Monday, April 19, 2010

বেনজীর হত্যাকাণ্ড ।। কালের কন্ঠ প্রতিবেদন


"হত্যা, প্রতিহিংসা আর ষঢ়যন্ত্রের রাজনীতি পিছু ছাড়েনি বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞের নায়ক ভুট্টো'র পরিবারের।"

বেনজীর হত্যাকাণ্ড ।। কালের কন্ঠ প্রতিবেদন

গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

জাতিসংঘ কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন

কার্যকর সারসংক্ষেপ

২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহতারেমা বেনজির ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডি শহরের লিয়াকতবাগে একটি নির্বাচনী প্রচারণা সেরে ফেরার সময় আত্দঘাতী হামলায় নিহত হন। মিসেস ভুট্টোর ওপর আক্রমণে আরো ২৪ জন নিহত এবং ৯১ জন গুরুতর আহত হন। পাকিস্তান সরকারের অনুরোধে এবং পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার পর জাতিসংঘের মহাসচিব সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের পারিপার্শি্বক ঘটনাবলি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন নিয়োগ দেন। একটি অপরাধের তদন্ত করার দায়িত্ব, অপরাধীকে খুঁজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করার কাজ পাকিস্তানের সক্ষম কর্তৃপক্ষের কাছে আটকে আছে। মহাসচিব কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন জাতিসংঘে চিলির স্থায়ী প্রতিনিধি হেরাল্ডো মুনোজকে। বাকি দুই সদস্য হলেন ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমান এবং আয়ারল্যান্ড পুলিশের সাবেক ডেপুটি কমিশনার পিটার ফিৎজেরাল্ড। ২০০৯ সালের ১ জুলাই কমিশন কাজ শুরু করে এবং ২০১০ সালের ৩০ মার্চ মহাসচিবের কাছে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে।

কমিশন তদন্তকালে পাকিস্তান সরকারের এবং জনগণের একটি বড় অংশের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা পায়। কমিশনাররা এবং স্টাফরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অবাধে পাকিস্তানে যাতায়াত করেছেন। তদন্তকালে ২৫০টিরও বেশি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা, বেসামরিক নাগরিক এবং পাকিস্তানে অবস্থানকারী যেসব বিদেশি নাগরিক ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত, তাঁদের সঙ্গে কমিশনের সদস্যরা কথা বলেন। কথা বলেন যুক্তরাজ্যের মেট্রোপলিটন পুলিশের (স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড) যে দলটি হত্যাকাণ্ডের আংশিক তদন্ত করে, তাদের সঙ্গে। কমিশন একই সঙ্গে শত শত ডকুমেন্ট, ভিডিওচিত্রসহ কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের সংগৃহীত প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে। এ ছাড়া কমিশন আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। সংশ্লিষ্ট কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কমিশন আলোচনা করতে পারেনি। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পারিপাশ্বর্িক ঘটনাবলি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার কাজ ব্যাহত হয়নি বলে মনে করেছে। এ ছাড়া বেনজির ভুট্টোকে দেওয়া হুমকিসহ আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য, যা পাকিস্তান সরকারের হাতে ছিল, ঘটনাক্রমে সেগুলো সম্পর্কে কমিশন অবগত হয়েছে।

সামরিক ও গোয়েন্দা তথ্যগুলো পাওয়ার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করতে কমিশনকে পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ধোঁকা দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ৩১ মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার ফলে কমিশন পাকিস্তানের বর্তমান ও সাবেক সেনা এবং গোয়েন্দা সদস্যদের সঙ্গে আরো অধিক পরিমাণ কথা বলতে পেরেছে।

প্রতিবেদনে বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তানে ফিরে আসার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে; বেনজির ভুট্টোর নিরাপত্তার তথা তাঁকে নিরাপদ করার ব্যাপারে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক দায়িত্ব, বেনজির ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপির) দায়িত্ব, হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি এবং এই অপরাধ সংঘটনের পর পাকিস্তান সরকার ও পুলিশের তদন্ত এবং পদক্ষেপের দিকে কমিশন আলোকপাত করেছে।

২০০৭ সালের ১৮ অক্টোবর বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তানে ফিরে আসা এবং একই বছর ২৭ অক্টোবর তাঁর হত্যাকাণ্ড পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে চরম পর্যায়ে পেঁৗছে দেয়। আট বছরের সামরিক শাসনের পর ওই বছরই শেষের দিকে নির্বাচনের শিডিউলকে ঘিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জোয়ার বয়ে যায়। এ বছরটি হলো পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম বড় সহিংসতার বছর। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যস্থতায় বেনজির ভুট্টো জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে একটি দুর্বল ও অস্পস্ট সমঝোতার মাধ্যমে দেশে ফিরে আসেন। যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে মিসেস ভুট্টোকে হত্যা করাটা রোধ করা যেত। হত্যাকাণ্ডের দিন বেনজির ভুট্টোর নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার পাঞ্জাব সরকার এবং রাওয়ালপিন্ডি ডিস্ট্রিক্ট পুলিশের হাতে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ তাদের ওপর ভরসা করে। তাদের কোনোটাই বেনজির ভুট্টো যে নিরাপত্তাজনিত হুমকির মধ্যে ছিলেন, সে তুলনায় দ্রুত প্রয়োজনীয়, উল্লেখ করার মতো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

জেনারেল মোশাররফের অধীনে কেন্দ্রীয় সরকার সব ব্যাপারে জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও, বেনজির ভুট্টোর প্রতি ভয়ানক হুমকির কথা জানা সত্ত্বেও তাঁকে ওই হুমকিগুলোর দিকে ঠেলে দেয়। এই হুমকির বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়াটা নিশ্চিত করেনি। এ কারণেই ২০০৭ সালের ১৮ অক্টোবর করাচিতে তিনি যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তখন তাঁর জন্য কবর রচনা করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

পিপিপি বেনজির ভুট্টোর জন্য অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। কমিশন লক্ষ করেছে পিপিপির কর্মীদের বীরত্বকে। তাঁদের অনেকেই বেনজিরকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু পিপিপির এই অতিরিক্ত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেতাদের নেতৃত্বের দুর্বলতা ছিল। নিরাপত্তাব্যবস্থাটি যথেষ্ট মানসম্মতভাবে করা হয়নি।

বেনজিরের হত্যাকাণ্ডের পর অপরাধস্থল থেকে হোসপাইপ দিয়ে আলামত মুছে ফেলাসহ রাওয়ালপিন্ডি জেলা পুলিশের নেওয়া পদক্ষেপগুলো তদন্তকাজে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। মিসেস ভুট্টো এবং তাঁর সঙ্গে নিহত হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে যারা দায়ী, সেসব অপরাধীকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে কোনো কমিটমেন্ট দেখা যায়নি, বিচারপ্রক্রিয়া নিষ্ক্রিয় হয়েছিল। বেনজির ভুট্টোর গাড়ির কাছে ১৫ বছর ছয় মাস বয়সের বালকের আত্দঘাতী বোমা হামলার ব্যাপারে কেউ বিশ্বাস করে না যে ছেলেটি একাই কাজটি করেছে।

মিসেস ভুট্টো বেশ কয়েকটি উৎস থেকে হুমকি পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে আল-কায়েদা, তালেবান, স্থানীয় জিহাদিরা এবং বিশেষ করে রাষ্ট্রের একটি ক্ষমতাশালী অংশের কাছ থেকে। অধিকন্তু কমিশন দেখতে পেয়েছে যে তদন্তে নিচের স্তরের কিছু তৎপরতাকারীর দিকে ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করা হয়েছে। তদন্তে ওপরের স্তরের পরিকল্পনাকারী, অর্থ দিয়ে মদদদানকারী বা হত্যাকে সুচারুরূপে সম্পাদনকারীদের ব্যাপারে নজর দেওয়া হয়নি।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরকারের কর্মকর্তারা তদন্তকে মারাত্দকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছেন, যা সত্যকে অবাধভাবে তুলে আনাটা বাধাগ্রস্ত করেছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) একই সঙ্গে পাশাপাশি একটি তদন্ত চালায়, আলামত জব্দ করে এবং সন্দেহভাজনদের বন্দি করে। এমন প্যারালাল তদন্তে সংগৃহীত আলামতের কিছু অংশ সম্পর্কে পুলিশকে অবহিত করে। কমিশন বিশ্বাস করে, মিসেস ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত পুলিশের ব্যর্থতার কারণটি উদ্দেশ্যমূলক। এই কর্মকর্তারা গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততায় ভীত ছিলেন। পেশাগতভাবে বোঝা সত্ত্বেও তাঁরা জানতেন না কতটা শক্তভাবে এ তদন্তকাজ তাঁরা এগিয়ে নিতে পারবেন। কার হাত ছিল, কে আদেশ দিয়েছিল এবং এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডটি সম্পন্ন করেছে, সে অপরাধ তদন্তের দায়িত্বটি মূলত ছিল পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের। এর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের সম্মুখীন করার দায়িত্বও ছিল তাদের। সেটা করতে পারলে পাকিস্তান দেশটি রাজনৈতিক ক্রাইম থেকে মুক্ত হতে পারত।

http://www.dailykalerkantho.com/?view=details&type=single&pub_no=138&cat_id=2&menu_id=23&news_type_id=1&index=1


No comments: