Wednesday, April 14, 2010

মুক্তিযোদ্ধার গলায় নিজ হাতে ছুরি চালিয়েছে 'মইত্যা রাজাকার' ।। সেই রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী

শনিবার, ৩ এপ্রিল ২০১০, ২০ চৈত্র ১৪১৬

মুক্তিযোদ্ধার গলায় নিজ হাতে ছুরি চালিয়েছে 'মইত্যা রাজাকার' ।। সেই রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী
মামুন-অর-রশিদ ॥ বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অন্যতম ভূমিকা পালনকারী আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন । তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর একজন বিশ্বস্ত সহচর হিসেবেই যে কেবল পরিকল্পনা দিয়ে বা সংগঠিত করে তাদের সহযোগিতা করেছেন তা-ই নয়; নিজেও পালন করেছেন ঘাতকের ভূমিকা। নিজ হাতে মুক্তিযোদ্ধার গলায় ছুরি চালিয়েছেন আবার হত্যাকান্ডের নীলনকশাও তৈরি করেছেন। পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানায় এখনও অনেক স্বজনহারা মানুষ নীরবে চোখের পানি ঝরান আর অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেন_ একাত্তরের সেই ঘাতক স্বাধীন দেশে একজন জাতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভুত হওয়ার ঘটনাপরিক্রমা। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যশোরে এক সমাবেশে মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, সম্প্রতিপ্রতি যারা পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে জড়িত, আল্লাহ তাদের প্রত্যেককে লাঞ্ছিত করেছেন। পাকিস্তানকে যারা আজিমপুর গোরস্তানে পাঠানোর স্লোগান দিয়েছিল তাদের পাকিস্তানের মাটি গ্রহণ করেনি। তাদের জন্য কলকাতা আর আগরতলার মহাশ্মশানই যথেষ্ট।
একাত্তরের সেই চিহ্নিত শত্রু জামায়াতে ইসলামী নতুন করে লিপ্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বিকৃতির নিকৃষ্ট কর্মে। সশস্ত্র বাঙালীর বিজয় অর্জনের দীর্ঘ ৩৬ বছর পর যে শত্রু নতুন করে নিজেদের নিরপরাধ দাবি করছে দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই বলে বড় গলা করছে; সেই শত্রুর বর্তমান নেতৃত্বের প্রধান যাকে পাবনাবাসী আজও একাত্তরের কুখ্যাত মইত্যা রাজাকার হিসেবেই চেনে। সেই মতিউর রহমান নিজামী যে এদেশে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের অন্যতম হোতা ছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আজও মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু মানুষ জীবিত রয়েছেন তার কুকর্ম ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে।
মতিউর রহমান নিজামী_ পিতা-খন্দকার লুৎফর রহমান, গ্রাম-মন্মথপুর, পোঃ বেড়া সোনাতলা, থানা-সাঁথিয়া, জেলা-পাবনা। বর্তমানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির এবং জামায়াতের সাবেক সংসদীয় দলের নেতা। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে এই জামায়াত নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুক্তিযু্দ্ধকে প্রতিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। মতিউর রহমান নিজামী এই আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। নিজামীর এ বদর বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য_পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা। আলবদরের নেতারা বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করেন এবং তাদের নির্দেশে ডিসেম্বর মাসে ঢাকাসহ সারাদেশে শত শত বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। নিজামীর নেতৃত্বে পরিচালিত আলবদর বাহিনীর হাতে বুদ্ধিজীবী হত্যার ভয়াবহ বিবরণ দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৭১-এর ২৩ সেপ্টেম্বর আলবদর ক্যাম্প ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় ছাত্রসংঘ আয়োজিত এক চা-চক্রে মতিউর রহমান নিজামী বলেন, সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও তাদের এদেশীয় দালালরা যে সস্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে, একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক যুবকরাই তাদের কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম। যারা ইসলাকে ভালবাসে, শুধু তারাই পাকিস্তানকে ভালবাসে। এবারের উদঘাটিত এ সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে, সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে সে প্রচেষ্টা তারা সার্থক করেছে।
দৈনিক সংগ্রামে নিজামীর লেখা একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে_ আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, পাক বাহিনীর সহযোগিতায় এদেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ সমাজ বদরযুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনীকে হিন্দুস্থানের অস্তিত্বকে খতম করে সারাবিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ নবেম্বর ১৯৭১) । নিজামীর এই স্বপ্ন অবশ্য সফল হয়নি।
শান্তি কমিটি গঠনের পর ১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে ঢাকায় প্রথম ঢাকা ঢোল পিটিয়ে মিছিল বের করা হয়। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন গোলাম আযম, খান এ সবুর, মতিউর রহমান নিজামী প্রমুখ। মিছিলশেষে গোলাম আযমের নেতৃত্বে পাকিস্তান রৰার জন্য মোনাজাত করা হয়। (তথ্যসূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১)। ২ আগস্ট চট্টগ্রাম ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক সমাবেশে আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী বলেন, দেশপ্রেমিক জনগণ যদি পহেলা মার্চ থেকে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবেলায় এগিয়ে আসত, তবে দেশে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আল্লাহ তার প্রিয়ভূমি পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ইমানদার মুসলমানদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু মুসলমানরা যখন ব্যর্থ হলো তখন আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দেশকে রক্ষা করছেন। চিনত্মা করুন, কি সর্বনাশের কথা! আল্লাহ মানুষ হত্যার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন!
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে তাদের ধ্বংস করার আহ্বান সংবলিত নিজামীর ভাষণ ও বিবৃতির বহু বিবরণ একাত্তরের জামায়াতে ইললামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে ছাপা হয়েছে। যশোর রাজাকার সদর দফতরে সমবেত রাজাকারদের উদ্দেশ করে নিজামী বলেন 'জাতির এ সঙ্কটজনক মুহূর্তে প্রত্যেক রেজাকারের উচিত ঈমানদারীর সাথে তাদের উপর অর্পিত এ জাতীয় কর্তব্য পালন করা এবং ওই সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।' (দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর)। মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তার এলাকাবাসীও হত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদির অভিযোগ এনেছেন।
পাবনা জেলার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রামের আমিনুল ইসলাম ডাবলু গণতন্ত কমিশনকে জানিয়েছেন, তার পিতা মোহাম্মদ সোহরাব আলীকে একাত্তরে নিজামীর নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরও জানান যে, নিজামীর নির্দেশেই তাদের এলাকার প্রফুল্ল (পিতা-নয়ন প্রামাণিক), ভাদু (পিতা- ক্ষিতীশ প্রামাণিক), মনু (পিতা- ফেলু প্রামাণিক) এবং ষষ্ঠী প্রামাণিককে (পিতা-প্রফুল্ল প্রামাণিক) গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীও রয়েছে বলে তিনি জানান।
১৯৭১-এ সাত নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দুসকে (পিতা-মৃত ডা. সৈয়দ আলী শেখ, সাং-মাধবপুর, পোঃ শোলাবাড়িয়া, থানা-পাবনা) আলবদররা ধরে নিয়ে প্রায় দু'সপ্তাহ আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়। ক্যাম্পে অবস্থানের সময় তিনি সেখানে আলবদর কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণ ইত্যাদির পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করেন। এ পরিকল্পনায় মতিউর রহমান নিজামী নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে তিনি জানান। ২৬ নবেম্বর সাত্তার রাজাকারের সহযোগিতায় ধুলাউড়ি গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা ৩০ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। মতিউর রহমান নিজামীর পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী সাত্তার রাজাকার তার কার্যক্রম পরিকল্পনা করত বলে তিনি জানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস আলবদর বাহিনীর একটি সমাবেশ এবং গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন। বৈঠকে মতিউর রহমান নিজামীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমূলে ধ্বংস করার নির্দেশ দেন বলে কুদ্দুস জানান। বৈঠকে কোথায় কোথায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বাড়ি আছে, তা চিহ্নিত করা হয়। তিনি জানান, নিজামী বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, ঘাঁটি ধ্বংস এবং আওয়ামী লীগারদের শেষ করার নির্দেশ দেন। বৈঠকের পরের দিন রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় হানাদাররা বৃশালিকা গ্রাম ঘিরে ফেলে গোলাগুলি চালায়, নির্যাতন করে, লুটতরাজ করে এবং বাড়িঘর আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তিনি আরও জানান, নিজামী তার গ্রামের ঝুটি সাহার ছেলে বটেশ্বর সাহা নামে এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন। নিজামীর বিরুদ্ধে প্রায় অনুরূপ অভিযোগ এনেছেন সাঁথিয়া থানার মিয়াপুর গ্রামের মোহাম্মদ শাহাজাহান আলী (পিতা-জামালউদ্দিন) যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হাতে আটক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার গলায়ও ছুরি চালানো হয়েছিল। অন্যদের জবাই করলেও শাহজাহান আলী ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। গলায় কাটা দাগ নিয়ে তিনি এখন পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। তার সহযোদ্ধা দারা, চাঁদ, মুসলেম, আখতার, শাহজাহান- এদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে গরু জবাই করার লম্বা ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। সেদিন প্রায় ১০/১২ মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করেছিল 'জানোয়ার' নিজামী। মুক্তিযোদ্ধা কবিরের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের নীলনকশা মতিউর রহমান নিজামীর বলে শাহজাহান আলী জানিয়েছেন। একাত্তরে নিজামীর দুষ্কর্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে আব্দুল লতিফ বলেন, নিজামী আলবদর ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যৌথভাবে তাদের গ্রাম বুশালিকা ঘিরে ফেলে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। সেই রাতে হামলাকারী আলবদর ও পাকিস্তানী হানাদাররা তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতানের পর গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার আগে একই বছরের ১৩ আগস্ট আলবদররা বেড়া বাজার থেকে আব্দুল লতিফকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সৌভাগ্যবশত তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন এবং এখন নিজামীর হত্যা- নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছেন।

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2010-04-03&ni=13553

No comments: