Wednesday, April 21, 2010

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু- এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা(২)।। মোঃ এনায়েত হোসেন

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু- এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা
মোঃ এনায়েত হোসেন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বঙ্গবন্ধুর মানসালোক গঠনে তাঁর জন্মের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়কালের ঘটনাপ্রাবাহ বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে (১৯১৪-১৮), রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয় (১৯১৭), জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের গণহত্যা (১৯১৮), মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর খেলাফত আন্দোলন (১৯২০), গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন (১৯২২), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টি গঠন (১৯২৩), অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০), শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নিখিল কৃষক প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠা (১৯২৭-২৮), ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ডের 'সামপ্রদায়িক রোয়েদাদ' ঘোষণা (১৯৩২), লন্ডনের চৌধুরী রহমত আলীর 'পাকিস্তান' নামে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের ইশ্তেহার প্রচার (১৯৩৩), ভারত শাসন আইন (১৯৩৫), ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন ও বাংলায় শেরে বাংলা কৃষক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয় (১৯৩৭), শেরে বাংলার সরকার আমলে ঋণ সালিশি বোর্ড (১৯৩৮), প্রজাস্বত্ব আইন (১৯৩৯) এবং মহাজনী আইন পাস (১৯৪০), ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ (১৯৪০), গান্ধীজীর ভারতছাড় আন্দোলন (১৯৪২), ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন অবসানের জন্য সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফোর্স গঠন এবং তেতাল্লিশের মন্বন্তর (১৯৪২-৪৩) ইত্যাদি ঘটনা শেখ মুজিবের জীবন ও রাজনৈতিক জীবনাদর্শ গঠনে ভূমিকা রাখে। ১৯৪২ সালে মুজিব গোপালগঞ্জের মিশন স্কুল থেকে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি কলকাতায় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য ভারতীয় রাজনৈতিক নেতার সংস্পর্শে আসেন এবং রাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে প্রবেশ করেন।
এ সময় শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজনীতির দুই মেরুতে অবস্থান করছিলেন। শেরে বাংলা তখন মুসলিম লীগের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তাঁর গড়া 'কৃষক প্রজা পার্টি' নিয়ে 'প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্লামেন্টারি পার্টির' নেতা হিসেবে বাংলার প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে সমাসীন। অন্যদিকে, সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছেন। তখন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ সময় তরম্নণ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হিসেবে তাঁর দলে কাজ শুরু করেন। মুজিব ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়রি মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথক 'ছাত্রলীগ' গঠনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ডাকা ধর্মঘটে সক্রিয় সমর্থন দান করার অপরাধে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। তখন তিনি আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এ বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে মুজিবের ছাত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট দ্বি-জাতিতত্ত্বের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত ও অপরাপর শ্রেণীর স্বপ্নের রাষ্ট্র পাকিস্তান লাভের পর পরই তাদের স্বপ্নভঙ্গের সূচনা শুরু হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে করাচীতে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। ঐ অধিবেশনে গণপরিষদের সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকে পরিষদের সরকারী ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি আরও বলেন যে, প্রাদেশিকতার মনোভাব নিয়ে তিনি এ প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ভাষা বাংলা। তাই বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হওয়া উচিত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেন পাকিস্তানের ঐ গণপরিষদের নেতা প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের 'বাংলাকে' অন্যতম সরকারী রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গণপরিষদে বাতিল হয়ে যায়। পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম ভাষারূপে সরকারী স্বীকৃতি দাবি উত্থাপনের ফলে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ২ মার্চ, ১৯৪৮ সালে ফজলুল হক হলে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় সর্বদলীয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানে বিরোধিতা করায় শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতাল পালন করা হয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক।

No comments: