 'গবর্নর জেনারেলের শাসন' তুলে নিলে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ঐ সালের ৫ জুন গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব পুনরায় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান গণপরিষদের স্পীকার নির্বাচিত হলেন আবদুল ওয়াহাব খান। ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। আওয়ামী মুসলীম লীগ বিরোধী দল গঠন করে। জাতীয় পরিষদ নতুন শাসনতন্ত্র গঠন করলে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানান। পাকিস্তান সরকার 'পূর্ব বাংলার' নাম পরিবর্তন করে 'পূর্ব পাকিস্তান' রাখার প্রস্তাব করলে ১৯৫৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, 'তারা পূর্ব বাংলার' পরিবর্তে 'পূর্ব পাকিস্তান' করতে চায়। আমরা বার বার দাবি করছি আপনারা এ অঞ্চলের নাম 'বাংলা' করবেন। বাংলার নিজস্ব ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। আপনারা জনগণকে জিজ্ঞাসা না করে এ নামের পরিবর্তন করতে পারবেন না। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান লেখা হয়।
মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের ৪ আগস্ট খাদ্যের দাবিতে ঢাকা শহরে বিরাট মিছিল হয় এবং পুলিশ ঐ মিছিলে গুলি করে। মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন সরকার পদত্যাগ করে। ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা খান আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিব শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দফতরের দায়িত্ব লাভ করেন। ১১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তানীদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। তারা আওয়ামী লীগকে দ্বিখণ্ডিত করতে সফল হয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রয়ে যান। একই ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। অবশেষে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জরি করেন। শাসনতন্ত্র বাতিল করে মন্ত্রিসভা ও আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব খান ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে নিজেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। অবশ্য ইতোমধ্যে ১২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করা হয়। যদিও ১৪ মাস কারাভোগের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি লাভ করেন কিন্তু তাঁর ভাগ্যে বাংলার মুক্ত জলবায়ুতে বেশিদিন অবস্থান করা বোধহয় সম্ভব ছিল না। সামরিক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করে ১৯৬২ সালে। (ক্রমশ)
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক।
শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের নিয়ে পূর্ববঙ্গ সরকারের সচিবালয় ঘেরাও করেন। পুলিশ ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং শেখ মুজিবসহ ৬৫ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ১৯ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার চুক্তি করেন এবং আটক ছাত্রদের মুক্তি দেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের একটি শোভাযাত্রা নিয়ে আইন পরিষদের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পূর্ব বাংলার মানুষ ও ছাত্রসমাজের ওপর মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতনের মাত্রা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠন করা হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ ছিলেন। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে তিনি কারামুক্ত হন। তখন বাংলায় দুর্ভিক্ষ চলছে। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকা আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা-মিছিল বের করে। পুলিশ রমনা গেটের কাছে মিছিলের নেতা মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। এবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় দু'বছর আটক রাখা হয়।
পূর্ব বাংলার দুর্ভিক্ষ, লবণ সঙ্কট (১৯৫১), দাঙ্গা, রাজনৈতিক নির্যাতন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থতার ফলে মুসলিম লীগ সরকার জনপ্রিয়তা হারায়। দেশের এ সঙ্কটময় মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ঘোষণা করলেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।" আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগ এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। মুজিব তখন কারাগারে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মুজিব ও বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদ কারাগারে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনশন শুরু করেন। তিনি জেলে থাকাকালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ শহীদ হন। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়। ১৯৫৩ সালে মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য পূর্ববাংলার গ্রামগ্রঞ্জে প্রচারণা চালান। যুক্তফ্রন্ট এ নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে এবং শেখ মুজিব মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে পরাজিত করে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সমবায়, কৃষি ও বন বিভাগের মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র শেরে বাংলার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনে। তদানীন্তন গবর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার ফলে ৩১ মে ১৯৫৪ কেন্দ্রীয় সরকার একে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৫ সালের ৩ জুন পূর্ব বাংলা থেকে 'গবর্নর জেনারেলের শাসন' তুলে নিলে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ঐ সালের ৫ জুন গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব পুনরায় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান গণপরিষদের স্পীকার নির্বাচিত হলেন আবদুল ওয়াহাব খান। ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। আওয়ামী মুসলীম লীগ বিরোধী দল গঠন করে। জাতীয় পরিষদ নতুন শাসনতন্ত্র গঠন করলে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানান। পাকিস্তান সরকার 'পূর্ব বাংলার' নাম পরিবর্তন করে 'পূর্ব পাকিস্তান' রাখার প্রস্তাব করলে ১৯৫৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, 'তারা পূর্ব বাংলার' পরিবর্তে 'পূর্ব পাকিস্তান' করতে চায়। আমরা বার বার দাবি করছি আপনারা এ অঞ্চলের নাম 'বাংলা' করবেন। বাংলার নিজস্ব ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। আপনারা জনগণকে জিজ্ঞাসা না করে এ নামের পরিবর্তন করতে পারবেন না। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান লেখা হয়।
মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের ৪ আগস্ট খাদ্যের দাবিতে ঢাকা শহরে বিরাট মিছিল হয় এবং পুলিশ ঐ মিছিলে গুলি করে। মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন সরকার পদত্যাগ করে। ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা খান আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিব শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দফতরের দায়িত্ব লাভ করেন। ১১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তানীদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। তারা আওয়ামী লীগকে দ্বিখণ্ডিত করতে সফল হয়। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রয়ে যান। একই ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। অবশেষে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জরি করেন। শাসনতন্ত্র বাতিল করে মন্ত্রিসভা ও আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব খান ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে নিজেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। অবশ্য ইতোমধ্যে ১২ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করা হয়। যদিও ১৪ মাস কারাভোগের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে মুক্তি লাভ করেন কিন্তু তাঁর ভাগ্যে বাংলার মুক্ত জলবায়ুতে বেশিদিন অবস্থান করা বোধহয় সম্ভব ছিল না। সামরিক সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করে ১৯৬২ সালে। (ক্রমশ)
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক।
যুদ্ধাপরাধীর বিচারে ট্রাইব্যুনাল ॥ প্রশ্নের সুযোগ নেই
যুদ্ধাপরাধীর বিচারে ট্রাইব্যুনাল ॥ প্রশ্নের সুযোগ নেই
০ যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা হয় অজ্ঞ না হয় জেনেশুনেই ভুল তথ্য দিচ্ছেন
০ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটি অসাধারণ
০ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটি অসাধারণ
স্টাফ রিপোর্টার ॥ এ দেশের হোক আর অন্য দেশেরই হোক না কেন যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার হবে। কোন আইন ব্যক্তি বিশেষের জন্য হয় না। আইন হয় একটি বিশেষ অপরাধের জন্য। শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর সর্বত্র যত দ-বিধি আছে, সবই অপরাধের বিরুদ্ধে। বিশেষ অপরাধের বিরুদ্ধেই বিশেষ আদালত হয়। যারা আদালত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে, তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ অথবা জেনেশুনে কথা বলছেন। ট্রাইব্যুনালে কোন বিচারকের প্রতি অনাস্থার সুযোগ নেই। এটা অসাধারণ আইন। দেশে যেমন পানি বিদ্যুত সমস্যা, সেটারও যেমন সমাধান চাই একই সাথে যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার চাই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিদেশী আইনজীবীদের আসা নিয়ে বার কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেবে। ট্রাইব্যুনালে কতগুলো কেস হবে তা তদন্তের ওপরই নির্ভর করবে। তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট যখন আসবে তখন বোঝা যাবে তদন্তকারী সংস্থা বা প্রসিকিউটর লাগবে কিনা। আর আইনে আছে মামলা বেশি হলে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়বে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান, সদস্য, তদন্তকারী সংস্থার সদস্য ও প্রসিকিউটরদের নিরাপত্তা দেয়া হবে। আমাদের দেশে যথেষ্ট অভিজ্ঞ পর্যাপ্ত আইনজীবী আছে। সে কারণে বাইরে থেকে ধার করে আনার দরকার নেই। অনেকেই আতঙ্কে আছে। কারণ তারা বিদেশে যেতে পারছে না। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিচ্ছে। এলোমেলোভাবে কথা বলছে। দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। পারছে না। কয়েকজনের গ্রেফতারের প্রস্তুতি সম্পন্ন। কাজেই আতঙ্ক থাকা স্বাভাবিক। বৃহস্পতিবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে '৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, দেশে-বিদেশে প্রশ্ন শীর্ষক এই আলোচনা সভায় মন্ত্রী, বিচারপতি, আইনজীবিগণ প্রশ্নের উত্তর দেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ক নাগরিক কমিশন ও '৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই প্রশ্ন উত্তর পর্বের আয়োজন করেন। '৭১-এর ঘাতক দালার নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে ৪৮টি প্রশ্নের উত্তর দেন। প্রধান বক্তা আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সূচনা বক্তব্য রাখেন '৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির। প্রশ্নের উত্তর দেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ক নাগরিক কমিশনের সভাপতি বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, প্রাক্তন সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান, আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক এম শাহ আলম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পরিচালক ড. শাহদীন মালিক, সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব এ্যাডভান্সড লিগ্যাল এইড এ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান, ল ডেভ বাংলাদেশ নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার ড. তুরীন আফরোজ।
আইনমন্ত্রীর ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছে প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে। এখন সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, তাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করবেন না, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করবেন। বিচারের প্রশ্নে সরকারের এই ভিন্ন অবস্থান কেন? এর উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রথমেই বলতে চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সরকারের কোন ভিন্ন অবস্থান নেই। যাঁরা শুনছেন তাঁদের বোঝার কিছু ত্রুটি আছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করেছে। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি ছিল। এ ব্যাপারে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই বিচারটি হবে ১৯৭৩ সালের আইনে। এর পরিধি ব্যাপক। যুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে শুধু তাই নয়। যারা এ দেশ থেকে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছে। অন্য দেশের হোক না কেন যারা নাগরিকত্ব নিয়েছে তাদেরও বিচার হবে। যারা মানবতাবিরোধী করেছে বা এর সাথে সম্পৃক্ত। এর সাথে যারা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, দখলদার বাহিনীকে সহায়তা করেছে। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করেছে, এক কথায় বলা যায়, এই আইনের যে ব্যাপকতা তার মধ্যেই অপরাধীদের বিচার হবে। এটা ট্রাইব্যুনালের অধিক্ষেত্র। বিএনপি জামায়াতের আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনাল) আইন এ অভিযুক্তদের সংবিধান প্রদত্ত মানবাধিকারে লঙ্ঘিত হয়েছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই প্রশ্নটা একেবারেই ভিত্তিহীন। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। কোন ব্যক্তি খুন, ধর্ষণ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী গণহত্যা বা আন্তর্জাতিক আইনে যে সমস্ত অপরাধ চিহ্নিত করে, সেগুলোর বিচার না করলে মানবতাবিরোধী লঙ্ঘন হবে। বাংলাদেশের জনগণও চায় অপরাধীর বিচার হোক। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের ট্রাইবুনালটি যে আইনে স্থাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে তদন্তকারী সংস্থা বাংলাদেশীদের অপরাধ তদন্ত করবে।
১৯৭৩-এ প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবীরা বলছেন, এটি একটি মৃত আইন, কালাকানুন, এই আইন কিসের ভিত্তিতে তেরি হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক সচিবও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, এক কথায় বলব যে, সম্পূর্ণ ভুল বলা হয়েছে। এটা মৃত আইন নয়। কালা আইনও নয়। বিএনপির উর্ধতন নেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মেদ বলেছেন, ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন হয়েছিল ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে বিচার না করে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে আইনটি অকেজো হয়ে গেছে। এই প্রশ্নের উত্তরে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেন, কোন আইন ব্যক্তিবিশেষের জন্য হয় না। আইন হয় একটি বিশেষ অপরাধের জন্য। তাহলে তো ১৯৫ জনই থাকত। এ সমস্ত আজগুবি কথা বলে মওদুদ সাহেব পার পেতে পারবে না। এটা টাকা পয়সার বিষয় না যে তামাদি হয়ে যাবে। মওদুদকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার চিন্তা নেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। দেশে ও বিদেশে নবগঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ট্রাইব্যুনাল কি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিচার করতে পারবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা এ প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অথবা জেনেশুনে ভুল তথ্য দিচ্ছেন। এই আইনে অনেক কিছু নিশ্চিত আছে। তাঁরা বার বার জেনেশুনে মিথ্যা কথা বলছেন। অভিযোগ উঠছে, দলীয় বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গোলাম আরিফ টিপু বলেন, প্রথমত এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, দ্বিতীয়ত ভিত্তিহীন, তৃতীয়ত সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ। বিএনপি জামাতের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের ভেতরও যুদ্ধাপরাধী আছে। নবগঠিত 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল' কি আওয়ামী লীগের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তরে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ হোসেন বলেছেন, দলে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। এই প্রশ্নটি একটি স্ববিরোধী প্রশ্ন। এমন ৪৮টি প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।
আইনমন্ত্রীর ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছে প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে। এখন সরকারের নীতি নির্ধারকরা বলছেন, তাঁরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করবেন না, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করবেন। বিচারের প্রশ্নে সরকারের এই ভিন্ন অবস্থান কেন? এর উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রথমেই বলতে চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সরকারের কোন ভিন্ন অবস্থান নেই। যাঁরা শুনছেন তাঁদের বোঝার কিছু ত্রুটি আছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করেছে। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি ছিল। এ ব্যাপারে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই বিচারটি হবে ১৯৭৩ সালের আইনে। এর পরিধি ব্যাপক। যুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে শুধু তাই নয়। যারা এ দেশ থেকে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছে। অন্য দেশের হোক না কেন যারা নাগরিকত্ব নিয়েছে তাদেরও বিচার হবে। যারা মানবতাবিরোধী করেছে বা এর সাথে সম্পৃক্ত। এর সাথে যারা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, দখলদার বাহিনীকে সহায়তা করেছে। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করেছে, এক কথায় বলা যায়, এই আইনের যে ব্যাপকতা তার মধ্যেই অপরাধীদের বিচার হবে। এটা ট্রাইব্যুনালের অধিক্ষেত্র। বিএনপি জামায়াতের আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনাল) আইন এ অভিযুক্তদের সংবিধান প্রদত্ত মানবাধিকারে লঙ্ঘিত হয়েছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এই প্রশ্নটা একেবারেই ভিত্তিহীন। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। কোন ব্যক্তি খুন, ধর্ষণ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী গণহত্যা বা আন্তর্জাতিক আইনে যে সমস্ত অপরাধ চিহ্নিত করে, সেগুলোর বিচার না করলে মানবতাবিরোধী লঙ্ঘন হবে। বাংলাদেশের জনগণও চায় অপরাধীর বিচার হোক। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের ট্রাইবুনালটি যে আইনে স্থাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে তদন্তকারী সংস্থা বাংলাদেশীদের অপরাধ তদন্ত করবে।
১৯৭৩-এ প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবীরা বলছেন, এটি একটি মৃত আইন, কালাকানুন, এই আইন কিসের ভিত্তিতে তেরি হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক সচিবও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, এক কথায় বলব যে, সম্পূর্ণ ভুল বলা হয়েছে। এটা মৃত আইন নয়। কালা আইনও নয়। বিএনপির উর্ধতন নেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মেদ বলেছেন, ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন হয়েছিল ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীকে বিচার না করে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে আইনটি অকেজো হয়ে গেছে। এই প্রশ্নের উত্তরে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেন, কোন আইন ব্যক্তিবিশেষের জন্য হয় না। আইন হয় একটি বিশেষ অপরাধের জন্য। তাহলে তো ১৯৫ জনই থাকত। এ সমস্ত আজগুবি কথা বলে মওদুদ সাহেব পার পেতে পারবে না। এটা টাকা পয়সার বিষয় না যে তামাদি হয়ে যাবে। মওদুদকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার চিন্তা নেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। দেশে ও বিদেশে নবগঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ট্রাইব্যুনাল কি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিচার করতে পারবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. শাহদীন মালিক বলেন, যাঁরা এ প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অথবা জেনেশুনে ভুল তথ্য দিচ্ছেন। এই আইনে অনেক কিছু নিশ্চিত আছে। তাঁরা বার বার জেনেশুনে মিথ্যা কথা বলছেন। অভিযোগ উঠছে, দলীয় বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক, আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গোলাম আরিফ টিপু বলেন, প্রথমত এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, দ্বিতীয়ত ভিত্তিহীন, তৃতীয়ত সত্যের সম্পূর্ণ অপলাপ। বিএনপি জামাতের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের ভেতরও যুদ্ধাপরাধী আছে। নবগঠিত 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল' কি আওয়ামী লীগের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তরে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ হোসেন বলেছেন, দলে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। এই প্রশ্নটি একটি স্ববিরোধী প্রশ্ন। এমন ৪৮টি প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।
আরও ৫শ' অপরাধীর তালিকা জমা হয়েছে তদন্ত সংস্থায়
আরও ৫শ' অপরাধীর তালিকা জমা হয়েছে তদন্ত সংস্থায়
যুদ্ধাপরাধীর বিচার
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি বৃহস্পতিবার আরও নতুন নতুন তথ্যউপাত্ত ও ৫ শতাধিক অপরাধীর তালিকা জমা দিয়েছে ট্রাইব্যুনালের তদনত্মকারী সংস্থার নিকট। ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এমএ হাসান তদন্ত কমিটির কাছে তথ্যউপাত্ত দিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ওপর নজরদারি রাখতে হবে। তা না হলে তারা বিভিন্নভাবে পালানোর চেষ্টা করবে। অপরাধীদের গৃহবন্দী, পাশাপাশি কয়েক জনকে গ্রেফতার করতে হবে।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এমএ হাসান দ্বিতীয় দফায় তদন্তকারী সংস্থার হাতে দালিলিক প্রমাণপত্র তুলে দেন। এর মধ্যে রয়েছে, একটি সংক্ষিপ্ত ৫০০ জনের তালিকা, অপরাধের বিবরণ, সাক্ষীর নাম; বইয়ের মধ্যে রয়েছে, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, যুদ্ধ ও নারী, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ১৯১ জনের নাম, শীর্ষ ১৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গে। এ ছাড়া অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের উল্লেখসহ '৭১ সালের ঢাকা শহরের মধ্যভূমির ম্যাপ, '৭২ সালের পত্রপত্রিকা, যার মধ্যে আছে দৈনিক ইত্তেফাক, পূর্বদেশ ও দৈনিক বাংলা। সৌদি আরব ও জাতিসংঘকে বিচারের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সে বিষয়ে রাজকীয় সৌদি আরবের দূতাবাসে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট দেয়া হয়। এ ছাড়া ২টি ডকুমেন্ট দেয়া হয়। এগুলো ইংরেজী ভাষায়।
১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরকারপ্রধান পর্যায়ে সিমলা চুক্তি হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন যে, যুদ্ধাপরাধীরা হয়ত আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। সে কারণেই এটি সংশোধন করা হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়াল ও টোকিও ট্রায়ালের পর এটিই হবে সমমানের প্রথম ট্রাইব্যুনাল। তদন্তকারী সংস্থার প্রধান আবদুল মতিন তথ্যউপাত্ত গ্রহণ করে বলেন, এগুলো তদন্ত কাজে সহায়ক হবে।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এমএ হাসান দ্বিতীয় দফায় তদন্তকারী সংস্থার হাতে দালিলিক প্রমাণপত্র তুলে দেন। এর মধ্যে রয়েছে, একটি সংক্ষিপ্ত ৫০০ জনের তালিকা, অপরাধের বিবরণ, সাক্ষীর নাম; বইয়ের মধ্যে রয়েছে, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, যুদ্ধ ও নারী, পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ১৯১ জনের নাম, শীর্ষ ১৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গে। এ ছাড়া অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের উল্লেখসহ '৭১ সালের ঢাকা শহরের মধ্যভূমির ম্যাপ, '৭২ সালের পত্রপত্রিকা, যার মধ্যে আছে দৈনিক ইত্তেফাক, পূর্বদেশ ও দৈনিক বাংলা। সৌদি আরব ও জাতিসংঘকে বিচারের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সে বিষয়ে রাজকীয় সৌদি আরবের দূতাবাসে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট দেয়া হয়। এ ছাড়া ২টি ডকুমেন্ট দেয়া হয়। এগুলো ইংরেজী ভাষায়।
১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরকারপ্রধান পর্যায়ে সিমলা চুক্তি হওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন যে, যুদ্ধাপরাধীরা হয়ত আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। সে কারণেই এটি সংশোধন করা হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়াল ও টোকিও ট্রায়ালের পর এটিই হবে সমমানের প্রথম ট্রাইব্যুনাল। তদন্তকারী সংস্থার প্রধান আবদুল মতিন তথ্যউপাত্ত গ্রহণ করে বলেন, এগুলো তদন্ত কাজে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-৩
যুগের বাণী বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-৩
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
প্রিয় পাঠক, প্রথম কিস্তির লেখাটির শুরুতে উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশের আদি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের প্রথম দফাটি : 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' ইতিপূর্বে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির আলোচ্য বিষয় ছিল যথাক্রমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। এবার তৃতীয় কিস্তির বিষয় হচ্ছে জাতীয়তা। প্রথমেই যে প্রশ্নটি হাজির হয়, সেটা হচ্ছে জাতি এই বিশেষার্থবোধক শব্দ বা পরিভাষাটির সংজ্ঞা কী? বর্তমানকালের নৃবিজ্ঞান কর্তৃক দেওয়া সংজ্ঞাটি এই : একদল লোক যাদের নিজস্ব সাধারণ ভাষা আছে এবং একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা আছে। অবশ্য তাদের একক কোনো সংস্কৃতি থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে এবং জাতি বর্ণগত উৎস এক নাও হতে পারে। সাধারণত তাদের একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকে, যাদের বৈধ, সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে।
দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এ সংজ্ঞাটির হুবহু মিল নেই। বাংলাদেশে একাধিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়েছেন বাঙালি ছাড়া আরো রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়া অঞ্চলের সাঁওতাল, ওরাওঁ ও রাজবংশী, সিলেটের মণিপুরি, পাঙন ও খাসিয়া, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের গারো ও হাজং এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মগ বা মারমা, কুকি, লুসাই, মুরং, টিপরা, সেন্দুজ, পাংখো, বনজোগি ও খুমি।
তবে এদের আদি পেশা চাষাবাদ এবং একাধারে তাঁরা কারুশিল্পী। তাঁরা ফসল উৎপাদন ও পরিচর্যা করেন কিংবা কারুকাজ করেন আপন আনন্দে, অন্তরের তাগিদে অর্থাৎ তাঁরা শ্রমকে ভালোবাসেন উত্তরাধিকার সূত্রে, অন্য কারণে নয় এবং সেই মতো অনুশীলন করেন। কায়িক শ্রম ও বুদ্ধি এবং বৃত্তিমূলক শ্রম তাঁদের কাছে বংশপরম্পরায় সমমর্যাদার।
ঐতিহাসিক ই এইচ কার বলেন, এ নামহীন লাখ লাখ ব্যক্তি হচ্ছেন মোটামুটি অচেতনভাবে একক ক্রিয়াশীল ব্যক্তি মানুষ এবং তাঁরা গড়ে তোলেন একটি সামাজিক শক্তি। সাধারণ পরিস্থিতিতে একটি অসন্তুষ্ট কৃষক বা একটি অসন্তুষ্ট গ্রামকে ঐতিহাসিকরা হিসাবে ধরবেন না। কিন্তু হাজার হাজার গ্রামে লাখ লাখ অসন্তুষ্ট কৃষক এমন একটি উপাদান, সেটিকে কোনো ঐতিহাসিক অগ্রাহ্য করবেন না। চিন্তাবিদ, লেখক আহমদ ছফা বলেন, 'আসল ব্যাপার হলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে ফেলার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছে।...কারণ, শুরু থেকেই এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে। সে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী তারা মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী হোক সকলের জন্য সমান অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।'
প্রিয় পাঠক, উপরিউক্ত জাতীয়তার দর্শনের দৃষ্টিতে আসুন বাংলাদেশের আদি সংবিধান বিবেচনা করা যাক। অতএব পড়তে হয় সংবিধানের চারটি অনুচ্ছেদ, যাদের উদ্ধৃতি এই : 'জাতীয় সংস্কৃতি-২৩। রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তারাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারে।' 'জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন প্রভৃতি-২৪। বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিবৃতি, বিনাশ বা অপসরাণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।' জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধে জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় স্মৃতিনিদর্শনগুলোর প্রতি পরস্পর মমত্ববোধ, যার মাধ্যমে প্রতিটি জাতিসত্তা নিজেকে প্রকাশ করে, নিজেকে খুঁজে পায়। উপরিউক্ত অনুচ্ছেদ দুটি একত্রে একটি বিরাট মানবিক পরিকল্পনা, যার ফলস্বরূপ একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে নানা জাতির সম্মিলন ঘটে।
এখন আর দুটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। 'ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য-২৮। (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। (২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবে। (৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। (৪) নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।' 'সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা-২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবে না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। (৩) এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই_(ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, (খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধানসংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে, (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।'
প্রিয় পাঠক, লেখাটির শুরুতে জাতীয়তার যে সংজ্ঞা দিয়েছিলাম সেটাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা যাক ইতিহাসের এবং বাংলাদেশের সংবিধানের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোর সাহায্যে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে একটি লোকায়ত রাষ্ট্র গড়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ধারাবাহিক সংগ্রাম করেছেন। এই সংগ্রাম কখনো কখনো রক্তক্ষয়ী ছিল তাদের ও পেছনে এই আকাঙ্ক্ষা কার্যকরী ছিল, ধর্ম কিংবা জাতিসত্তা নির্বিশেষে সবার জন্য সর্বক্ষেত্রে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেগুলোর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে। এটা আমাদের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং তারই ধারাবাহিকতায় সংবিধানের যে খসড়া বা বিল প্রণীত হয়েছিল সেখানে ৬ অনুচ্ছেদটি ছিল এই : 'বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। এটাই একটি লোকায়ত সমাজবাদী রাষ্ট্র কর্তৃক তার সকল নাগরিকদেরকে দেয়া সার্বজনীন স্বীকৃতি। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের তেরতম সংশোধনীর ১ অনুচ্ছেদ : সকল ব্যক্তি যারা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছেন কিংবা বৈধ অভিবাসী তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।'
একই কথা বলা হয়েছে ভারত রাষ্ট্রের সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে। উভয় দেশেই বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠী বাস করেন। কিন্তু সংবিধানে বিচ্যুতি দেখা গেল যখন চূড়ান্তভাবে সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ প্রণীত হলো : 'নাগরিকত্ব-৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবেন।' ৬ অনুচ্ছেদের শেষাংশটি প্রিয় পাঠক, একটু লক্ষ করলেই আপনার কাছে স্পষ্ট হবে, সংবিধানের উপরোক্ত ২৩, ২৪, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতঃপর এক সামরিক স্বৈরশাসক মূঢ়তার পরিচয় দিলেন ১৯৭৮ সালে ৬ অনুচ্ছেদের শেষাংশটি পরিবর্তন করে : 'বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।' বাংলাদেশ একটি ভৌগোলিক বাস্তবতা। অপরদিকে একই রাষ্ট্রে বহুমাত্রিক গোষ্ঠী বাস করে এবং তাদের বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও তাদের বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি বলার অর্থ জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য অস্বীকার করা, অন্য অর্থে মুক্তিযুদ্ধকে উপেক্ষা করা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ,
সুপ্রিম কোর্ট
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
প্রিয় পাঠক, প্রথম কিস্তির লেখাটির শুরুতে উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশের আদি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের প্রথম দফাটি : 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' ইতিপূর্বে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির আলোচ্য বিষয় ছিল যথাক্রমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। এবার তৃতীয় কিস্তির বিষয় হচ্ছে জাতীয়তা। প্রথমেই যে প্রশ্নটি হাজির হয়, সেটা হচ্ছে জাতি এই বিশেষার্থবোধক শব্দ বা পরিভাষাটির সংজ্ঞা কী? বর্তমানকালের নৃবিজ্ঞান কর্তৃক দেওয়া সংজ্ঞাটি এই : একদল লোক যাদের নিজস্ব সাধারণ ভাষা আছে এবং একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা আছে। অবশ্য তাদের একক কোনো সংস্কৃতি থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে এবং জাতি বর্ণগত উৎস এক নাও হতে পারে। সাধারণত তাদের একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকে, যাদের বৈধ, সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে।
দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এ সংজ্ঞাটির হুবহু মিল নেই। বাংলাদেশে একাধিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়েছেন বাঙালি ছাড়া আরো রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়া অঞ্চলের সাঁওতাল, ওরাওঁ ও রাজবংশী, সিলেটের মণিপুরি, পাঙন ও খাসিয়া, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের গারো ও হাজং এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মগ বা মারমা, কুকি, লুসাই, মুরং, টিপরা, সেন্দুজ, পাংখো, বনজোগি ও খুমি।
তবে এদের আদি পেশা চাষাবাদ এবং একাধারে তাঁরা কারুশিল্পী। তাঁরা ফসল উৎপাদন ও পরিচর্যা করেন কিংবা কারুকাজ করেন আপন আনন্দে, অন্তরের তাগিদে অর্থাৎ তাঁরা শ্রমকে ভালোবাসেন উত্তরাধিকার সূত্রে, অন্য কারণে নয় এবং সেই মতো অনুশীলন করেন। কায়িক শ্রম ও বুদ্ধি এবং বৃত্তিমূলক শ্রম তাঁদের কাছে বংশপরম্পরায় সমমর্যাদার।
ঐতিহাসিক ই এইচ কার বলেন, এ নামহীন লাখ লাখ ব্যক্তি হচ্ছেন মোটামুটি অচেতনভাবে একক ক্রিয়াশীল ব্যক্তি মানুষ এবং তাঁরা গড়ে তোলেন একটি সামাজিক শক্তি। সাধারণ পরিস্থিতিতে একটি অসন্তুষ্ট কৃষক বা একটি অসন্তুষ্ট গ্রামকে ঐতিহাসিকরা হিসাবে ধরবেন না। কিন্তু হাজার হাজার গ্রামে লাখ লাখ অসন্তুষ্ট কৃষক এমন একটি উপাদান, সেটিকে কোনো ঐতিহাসিক অগ্রাহ্য করবেন না। চিন্তাবিদ, লেখক আহমদ ছফা বলেন, 'আসল ব্যাপার হলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে ফেলার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছে।...কারণ, শুরু থেকেই এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে। সে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী তারা মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী হোক সকলের জন্য সমান অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।'
প্রিয় পাঠক, উপরিউক্ত জাতীয়তার দর্শনের দৃষ্টিতে আসুন বাংলাদেশের আদি সংবিধান বিবেচনা করা যাক। অতএব পড়তে হয় সংবিধানের চারটি অনুচ্ছেদ, যাদের উদ্ধৃতি এই : 'জাতীয় সংস্কৃতি-২৩। রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তারাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারে।' 'জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন প্রভৃতি-২৪। বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিবৃতি, বিনাশ বা অপসরাণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।' জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধে জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় স্মৃতিনিদর্শনগুলোর প্রতি পরস্পর মমত্ববোধ, যার মাধ্যমে প্রতিটি জাতিসত্তা নিজেকে প্রকাশ করে, নিজেকে খুঁজে পায়। উপরিউক্ত অনুচ্ছেদ দুটি একত্রে একটি বিরাট মানবিক পরিকল্পনা, যার ফলস্বরূপ একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে নানা জাতির সম্মিলন ঘটে।
এখন আর দুটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। 'ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য-২৮। (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। (২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবে। (৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। (৪) নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।' 'সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা-২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবে না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। (৩) এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই_(ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, (খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধানসংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে, (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।'
প্রিয় পাঠক, লেখাটির শুরুতে জাতীয়তার যে সংজ্ঞা দিয়েছিলাম সেটাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা যাক ইতিহাসের এবং বাংলাদেশের সংবিধানের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোর সাহায্যে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে একটি লোকায়ত রাষ্ট্র গড়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ধারাবাহিক সংগ্রাম করেছেন। এই সংগ্রাম কখনো কখনো রক্তক্ষয়ী ছিল তাদের ও পেছনে এই আকাঙ্ক্ষা কার্যকরী ছিল, ধর্ম কিংবা জাতিসত্তা নির্বিশেষে সবার জন্য সর্বক্ষেত্রে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেগুলোর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে। এটা আমাদের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং তারই ধারাবাহিকতায় সংবিধানের যে খসড়া বা বিল প্রণীত হয়েছিল সেখানে ৬ অনুচ্ছেদটি ছিল এই : 'বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। এটাই একটি লোকায়ত সমাজবাদী রাষ্ট্র কর্তৃক তার সকল নাগরিকদেরকে দেয়া সার্বজনীন স্বীকৃতি। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের তেরতম সংশোধনীর ১ অনুচ্ছেদ : সকল ব্যক্তি যারা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছেন কিংবা বৈধ অভিবাসী তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।'
একই কথা বলা হয়েছে ভারত রাষ্ট্রের সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে। উভয় দেশেই বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠী বাস করেন। কিন্তু সংবিধানে বিচ্যুতি দেখা গেল যখন চূড়ান্তভাবে সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ প্রণীত হলো : 'নাগরিকত্ব-৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবেন।' ৬ অনুচ্ছেদের শেষাংশটি প্রিয় পাঠক, একটু লক্ষ করলেই আপনার কাছে স্পষ্ট হবে, সংবিধানের উপরোক্ত ২৩, ২৪, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতঃপর এক সামরিক স্বৈরশাসক মূঢ়তার পরিচয় দিলেন ১৯৭৮ সালে ৬ অনুচ্ছেদের শেষাংশটি পরিবর্তন করে : 'বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।' বাংলাদেশ একটি ভৌগোলিক বাস্তবতা। অপরদিকে একই রাষ্ট্রে বহুমাত্রিক গোষ্ঠী বাস করে এবং তাদের বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও তাদের বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি বলার অর্থ জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য অস্বীকার করা, অন্য অর্থে মুক্তিযুদ্ধকে উপেক্ষা করা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ,
সুপ্রিম কোর্ট
একাত্তরে তাঁরা কে কোন দলে ছিলেন, কী করেছেন
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
একাত্তরে তাঁরা কে কোন দলে ছিলেন, কী করেছেন
প্রতীক ইজাজ ও উম্মুল ওয়ারা সুইটিএ
একাত্তরে নেতৃস্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিরা ছিলেন কয়েকটি ডানপন্থী দলের। দলগুলো হলো_জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) এবং মুসলিম লীগের কয়েকটি অংশ। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে এসব দলের নেতারাই গঠন করেছিলেন শান্তি কমিটি। জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে দেশব্যাপী গঠন করা হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। পাকিস্তানের সামরিক সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে রাজাকার বাহিনীকে আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করেছিল। এ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের জন্য মাসিক মাসোহারা নির্ধারিত ছিল এবং তা সরকারি কোষাগার থেকেই দেওয়া হতো। আলবদর ও আলশামস ছিল রাজাকার বাহিনীরই দুটি বিশেষ ব্রিগেড।
বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ একাত্তরে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা থেকে ওই নেতাদের তৎকালীন অবস্থান সম্পর্কে জানা গেছে।
গোলাম আযম : মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। একাত্তরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত এক সভায় পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য নতুন কর্মী বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। তাঁর ব্যক্তিগত পরামর্শ ও সক্রিয় সহযোগিতায় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর উদ্যোগে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। গোলাম আযম একাত্তরের ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানি আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার আহ্বান জানান। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের পর ১০ দিনের মধ্যে নুরুল আমিন, গোলাম আযম, ফরিদ আহমদ, খাজা খায়েরউদ্দীন, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ নেতা সামরিক প্রশাসক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মতিউর রহমান নিজামী : একাত্তরে ছিলেন নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই গঠন করা হয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির। আলবদর বাহিনীর গঠন প্রসঙ্গে একাত্তরের ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে এক নিবন্ধে নিজামী বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও ৩১৩ যুবকের সমন্বয়ে একেকটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ : একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর অপতৎপরতার ছবিও প্রকাশিত হয় একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে। ছবির ক্যাপশন ছিল_'গতকাল গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি প্রদান করিয়া আলবদর আয়োজিত পথসভায় বক্তৃতা করিতেছেন আলবদর প্রধান জনাব মুজাহিদ।' এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান। জামালপুরে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে, যার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' শীর্ষক বইয়ের ১১১-১১২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে জানা যায়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বেই ময়মনসিংহ জেলার সব ছাত্রসংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ কে এম ইউসুফ : একাত্তরের মে মাসে তিনিই প্রথম জামায়াতের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। খুলনার তৎকালীন ভূতেরবাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টার) ছিল তাঁর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য গঠিত ডা. মালেক মন্ত্রিসভার রাজস্ব মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
মাওলানা হাবিবুর রহমান : চুয়াডাঙ্গার হাবিবুর রহমান একাত্তরে ছিলেন জেলার জীবননগর উপজেলা শান্তি কমিটির সদস্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে যাঁদের শাস্তি হয়েছিল তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। অভিযোগ আছে, তাঁর নেতৃত্বেই কয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাককে হাসাদহ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়।
রিয়াছাত আলী বিশ্বাস : তিনি ছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে কালীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইউনুসকে হত্যা করার। তাঁর তত্ত্বাবধানেই একাত্তরের জুলাই মাসে পাকিস্তানি সেনারা গানবোটে চড়ে প্রতাপনগর গ্রামে হানা দিয়েছিল বলে গণআদালতে সাক্ষ্য দেন সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক আহ্বায়ক মহিয়ার রহমান।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের সিলেট জেলা সভাপতি এবং সিলেট আলবদর বাহিনীর কমান্ডার। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের খাদিমপাড়ার ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে সভা করে ফরিদ উদ্দিন আলবদর বাহিনী গঠন করেন এবং পাকিমআনি সেনাদের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন ও সম্পদ লুটপাটে অংশ নেন।
অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুস : একাত্তরে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির ২৩ নম্বর সদস্য। ছিলেন রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক ও আলবদর বাহিনীর নেতা। বাগেরহাটের একটি কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর নেতা হিসেবে বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন।
আবদুল আলীম : জয়পুরহাট মহকুমা (বর্তমান জেলা) শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িটি তখন ছিল জয়পুরহাটের রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প। আবদুল আলীমই ওই এলাকায় রাজাকার রিক্রুট করেছিলেন। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা গেছে, একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনারা সড়ক থেকে ২৬ নিরীহ গাড়োয়ালকে আবদুল আলীমের বাড়ির চাতালে তিন-চার দিন আটকে রাখার পর খঞ্জনপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল আলীম ও তাঁর সহযোগীরা জয়পুরহাটের মঙ্গলবাড়ী গ্রাম থেকে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে দুটি ট্রাকে করে জয়পুরহাটের শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছিল। পরে তাঁর নির্দেশে ওখানেই ২৬ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী : মুসলিম লীগের ব্যানারে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করেন এ দুই ভাই। তাঁদের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী (মৃত) ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক শামসুল আরেফিনের প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে সালাউদ্দিন কাদেরদের বাসায় (গুডস হিল) পাকিস্তানি বাহিনীর এক প্লাটুন সেনা মোতায়েন থাকত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সাকার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজাফফর ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে সড়ক থেকে ধরে হাটহাজারী ক্যাম্পে নিয়ে মেরে ফেলা হয়। গুডস হিল নামের ওই বাড়িটি ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ওই বাড়িতেই একাত্তরের ১৭ জুলাই ছাত্রনেতা ফারুককে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় হত্যা করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষকে ধরে এ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো। মেয়েদের তুলে দেওয়া হতো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।
মাওলানা আব্দুস সোবহান : একাত্তরে তিনি পাবনা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন। তিনি পাবনা শান্তি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাবনায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত গ্রন্থ 'একাত্তরের রাজাকারদের ২০০১ নির্বাচনে বর্জন করুন' থেকে জানা গেছে, ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাবনায় সোবহানের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী : ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা যায়, পিরোজপুরে নিজ এলাকায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠনে সার্বিক সহযোগিতা করেন সাঈদী। চার সহযোগী নিয়ে 'পাঁচ তহবিল' নামে একটি সংগঠন গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুদের বাড়িঘর দখল ও সম্পদ লুট করতেন। লুণ্ঠিত এসব সম্পদ 'গণিমতের মাল' আখ্যা দিয়ে সাঈদী নিজে ভোগ এবং পাড়েরহাট বন্দরে এসব বিক্রি করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি এলাকার পাড়েরহাট বন্দরের বিপদ সাহার বাড়ি দখল করে সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে বসেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারের তালিকা তৈরিসহ মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে সেনা ক্যাম্পে দিয়ে আসতেন।
আব্দুল কাদের মোল্লা : একাত্তরে ঢাকার মিরপুরে বিহারিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ওই সময় মিরপুরের বাসিন্দাদের কাছে তিনি 'জল্লাদ' ও 'কসাই' নামে পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ আছে, শিয়ালবাড়ী, রূপনগরসহ মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন কাদের মোল্লা।
এ বি এম খালেক মজুমদার : একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর অফিস সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি আলবদর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ডা. এম এ হাসানের বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খালেক মজুমদারের নেতৃত্বে একদল আলবদর পুরান ঢাকার ২৯ নম্বর কায়েতটুলী থেকে সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
মীর কাসেম আলী : আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি ক্যাম্প গঠন করে আলবদর ও রাজাকার রিক্রুট শুরু করেন। একাত্তরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে জানা গেছে, তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ১০টিরও বেশি গণহত্যা হয়েছিল। বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম সংগ্রহ এবং তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাদের তথ্য দিতেন। চট্টগ্রামের কুমিরায় এক রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ৪৫ জনকে হত্যা করা হয়।
একাত্তরে তাঁরা কে কোন দলে ছিলেন, কী করেছেন
প্রতীক ইজাজ ও উম্মুল ওয়ারা সুইটিএ
একাত্তরে নেতৃস্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিরা ছিলেন কয়েকটি ডানপন্থী দলের। দলগুলো হলো_জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) এবং মুসলিম লীগের কয়েকটি অংশ। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে এসব দলের নেতারাই গঠন করেছিলেন শান্তি কমিটি। জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে দেশব্যাপী গঠন করা হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। পাকিস্তানের সামরিক সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে রাজাকার বাহিনীকে আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করেছিল। এ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের জন্য মাসিক মাসোহারা নির্ধারিত ছিল এবং তা সরকারি কোষাগার থেকেই দেওয়া হতো। আলবদর ও আলশামস ছিল রাজাকার বাহিনীরই দুটি বিশেষ ব্রিগেড।
বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ একাত্তরে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা থেকে ওই নেতাদের তৎকালীন অবস্থান সম্পর্কে জানা গেছে।
গোলাম আযম : মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। একাত্তরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত এক সভায় পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য নতুন কর্মী বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। তাঁর ব্যক্তিগত পরামর্শ ও সক্রিয় সহযোগিতায় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর উদ্যোগে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। গোলাম আযম একাত্তরের ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানি আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার আহ্বান জানান। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের পর ১০ দিনের মধ্যে নুরুল আমিন, গোলাম আযম, ফরিদ আহমদ, খাজা খায়েরউদ্দীন, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ নেতা সামরিক প্রশাসক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মতিউর রহমান নিজামী : একাত্তরে ছিলেন নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই গঠন করা হয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির। আলবদর বাহিনীর গঠন প্রসঙ্গে একাত্তরের ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে এক নিবন্ধে নিজামী বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও ৩১৩ যুবকের সমন্বয়ে একেকটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ : একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর অপতৎপরতার ছবিও প্রকাশিত হয় একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে। ছবির ক্যাপশন ছিল_'গতকাল গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি প্রদান করিয়া আলবদর আয়োজিত পথসভায় বক্তৃতা করিতেছেন আলবদর প্রধান জনাব মুজাহিদ।' এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান। জামালপুরে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে, যার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' শীর্ষক বইয়ের ১১১-১১২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে জানা যায়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বেই ময়মনসিংহ জেলার সব ছাত্রসংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ কে এম ইউসুফ : একাত্তরের মে মাসে তিনিই প্রথম জামায়াতের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। খুলনার তৎকালীন ভূতেরবাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টার) ছিল তাঁর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য গঠিত ডা. মালেক মন্ত্রিসভার রাজস্ব মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
মাওলানা হাবিবুর রহমান : চুয়াডাঙ্গার হাবিবুর রহমান একাত্তরে ছিলেন জেলার জীবননগর উপজেলা শান্তি কমিটির সদস্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে যাঁদের শাস্তি হয়েছিল তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। অভিযোগ আছে, তাঁর নেতৃত্বেই কয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাককে হাসাদহ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়।
রিয়াছাত আলী বিশ্বাস : তিনি ছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে কালীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইউনুসকে হত্যা করার। তাঁর তত্ত্বাবধানেই একাত্তরের জুলাই মাসে পাকিস্তানি সেনারা গানবোটে চড়ে প্রতাপনগর গ্রামে হানা দিয়েছিল বলে গণআদালতে সাক্ষ্য দেন সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক আহ্বায়ক মহিয়ার রহমান।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের সিলেট জেলা সভাপতি এবং সিলেট আলবদর বাহিনীর কমান্ডার। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের খাদিমপাড়ার ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে সভা করে ফরিদ উদ্দিন আলবদর বাহিনী গঠন করেন এবং পাকিমআনি সেনাদের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন ও সম্পদ লুটপাটে অংশ নেন।
অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুস : একাত্তরে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির ২৩ নম্বর সদস্য। ছিলেন রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক ও আলবদর বাহিনীর নেতা। বাগেরহাটের একটি কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর নেতা হিসেবে বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন।
আবদুল আলীম : জয়পুরহাট মহকুমা (বর্তমান জেলা) শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িটি তখন ছিল জয়পুরহাটের রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প। আবদুল আলীমই ওই এলাকায় রাজাকার রিক্রুট করেছিলেন। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা গেছে, একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনারা সড়ক থেকে ২৬ নিরীহ গাড়োয়ালকে আবদুল আলীমের বাড়ির চাতালে তিন-চার দিন আটকে রাখার পর খঞ্জনপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল আলীম ও তাঁর সহযোগীরা জয়পুরহাটের মঙ্গলবাড়ী গ্রাম থেকে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে দুটি ট্রাকে করে জয়পুরহাটের শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছিল। পরে তাঁর নির্দেশে ওখানেই ২৬ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী : মুসলিম লীগের ব্যানারে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করেন এ দুই ভাই। তাঁদের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী (মৃত) ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক শামসুল আরেফিনের প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে সালাউদ্দিন কাদেরদের বাসায় (গুডস হিল) পাকিস্তানি বাহিনীর এক প্লাটুন সেনা মোতায়েন থাকত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সাকার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজাফফর ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে সড়ক থেকে ধরে হাটহাজারী ক্যাম্পে নিয়ে মেরে ফেলা হয়। গুডস হিল নামের ওই বাড়িটি ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ওই বাড়িতেই একাত্তরের ১৭ জুলাই ছাত্রনেতা ফারুককে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় হত্যা করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষকে ধরে এ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো। মেয়েদের তুলে দেওয়া হতো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।
মাওলানা আব্দুস সোবহান : একাত্তরে তিনি পাবনা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন। তিনি পাবনা শান্তি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাবনায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত গ্রন্থ 'একাত্তরের রাজাকারদের ২০০১ নির্বাচনে বর্জন করুন' থেকে জানা গেছে, ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাবনায় সোবহানের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী : ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা যায়, পিরোজপুরে নিজ এলাকায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠনে সার্বিক সহযোগিতা করেন সাঈদী। চার সহযোগী নিয়ে 'পাঁচ তহবিল' নামে একটি সংগঠন গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুদের বাড়িঘর দখল ও সম্পদ লুট করতেন। লুণ্ঠিত এসব সম্পদ 'গণিমতের মাল' আখ্যা দিয়ে সাঈদী নিজে ভোগ এবং পাড়েরহাট বন্দরে এসব বিক্রি করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি এলাকার পাড়েরহাট বন্দরের বিপদ সাহার বাড়ি দখল করে সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে বসেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারের তালিকা তৈরিসহ মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে সেনা ক্যাম্পে দিয়ে আসতেন।
আব্দুল কাদের মোল্লা : একাত্তরে ঢাকার মিরপুরে বিহারিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ওই সময় মিরপুরের বাসিন্দাদের কাছে তিনি 'জল্লাদ' ও 'কসাই' নামে পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ আছে, শিয়ালবাড়ী, রূপনগরসহ মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন কাদের মোল্লা।
এ বি এম খালেক মজুমদার : একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর অফিস সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি আলবদর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ডা. এম এ হাসানের বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খালেক মজুমদারের নেতৃত্বে একদল আলবদর পুরান ঢাকার ২৯ নম্বর কায়েতটুলী থেকে সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
মীর কাসেম আলী : আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি ক্যাম্প গঠন করে আলবদর ও রাজাকার রিক্রুট শুরু করেন। একাত্তরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে জানা গেছে, তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ১০টিরও বেশি গণহত্যা হয়েছিল। বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম সংগ্রহ এবং তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাদের তথ্য দিতেন। চট্টগ্রামের কুমিরায় এক রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ৪৫ জনকে হত্যা করা হয়।
২৫ থেকে ২৬ মার্চ, ১৯৭১
২৫ থেকে ২৬ মার্চ, ১৯৭১
শহিদুল ইসলাম
২৫ মার্চ, ১৯৭১ ভয়াল কাল রাতের কথা হঠাৎ করেই লেখা যায় না। পেছনের ইতিহাস টানতে হয়। নিদেনপক্ষে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটি সামনে না রাখলে ২৫ মার্চের সে ভয়ংকর রাতের কথা ফোটানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমাকে ২৫ ও ২৬ মার্চের কথাই লিখতে বলা হয়েছে। তাই সে প্রেক্ষাপটটি এখানে লেখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রয়োজনও আছে বলে আমার মনে হয় না। আজকের সংবাদপত্রগুলো এবং টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো 'রক্তঝরা' মার্চের প্রতিদিনের ঘটনা যেভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরছে, তাতে সে সম্পর্কে আমার কিছু না লিখলেও চলবে। শুধু একটা কথাই বলব, ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে আগুন ধরে যায়। স্বাধীনতার কম কিছুতেই মানুষ আর মানতে নারাজ। '৭০-এর নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বাঙালির আসন পাকাপোক্ত করার জন্য, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানের প্রথম বাঙালি সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্য বানচালের চক্রান্তে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। সারাদেশ আন্দোলনে নেচে ওঠে।
আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তারাও সে আন্দোলনে পিছিয়ে ছিলাম না। বরং ১৮ ফেব্রুয়ারি জোহা স্যারের হত্যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অন্য ধরনের সম্মান এনে দেয়। তদুপরি ৫ মার্চ শিক্ষক সমিতি 'স্বাধীনতার' প্রস্তাব গ্রহণ করে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হওয়ার সম্মান লাভ করে। ৩ মার্চ ছাত্র-শিক্ষকরা কলাভবনের সামনের শহীদ মিনারে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ান, প্রশাসনিক ভবনের মাথায় উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের পতাকা। যাওয়া-আসার পথে ওই পতাকার দিকে চোখ পড়লে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যেত। সেদিন ঢাকায় কী হচ্ছে, তা আমরা আজকের মতো সহজেই জানতে পারতাম না। তাই একটি ঘটনা নানা ডালপালা মেলে আমাদের মুখে মুখে ফিরত। ইয়াহিয়ার ঘোষণা 'মুজিব ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী', ভুট্টোর 'দু'দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের' প্রস্তাব আমাদের মনে নানা ধরনের বার্তাবহন করে আনত। যাক সে কথা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। প্রতিদিনের মতো আমরা, বজলুল মোবিন চৌধুরী, খালেদ হাসান, আবদুর রাজ্জাক, সনৎ কুমার সাহা, নুরুদ্দীন আহমেদ, লুৎফর রহমান অনেক রাত পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশনের খবর সংগ্রহ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানারকম সম্ভাবনার কথা আলোচনা করতাম। ২৫ মার্চ ভয়াল রাত। ঢাকায় যা ঘটেছে আমরা ওই রাতে কোনো খবরই পাইনি। বরং একটা সমঝোতার সম্ভাবনা মনের ভেতর নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে যাই রাত বারোটার আগে নয়। ঢাকায় যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, আমরা সে রাতে কিছুই জানি না। আমাদের কাছে ২৬ মার্চ হচ্ছে ভয়াল দিন। ২৬ মার্চ আমার জন্য এক ভয়ঙ্কর দিন। সংক্ষেপে সে কথাই লিখি আজ।
৩ মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে জুবেরি ভবনের সব শিক্ষক যে যার বাড়ি চলে যান। থাকি আমি, অজিত কুমার ঘোষ এবং মুজিবুর রহমান। রান্নাঘর সামলাত জয়নাল। অজিত ও আমি পাশাপাশি কক্ষে থাকতাম। শুভ রাত্রি বলে আমরা যে যার ঘরে ঢুকি। শুয়ে গভীর নিদ্রার কোলে আশ্রয় নিই। বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, জানার কোনো উপায় ছিল না। ঘুম ভাঙল দরজায় প্রবল আঘাতের শব্দে। ভালো করে ঠাহর করার আগেই স্যান্ডোগেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দরজা খুলি। সঙ্গে সঙ্গে দুইজন সৈন্য ঘরে ঢুকে পরল।পেছন থেকে লাথি মেরে বলল 'নিকালো শালে।' বাইরে বেরিয়ে দেখি মুজিবুর রহমান ও অজিতকে আগেই বের করে এনেছে। রাইফেল উঁচিয়ে তিন পাকিস্তানি সেনা আমাদের জুবেরি ভবন থেকে প্যারিস রোডের দিকে নিয়ে চলল। ডানে ঘুরে উপাচার্যের বাড়ির দিকে এগোলাম। হাতের বামে শিক্ষকদের ফ্লাটগুলো থেকে উঁকি মেরে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া দেখছিল শিক্ষকদের পরিবার। অজিতের মুখ শুকিয়ে চুন। মুজিবুর রহমানকে অতটা বিস্মিত হতে দেখলাম না। করাচিতে ছিলেন বহুদিন। উর্দুটা ভালোই জানতেন। উর্দুতে সৈন্যদের সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা কেউ কথা না বলে বন্দুক উঁচিয়ে উপাচার্য সাজ্জাদ হোসাইনের বাড়িতে নিয়ে গেল। সামনে দিয়ে জোরে আঘাত করলে মুজিবুর পড়ে যান। তারা এলোপাতাতি লাথি মারতে লাগল। তারপর টেনে তুলে উপাচার্যের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সাজ্জাদ হোসাইন বাগানে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁর সামনে আমাদের হাজির করলে তিনি বললেন 'এঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।' ওরা প্রশ্ন করল 'ছুটির মধ্যে গেস্ট হাউসে কী করে এঁরা।' সাজ্জাদ হোসাইন বললেন 'পড়াশোনা করার জন্য এরা থেকে গেছে।' তারপর তিনজন একত্রে কী আলাপ করল। তারপর আমাদের বলল 'চলিয়ে।' আমাদের ফের যে পথ দিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরে যার যার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল_'কেউ ঘর থেকে বেরুবে না। তাহলে গুলি করব।' আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকে একা একা অস্থির হয়ে গেলাম। আমার 'ন্যাশনাল তিন ব্যান্ডের রেডিওতে' আকাশবাণী শুনলাম খুব আস্তে। ভেসে এল দেবদুলাল বঙ্গোপাধ্যায়ের কাঁপা গলা। 'বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।' মৃতদের মধ্যে জি সি দেবের নামও ছিল। খবর শুনে আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম। আমাদের ঘরের দরজায় ও পেছনের গ্রিলের বাইরে সেপাহি দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বাড়তে থাকলে ক্ষুধায় অস্থির হয়ে দরজা খুলে সেপাহিকে বললাম। সে জিজ্ঞেস করল 'তোমরা কোথায় খাও।' আমি খাবার ঘরটি দেখিয়ে দিলাম। তখন অজিতকে বের করে বন্দুকের নলের সামনে আমরা খাবার ঘরের দিকে এগুলাম। যাওয়ার সময় মুজিবুর রহমানকে বের করে নিলাম। খাবার ঘরে গিয়ে ডাকাডাকি করে বহু পরে জয়নালের সাড়া পেলাম। সে আমাদের গলা শুনে সাহস পেয়ে দরজা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সেপাহি তাকে লাথি মেরে গালাগাল দিল এবং আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করতে বলল। আমরা খাবার টেবিল ঘিরে তিনজন বসে গেলাম। জয়নাল পরোটা ও ডিম ভাজি করে আমাদের দিল। ভদ্রতার খাতিরে আমি দাঁড়িয়ে থাকা সেপাহিকে আমাদের সঙ্গে খেতে আহ্বান জানালে সে জানাল 'অর্ডার নাই।' দুপুরেও বন্দুকের নলের মুখে আমরা আহার সারি।
ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা একাকী সারাটা দিন কাটিয়ে দি। মাঝেমধ্যে দরজায় টোকা। খুলেই দেখি পাকিস্তানি সেনা। ঘরের মধ্যে ঢোকে। এটা দেখে, ওটা দেখে। জিজ্ঞেস করে 'তোমার দুটো রেডিও?' আমি বলি না একটা রেকর্ড প্লেয়ার আর একটা রেডিও। রেকর্ড প্লেয়ারে এক লং-প্লে চড়িয়ে তাকে বোঝাই জিনিসটা কি? যাওয়ার সময় রেডিওটা নিয়ে গেল। বলে গেল ২টার সময় দিয়ে যাবে। না দিলেই বা কি করার ছিল। হাসিমুখে দিলাম। ঐদিন ৩ ব্যান্ডের ন্যাশনাল রেডিওটাই ছিল আমার সময় কাটানোর উপায়। আকাশবাণী ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাংলাদেশের খবর প্রচার করছে। সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ঢাকায় কারা কারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের নাম। সেই রেডিওটাও নিয়ে গেল ওরা। পরে এক ফাঁকে অজিতের ঘরে গেলাম। শুনলাম, ওর রেডিওটাও নিয়ে গেছে। বুঝলাম কোনো খবর যেন আমরা শুনতে না পারি। যাহোক, অজিতকে বললাম 'খবরদার, তোমার আসল নাম বলবে না কখনো?' ও জিজ্ঞেস করল 'তাহলে কী বলব?' আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল 'ওয়াজেদ গাউস।' অজিত ঘোষের সঙ্গে মিল রেখে।
সন্ধ্যায় ওদের শিফট পরিবর্তনের সময় আমি ও অজিত গেস্ট হাউস থেকে পালাই। আসার সময় মুজিবুর রহমানকেও আমাদের সঙ্গে আসতে বলি। তিনি এলেন না। আমি আফতাবুর রহিম ও অজিত, প্রফেসর মুশাররফ হোসেনের বাসায় উঠি। এভাবে সমস্ত ২৬ মার্চ আমাদের কাটল। ২৭ মার্চ বিকেল থেকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস ত্যাগ করলে আমরা বাইরে বেরুতে সাহস পাই। সন্ধ্যার পর ক্লাবেও আসি। গল্প-গুজব হয়। ক্লাবেই শুনি ২৬ মার্চ ভোরের দৈনন্দিন হাঁটার সময় জোহা হলের প্রোভোস্ট ড. সিরাজুল আরেফীন, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তারা বিষয়টি বুঝে তাঁকে ছেড়ে দেয়। আরেফীন স্যার তখন শিক্ষক সমিতির সভাপতি। ৫ মার্চ তাঁরই সভাপতিত্বে শিক্ষকরা 'স্বাধীন বাংলাদেশের' প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৩ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস দখলে নেয়। শিক্ষকদের স্বাধীন চলাফেরা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৪ এপ্রিল সুখরঞ্জন সমাদ্দারকেও ধরে নিয়ে হত্যা করে সেনারা। ১৫ এপ্রিল অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
শহিদুল ইসলাম
২৫ মার্চ, ১৯৭১ ভয়াল কাল রাতের কথা হঠাৎ করেই লেখা যায় না। পেছনের ইতিহাস টানতে হয়। নিদেনপক্ষে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটি সামনে না রাখলে ২৫ মার্চের সে ভয়ংকর রাতের কথা ফোটানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমাকে ২৫ ও ২৬ মার্চের কথাই লিখতে বলা হয়েছে। তাই সে প্রেক্ষাপটটি এখানে লেখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রয়োজনও আছে বলে আমার মনে হয় না। আজকের সংবাদপত্রগুলো এবং টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো 'রক্তঝরা' মার্চের প্রতিদিনের ঘটনা যেভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরছে, তাতে সে সম্পর্কে আমার কিছু না লিখলেও চলবে। শুধু একটা কথাই বলব, ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে আগুন ধরে যায়। স্বাধীনতার কম কিছুতেই মানুষ আর মানতে নারাজ। '৭০-এর নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বাঙালির আসন পাকাপোক্ত করার জন্য, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানের প্রথম বাঙালি সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্য বানচালের চক্রান্তে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। সারাদেশ আন্দোলনে নেচে ওঠে।
আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তারাও সে আন্দোলনে পিছিয়ে ছিলাম না। বরং ১৮ ফেব্রুয়ারি জোহা স্যারের হত্যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অন্য ধরনের সম্মান এনে দেয়। তদুপরি ৫ মার্চ শিক্ষক সমিতি 'স্বাধীনতার' প্রস্তাব গ্রহণ করে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হওয়ার সম্মান লাভ করে। ৩ মার্চ ছাত্র-শিক্ষকরা কলাভবনের সামনের শহীদ মিনারে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ান, প্রশাসনিক ভবনের মাথায় উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের পতাকা। যাওয়া-আসার পথে ওই পতাকার দিকে চোখ পড়লে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যেত। সেদিন ঢাকায় কী হচ্ছে, তা আমরা আজকের মতো সহজেই জানতে পারতাম না। তাই একটি ঘটনা নানা ডালপালা মেলে আমাদের মুখে মুখে ফিরত। ইয়াহিয়ার ঘোষণা 'মুজিব ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী', ভুট্টোর 'দু'দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের' প্রস্তাব আমাদের মনে নানা ধরনের বার্তাবহন করে আনত। যাক সে কথা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। প্রতিদিনের মতো আমরা, বজলুল মোবিন চৌধুরী, খালেদ হাসান, আবদুর রাজ্জাক, সনৎ কুমার সাহা, নুরুদ্দীন আহমেদ, লুৎফর রহমান অনেক রাত পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশনের খবর সংগ্রহ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানারকম সম্ভাবনার কথা আলোচনা করতাম। ২৫ মার্চ ভয়াল রাত। ঢাকায় যা ঘটেছে আমরা ওই রাতে কোনো খবরই পাইনি। বরং একটা সমঝোতার সম্ভাবনা মনের ভেতর নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে যাই রাত বারোটার আগে নয়। ঢাকায় যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, আমরা সে রাতে কিছুই জানি না। আমাদের কাছে ২৬ মার্চ হচ্ছে ভয়াল দিন। ২৬ মার্চ আমার জন্য এক ভয়ঙ্কর দিন। সংক্ষেপে সে কথাই লিখি আজ।
৩ মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে জুবেরি ভবনের সব শিক্ষক যে যার বাড়ি চলে যান। থাকি আমি, অজিত কুমার ঘোষ এবং মুজিবুর রহমান। রান্নাঘর সামলাত জয়নাল। অজিত ও আমি পাশাপাশি কক্ষে থাকতাম। শুভ রাত্রি বলে আমরা যে যার ঘরে ঢুকি। শুয়ে গভীর নিদ্রার কোলে আশ্রয় নিই। বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, জানার কোনো উপায় ছিল না। ঘুম ভাঙল দরজায় প্রবল আঘাতের শব্দে। ভালো করে ঠাহর করার আগেই স্যান্ডোগেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দরজা খুলি। সঙ্গে সঙ্গে দুইজন সৈন্য ঘরে ঢুকে পরল।পেছন থেকে লাথি মেরে বলল 'নিকালো শালে।' বাইরে বেরিয়ে দেখি মুজিবুর রহমান ও অজিতকে আগেই বের করে এনেছে। রাইফেল উঁচিয়ে তিন পাকিস্তানি সেনা আমাদের জুবেরি ভবন থেকে প্যারিস রোডের দিকে নিয়ে চলল। ডানে ঘুরে উপাচার্যের বাড়ির দিকে এগোলাম। হাতের বামে শিক্ষকদের ফ্লাটগুলো থেকে উঁকি মেরে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া দেখছিল শিক্ষকদের পরিবার। অজিতের মুখ শুকিয়ে চুন। মুজিবুর রহমানকে অতটা বিস্মিত হতে দেখলাম না। করাচিতে ছিলেন বহুদিন। উর্দুটা ভালোই জানতেন। উর্দুতে সৈন্যদের সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা কেউ কথা না বলে বন্দুক উঁচিয়ে উপাচার্য সাজ্জাদ হোসাইনের বাড়িতে নিয়ে গেল। সামনে দিয়ে জোরে আঘাত করলে মুজিবুর পড়ে যান। তারা এলোপাতাতি লাথি মারতে লাগল। তারপর টেনে তুলে উপাচার্যের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সাজ্জাদ হোসাইন বাগানে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁর সামনে আমাদের হাজির করলে তিনি বললেন 'এঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।' ওরা প্রশ্ন করল 'ছুটির মধ্যে গেস্ট হাউসে কী করে এঁরা।' সাজ্জাদ হোসাইন বললেন 'পড়াশোনা করার জন্য এরা থেকে গেছে।' তারপর তিনজন একত্রে কী আলাপ করল। তারপর আমাদের বলল 'চলিয়ে।' আমাদের ফের যে পথ দিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরে যার যার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল_'কেউ ঘর থেকে বেরুবে না। তাহলে গুলি করব।' আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকে একা একা অস্থির হয়ে গেলাম। আমার 'ন্যাশনাল তিন ব্যান্ডের রেডিওতে' আকাশবাণী শুনলাম খুব আস্তে। ভেসে এল দেবদুলাল বঙ্গোপাধ্যায়ের কাঁপা গলা। 'বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।' মৃতদের মধ্যে জি সি দেবের নামও ছিল। খবর শুনে আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম। আমাদের ঘরের দরজায় ও পেছনের গ্রিলের বাইরে সেপাহি দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বাড়তে থাকলে ক্ষুধায় অস্থির হয়ে দরজা খুলে সেপাহিকে বললাম। সে জিজ্ঞেস করল 'তোমরা কোথায় খাও।' আমি খাবার ঘরটি দেখিয়ে দিলাম। তখন অজিতকে বের করে বন্দুকের নলের সামনে আমরা খাবার ঘরের দিকে এগুলাম। যাওয়ার সময় মুজিবুর রহমানকে বের করে নিলাম। খাবার ঘরে গিয়ে ডাকাডাকি করে বহু পরে জয়নালের সাড়া পেলাম। সে আমাদের গলা শুনে সাহস পেয়ে দরজা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সেপাহি তাকে লাথি মেরে গালাগাল দিল এবং আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করতে বলল। আমরা খাবার টেবিল ঘিরে তিনজন বসে গেলাম। জয়নাল পরোটা ও ডিম ভাজি করে আমাদের দিল। ভদ্রতার খাতিরে আমি দাঁড়িয়ে থাকা সেপাহিকে আমাদের সঙ্গে খেতে আহ্বান জানালে সে জানাল 'অর্ডার নাই।' দুপুরেও বন্দুকের নলের মুখে আমরা আহার সারি।
ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা একাকী সারাটা দিন কাটিয়ে দি। মাঝেমধ্যে দরজায় টোকা। খুলেই দেখি পাকিস্তানি সেনা। ঘরের মধ্যে ঢোকে। এটা দেখে, ওটা দেখে। জিজ্ঞেস করে 'তোমার দুটো রেডিও?' আমি বলি না একটা রেকর্ড প্লেয়ার আর একটা রেডিও। রেকর্ড প্লেয়ারে এক লং-প্লে চড়িয়ে তাকে বোঝাই জিনিসটা কি? যাওয়ার সময় রেডিওটা নিয়ে গেল। বলে গেল ২টার সময় দিয়ে যাবে। না দিলেই বা কি করার ছিল। হাসিমুখে দিলাম। ঐদিন ৩ ব্যান্ডের ন্যাশনাল রেডিওটাই ছিল আমার সময় কাটানোর উপায়। আকাশবাণী ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাংলাদেশের খবর প্রচার করছে। সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ঢাকায় কারা কারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের নাম। সেই রেডিওটাও নিয়ে গেল ওরা। পরে এক ফাঁকে অজিতের ঘরে গেলাম। শুনলাম, ওর রেডিওটাও নিয়ে গেছে। বুঝলাম কোনো খবর যেন আমরা শুনতে না পারি। যাহোক, অজিতকে বললাম 'খবরদার, তোমার আসল নাম বলবে না কখনো?' ও জিজ্ঞেস করল 'তাহলে কী বলব?' আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল 'ওয়াজেদ গাউস।' অজিত ঘোষের সঙ্গে মিল রেখে।
সন্ধ্যায় ওদের শিফট পরিবর্তনের সময় আমি ও অজিত গেস্ট হাউস থেকে পালাই। আসার সময় মুজিবুর রহমানকেও আমাদের সঙ্গে আসতে বলি। তিনি এলেন না। আমি আফতাবুর রহিম ও অজিত, প্রফেসর মুশাররফ হোসেনের বাসায় উঠি। এভাবে সমস্ত ২৬ মার্চ আমাদের কাটল। ২৭ মার্চ বিকেল থেকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস ত্যাগ করলে আমরা বাইরে বেরুতে সাহস পাই। সন্ধ্যার পর ক্লাবেও আসি। গল্প-গুজব হয়। ক্লাবেই শুনি ২৬ মার্চ ভোরের দৈনন্দিন হাঁটার সময় জোহা হলের প্রোভোস্ট ড. সিরাজুল আরেফীন, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তারা বিষয়টি বুঝে তাঁকে ছেড়ে দেয়। আরেফীন স্যার তখন শিক্ষক সমিতির সভাপতি। ৫ মার্চ তাঁরই সভাপতিত্বে শিক্ষকরা 'স্বাধীন বাংলাদেশের' প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৩ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস দখলে নেয়। শিক্ষকদের স্বাধীন চলাফেরা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৪ এপ্রিল সুখরঞ্জন সমাদ্দারকেও ধরে নিয়ে হত্যা করে সেনারা। ১৫ এপ্রিল অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
অপরাধ '৭১: প্রশ্ন খণ্ডন করলেন একদল আইনজীবী
ঢাকা, এপ্রিল ২২ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- '৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিচারে দেশে-বিদেশে ওঠা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছে আইনজীবীদের একটি দল।
'৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের করা মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিচারে গঠিত তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী প্যানেল এবং ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তোলা বিভিন্ন 'প্রশ্ন' ও সম্ভাব্য প্রশ্ন মিলিয়ে ৪৮টি প্রশ্নের 'উত্তর' দেয় দলটি।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে '৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার : দেশে-বিদেশে প্রশ্ন' শীর্ষক এক প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানে এমত দেন দলটির আইনজীবীরা।
অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ক নাগরিক কমিশন এবং ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।
আইনজীবী দলে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক এম শাহ আলম, সাবেক রাষ্ট্রদূত সৈয়দ ওয়ালি-উর-রহমান, সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড লিগাল এইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, অপরাধ বিচারে গঠিত আইনজীবী প্যানেলের প্রধান গোলাম আরিফ টিপু ও ড. তুরীন আফরোজ সদস্য হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।
নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।
দলটির মতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের করা অপরাধের বিচার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনেই স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের হবে।
গত ১৬ এপ্রিল একটি সেমিনারে 'একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইবুনালে আসামিদের আপিলের সুযোগ নেই' অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের দাবি জানায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সমর্থক আইনজীবীরা।
দি ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটসের (এনএফপিএইচআর) ওই সেমিনারে বলা হয়, ১৯৭৩ সালের ওই আইনে সঠিক বিচার সম্ভব নয়।
সাবেক স্পিকার ও বিএনপির সংসদ সদস্য মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার ওই সংগঠনটির প্রধান।
প্রশ্নোত্তর পর্বে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তোলা বিভিন্ন প্রশ্ন 'বিভ্রান্তিকর' বলে বৃহস্পতিবার মন্তব্য করেন আইনজীবীরা।
"আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অবস্থান থেকে সরে এসেছে� এই অভিযোগ ঠিক নয়," মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, "আমরা আগেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে আমরা তাদেরই বিচার করবো।"
এ বিচারে সাক্ষীদের নিরাপত্তা সরকার আইন করার কথা ভাবছে বলেও জানান তিনি।
শফিক বলেন, "তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী প্যানেল এবং ট্রাইবুনালের সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মান্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে।"
ড. শাহদীন মালিক বলেন, "ট্রাইবুনাল নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলা হচ্ছে এটি আন্তর্জাতিক মানের নয়। আইন সম্পর্কে আমার ধারণা থেকে বলতে পারি যারা এটি বলছেন তারা হয় অজ্ঞ না হয় জেনেশুনেই মিথ্যা বলছেন।
"কেননা এই ট্রাইবুনালে একজন অভিযুক্ত আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবেন, আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন, সাক্ষীদের জেরা করতে পারবেন, এমনকি অভিযোগ প্রমাণিত হলে আপিলও করতে পারবেন।"
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, "আইন কখনো তামাদি হয় না। ৩৯ বছর পর এই বিচার হতে যাচ্ছে। এটা খুব বেশি সময় পর নয়, কারণ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের অপরাধের বিচার এখনো হচ্ছে।"
বঙ্গবন্ধু রাজাকার, আলবদরদের সাধারণ ক্ষমা করেননি বলে জানান তিনি।
সুরঞ্জিত বলেন, "তিনি দালাল আইনে ৬০ হাজার অপরাধীর বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
"কিন্তু ৭৫-এর পরে সেনাপতি-বিচারপতি আর ভগ্নিপতিরা দেশ এবং দেশের সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেছেন।"
স্বাধীনতার পর কোন যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিয়ে থাকলে তারও বিচার হবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান বলেন, "অভিযুক্তদের পছন্দমত বিচারক নিয়োগ দিতে হবে এমন আবদার পৃথিবীর কোন দেশেই নেই। কাকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে সে বিষয়ে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে।"
পৃথিবীর কোন দেশই জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে না� দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম বলেন, "দেশের সব মানুষই জানে '৭১-এ তারা কী অপকর্ম করেছে।"
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, "ঘটনায় জড়িতরাই এসব প্রশ্ন তুলেছেন।" তিনি বিচারের দোষি প্রমাণিত অপরাদীদের সাজা দ্রুত কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/পিসি/পিডি/২২২৪ ঘ.
'৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের করা মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিচারে গঠিত তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী প্যানেল এবং ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তোলা বিভিন্ন 'প্রশ্ন' ও সম্ভাব্য প্রশ্ন মিলিয়ে ৪৮টি প্রশ্নের 'উত্তর' দেয় দলটি।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে '৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার : দেশে-বিদেশে প্রশ্ন' শীর্ষক এক প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানে এমত দেন দলটির আইনজীবীরা।
অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ক নাগরিক কমিশন এবং ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।
আইনজীবী দলে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক এম শাহ আলম, সাবেক রাষ্ট্রদূত সৈয়দ ওয়ালি-উর-রহমান, সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড লিগাল এইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, অপরাধ বিচারে গঠিত আইনজীবী প্যানেলের প্রধান গোলাম আরিফ টিপু ও ড. তুরীন আফরোজ সদস্য হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।
নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।
দলটির মতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের করা অপরাধের বিচার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনালস) আইনেই স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের হবে।
গত ১৬ এপ্রিল একটি সেমিনারে 'একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইবুনালে আসামিদের আপিলের সুযোগ নেই' অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের দাবি জানায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সমর্থক আইনজীবীরা।
দি ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটসের (এনএফপিএইচআর) ওই সেমিনারে বলা হয়, ১৯৭৩ সালের ওই আইনে সঠিক বিচার সম্ভব নয়।
সাবেক স্পিকার ও বিএনপির সংসদ সদস্য মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার ওই সংগঠনটির প্রধান।
প্রশ্নোত্তর পর্বে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তোলা বিভিন্ন প্রশ্ন 'বিভ্রান্তিকর' বলে বৃহস্পতিবার মন্তব্য করেন আইনজীবীরা।
"আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অবস্থান থেকে সরে এসেছে� এই অভিযোগ ঠিক নয়," মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, "আমরা আগেই বলেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে আমরা তাদেরই বিচার করবো।"
এ বিচারে সাক্ষীদের নিরাপত্তা সরকার আইন করার কথা ভাবছে বলেও জানান তিনি।
শফিক বলেন, "তদন্ত সংস্থা, আইনজীবী প্যানেল এবং ট্রাইবুনালের সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মান্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে।"
ড. শাহদীন মালিক বলেন, "ট্রাইবুনাল নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলা হচ্ছে এটি আন্তর্জাতিক মানের নয়। আইন সম্পর্কে আমার ধারণা থেকে বলতে পারি যারা এটি বলছেন তারা হয় অজ্ঞ না হয় জেনেশুনেই মিথ্যা বলছেন।
"কেননা এই ট্রাইবুনালে একজন অভিযুক্ত আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবেন, আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন, সাক্ষীদের জেরা করতে পারবেন, এমনকি অভিযোগ প্রমাণিত হলে আপিলও করতে পারবেন।"
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, "আইন কখনো তামাদি হয় না। ৩৯ বছর পর এই বিচার হতে যাচ্ছে। এটা খুব বেশি সময় পর নয়, কারণ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের অপরাধের বিচার এখনো হচ্ছে।"
বঙ্গবন্ধু রাজাকার, আলবদরদের সাধারণ ক্ষমা করেননি বলে জানান তিনি।
সুরঞ্জিত বলেন, "তিনি দালাল আইনে ৬০ হাজার অপরাধীর বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
"কিন্তু ৭৫-এর পরে সেনাপতি-বিচারপতি আর ভগ্নিপতিরা দেশ এবং দেশের সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে রাজাকারদের পুনর্বাসিত করেছেন।"
স্বাধীনতার পর কোন যুদ্ধাপরাধী আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিয়ে থাকলে তারও বিচার হবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান বলেন, "অভিযুক্তদের পছন্দমত বিচারক নিয়োগ দিতে হবে এমন আবদার পৃথিবীর কোন দেশেই নেই। কাকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে সে বিষয়ে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে।"
পৃথিবীর কোন দেশই জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে না� দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম বলেন, "দেশের সব মানুষই জানে '৭১-এ তারা কী অপকর্ম করেছে।"
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, "ঘটনায় জড়িতরাই এসব প্রশ্ন তুলেছেন।" তিনি বিচারের দোষি প্রমাণিত অপরাদীদের সাজা দ্রুত কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/পিসি/পিডি/২২২৪ ঘ.
Thursday, April 22, 2010
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-২
যুগের বাণীবাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-২
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
প্রিয় পাঠক, এই শিরোনামে চারটি ধারাবাহিক লেখার ইচ্ছার দ্বিতীয়টি আজ দ্বিপ্রহরে শুরু করেছি। ১৯ মার্চ ছাপা প্রথমটিতে লিখেছিলাম, সংবিধান সব দেশেরই জনগণের আদরের ধন_বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাদের সাধ-আহ্লাদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়।
আগের লেখাটিতে আদি সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছিলাম, যেটা এক সামরিক স্বৈরশাসক কর্তৃক সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য নয়। এ বক্তব্যের পক্ষে ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে ইসলামের নবী কর্তৃক প্রণীত 'মদিনার সংবিধান', যার ২৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ইহুদি ও মুসলমানরা এক উম্মাহ বা জাতি। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। আজকের লেখাটিতে বাংলাদেশের সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোচনা করব, সেটা হচ্ছে 'গণতন্ত্র'। প্রিয় পাঠক, অনুমান করি আপনি ভাবছেন এটা এখন আলোচনার বিষয় নয়, কারণ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংসদ অধিবেশন নিয়মিত চলছে। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে সংসদে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। অতএব আমার আজকের লেখাটির বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দেওয়া যায় না। কিন্তু এটা সঠিক নয়। কেন নয়, সেটা লিখছি।
আপনার উপরোক্ত যুক্তি বোধ করি এই ধারণা থেকে উপনীত যে গণতন্ত্রে একজন নাগরিকের সর্বশেষ সর্বোচ্চ অধিকার হচ্ছে জাতীয় সংসদে তাঁর এলাকার সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার। এই ধারণাটি সঠিক কি না, আসুন সেটা যাচাই করা যাক যুক্তিবিজ্ঞানের আরোহ ও অবরোহ পদ্ধতি অনুসরণে। আপনি একটি ফলের দোকানে, ধরা যাক, আপেল কিনতে গেলেন। দোকানি আপনাকে সবুজ রঙের এক কেজি আপেল দিলেন। বাসায় ফিরে একটি আপেলে কামড় দিতেই টক স্বাদ পেলেন। আরেকটিতে, তারপর আরেকটিতে কামড় দিতে একই টক স্বাদ পেলেন। পরদিন সবুজ নয়, হলুদ রঙের আপেল কিনলেন। এবার প্রতিটিতে পেলেন মিষ্টি স্বাদ। এ দুটি অভিজ্ঞতায় অর্থাৎ আরোহ পদ্ধতিতে পেয়ে গেলেন যে আপনার কেনা সবুজ ও হলুদ রঙের আপেলগুলো যথাক্রমে টক ও মিষ্টি। অতঃপর অবরোহী যুক্তিধারায় আপনি একটি সাধারণ সূত্র পেলেন : সব সবুজ রঙের আপেল টক আর হলুদ রঙের আপেল মিষ্টি হয়।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রকে বিবেচনা করা যাক। উদাহরণ হিসেবে সংবাদপত্রে ছাপা পুরনো দুটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছি। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি এলাকায় ২০০৪ সালে ওয়াপদার খালের ওপর একটি পাকা সেতুর কাজ শুরু হয়। সেতুটি এলাকার জনগণের যাতায়াতের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। সেটি নির্মাণের জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তিনটি পিলার নির্মাণ এবং তিনটি স্লাবের একটি ঢালাই করা হয়। ঠিকাদার স্থানীয় লোক ছিলেন না। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে বিলের টাকা তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যান। অতঃপর এলাকাবাসী পাকা সেতুর বদলে একটা বাঁশের সেতু নির্মাণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দীর্ঘকাল আবেদন করে ব্যর্থ হয়। ওয়াপদার এই খালে বছরের আট মাসই মাথা-উঁচু পানি থাকে। অথচ এ এলাকার ২৫টি গ্রামের ১০ হাজার লোককে প্রতিদিন খালটি পার হয়ে যাতায়াত করতে হয়। অবশেষে এ এলাকার জনগণ নিজেদের উদ্যোগে একটি বাঁশের সাঁকো নির্মাণের উদ্দেশ্যে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির নেতৃত্বে এলাকাবাসীর কাছ থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয় এবং স্বেচ্ছাশ্রমে সাত দিনে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁশের সাঁকো নির্মিত হয়। এই সাঁকোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাতায়াত করা ছাড়াও সাইকেল, মোটরসাইকেল ও রিকশা চলাচল করছে।
অন্য প্রতিবেদনটি এখন উল্লেখ করছি। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীর বরাবর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঘেঁষা ছয়টি গ্রাম এবং সেখানে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ তিনফসলি উর্বর জমিতে চাষাবাদ করে আসছে। যখনকার কথা লিখছি, তখন ৩০০ মিটার পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রবল জলস্রোতে ভেঙে গিয়েছিল এবং সেটি মেরামত ও আরো উঁচু করার উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প তৈরি করে খরচ বাবদ ৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অথচ ওই ৩০০ মিটার বাঁধ ভাঙার অজুহাতে ভাঙা অংশের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত অর্ধবৃত্তাকারে ৩ দশমিক ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বিকল্প বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। মূল বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে বিকল্প বাঁধটি আপনা-আপনি অনাবশ্যক হয়ে যাবে। বিকল্প বাঁধ নির্মিত হলে ওই ছয়টি গ্রামের বাসিন্দারা ভিটেমাটি, চাষাবাদের জমি হারিয়ে বাস্তুহারা হবে। অথচ এটা নির্মাণের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনগণ আন্দোলন করে সেটার নির্মাণ বন্ধ করেছিল।
প্রিয় পাঠক, উপরোউক্ত প্রতিবেদন দুটি পাঠের অভিজ্ঞতায় অর্থাৎ আরোহ পদ্ধতিতে আপনি একটি সিদ্ধান্তে পেঁৗছেছেন যে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের কাজ জনস্বার্থের তোয়াক্কা করে না। শুধু তা-ই নয়, কখনো জনগণকে বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে সে কাজ করতে হয়, কিংবা কখনো জনগণকে সরকারি কাজটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়। অতঃপর অবরোহী যুক্তিধারায় একটি সাধারণ সূত্রে আপনাকে পেঁৗছতেই হবে এবং সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে উচ্চারিত বাক্যটি 'জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক' একটি বিমূর্ত ধারণা। এই সূত্রটি একপেশে। কারণ সূত্রটি তৈরি হয়েছে সরকারের কাজের ভিত্তি কী হবে এই পরোক্ষ বিবেচনায়, কিন্তু প্রতিবেদন দুটিতে সরকারের কাজের বিপরীতে জনগণের প্রতিক্রিয়ার বিবেচনায় একটি বিপরীত সূত্র পাওয়া যাচ্ছে যে প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা উপভোগের ক্ষমতা আছে এবং তিনি নিজেই তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টায় সেটি পেতে পারেন। এর সঙ্গে সহজেই দাবি করা যায়, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।
টলস্টয় তাঁর লেখা 'এ গ্রেট ইন্ইকুইটি' (চরম অবিচার) প্রবন্ধে রূপকাশ্রিত একটি গল্প বলেছেন : 'একদল মানুষ একপাল গরুকে, যাদের দুধে তৈরি খাদ্যে তাদের জীবনোপায়, একটি বেষ্টনীর ভেতরে তাদের তাড়িয়ে নিয়েছে। বেষ্টনীর ভেতরের বিচালি গরুরা খেয়ে ও পায়ে মাড়িয়ে শেষ করেছে, তারা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে একে অপরের লেজ চিবিয়েছে, তারা হাম্বা হাম্বা করছে আর বেষ্টনীর বাইরে অদূরে চারণভূমিতে যাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করছে। কিন্তু মানুষ, যারা ওই গরুদের দুধে বেঁচে আছে, বেষ্টনীর চারধারে পুদিনা, রঞ্জক ও তামাকের ক্ষেত করেছে; ফুলের আবাদ করেছে; ঘোড়দৌড়ের মাঠ, পার্ক, টেনিসের মাঠ তৈরি করেছে এবং তারা গরুগুলোকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না, পাছে এগুলো নষ্ট হয়।
অন্যদিকে গরুগুলো চিৎকার করছে, কৃশকায় হচ্ছে। অবশেষে মানুষ ভয় পেল, তারা আর দুধ পাবে না। সে কারণে গরুদের অবস্থা উন্নয়নে তারা নানা পরিকল্পনা নিল। তারা চাঁদোয়ার ব্যবস্থা করল, ভেজা বুরুশ দিয়ে গা মালিশ করল এবং দুধ দোয়ানোর সময় বদলে দিল। বৃদ্ধ ও রুগ্ণদের দেখাশোনা ও চিকিৎসায় তারা গুরুত্ব দিল। তারা দুগ্ধ-দোহনের আধুনিক পদ্ধতি বের করল। তা ছাড়া অতিরিক্ত পুষ্টিকর ঘাসের বীজ বপন করল। তারা এগুলো ও আরো বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করল, কিন্তু সরল কাজটি করল না_যেটা গুরু ও তাদের জন্যও অপরিহার্য_সেটা হচ্ছে, বেষ্টনীর বেড়াগুলো সরিয়ে ফেলা এবং গরুদের ইচ্ছামতো স্বাভাবিকভাবে চতুর্দিকের চারণভূমিকে ভোগ করতে দেওয়া।'
এই যে স্বাভাবিকভাবে জনগণকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করতে দেওয়া, তারই নকশা পাওয়া যাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ দুটিতে, যেগুলোর নির্গলিতার্থ এই : ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যসাধনকল্পে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের দ্বারা অভিহিত ও নির্দিষ্ট-সংখ্যক জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর দায়িত্বে থাকবে_(ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কাজ, (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং (গ) উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ৬০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিট বা স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা এই (ক) স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ (খ) বাজেট প্রস্তুতকরণ এবং (গ) নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করা, যা জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা ঠিক করা হবে। প্রিয় পাঠক, স্থানীয় সরকারের নকশাটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি বৈশিষ্ট্য এবং জাতীয় সংসদ কর্তৃক সেটি উপেক্ষিত হওয়াটাই বিচ্যুতি। জাতীয় সংসদ সেটা উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে এটা-ওটা আইন করছে, কিন্তু জনগণকে তাদের স্বাভাবিক সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে দিচ্ছে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগ, সুপ্রিমকোর্ট
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
প্রিয় পাঠক, এই শিরোনামে চারটি ধারাবাহিক লেখার ইচ্ছার দ্বিতীয়টি আজ দ্বিপ্রহরে শুরু করেছি। ১৯ মার্চ ছাপা প্রথমটিতে লিখেছিলাম, সংবিধান সব দেশেরই জনগণের আদরের ধন_বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাদের সাধ-আহ্লাদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়।
আগের লেখাটিতে আদি সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছিলাম, যেটা এক সামরিক স্বৈরশাসক কর্তৃক সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য নয়। এ বক্তব্যের পক্ষে ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে ইসলামের নবী কর্তৃক প্রণীত 'মদিনার সংবিধান', যার ২৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ইহুদি ও মুসলমানরা এক উম্মাহ বা জাতি। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। আজকের লেখাটিতে বাংলাদেশের সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোচনা করব, সেটা হচ্ছে 'গণতন্ত্র'। প্রিয় পাঠক, অনুমান করি আপনি ভাবছেন এটা এখন আলোচনার বিষয় নয়, কারণ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংসদ অধিবেশন নিয়মিত চলছে। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে সংসদে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। অতএব আমার আজকের লেখাটির বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দেওয়া যায় না। কিন্তু এটা সঠিক নয়। কেন নয়, সেটা লিখছি।
আপনার উপরোক্ত যুক্তি বোধ করি এই ধারণা থেকে উপনীত যে গণতন্ত্রে একজন নাগরিকের সর্বশেষ সর্বোচ্চ অধিকার হচ্ছে জাতীয় সংসদে তাঁর এলাকার সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার। এই ধারণাটি সঠিক কি না, আসুন সেটা যাচাই করা যাক যুক্তিবিজ্ঞানের আরোহ ও অবরোহ পদ্ধতি অনুসরণে। আপনি একটি ফলের দোকানে, ধরা যাক, আপেল কিনতে গেলেন। দোকানি আপনাকে সবুজ রঙের এক কেজি আপেল দিলেন। বাসায় ফিরে একটি আপেলে কামড় দিতেই টক স্বাদ পেলেন। আরেকটিতে, তারপর আরেকটিতে কামড় দিতে একই টক স্বাদ পেলেন। পরদিন সবুজ নয়, হলুদ রঙের আপেল কিনলেন। এবার প্রতিটিতে পেলেন মিষ্টি স্বাদ। এ দুটি অভিজ্ঞতায় অর্থাৎ আরোহ পদ্ধতিতে পেয়ে গেলেন যে আপনার কেনা সবুজ ও হলুদ রঙের আপেলগুলো যথাক্রমে টক ও মিষ্টি। অতঃপর অবরোহী যুক্তিধারায় আপনি একটি সাধারণ সূত্র পেলেন : সব সবুজ রঙের আপেল টক আর হলুদ রঙের আপেল মিষ্টি হয়।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রকে বিবেচনা করা যাক। উদাহরণ হিসেবে সংবাদপত্রে ছাপা পুরনো দুটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছি। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি এলাকায় ২০০৪ সালে ওয়াপদার খালের ওপর একটি পাকা সেতুর কাজ শুরু হয়। সেতুটি এলাকার জনগণের যাতায়াতের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। সেটি নির্মাণের জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তিনটি পিলার নির্মাণ এবং তিনটি স্লাবের একটি ঢালাই করা হয়। ঠিকাদার স্থানীয় লোক ছিলেন না। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে বিলের টাকা তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যান। অতঃপর এলাকাবাসী পাকা সেতুর বদলে একটা বাঁশের সেতু নির্মাণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দীর্ঘকাল আবেদন করে ব্যর্থ হয়। ওয়াপদার এই খালে বছরের আট মাসই মাথা-উঁচু পানি থাকে। অথচ এ এলাকার ২৫টি গ্রামের ১০ হাজার লোককে প্রতিদিন খালটি পার হয়ে যাতায়াত করতে হয়। অবশেষে এ এলাকার জনগণ নিজেদের উদ্যোগে একটি বাঁশের সাঁকো নির্মাণের উদ্দেশ্যে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির নেতৃত্বে এলাকাবাসীর কাছ থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয় এবং স্বেচ্ছাশ্রমে সাত দিনে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁশের সাঁকো নির্মিত হয়। এই সাঁকোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাতায়াত করা ছাড়াও সাইকেল, মোটরসাইকেল ও রিকশা চলাচল করছে।
অন্য প্রতিবেদনটি এখন উল্লেখ করছি। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীর বরাবর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঘেঁষা ছয়টি গ্রাম এবং সেখানে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ তিনফসলি উর্বর জমিতে চাষাবাদ করে আসছে। যখনকার কথা লিখছি, তখন ৩০০ মিটার পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রবল জলস্রোতে ভেঙে গিয়েছিল এবং সেটি মেরামত ও আরো উঁচু করার উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প তৈরি করে খরচ বাবদ ৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অথচ ওই ৩০০ মিটার বাঁধ ভাঙার অজুহাতে ভাঙা অংশের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত অর্ধবৃত্তাকারে ৩ দশমিক ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বিকল্প বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। মূল বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে বিকল্প বাঁধটি আপনা-আপনি অনাবশ্যক হয়ে যাবে। বিকল্প বাঁধ নির্মিত হলে ওই ছয়টি গ্রামের বাসিন্দারা ভিটেমাটি, চাষাবাদের জমি হারিয়ে বাস্তুহারা হবে। অথচ এটা নির্মাণের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনগণ আন্দোলন করে সেটার নির্মাণ বন্ধ করেছিল।
প্রিয় পাঠক, উপরোউক্ত প্রতিবেদন দুটি পাঠের অভিজ্ঞতায় অর্থাৎ আরোহ পদ্ধতিতে আপনি একটি সিদ্ধান্তে পেঁৗছেছেন যে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের কাজ জনস্বার্থের তোয়াক্কা করে না। শুধু তা-ই নয়, কখনো জনগণকে বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে সে কাজ করতে হয়, কিংবা কখনো জনগণকে সরকারি কাজটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়। অতঃপর অবরোহী যুক্তিধারায় একটি সাধারণ সূত্রে আপনাকে পেঁৗছতেই হবে এবং সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে উচ্চারিত বাক্যটি 'জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক' একটি বিমূর্ত ধারণা। এই সূত্রটি একপেশে। কারণ সূত্রটি তৈরি হয়েছে সরকারের কাজের ভিত্তি কী হবে এই পরোক্ষ বিবেচনায়, কিন্তু প্রতিবেদন দুটিতে সরকারের কাজের বিপরীতে জনগণের প্রতিক্রিয়ার বিবেচনায় একটি বিপরীত সূত্র পাওয়া যাচ্ছে যে প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা উপভোগের ক্ষমতা আছে এবং তিনি নিজেই তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টায় সেটি পেতে পারেন। এর সঙ্গে সহজেই দাবি করা যায়, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।
টলস্টয় তাঁর লেখা 'এ গ্রেট ইন্ইকুইটি' (চরম অবিচার) প্রবন্ধে রূপকাশ্রিত একটি গল্প বলেছেন : 'একদল মানুষ একপাল গরুকে, যাদের দুধে তৈরি খাদ্যে তাদের জীবনোপায়, একটি বেষ্টনীর ভেতরে তাদের তাড়িয়ে নিয়েছে। বেষ্টনীর ভেতরের বিচালি গরুরা খেয়ে ও পায়ে মাড়িয়ে শেষ করেছে, তারা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে একে অপরের লেজ চিবিয়েছে, তারা হাম্বা হাম্বা করছে আর বেষ্টনীর বাইরে অদূরে চারণভূমিতে যাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করছে। কিন্তু মানুষ, যারা ওই গরুদের দুধে বেঁচে আছে, বেষ্টনীর চারধারে পুদিনা, রঞ্জক ও তামাকের ক্ষেত করেছে; ফুলের আবাদ করেছে; ঘোড়দৌড়ের মাঠ, পার্ক, টেনিসের মাঠ তৈরি করেছে এবং তারা গরুগুলোকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না, পাছে এগুলো নষ্ট হয়।
অন্যদিকে গরুগুলো চিৎকার করছে, কৃশকায় হচ্ছে। অবশেষে মানুষ ভয় পেল, তারা আর দুধ পাবে না। সে কারণে গরুদের অবস্থা উন্নয়নে তারা নানা পরিকল্পনা নিল। তারা চাঁদোয়ার ব্যবস্থা করল, ভেজা বুরুশ দিয়ে গা মালিশ করল এবং দুধ দোয়ানোর সময় বদলে দিল। বৃদ্ধ ও রুগ্ণদের দেখাশোনা ও চিকিৎসায় তারা গুরুত্ব দিল। তারা দুগ্ধ-দোহনের আধুনিক পদ্ধতি বের করল। তা ছাড়া অতিরিক্ত পুষ্টিকর ঘাসের বীজ বপন করল। তারা এগুলো ও আরো বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করল, কিন্তু সরল কাজটি করল না_যেটা গুরু ও তাদের জন্যও অপরিহার্য_সেটা হচ্ছে, বেষ্টনীর বেড়াগুলো সরিয়ে ফেলা এবং গরুদের ইচ্ছামতো স্বাভাবিকভাবে চতুর্দিকের চারণভূমিকে ভোগ করতে দেওয়া।'
এই যে স্বাভাবিকভাবে জনগণকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করতে দেওয়া, তারই নকশা পাওয়া যাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ দুটিতে, যেগুলোর নির্গলিতার্থ এই : ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যসাধনকল্পে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের দ্বারা অভিহিত ও নির্দিষ্ট-সংখ্যক জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর দায়িত্বে থাকবে_(ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কাজ, (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং (গ) উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ৬০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিট বা স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা এই (ক) স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ (খ) বাজেট প্রস্তুতকরণ এবং (গ) নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করা, যা জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা ঠিক করা হবে। প্রিয় পাঠক, স্থানীয় সরকারের নকশাটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি বৈশিষ্ট্য এবং জাতীয় সংসদ কর্তৃক সেটি উপেক্ষিত হওয়াটাই বিচ্যুতি। জাতীয় সংসদ সেটা উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে এটা-ওটা আইন করছে, কিন্তু জনগণকে তাদের স্বাভাবিক সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে দিচ্ছে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগ, সুপ্রিমকোর্ট
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-১
যুগের বাণীবাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-১
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের এক দফাটি ছিল এই : 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' উল্লেখ্য, এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শিরোনামের দ্বিতীয় ভাগ-এ অন্তর্ভুক্ত প্রথম অনুচ্ছেদ। সংবিধান সব দেশেরই নাগরিকদের আদরের ধন_বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সাধ-আহ্লাদ মূর্ত হয়। বিশেষ করে প্রথমে ইংরেজ ঔপনিবেশিক, অতঃপর পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনের মোকাবিলা করতে হয় বাংলাদেশের জনগণকে। ১৭৬০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ সতেরো বার বিদ্রোহ করে এবং ১৯৭১ সালে একই কারণে বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়। অতঃপর জনগণের বিজয় চূড়ান্ত লক্ষ্যে পেঁৗছে। এই বিদ্রোহ-যুদ্ধের সব কয়টিরই চরিত্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রত্যেকটির পেছনে ছিল কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো প্রকাশ্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। অবশেষে আহমদ ছফার ভাষায়_'এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্যদিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে।'
ইতিপূর্বে এই পৃষ্ঠায় 'আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্বেষণ' শিরোনামে আমার চারটি ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়েছে এবং অন্বেষণের ফলস্বরূপ যে চারটি সূত্র পাওয়া গেছে তার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ বংশপরম্পরাক্রমে যে স্বপ্ন দেখেছে, যে সংগ্রাম করেছে তার আবহ সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ লোকায়ত ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ ছিল এই : 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।'
একটি দেশ বলতে কী বোঝায়? প্রশ্নটির সরল উত্তর হচ্ছে_দেশ একটি ভৌগোলিক বাস্তবতা। জাতি কী? এরও সরল উত্তর হচ্ছে, বহু কোটি লোক যারা বংশপরম্পরায় ওই ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়েছে। তাই প্রতিটি মানুষ তার জন্মভূমিকে ভালোবাসে।
রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ হাতে হাত মিলিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু উভয়েই বাঙালি জাতি। মহরমের মিছিল কিংবা জন্মাষ্টমীর রথের মিছিল যেমন যথাক্রমে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দুর উৎসব, আবার পয়লা বৈশাখে নববর্ষের মিছিল ও অনুষ্ঠান তাদের উভয়ের মিলিত উৎসব। এবার অন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। শবেবরাত উৎসবের দিনের বিকেল বেলা যখন একজন বাঙালি মুসলমান তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দুকে এক বাটি হালুয়া দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। আবার বিজয়া দশমীর সকালবেলা যখন একজন বাঙালি হিন্দু তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমানকে এক থালা সন্দেশ দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। অর্থাৎ স্বতন্ত্র উৎসবে পরস্পরের যেমন সহনশীলতার, তেমনি যৌথ উৎসবে পরস্পরের ভালোবাসার কমতি ঘটে না।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ওই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকার কারণ হচ্ছে মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি বা গোষ্ঠী বা Race নন। ১৯৩৮ সালে 'মুত্তাহিদা কওমিয়াত আউর ইসলাম' (সম্মিলিত জাতীয়তা এবং ইসলাম) শিরোনামে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা হুসেন আহমদ মাদানী লিখেছিলেন, 'একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য উপাদান নয়। কারণ কোরআনের সব জায়গায় মুসলমানদের একই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে, কখনো একই কওমের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়নি। আরবি ভাষায়, বিশেষ করে কোরআনে মিল্লাত শব্দটি আইন ও ধর্ম অর্থে এবং কওম শব্দটি জাতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দ দুটির মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান। জাতিকে যদি তুলনা করা যায় জমিনের সঙ্গে, তাহলে মিল্লাত হচ্ছে আসমানের মতো।' এই নীতির কারণে ইসলামের নবী মদিনায় যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেন তার চরিত্র ছিল সেক্যুলার বা লোকায়ত। মদিনার সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ইহুদি ও মুসলমানরা এক উম্মাহ বা জাতি। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম।
ওই নীতির কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে সংগঠনের স্বাধীনতা_এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া ৩৮ অনুচ্ছেদটি শর্তযুক্ত ছিল, যার উদ্ধৃতি এই : '৩৮ জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে: তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, বাংলাদেশের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ছবিটি বংশপরম্পরায় দৃঢ় ও অম্লান ছিল এবং যা বাস্তবায়িত হয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে সেগুলোর পক্ষে ধর্মীয় ও সামাজিক যুক্তিগুলো দেওয়া গেল। রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা 'বাংলাদেশের ইতিহাস' বইটির চতুর্থ খণ্ড থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক : 'ইংরেজদের ওপর চাপ দিয়া যাহাতে তুরস্কের খলিফার শক্তি ও সাম্রাজ্য ফিরাইয়া আনা যায় এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানেরা একটি কমিটি গঠন করে। তাহাদের এই আন্দোলন 'খিলাফৎ আন্দোলন' নামে পরিচিত। গান্ধীর সাহায্যে ও সমর্থনে এই আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল। ... কিন্তু গান্ধী জাতীয়তাবাদের মূল সূত্রটি ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কোনো দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঐক্যে একটি জাতি গঠন করিতে হইলে তাহার সর্বপ্রথম উপাদান এই যে, এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটির সহিত অপরের যে সম্বন্ধ, দেশের বহির্ভূত অপর কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে একটিরও তদনুরূপ বা অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের বন্ধন থাকিবে না। যদি থাকে, তবে তাহারা এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে না।' উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের জাতীয় সংসদ খলিফার পদ বিলুপ্ত করে যে আইনটি প্রণয়ন করে তাতে বলা হয়, 'খেলাফতের দপ্তর বিলুপ্ত হয়েছে যেহেতু খেলাফত অপরিহার্যভাবে সরকার ও প্রজাতন্ত্রের উদ্দেশ্য ও ধারণার মধ্যেই আছে।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এখন ১৯৭৮ সালে একজন সামরিক প্রশাসক কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধানের বিচ্যুতি-অপকর্মগুলো উল্লেখ করব এবং আপনাকেই লক্ষ করতে হবে কী কায়দায় পদে পদে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নাশ করা হয়েছে এবং তার মূল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম' শব্দগুলো যোগ করা হয় এবং আট অনুচ্ছেদের এক মূল দফাটি বদলে লেখা হয় : '৮। (১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস... রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। ১(ক) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি।' একই সঙ্গে ওপরে উদ্ধৃত সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদটি এবং ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত দফাটি বিলুপ্ত করা হয়। এখানে অপকর্ম শেষ হয় না। 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' পার্শ্ব-শিরোনামযুক্ত ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশকে এক দফা করে নতুন দুই দফা যোগ করা হয়, সেটা এই : (২) রাষ্ট্র 'ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' এই দুই দফাটির সংযোজনও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদল করার আর একটি সূক্ষ্ম কৌশল, নতুবা ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশটি 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে যথেষ্ট ছিল।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের এক দফাটি ছিল এই : 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' উল্লেখ্য, এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শিরোনামের দ্বিতীয় ভাগ-এ অন্তর্ভুক্ত প্রথম অনুচ্ছেদ। সংবিধান সব দেশেরই নাগরিকদের আদরের ধন_বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সাধ-আহ্লাদ মূর্ত হয়। বিশেষ করে প্রথমে ইংরেজ ঔপনিবেশিক, অতঃপর পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনের মোকাবিলা করতে হয় বাংলাদেশের জনগণকে। ১৭৬০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ সতেরো বার বিদ্রোহ করে এবং ১৯৭১ সালে একই কারণে বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়। অতঃপর জনগণের বিজয় চূড়ান্ত লক্ষ্যে পেঁৗছে। এই বিদ্রোহ-যুদ্ধের সব কয়টিরই চরিত্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রত্যেকটির পেছনে ছিল কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো প্রকাশ্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। অবশেষে আহমদ ছফার ভাষায়_'এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্যদিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে।'
ইতিপূর্বে এই পৃষ্ঠায় 'আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্বেষণ' শিরোনামে আমার চারটি ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়েছে এবং অন্বেষণের ফলস্বরূপ যে চারটি সূত্র পাওয়া গেছে তার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ বংশপরম্পরাক্রমে যে স্বপ্ন দেখেছে, যে সংগ্রাম করেছে তার আবহ সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ লোকায়ত ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ ছিল এই : 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।'
একটি দেশ বলতে কী বোঝায়? প্রশ্নটির সরল উত্তর হচ্ছে_দেশ একটি ভৌগোলিক বাস্তবতা। জাতি কী? এরও সরল উত্তর হচ্ছে, বহু কোটি লোক যারা বংশপরম্পরায় ওই ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়েছে। তাই প্রতিটি মানুষ তার জন্মভূমিকে ভালোবাসে।
রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ হাতে হাত মিলিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু উভয়েই বাঙালি জাতি। মহরমের মিছিল কিংবা জন্মাষ্টমীর রথের মিছিল যেমন যথাক্রমে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দুর উৎসব, আবার পয়লা বৈশাখে নববর্ষের মিছিল ও অনুষ্ঠান তাদের উভয়ের মিলিত উৎসব। এবার অন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। শবেবরাত উৎসবের দিনের বিকেল বেলা যখন একজন বাঙালি মুসলমান তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দুকে এক বাটি হালুয়া দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। আবার বিজয়া দশমীর সকালবেলা যখন একজন বাঙালি হিন্দু তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমানকে এক থালা সন্দেশ দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। অর্থাৎ স্বতন্ত্র উৎসবে পরস্পরের যেমন সহনশীলতার, তেমনি যৌথ উৎসবে পরস্পরের ভালোবাসার কমতি ঘটে না।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ওই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকার কারণ হচ্ছে মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি বা গোষ্ঠী বা Race নন। ১৯৩৮ সালে 'মুত্তাহিদা কওমিয়াত আউর ইসলাম' (সম্মিলিত জাতীয়তা এবং ইসলাম) শিরোনামে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা হুসেন আহমদ মাদানী লিখেছিলেন, 'একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য উপাদান নয়। কারণ কোরআনের সব জায়গায় মুসলমানদের একই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে, কখনো একই কওমের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়নি। আরবি ভাষায়, বিশেষ করে কোরআনে মিল্লাত শব্দটি আইন ও ধর্ম অর্থে এবং কওম শব্দটি জাতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দ দুটির মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান। জাতিকে যদি তুলনা করা যায় জমিনের সঙ্গে, তাহলে মিল্লাত হচ্ছে আসমানের মতো।' এই নীতির কারণে ইসলামের নবী মদিনায় যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেন তার চরিত্র ছিল সেক্যুলার বা লোকায়ত। মদিনার সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ইহুদি ও মুসলমানরা এক উম্মাহ বা জাতি। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম।
ওই নীতির কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে সংগঠনের স্বাধীনতা_এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া ৩৮ অনুচ্ছেদটি শর্তযুক্ত ছিল, যার উদ্ধৃতি এই : '৩৮ জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে: তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, বাংলাদেশের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ছবিটি বংশপরম্পরায় দৃঢ় ও অম্লান ছিল এবং যা বাস্তবায়িত হয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে সেগুলোর পক্ষে ধর্মীয় ও সামাজিক যুক্তিগুলো দেওয়া গেল। রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা 'বাংলাদেশের ইতিহাস' বইটির চতুর্থ খণ্ড থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক : 'ইংরেজদের ওপর চাপ দিয়া যাহাতে তুরস্কের খলিফার শক্তি ও সাম্রাজ্য ফিরাইয়া আনা যায় এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানেরা একটি কমিটি গঠন করে। তাহাদের এই আন্দোলন 'খিলাফৎ আন্দোলন' নামে পরিচিত। গান্ধীর সাহায্যে ও সমর্থনে এই আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল। ... কিন্তু গান্ধী জাতীয়তাবাদের মূল সূত্রটি ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কোনো দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঐক্যে একটি জাতি গঠন করিতে হইলে তাহার সর্বপ্রথম উপাদান এই যে, এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটির সহিত অপরের যে সম্বন্ধ, দেশের বহির্ভূত অপর কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে একটিরও তদনুরূপ বা অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের বন্ধন থাকিবে না। যদি থাকে, তবে তাহারা এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে না।' উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের জাতীয় সংসদ খলিফার পদ বিলুপ্ত করে যে আইনটি প্রণয়ন করে তাতে বলা হয়, 'খেলাফতের দপ্তর বিলুপ্ত হয়েছে যেহেতু খেলাফত অপরিহার্যভাবে সরকার ও প্রজাতন্ত্রের উদ্দেশ্য ও ধারণার মধ্যেই আছে।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এখন ১৯৭৮ সালে একজন সামরিক প্রশাসক কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধানের বিচ্যুতি-অপকর্মগুলো উল্লেখ করব এবং আপনাকেই লক্ষ করতে হবে কী কায়দায় পদে পদে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নাশ করা হয়েছে এবং তার মূল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম' শব্দগুলো যোগ করা হয় এবং আট অনুচ্ছেদের এক মূল দফাটি বদলে লেখা হয় : '৮। (১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস... রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। ১(ক) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি।' একই সঙ্গে ওপরে উদ্ধৃত সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদটি এবং ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত দফাটি বিলুপ্ত করা হয়। এখানে অপকর্ম শেষ হয় না। 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' পার্শ্ব-শিরোনামযুক্ত ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশকে এক দফা করে নতুন দুই দফা যোগ করা হয়, সেটা এই : (২) রাষ্ট্র 'ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' এই দুই দফাটির সংযোজনও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদল করার আর একটি সূক্ষ্ম কৌশল, নতুবা ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশটি 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে যথেষ্ট ছিল।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
মঙ্গল-অমঙ্গলের পূর্বাভাস
মঙ্গল-অমঙ্গলের পূর্বাভাস
মামুনুর রশীদ
৯৭১ সালের মার্চ মাসের গোড়া থেকেই ঢাকা শহরে কুকুরের কান্না শোনা যেত। এই কান্না ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তীব্র আকার ধারণ করে মার্চের ২০ তারিখের পর। কুকুরের কান্না শুনতে শুনতে গা ছমছম করা এক রাতে আমরা তিন বন্ধু যাচ্ছিলাম গুলিস্তানের কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসের পাশ দিয়ে। মার্চের ১০ কি ১১ তারিখ। ইপিআর বাহিনীর একজন সিপাই আমাদের ডাকলেন। তাঁর কণ্ঠে উদ্বেগ_ 'শেখ সাহেবকে একটা খবর দেবেন ভাই? আমাগো হাতিয়ার কিন্তু ক্লোজ করা শুরু করছে। একটা কিছু তলে তলে, ভেতরে ভেতরে শুরু হইছে।' তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের কান্না মিলে কী রকম একটা ভয়ার্ত পরিবেশ শুরু হয়েছিল।
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর চারদিকে ব্যারিকেড নির্মাণ শুরু হলো। জানলাম, ইয়াহিয়া-ভুট্টো চলে গেছে পাকিস্তানে। একটা কিছু আসন্ন; কিন্তু কোনো ধরনের রাজনৈতিক যুক্তি বা কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। কী হতে পারে? এর আগে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ আমরা দেখেছি। সে তো শুধু ছাউনি থেকে সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। তারপর কিছু মার্শাল ল শাসক তৈরি হয়, কিছু দ্রুত আদালত হয়। কালো আইন দেশের মানবাধিকার কেড়ে নেয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এটা। এখনো সেই ব্যবস্থা ওই দেশে জারি আছে। এ দেশেও ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের পর তা-ই হয়েছে।
রাত নামছে। ওই রকমই আশঙ্কা আমাদের। কিন্তু সব পূর্বাভাসকে ম্লান করে দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এল ট্যাংক, সাঁজোয়া বাহিনী। বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল বারুদের ঘ্রাণ। এক সভ্যতাবিধ্বংসী কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সূচনায়ই তারা কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ফেলল, যারা ছিল বাজারে, পথে, স্টেশনে, পেট্রল পাম্পে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। টেলিফোন কাজ করছে না। সমগ্র যোগাযোগব্যবস্থা সেনাবাহিনীর হাতে। আমরা পাল্টা গোলাগুলি শুনলাম পিলখানা আর রাজারবাগে। কে কোথায় আছে, জানার কোনো উপায় নেই। ওই রাতে আমি আটকা পড়ে গেলাম সামাদ ভাইয়ের বাসায়। তখন চিত্রগ্রাহক সামাদ ভাই চিত্র পরিচালক হতে চলেছেন। তাঁর প্রথম ছবি 'সূর্য গ্রহণ'-এর চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখছি। মাঝেমধ্যেই ওখানে থেকে যাই। সামাদ ভাইয়ের স্ত্রী রোজী ভাবি তখন নাম করা নায়িকা। তাঁকে নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাসলত আমরা জানি। বাসাটা একেবারেই গ্রিন রোডের ওপরে। বারান্দায় যাওয়ার উপায় নেই। বারান্দার সামনেই নিচু একটা দেয়াল। ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি তখন ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় প্রবেশপথ তখন তিনটি_ ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার দিয়ে একটি, গ্রিন রোড দিয়ে একটি, অন্যটি মিরপুর রোড দিয়ে। তাই পিলখানা ও বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পথ এটাই। আজকের দিনে অবশ্য সেই রাতের আক্রমণের নীলনকশা অনেকেই জানেন।
এরই মধ্যে রেডিওতে নরখাদক ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগ এবং শেখ সাহেবকে দোষারোপ করে হুঙ্কার ছাড়া হলো। স্পষ্টতই এক রক্তপায়ী দস্যুর গোঙানি শুনতে পেলাম আমরা। আজ এত বছর পর শুধু মনে আছে, একজন মদ্যপানরত জেনারেল রক্তের লালসায় কী যেন প্রলাপ বকে যাচ্ছে। তখন বার বার ৭ মার্চের শেখ সাহেবের বজ্রকণ্ঠ শুনে বাঁচার প্রেরণা পাচ্ছিলাম।
আমরা এমনিতেই প্রতি রাতে একটু বিলম্বে খেতাম। সেই রাতে আর খাওয়ার প্রশ্নই নেই। কোনো একটা জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতেই শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম আগুন আর ধোঁয়া। বাড়িটা বার বার কামানের গোলায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল। রোজী ভাবিকে পেছনের দেয়ালের পাশে একটা ঘরে রাখা হলো, যাতে সেনাবাহিনী ঢুকলে পেছনের দেয়াল টপকে দ্রুত অন্য বাড়িতে পার করে দেওয়া যায়। মেয়ে কবিতা তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও বার বার কেঁদে উঠছিল। আমরা প্রাণপণে ওকে থামানোর চেষ্টা করছিলাম। পুরান ঢাকার আত্দীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়ার কোনো উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বন্ধুদের কী হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কী হলো, টাঙ্গাইল শহরে আমার বাবা-মা, ভাইবোনের কী হলো_ এসব ভাবতেও পারছিলাম না। কামানের গুলিতে সব ভাবনা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ১ মার্চ থেকে টেলিভিশনের ঢাকা স্টেশন একেবারেই পাল্টে গিয়েছিল। সেই সময় ১ মার্চ আমার লেখা একটি নাটকও প্রচারিত হয়েছিল। নাটকটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু তো আমাকেও খুঁজবে। এমনি করেই সারা রাত না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি। আবার কুকুরের কান্না। এসব কুকুরের কান্নার মাঝে এক মহিলার বিলাপ শুনলাম। অনুমান করলাম, বস্তি পুড়িয়ে দেওয়ার পর নিশ্চয়ই ওর সব আপনজন হত্যা করেছে সেনাবাহিনী।
সকালের আজান শোনা গেল। ঠিক আজানের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের রক্ষক সেনাবাহিনীর কামানও গর্জে উঠল।
প্রাকৃতিক নিয়মে ভোর হলো। কিন্তু কারো ক্ষুধা নেই। বিনিদ্র রাতের ক্লান্তিও নেই। সামান্য চা-বিস্কুট জুটল। সেই সঙ্গে আবারও চলছে গোলাগুলি। কোনো যোগাযোগ নেই, শুধুই অনুমান। অনুমান করলাম, পিলখানা আর রাজারবাগের এখনো পতন হয়নি। মাইকে ভয়ঙ্কর সব উর্দুতে এলান শোনা যাচ্ছে। 'ঘর ছে বাহার আও তো গুলি মার দুঙ্গা' ইত্যাদি।
প্রতিটি গৃহ আলাদা আলাদা দ্বীপ। কারো সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ নেই। সব কল্পনা-অনুমান, সবই শুধু পরিবারের মধ্যে।
ইতিহাসে নাদির শাহের দিলি্ল লুণ্ঠনের কাহিনী পড়েছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর শহর পতন ঘটানোর কাহিনী পড়েছি। এগুলো ইতিহাসের পাঠ। কিন্তু যে ঘটনার মুখোমুখি আমরা ওই রাতে, তা আমাদের বুকের ওপর ঘটেছে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। হৃদয়ের মতো মারাত্দক আগ্নেয়াস্ত্রটি তখন জেগে উঠতে শুরু করেছে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম_ 'আর নয়, প্রতিশোধ নেব।' যুদ্ধের অনিবার্য পূর্বাভাস দেহের রক্তে বইতে শুরু করেছে।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বভ
মামুনুর রশীদ
৯৭১ সালের মার্চ মাসের গোড়া থেকেই ঢাকা শহরে কুকুরের কান্না শোনা যেত। এই কান্না ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তীব্র আকার ধারণ করে মার্চের ২০ তারিখের পর। কুকুরের কান্না শুনতে শুনতে গা ছমছম করা এক রাতে আমরা তিন বন্ধু যাচ্ছিলাম গুলিস্তানের কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসের পাশ দিয়ে। মার্চের ১০ কি ১১ তারিখ। ইপিআর বাহিনীর একজন সিপাই আমাদের ডাকলেন। তাঁর কণ্ঠে উদ্বেগ_ 'শেখ সাহেবকে একটা খবর দেবেন ভাই? আমাগো হাতিয়ার কিন্তু ক্লোজ করা শুরু করছে। একটা কিছু তলে তলে, ভেতরে ভেতরে শুরু হইছে।' তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের কান্না মিলে কী রকম একটা ভয়ার্ত পরিবেশ শুরু হয়েছিল।
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর চারদিকে ব্যারিকেড নির্মাণ শুরু হলো। জানলাম, ইয়াহিয়া-ভুট্টো চলে গেছে পাকিস্তানে। একটা কিছু আসন্ন; কিন্তু কোনো ধরনের রাজনৈতিক যুক্তি বা কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। কী হতে পারে? এর আগে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ আমরা দেখেছি। সে তো শুধু ছাউনি থেকে সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। তারপর কিছু মার্শাল ল শাসক তৈরি হয়, কিছু দ্রুত আদালত হয়। কালো আইন দেশের মানবাধিকার কেড়ে নেয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এটা। এখনো সেই ব্যবস্থা ওই দেশে জারি আছে। এ দেশেও ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের পর তা-ই হয়েছে।
রাত নামছে। ওই রকমই আশঙ্কা আমাদের। কিন্তু সব পূর্বাভাসকে ম্লান করে দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এল ট্যাংক, সাঁজোয়া বাহিনী। বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল বারুদের ঘ্রাণ। এক সভ্যতাবিধ্বংসী কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সূচনায়ই তারা কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ফেলল, যারা ছিল বাজারে, পথে, স্টেশনে, পেট্রল পাম্পে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। টেলিফোন কাজ করছে না। সমগ্র যোগাযোগব্যবস্থা সেনাবাহিনীর হাতে। আমরা পাল্টা গোলাগুলি শুনলাম পিলখানা আর রাজারবাগে। কে কোথায় আছে, জানার কোনো উপায় নেই। ওই রাতে আমি আটকা পড়ে গেলাম সামাদ ভাইয়ের বাসায়। তখন চিত্রগ্রাহক সামাদ ভাই চিত্র পরিচালক হতে চলেছেন। তাঁর প্রথম ছবি 'সূর্য গ্রহণ'-এর চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখছি। মাঝেমধ্যেই ওখানে থেকে যাই। সামাদ ভাইয়ের স্ত্রী রোজী ভাবি তখন নাম করা নায়িকা। তাঁকে নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাসলত আমরা জানি। বাসাটা একেবারেই গ্রিন রোডের ওপরে। বারান্দায় যাওয়ার উপায় নেই। বারান্দার সামনেই নিচু একটা দেয়াল। ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি তখন ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় প্রবেশপথ তখন তিনটি_ ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার দিয়ে একটি, গ্রিন রোড দিয়ে একটি, অন্যটি মিরপুর রোড দিয়ে। তাই পিলখানা ও বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পথ এটাই। আজকের দিনে অবশ্য সেই রাতের আক্রমণের নীলনকশা অনেকেই জানেন।
এরই মধ্যে রেডিওতে নরখাদক ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগ এবং শেখ সাহেবকে দোষারোপ করে হুঙ্কার ছাড়া হলো। স্পষ্টতই এক রক্তপায়ী দস্যুর গোঙানি শুনতে পেলাম আমরা। আজ এত বছর পর শুধু মনে আছে, একজন মদ্যপানরত জেনারেল রক্তের লালসায় কী যেন প্রলাপ বকে যাচ্ছে। তখন বার বার ৭ মার্চের শেখ সাহেবের বজ্রকণ্ঠ শুনে বাঁচার প্রেরণা পাচ্ছিলাম।
আমরা এমনিতেই প্রতি রাতে একটু বিলম্বে খেতাম। সেই রাতে আর খাওয়ার প্রশ্নই নেই। কোনো একটা জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতেই শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম আগুন আর ধোঁয়া। বাড়িটা বার বার কামানের গোলায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল। রোজী ভাবিকে পেছনের দেয়ালের পাশে একটা ঘরে রাখা হলো, যাতে সেনাবাহিনী ঢুকলে পেছনের দেয়াল টপকে দ্রুত অন্য বাড়িতে পার করে দেওয়া যায়। মেয়ে কবিতা তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও বার বার কেঁদে উঠছিল। আমরা প্রাণপণে ওকে থামানোর চেষ্টা করছিলাম। পুরান ঢাকার আত্দীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়ার কোনো উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বন্ধুদের কী হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কী হলো, টাঙ্গাইল শহরে আমার বাবা-মা, ভাইবোনের কী হলো_ এসব ভাবতেও পারছিলাম না। কামানের গুলিতে সব ভাবনা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ১ মার্চ থেকে টেলিভিশনের ঢাকা স্টেশন একেবারেই পাল্টে গিয়েছিল। সেই সময় ১ মার্চ আমার লেখা একটি নাটকও প্রচারিত হয়েছিল। নাটকটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু তো আমাকেও খুঁজবে। এমনি করেই সারা রাত না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি। আবার কুকুরের কান্না। এসব কুকুরের কান্নার মাঝে এক মহিলার বিলাপ শুনলাম। অনুমান করলাম, বস্তি পুড়িয়ে দেওয়ার পর নিশ্চয়ই ওর সব আপনজন হত্যা করেছে সেনাবাহিনী।
সকালের আজান শোনা গেল। ঠিক আজানের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের রক্ষক সেনাবাহিনীর কামানও গর্জে উঠল।
প্রাকৃতিক নিয়মে ভোর হলো। কিন্তু কারো ক্ষুধা নেই। বিনিদ্র রাতের ক্লান্তিও নেই। সামান্য চা-বিস্কুট জুটল। সেই সঙ্গে আবারও চলছে গোলাগুলি। কোনো যোগাযোগ নেই, শুধুই অনুমান। অনুমান করলাম, পিলখানা আর রাজারবাগের এখনো পতন হয়নি। মাইকে ভয়ঙ্কর সব উর্দুতে এলান শোনা যাচ্ছে। 'ঘর ছে বাহার আও তো গুলি মার দুঙ্গা' ইত্যাদি।
প্রতিটি গৃহ আলাদা আলাদা দ্বীপ। কারো সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ নেই। সব কল্পনা-অনুমান, সবই শুধু পরিবারের মধ্যে।
ইতিহাসে নাদির শাহের দিলি্ল লুণ্ঠনের কাহিনী পড়েছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর শহর পতন ঘটানোর কাহিনী পড়েছি। এগুলো ইতিহাসের পাঠ। কিন্তু যে ঘটনার মুখোমুখি আমরা ওই রাতে, তা আমাদের বুকের ওপর ঘটেছে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। হৃদয়ের মতো মারাত্দক আগ্নেয়াস্ত্রটি তখন জেগে উঠতে শুরু করেছে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম_ 'আর নয়, প্রতিশোধ নেব।' যুদ্ধের অনিবার্য পূর্বাভাস দেহের রক্তে বইতে শুরু করেছে।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বভ
সংবাদ ভাষ্য গোলাম আযম তার কাজ করছেন সরকার কি তার কাজ করছে?
সংবাদ ভাষ্য গোলাম আযম তার কাজ করছেন সরকার কি তার কাজ করছে?
সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং সে কারণে অবশ্যই সরকার অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু, তারপরও প্রশ্ন আছে এবং এ প্রশ্নগুলো বিভিন্নভাবে মিডিয়ায় এসেছে। এর মূল কথা হলো সরকার কতটা প্রস্তুত?
এই সংবাদটি দৈনিক জনকণ্ঠ ছাড়া কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। খবরটির শিরোনাম 'হঠাৎ আসরে গোলাম আযম' [৭.৪.১০]। খবরের সারমর্ম এই যে গত সপ্তাহে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অনুমিতরা গোপনে একটি বৈঠক করে গোলাম আযমকে নিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামের ২৪ জন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন, বিএনপির মওদুদ আহমেদ। অবশ্য, তাকে বৈঠকে না ডাকলেও চলত। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেই হতো। বিএনপি জামায়াতের নির্দেশ অমান্য করবে না, করার সাহস বা সাধ্য কোনটিই নেই। পরে, একটি প্রতিনিধিদল বেগম জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাত করে। মওদুদ আহমদের উপস্থিতি ও তারপর বেগম জিয়াকে বৈঠকের ফলাফল জানানো দু'টি দিক তুলে ধরে। মওদুদ কোথাও থাকা মানে বিপর্যয় ঘটে যাওয়া বা ঘটানো। মূর্তিমান 'ইভিলে'র প্রতীক এই ব্যারিস্টার। অন্যদিকে, এটিও প্রমাণিত হলো, জামায়াতের মতো বিএনপিও ১৯৭১ সালের অপরাধসমূহের বিচারের বিরোধী। অর্থাৎ তাদের অবস্থান
সাধারণ মানুষের বিপক্ষে, পাকিস্তানীমনাদের পক্ষে। বিএনপিও রাজাকারদের দোসারদের দল হয়ে গেল! শুনেছি, বাচ্চা জামায়াতীরা এখন জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বলা পছন্দ করছে না। তেমনি বাচ্চা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরাও রাজাকার দোসর দল হিসেবে নিজেদের পছন্দ করছে না। কিন্তু তখন আর উপায় থাকবে না।
গোলাম আযমদের বৈঠকের মূল এজেন্ডা ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানো। চারটি কৌশলের বিষয়ে তারা একমত হয়েছে।
১. কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিচার ঠেকানো।
২. 'সরকারের বিভিন্ন দুর্বল দিকগুলি চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী সরকারকে ঘায়েল করা। এক্ষেত্রে রাজধানীতে পানি, বিদ্যুত ও গ্যাসকে প্রাধান্য দেয়া।'
৩. আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আইনবিদ যোগাড় করে প্যানেল গঠন করা
৪. এর কোনটিতে কাজ "না হলে সারাদেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে সরকারকে এবং পুরো দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে বিদেশী শক্তিকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।"
গোলাম আযমরা যা করছে তা খুবই স্বাভাবিক। গত তিন দশকে এই প্রথম একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তারা কখনই ভাবেনি ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিচারের সম্মুখীন হয়ত হতে হবে। এই 'হয়ত' যত সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে ততই জামায়াতের নেতারা শঙ্কিত হয়ে উঠছে। আমি এখানে 'অস্তিত্বের সঙ্কট' শব্দ দুটি ব্যবহার করিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে জামায়াতের প্রথম সারির সব নেতাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী ও খুনীদের দল হিসেবে এটি পরিচিত হয়ে উঠবে। এবং চিরতরে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কিন্তু, নতুন জামায়াতীরা থাকবে, দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে না সত্যি কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে তাদের দরকষাকষির যে সুযোগ তারা এত দিন পেয়ে আসছিল তা থাকবে না। সুতরাং এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য তারা যা যা দরকার তা করবে।
জামায়াতের ফ্রন্ট হিসেবে বিএনপিও নাজুক অবস্থায় পড়বে। বেগম জিয়া যতই আন্দোলনের হুমকি দেন না কেন বিচার শুরু হলে, যুদ্ধাপরাধীদের দায় বিএনপিকেও সামলাতে হবে কারণ বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব এই দায় নিজের কাঁধে নিয়েছে। বিভিন্ন কারণে যারা আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং বিএনপির সমর্থক তারা এই দায় নিতে নারাজ। সুতরাং সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠিক এই মুহূর্তে কতটা জোরদার হবে তাতে সন্দেহ আছে। জামায়াত-বিএনপি তাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে, এখন তারা তা কার্যকর করবে। কিন্তু, এর বিপরীতে সরকারের অবস্থান কি? বল এখন সরকারের কোর্টে। আমরা অনেকে ভেবেছিলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বললেও সরকার তাতে অগ্রসর হবে না। কিন্তু, সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং সে কারণে অবশ্যই সরকার অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু, তারপরও প্রশ্ন আছে এবং এ প্রশ্নগুলো বিভিন্নভাবে মিডিয়ায় এসেছে। এর মূল কথা হলো সরকার কতটা প্রস্তুত?
প্রথম কথা হলো, ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নে জামায়াতীরা আদালতে যেতে পারে। সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলবে। সেগুলো কুযুক্তি কী সুযুক্তি তার মধ্যে যাব না। কিন্তু, সাংবিধানিক প্রশ্নে কোন ফাঁকফোকর আছে কি-না তা কি সরকার ভালভাবে খতিয়ে দেখেছে?
দ্বিতীয়, অনেকের মনে হচ্ছে, এ বিচার সুচারুভাবে সম্পন্ন ও জামায়াত-বিএনপি কৌশল অকার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে সমন্বিত কোন কার্যক্রম নেয়া হয়নি। কারণ, সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হচ্ছে এবং এই সমন্বয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। তদনত্দ কমিটিও প্রসিকিউশন নিয়ে নানা খবর বেরুচ্ছে। অনেকের ধারণা, সরকারের অনেকের ধারণা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বোধহয় এক ধরনের ফৌজদারি মামলা। সরকার কি সম্পূর্ণভাবে এই ধারণা থেকে মুক্ত?
তৃতীয়, এই বিচার নস্যাতের জন্য জামায়াত বিএনপি ব্যাপক প্রচার করছে। বিচারের পক্ষে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছি। কিন্তু দল ও সরকার হিসেবে বিচারের পক্ষে সরকারের যে প্রবলভাবে নামা উচিত ছিল তা কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেন এই আড়ষ্টতা এর উত্তর কেউ খুঁজে পাচ্ছেন না।
জামায়াত-বিএনপির কর্মকৌশল আলোচনা করা যাক। কূটনৈতিক তৎপরতা জামায়াতীরা যে দীর্ঘদিন ধরে চালাচ্ছে এটা নতুন কোন কথা নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাংগঠনিকভাবে সে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। অন্তত দু' একটি দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন সদুত্তর পাইনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা বিবৃতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মন্তব্য করেছেন কিন্তু সেটিই কি যথেষ্ট? জামায়াত-বিএনপি সৌদি আরব এবং পাকিস্তানকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কিন্তু দু'টি দেশই স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছে এটি বাংলাদেশের ব্যাপার। এ দিকটায় মার খেয়েই জামায়াত খানিকটা বিচলিত। যুদ্ধ শুরু হলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, ব্যক্তি, রাষ্ট্র নানা বিষয়ে জানতে চাইবে। আমরা নিশ্চিত সরকার সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুত নয়।
সরকারের সব দিক সবল নয়_এটি সরকার না বুঝলেও আমরা বুঝি। আমলাতন্ত্র যে কাজ করছে না বা কাজ করানো যাচ্ছে না এটি মন্ত্রীরা না বুঝলেও আমরা বুঝি। গতানুগতিক একটি সরকার হয়েছে। মন্ত্রীরা এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয় বা এমন দক্ষ নয় যে, সরকারের নীতি তারা কার্যকর করতে চাইলেই পারবেন। পানি, বিদ্যুত, গ্যাস সমস্যায় সরকার বিপর্যসত্দ_এটি আমরা জানি। কিন্তু সমন্বিতভাবে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রী, দলের নেতারা কি তুলে ধরেছেন যে, পানির জন্য ২০০১-৮= সাত বছরে শোধনাগার হয়নি, বিদ্যুতের খাম্বা ছাড়া কিছুই লাগানো হয়নি এবং গ্যাস নেই, তারপরও এই নেই গ্যাসটুকু নিজামী খালেদা টাটাকে দিয়ে দিতে চেয়েছিল ভারতীয় পুঁজিপতিদের কাছে নতজানু হয়ে। না, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ সোচ্চার নন। গত আমলেও একই ব্যাপার ঘটেছে, অতি-কেন্দ্রিকরণ ও ভয় থেকেই বোধহয় সবাই চুপ থাকেন। প্রধানমন্ত্রী যদি এখন বলেন, যে এসব বিষয় যত সোচ্চারভাবে তুলে ধরবে, মন্ত্রিত্বের দিকে সে তত এগুবে এবং যে যত কম বলবে সে মন্ত্রিত্ব হারাবে, তা হলে হয়ত তা কোরামিনের কাজ করবে। তবে, নিজামী-খালেদা কিছু করেনি এটি জনমনের ক্ষোভ নিরসনে যথেষ্ট নয়। নিজামী-খালেদা অকর্মণ্য, লোভী দেখেই তো শেখ হাসিনাকে ভোট দেয়া হয়েছে। সরকার এই সঙ্কট নিরসনে কী করছে তাও তুলে ধরতে হবে।
জামায়াত-বিএনপি আইনী লড়াইয়ের কথা ভাবছে। তারা হাজার হাজার আইনবিদ নিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে। সেটি বাগাড়ম্বর। বাংলাদেশে জামায়াত করে এমন আইনজীবী হাজারও নেই। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় অনেক আইনজীবী হয়ত আসবে। আমাদের সরকার সে ক্ষেত্রে কী করছে? এক্ষেত্রে চিত্রটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কাগজে যা দেখেছি ও যা শুনেছি তাতে অনুমান করছি, আইন প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে একদিকে, আইনমন্ত্রী আরেক দিকে। প্রথমোক্তদের ধারণা, এ বিচার ফৌজদারি বিচারতুল্য সুতরাং নিম্ন আদালতের উকিলরাই যথেষ্ট। দ্বিতীয় পৰের ধারণা, এটি বিশেষ বিচার, বিশেষ আইনজীবী দরকার কিন্তু তার জন্য আনুষঙ্গিক কী কী উপাদান সে সব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে কী না সন্দেহ। প্রথমদিকে, আদালতের জায়গা নির্বাচন থেকেই তা স্পষ্ট। অবকাঠামোগত সুবিধাও প্রসিকিউটর, তদন্ত সংস্থা পায়নি। যারা দীর্ঘদিন এই আন্দোলন করেছেন তাদের নিয়ে বসে কী ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। তা নিয়েও সমন্বিত আলোচনা হয়নি। কেন যেন মনে হয় আমরা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত সরকার এতটাই গা-ছাড়া।
জামায়াত-বিএনপির শেষ কৌশল ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কাজ করা। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। বলার আছে এটুকু যে, এ দু'টি দল সবসময় ধ্বংসাত্মক কাজেই পারদর্শী, অভ্যস্ত। দেশ থেকে তাদের কাছে দল বড়, দল থেকে ব্যক্তি বড়। এদের ব্যারিস্টার, নেতা, জাঁদরেল নেতারা যেভাবে তারেক বন্দনা করেন তাতে লজ্জা হয়। তাদের অনেকের থেকে তো বটেই তাদের সনত্দানদের থেকেও হয়ত তারেক শিক্ষিত নয়, কোন গুণের কথাও শোনা যায়নি, অর্থ যোগাড় করা ছাড়া তাও তার মা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে। সরকার জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তা জোরদার করছে। কিন্তু ১৬ কোটির দেশে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারলেই নিরাপত্তা আসবে। অন্যথায় নয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিবাদ নির্মূল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রভাবহীন করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ে তোলা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো দৃঢ়করণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যারা বিশ্বাসী তাদের অস্তিত্ব রক্ষা_সবকিছু এই বিচারের ওপর নির্ভর করছে। নিছক ওয়াদা পূরণ ও জনচাপে কাজ করা এবং বিশ্বাস করে একবারের জন্য বিষয়টি মীমাংসা করা_এ দু'টির মধ্যে তফাৎ আছে। সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সত্ত্বেও প্রথম ধারণাটাই জনমনে এখনও রয়ে যাচ্ছে। এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি আমাদের অনেক দিনের, এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সহযোগী কিন্তু আমরা চাই না সরকারের কর্মকণ্ডে দ্বিতীয় বিষয়টি যেন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। ব্যর্থ হলে সরকার পতন অবশ্যম্ভাবী শুধু নয়, বিরাটসংখ্যক মানুষকে দেশত্যাগ করতে হবে এবং আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে বলে প্রায়ই দাবি করে তা চিরতরের জন্য বিলুপ্ত হবে।
সাধারণ মানুষের বিপক্ষে, পাকিস্তানীমনাদের পক্ষে। বিএনপিও রাজাকারদের দোসারদের দল হয়ে গেল! শুনেছি, বাচ্চা জামায়াতীরা এখন জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বলা পছন্দ করছে না। তেমনি বাচ্চা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরাও রাজাকার দোসর দল হিসেবে নিজেদের পছন্দ করছে না। কিন্তু তখন আর উপায় থাকবে না।
গোলাম আযমদের বৈঠকের মূল এজেন্ডা ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানো। চারটি কৌশলের বিষয়ে তারা একমত হয়েছে।
১. কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিচার ঠেকানো।
২. 'সরকারের বিভিন্ন দুর্বল দিকগুলি চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী সরকারকে ঘায়েল করা। এক্ষেত্রে রাজধানীতে পানি, বিদ্যুত ও গ্যাসকে প্রাধান্য দেয়া।'
৩. আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আইনবিদ যোগাড় করে প্যানেল গঠন করা
৪. এর কোনটিতে কাজ "না হলে সারাদেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে সরকারকে এবং পুরো দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে বিদেশী শক্তিকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।"
গোলাম আযমরা যা করছে তা খুবই স্বাভাবিক। গত তিন দশকে এই প্রথম একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তারা কখনই ভাবেনি ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিচারের সম্মুখীন হয়ত হতে হবে। এই 'হয়ত' যত সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে ততই জামায়াতের নেতারা শঙ্কিত হয়ে উঠছে। আমি এখানে 'অস্তিত্বের সঙ্কট' শব্দ দুটি ব্যবহার করিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে জামায়াতের প্রথম সারির সব নেতাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী ও খুনীদের দল হিসেবে এটি পরিচিত হয়ে উঠবে। এবং চিরতরে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কিন্তু, নতুন জামায়াতীরা থাকবে, দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে না সত্যি কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে তাদের দরকষাকষির যে সুযোগ তারা এত দিন পেয়ে আসছিল তা থাকবে না। সুতরাং এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য তারা যা যা দরকার তা করবে।
জামায়াতের ফ্রন্ট হিসেবে বিএনপিও নাজুক অবস্থায় পড়বে। বেগম জিয়া যতই আন্দোলনের হুমকি দেন না কেন বিচার শুরু হলে, যুদ্ধাপরাধীদের দায় বিএনপিকেও সামলাতে হবে কারণ বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব এই দায় নিজের কাঁধে নিয়েছে। বিভিন্ন কারণে যারা আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং বিএনপির সমর্থক তারা এই দায় নিতে নারাজ। সুতরাং সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠিক এই মুহূর্তে কতটা জোরদার হবে তাতে সন্দেহ আছে। জামায়াত-বিএনপি তাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে, এখন তারা তা কার্যকর করবে। কিন্তু, এর বিপরীতে সরকারের অবস্থান কি? বল এখন সরকারের কোর্টে। আমরা অনেকে ভেবেছিলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বললেও সরকার তাতে অগ্রসর হবে না। কিন্তু, সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং সে কারণে অবশ্যই সরকার অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু, তারপরও প্রশ্ন আছে এবং এ প্রশ্নগুলো বিভিন্নভাবে মিডিয়ায় এসেছে। এর মূল কথা হলো সরকার কতটা প্রস্তুত?
প্রথম কথা হলো, ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নে জামায়াতীরা আদালতে যেতে পারে। সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলবে। সেগুলো কুযুক্তি কী সুযুক্তি তার মধ্যে যাব না। কিন্তু, সাংবিধানিক প্রশ্নে কোন ফাঁকফোকর আছে কি-না তা কি সরকার ভালভাবে খতিয়ে দেখেছে?
দ্বিতীয়, অনেকের মনে হচ্ছে, এ বিচার সুচারুভাবে সম্পন্ন ও জামায়াত-বিএনপি কৌশল অকার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে সমন্বিত কোন কার্যক্রম নেয়া হয়নি। কারণ, সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হচ্ছে এবং এই সমন্বয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। তদনত্দ কমিটিও প্রসিকিউশন নিয়ে নানা খবর বেরুচ্ছে। অনেকের ধারণা, সরকারের অনেকের ধারণা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বোধহয় এক ধরনের ফৌজদারি মামলা। সরকার কি সম্পূর্ণভাবে এই ধারণা থেকে মুক্ত?
তৃতীয়, এই বিচার নস্যাতের জন্য জামায়াত বিএনপি ব্যাপক প্রচার করছে। বিচারের পক্ষে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছি। কিন্তু দল ও সরকার হিসেবে বিচারের পক্ষে সরকারের যে প্রবলভাবে নামা উচিত ছিল তা কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেন এই আড়ষ্টতা এর উত্তর কেউ খুঁজে পাচ্ছেন না।
জামায়াত-বিএনপির কর্মকৌশল আলোচনা করা যাক। কূটনৈতিক তৎপরতা জামায়াতীরা যে দীর্ঘদিন ধরে চালাচ্ছে এটা নতুন কোন কথা নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাংগঠনিকভাবে সে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। অন্তত দু' একটি দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন সদুত্তর পাইনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা বিবৃতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মন্তব্য করেছেন কিন্তু সেটিই কি যথেষ্ট? জামায়াত-বিএনপি সৌদি আরব এবং পাকিস্তানকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কিন্তু দু'টি দেশই স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছে এটি বাংলাদেশের ব্যাপার। এ দিকটায় মার খেয়েই জামায়াত খানিকটা বিচলিত। যুদ্ধ শুরু হলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, ব্যক্তি, রাষ্ট্র নানা বিষয়ে জানতে চাইবে। আমরা নিশ্চিত সরকার সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুত নয়।
সরকারের সব দিক সবল নয়_এটি সরকার না বুঝলেও আমরা বুঝি। আমলাতন্ত্র যে কাজ করছে না বা কাজ করানো যাচ্ছে না এটি মন্ত্রীরা না বুঝলেও আমরা বুঝি। গতানুগতিক একটি সরকার হয়েছে। মন্ত্রীরা এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয় বা এমন দক্ষ নয় যে, সরকারের নীতি তারা কার্যকর করতে চাইলেই পারবেন। পানি, বিদ্যুত, গ্যাস সমস্যায় সরকার বিপর্যসত্দ_এটি আমরা জানি। কিন্তু সমন্বিতভাবে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রী, দলের নেতারা কি তুলে ধরেছেন যে, পানির জন্য ২০০১-৮= সাত বছরে শোধনাগার হয়নি, বিদ্যুতের খাম্বা ছাড়া কিছুই লাগানো হয়নি এবং গ্যাস নেই, তারপরও এই নেই গ্যাসটুকু নিজামী খালেদা টাটাকে দিয়ে দিতে চেয়েছিল ভারতীয় পুঁজিপতিদের কাছে নতজানু হয়ে। না, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ সোচ্চার নন। গত আমলেও একই ব্যাপার ঘটেছে, অতি-কেন্দ্রিকরণ ও ভয় থেকেই বোধহয় সবাই চুপ থাকেন। প্রধানমন্ত্রী যদি এখন বলেন, যে এসব বিষয় যত সোচ্চারভাবে তুলে ধরবে, মন্ত্রিত্বের দিকে সে তত এগুবে এবং যে যত কম বলবে সে মন্ত্রিত্ব হারাবে, তা হলে হয়ত তা কোরামিনের কাজ করবে। তবে, নিজামী-খালেদা কিছু করেনি এটি জনমনের ক্ষোভ নিরসনে যথেষ্ট নয়। নিজামী-খালেদা অকর্মণ্য, লোভী দেখেই তো শেখ হাসিনাকে ভোট দেয়া হয়েছে। সরকার এই সঙ্কট নিরসনে কী করছে তাও তুলে ধরতে হবে।
জামায়াত-বিএনপি আইনী লড়াইয়ের কথা ভাবছে। তারা হাজার হাজার আইনবিদ নিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে। সেটি বাগাড়ম্বর। বাংলাদেশে জামায়াত করে এমন আইনজীবী হাজারও নেই। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় অনেক আইনজীবী হয়ত আসবে। আমাদের সরকার সে ক্ষেত্রে কী করছে? এক্ষেত্রে চিত্রটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কাগজে যা দেখেছি ও যা শুনেছি তাতে অনুমান করছি, আইন প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে একদিকে, আইনমন্ত্রী আরেক দিকে। প্রথমোক্তদের ধারণা, এ বিচার ফৌজদারি বিচারতুল্য সুতরাং নিম্ন আদালতের উকিলরাই যথেষ্ট। দ্বিতীয় পৰের ধারণা, এটি বিশেষ বিচার, বিশেষ আইনজীবী দরকার কিন্তু তার জন্য আনুষঙ্গিক কী কী উপাদান সে সব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে কী না সন্দেহ। প্রথমদিকে, আদালতের জায়গা নির্বাচন থেকেই তা স্পষ্ট। অবকাঠামোগত সুবিধাও প্রসিকিউটর, তদন্ত সংস্থা পায়নি। যারা দীর্ঘদিন এই আন্দোলন করেছেন তাদের নিয়ে বসে কী ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। তা নিয়েও সমন্বিত আলোচনা হয়নি। কেন যেন মনে হয় আমরা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত সরকার এতটাই গা-ছাড়া।
জামায়াত-বিএনপির শেষ কৌশল ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কাজ করা। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। বলার আছে এটুকু যে, এ দু'টি দল সবসময় ধ্বংসাত্মক কাজেই পারদর্শী, অভ্যস্ত। দেশ থেকে তাদের কাছে দল বড়, দল থেকে ব্যক্তি বড়। এদের ব্যারিস্টার, নেতা, জাঁদরেল নেতারা যেভাবে তারেক বন্দনা করেন তাতে লজ্জা হয়। তাদের অনেকের থেকে তো বটেই তাদের সনত্দানদের থেকেও হয়ত তারেক শিক্ষিত নয়, কোন গুণের কথাও শোনা যায়নি, অর্থ যোগাড় করা ছাড়া তাও তার মা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে। সরকার জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তা জোরদার করছে। কিন্তু ১৬ কোটির দেশে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারলেই নিরাপত্তা আসবে। অন্যথায় নয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিবাদ নির্মূল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রভাবহীন করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ে তোলা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো দৃঢ়করণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যারা বিশ্বাসী তাদের অস্তিত্ব রক্ষা_সবকিছু এই বিচারের ওপর নির্ভর করছে। নিছক ওয়াদা পূরণ ও জনচাপে কাজ করা এবং বিশ্বাস করে একবারের জন্য বিষয়টি মীমাংসা করা_এ দু'টির মধ্যে তফাৎ আছে। সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সত্ত্বেও প্রথম ধারণাটাই জনমনে এখনও রয়ে যাচ্ছে। এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি আমাদের অনেক দিনের, এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সহযোগী কিন্তু আমরা চাই না সরকারের কর্মকণ্ডে দ্বিতীয় বিষয়টি যেন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। ব্যর্থ হলে সরকার পতন অবশ্যম্ভাবী শুধু নয়, বিরাটসংখ্যক মানুষকে দেশত্যাগ করতে হবে এবং আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে বলে প্রায়ই দাবি করে তা চিরতরের জন্য বিলুপ্ত হবে।
লালমোহনে আওয়ামী লীগের শোডাউনে জনতার ঢল
লালমোহনে আওয়ামী লীগের শোডাউনে জনতার ঢল
বিশেষ প্রতিনিধি/নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমোহন ॥ আবার নামল ঢল মানুষের, আবার নামল বান। ঠিক যেন বাঁধভাঙ্গা স্রোত। লালমোহন বাজারের কেন্দ্রস্থলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের শেষ নির্বাচনী জনসভায় চতুর্দিকে থেকে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে যায় লালমোহনের সদর। আৰরিক অর্থেই তিলধারণের ঠাঁই নেই, ঠিক যেন 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী।' কপালে-কব্জিতে লাল সালু বেঁধে, হাতে পস্ন্যাকার্ড নিয়ে, মাইকের সেস্নাগানে নৃত্যের তালে চরাঞ্চল থেকে প্রত্যন্ত জনপদ থেকে আসা জনতার স্রোত বক্তার শব্দে-বাক্যে আলাদা গতি সঞ্চার করেছে। বয়োজ্যেষ্ঠ মুরবি্ব, মধ্যবয়সী যুবক, কৃষক-কৃষাণীর কণ্ঠে ছিল 'হাফিজের ২৫ বছরের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চাই।' জনসভার সামনে দাঁড়িয়ে যখন রিপোর্ট লিখছি তখন বিস্মিলস্নাহ ট্রেডার্সের সামনে দাঁড়িয়ে যুবক ইব্রাহিম বলে, 'বিকেলে দেখলাম খালি, এখন এত লোক এলো কোথা থেকে?' বিস্মিলস্নাহ ট্রেডার্সের মালিক নুরম্নন্নবী জনকণ্ঠকে বলেন, 'লালমোহনে এত বড় জনসভা কোন দিন হয়নি। লোকসমাগম দেখে আয়োজকরা অবাক-উলস্নসিত। শাওনের বিজয় নিয়ে তাঁরা দারম্নণ আশাবাদী। জনস্রোত দেখে লালমোহন বাজারের দোকানিরা হতবাক। তাঁরা বলছেন, 'শাওনের বিজয় সুনিশ্চিত। জনসভায় মতানত্মরে অর্ধলৰাধিক থেকে লৰাধিক জনসমাগমের কথা বিভিন্ন মহল আলোচনা করেছে। জনসভায় হাফিজ বাহিনীর হাতে নির্যাতিত অনেকে বক্তৃতা করেন।
লালমোহন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যৰ নজরম্নল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা করেন জননেতা তোফায়েল, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, বরিশাল বিভাগীয় দায়িত্বে সাংগঠনিক সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম, চরফ্যাশনের এমপি আব্দুলস্নাহ আল ইসলাম জ্যাকব। এছাড়া সমাগত জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করেন নৌকা প্রতীকের প্রাথর্ী নুরম্নন্নবী চৌধুরী শাওন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, সাইদ আল মাহমুদ স্বপনসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
অভূতপূর্ব জনসমাবেশ থেকে দলীয় কমর্ী-সমর্থক সাধারণ মানুষ সবার প্রশ্ন ছিল_ এত লোক কোত্থেকে এলো? জনতার উত্তাল তরঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারাও হয়েছেন অভিভূত। খোদ আওয়ামী লীগ প্রাথর্ী শাওন বলেছেন, লালমোহনে এতবড় সমাবেশ আমার জীবনে দেখিনি। তিনি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যারপরনাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জনসভায় লোকসমাগম দেখে অনেক দোকানি বলেছে, 'যে অবস্থা তাতে হাফিজ সাহেবের নির্বাচন না করাই ভাল। নির্বাচন করার ব্যাপারে তিনি যে কেন্দ্রীয় নির্দেশনার নামে পিছুটান দিয়েছেন তা ভালই করেছেন। অন্যথায় নিজের সম্মানই বাঁচাতে পারবেন না।' সমাবেশ শেষ হতে হয়ত রাত ন'টা বেজে যাবে, কিন্তু সমাগত দর্শক-শ্রোতারা জনসভা ছেড়ে যাচ্ছেন না। সদর রোডেও লোক দাঁড়ানোর ঠাঁইটুকু পর্যনত্ম নেই। নেতৃবৃন্দ সংৰিপ্ত বক্তৃতা দেন। তবে প্রাথর্ী নুরম্নন্নবী চৌধুরী শাওন দীর্ঘ বক্তৃতা দেন।
জনতার বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে সমাবেশস্থলে উৎসবের আমেজ নেমে আসে। আলোচনায় অংশ নিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশন দু'পৰের মতামত নিয়েই ২২ এপ্রিলের পর নির্বাচনী এলাকায় বহিরাগত অবস্থান নিষিদ্ধের সিদ্ধানত্ম নেন। এখন মেজর হাফিজ অস্বীকার করে বলছেন, তাঁর কোন কথা রাখা হয়নি। তোফায়েল আহমেদ নাসরিন লঞ্চডুবির পর নিহতদের স্মরণে মিলাদ পড়তে এলে হাফিজের লোকজন আমার গাড়ি ভাংচুর করে, আমাকে রক্তাক্ত করে। লালমোহন-তজুমদ্দিনের মানুষ হাফিজের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায়।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, কে জয়ী, কে বিজিত হবে সেটি বিষয় নয়। আওযামী লীগ গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করতে চায় বলেই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। নির্বাচন কমিশন প্রতিপৰ প্রাথর্ীর বেশ কয়েক দফা দাবি মেনে নেয়ার পরে সে নিত্যনতুন কথা বলছে। মৌমাছি বাহিনী, মার্শাল বাহিনী আর হকিস্টিক বাহিনী অতীতের নির্বাচনের মতো ব্যবহার করতে পারছে না বলেই নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে টালবাহানা করছে। আফম বাহাউদ্দিন বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, মাননীয় বিএনপি চেয়ারপার্সন আসুন, দেখে যান জনতার ঢল, মানুষের ঐক্যের শক্তির সামনে আপনাদের কোন ষড়যন্ত্রই টিকবে না। ২৪ তারিখের ভোটযুদ্ধে সেটি প্রমাণিত হবে। আব্দুলস্নাহ আল ইসলাম জ্যাকব বলেন, ২৫ বছরের হাফিজীয় দুঃশাসন অবসানের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার মতো আরেক তরম্নণ শাওনকে পাঠিয়েছে। উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বিবেচনা করে আপনারা শাওনকে নির্বাচিত করবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
মেজর হাফিজের আমলে নির্বাচিত অনেকে মঞ্চে উঠে নেতাদের সরিয়ে বক্তৃতা করেন।
লালমোহন উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যৰ নজরম্নল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা করেন জননেতা তোফায়েল, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, বরিশাল বিভাগীয় দায়িত্বে সাংগঠনিক সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম, চরফ্যাশনের এমপি আব্দুলস্নাহ আল ইসলাম জ্যাকব। এছাড়া সমাগত জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করেন নৌকা প্রতীকের প্রাথর্ী নুরম্নন্নবী চৌধুরী শাওন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, সাইদ আল মাহমুদ স্বপনসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
অভূতপূর্ব জনসমাবেশ থেকে দলীয় কমর্ী-সমর্থক সাধারণ মানুষ সবার প্রশ্ন ছিল_ এত লোক কোত্থেকে এলো? জনতার উত্তাল তরঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারাও হয়েছেন অভিভূত। খোদ আওয়ামী লীগ প্রাথর্ী শাওন বলেছেন, লালমোহনে এতবড় সমাবেশ আমার জীবনে দেখিনি। তিনি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যারপরনাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জনসভায় লোকসমাগম দেখে অনেক দোকানি বলেছে, 'যে অবস্থা তাতে হাফিজ সাহেবের নির্বাচন না করাই ভাল। নির্বাচন করার ব্যাপারে তিনি যে কেন্দ্রীয় নির্দেশনার নামে পিছুটান দিয়েছেন তা ভালই করেছেন। অন্যথায় নিজের সম্মানই বাঁচাতে পারবেন না।' সমাবেশ শেষ হতে হয়ত রাত ন'টা বেজে যাবে, কিন্তু সমাগত দর্শক-শ্রোতারা জনসভা ছেড়ে যাচ্ছেন না। সদর রোডেও লোক দাঁড়ানোর ঠাঁইটুকু পর্যনত্ম নেই। নেতৃবৃন্দ সংৰিপ্ত বক্তৃতা দেন। তবে প্রাথর্ী নুরম্নন্নবী চৌধুরী শাওন দীর্ঘ বক্তৃতা দেন।
জনতার বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে সমাবেশস্থলে উৎসবের আমেজ নেমে আসে। আলোচনায় অংশ নিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশন দু'পৰের মতামত নিয়েই ২২ এপ্রিলের পর নির্বাচনী এলাকায় বহিরাগত অবস্থান নিষিদ্ধের সিদ্ধানত্ম নেন। এখন মেজর হাফিজ অস্বীকার করে বলছেন, তাঁর কোন কথা রাখা হয়নি। তোফায়েল আহমেদ নাসরিন লঞ্চডুবির পর নিহতদের স্মরণে মিলাদ পড়তে এলে হাফিজের লোকজন আমার গাড়ি ভাংচুর করে, আমাকে রক্তাক্ত করে। লালমোহন-তজুমদ্দিনের মানুষ হাফিজের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায়।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, কে জয়ী, কে বিজিত হবে সেটি বিষয় নয়। আওযামী লীগ গণতন্ত্রের ভিত শক্তিশালী করতে চায় বলেই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। নির্বাচন কমিশন প্রতিপৰ প্রাথর্ীর বেশ কয়েক দফা দাবি মেনে নেয়ার পরে সে নিত্যনতুন কথা বলছে। মৌমাছি বাহিনী, মার্শাল বাহিনী আর হকিস্টিক বাহিনী অতীতের নির্বাচনের মতো ব্যবহার করতে পারছে না বলেই নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে টালবাহানা করছে। আফম বাহাউদ্দিন বেগম জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, মাননীয় বিএনপি চেয়ারপার্সন আসুন, দেখে যান জনতার ঢল, মানুষের ঐক্যের শক্তির সামনে আপনাদের কোন ষড়যন্ত্রই টিকবে না। ২৪ তারিখের ভোটযুদ্ধে সেটি প্রমাণিত হবে। আব্দুলস্নাহ আল ইসলাম জ্যাকব বলেন, ২৫ বছরের হাফিজীয় দুঃশাসন অবসানের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার মতো আরেক তরম্নণ শাওনকে পাঠিয়েছে। উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা বিবেচনা করে আপনারা শাওনকে নির্বাচিত করবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
মেজর হাফিজের আমলে নির্বাচিত অনেকে মঞ্চে উঠে নেতাদের সরিয়ে বক্তৃতা করেন।
Subscribe to:
Comments (Atom)