২৫ থেকে ২৬ মার্চ, ১৯৭১
শহিদুল ইসলাম
২৫ মার্চ, ১৯৭১ ভয়াল কাল রাতের কথা হঠাৎ করেই লেখা যায় না। পেছনের ইতিহাস টানতে হয়। নিদেনপক্ষে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটি সামনে না রাখলে ২৫ মার্চের সে ভয়ংকর রাতের কথা ফোটানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমাকে ২৫ ও ২৬ মার্চের কথাই লিখতে বলা হয়েছে। তাই সে প্রেক্ষাপটটি এখানে লেখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রয়োজনও আছে বলে আমার মনে হয় না। আজকের সংবাদপত্রগুলো এবং টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো 'রক্তঝরা' মার্চের প্রতিদিনের ঘটনা যেভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরছে, তাতে সে সম্পর্কে আমার কিছু না লিখলেও চলবে। শুধু একটা কথাই বলব, ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে আগুন ধরে যায়। স্বাধীনতার কম কিছুতেই মানুষ আর মানতে নারাজ। '৭০-এর নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বাঙালির আসন পাকাপোক্ত করার জন্য, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানের প্রথম বাঙালি সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্য বানচালের চক্রান্তে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। সারাদেশ আন্দোলনে নেচে ওঠে।
আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তারাও সে আন্দোলনে পিছিয়ে ছিলাম না। বরং ১৮ ফেব্রুয়ারি জোহা স্যারের হত্যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অন্য ধরনের সম্মান এনে দেয়। তদুপরি ৫ মার্চ শিক্ষক সমিতি 'স্বাধীনতার' প্রস্তাব গ্রহণ করে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হওয়ার সম্মান লাভ করে। ৩ মার্চ ছাত্র-শিক্ষকরা কলাভবনের সামনের শহীদ মিনারে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ান, প্রশাসনিক ভবনের মাথায় উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের পতাকা। যাওয়া-আসার পথে ওই পতাকার দিকে চোখ পড়লে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যেত। সেদিন ঢাকায় কী হচ্ছে, তা আমরা আজকের মতো সহজেই জানতে পারতাম না। তাই একটি ঘটনা নানা ডালপালা মেলে আমাদের মুখে মুখে ফিরত। ইয়াহিয়ার ঘোষণা 'মুজিব ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী', ভুট্টোর 'দু'দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের' প্রস্তাব আমাদের মনে নানা ধরনের বার্তাবহন করে আনত। যাক সে কথা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। প্রতিদিনের মতো আমরা, বজলুল মোবিন চৌধুরী, খালেদ হাসান, আবদুর রাজ্জাক, সনৎ কুমার সাহা, নুরুদ্দীন আহমেদ, লুৎফর রহমান অনেক রাত পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশনের খবর সংগ্রহ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানারকম সম্ভাবনার কথা আলোচনা করতাম। ২৫ মার্চ ভয়াল রাত। ঢাকায় যা ঘটেছে আমরা ওই রাতে কোনো খবরই পাইনি। বরং একটা সমঝোতার সম্ভাবনা মনের ভেতর নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে যাই রাত বারোটার আগে নয়। ঢাকায় যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, আমরা সে রাতে কিছুই জানি না। আমাদের কাছে ২৬ মার্চ হচ্ছে ভয়াল দিন। ২৬ মার্চ আমার জন্য এক ভয়ঙ্কর দিন। সংক্ষেপে সে কথাই লিখি আজ।
৩ মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে জুবেরি ভবনের সব শিক্ষক যে যার বাড়ি চলে যান। থাকি আমি, অজিত কুমার ঘোষ এবং মুজিবুর রহমান। রান্নাঘর সামলাত জয়নাল। অজিত ও আমি পাশাপাশি কক্ষে থাকতাম। শুভ রাত্রি বলে আমরা যে যার ঘরে ঢুকি। শুয়ে গভীর নিদ্রার কোলে আশ্রয় নিই। বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, জানার কোনো উপায় ছিল না। ঘুম ভাঙল দরজায় প্রবল আঘাতের শব্দে। ভালো করে ঠাহর করার আগেই স্যান্ডোগেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দরজা খুলি। সঙ্গে সঙ্গে দুইজন সৈন্য ঘরে ঢুকে পরল।পেছন থেকে লাথি মেরে বলল 'নিকালো শালে।' বাইরে বেরিয়ে দেখি মুজিবুর রহমান ও অজিতকে আগেই বের করে এনেছে। রাইফেল উঁচিয়ে তিন পাকিস্তানি সেনা আমাদের জুবেরি ভবন থেকে প্যারিস রোডের দিকে নিয়ে চলল। ডানে ঘুরে উপাচার্যের বাড়ির দিকে এগোলাম। হাতের বামে শিক্ষকদের ফ্লাটগুলো থেকে উঁকি মেরে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া দেখছিল শিক্ষকদের পরিবার। অজিতের মুখ শুকিয়ে চুন। মুজিবুর রহমানকে অতটা বিস্মিত হতে দেখলাম না। করাচিতে ছিলেন বহুদিন। উর্দুটা ভালোই জানতেন। উর্দুতে সৈন্যদের সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা কেউ কথা না বলে বন্দুক উঁচিয়ে উপাচার্য সাজ্জাদ হোসাইনের বাড়িতে নিয়ে গেল। সামনে দিয়ে জোরে আঘাত করলে মুজিবুর পড়ে যান। তারা এলোপাতাতি লাথি মারতে লাগল। তারপর টেনে তুলে উপাচার্যের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সাজ্জাদ হোসাইন বাগানে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁর সামনে আমাদের হাজির করলে তিনি বললেন 'এঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।' ওরা প্রশ্ন করল 'ছুটির মধ্যে গেস্ট হাউসে কী করে এঁরা।' সাজ্জাদ হোসাইন বললেন 'পড়াশোনা করার জন্য এরা থেকে গেছে।' তারপর তিনজন একত্রে কী আলাপ করল। তারপর আমাদের বলল 'চলিয়ে।' আমাদের ফের যে পথ দিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরে যার যার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল_'কেউ ঘর থেকে বেরুবে না। তাহলে গুলি করব।' আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকে একা একা অস্থির হয়ে গেলাম। আমার 'ন্যাশনাল তিন ব্যান্ডের রেডিওতে' আকাশবাণী শুনলাম খুব আস্তে। ভেসে এল দেবদুলাল বঙ্গোপাধ্যায়ের কাঁপা গলা। 'বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।' মৃতদের মধ্যে জি সি দেবের নামও ছিল। খবর শুনে আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম। আমাদের ঘরের দরজায় ও পেছনের গ্রিলের বাইরে সেপাহি দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বাড়তে থাকলে ক্ষুধায় অস্থির হয়ে দরজা খুলে সেপাহিকে বললাম। সে জিজ্ঞেস করল 'তোমরা কোথায় খাও।' আমি খাবার ঘরটি দেখিয়ে দিলাম। তখন অজিতকে বের করে বন্দুকের নলের সামনে আমরা খাবার ঘরের দিকে এগুলাম। যাওয়ার সময় মুজিবুর রহমানকে বের করে নিলাম। খাবার ঘরে গিয়ে ডাকাডাকি করে বহু পরে জয়নালের সাড়া পেলাম। সে আমাদের গলা শুনে সাহস পেয়ে দরজা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সেপাহি তাকে লাথি মেরে গালাগাল দিল এবং আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করতে বলল। আমরা খাবার টেবিল ঘিরে তিনজন বসে গেলাম। জয়নাল পরোটা ও ডিম ভাজি করে আমাদের দিল। ভদ্রতার খাতিরে আমি দাঁড়িয়ে থাকা সেপাহিকে আমাদের সঙ্গে খেতে আহ্বান জানালে সে জানাল 'অর্ডার নাই।' দুপুরেও বন্দুকের নলের মুখে আমরা আহার সারি।
ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা একাকী সারাটা দিন কাটিয়ে দি। মাঝেমধ্যে দরজায় টোকা। খুলেই দেখি পাকিস্তানি সেনা। ঘরের মধ্যে ঢোকে। এটা দেখে, ওটা দেখে। জিজ্ঞেস করে 'তোমার দুটো রেডিও?' আমি বলি না একটা রেকর্ড প্লেয়ার আর একটা রেডিও। রেকর্ড প্লেয়ারে এক লং-প্লে চড়িয়ে তাকে বোঝাই জিনিসটা কি? যাওয়ার সময় রেডিওটা নিয়ে গেল। বলে গেল ২টার সময় দিয়ে যাবে। না দিলেই বা কি করার ছিল। হাসিমুখে দিলাম। ঐদিন ৩ ব্যান্ডের ন্যাশনাল রেডিওটাই ছিল আমার সময় কাটানোর উপায়। আকাশবাণী ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাংলাদেশের খবর প্রচার করছে। সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ঢাকায় কারা কারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের নাম। সেই রেডিওটাও নিয়ে গেল ওরা। পরে এক ফাঁকে অজিতের ঘরে গেলাম। শুনলাম, ওর রেডিওটাও নিয়ে গেছে। বুঝলাম কোনো খবর যেন আমরা শুনতে না পারি। যাহোক, অজিতকে বললাম 'খবরদার, তোমার আসল নাম বলবে না কখনো?' ও জিজ্ঞেস করল 'তাহলে কী বলব?' আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল 'ওয়াজেদ গাউস।' অজিত ঘোষের সঙ্গে মিল রেখে।
সন্ধ্যায় ওদের শিফট পরিবর্তনের সময় আমি ও অজিত গেস্ট হাউস থেকে পালাই। আসার সময় মুজিবুর রহমানকেও আমাদের সঙ্গে আসতে বলি। তিনি এলেন না। আমি আফতাবুর রহিম ও অজিত, প্রফেসর মুশাররফ হোসেনের বাসায় উঠি। এভাবে সমস্ত ২৬ মার্চ আমাদের কাটল। ২৭ মার্চ বিকেল থেকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস ত্যাগ করলে আমরা বাইরে বেরুতে সাহস পাই। সন্ধ্যার পর ক্লাবেও আসি। গল্প-গুজব হয়। ক্লাবেই শুনি ২৬ মার্চ ভোরের দৈনন্দিন হাঁটার সময় জোহা হলের প্রোভোস্ট ড. সিরাজুল আরেফীন, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তারা বিষয়টি বুঝে তাঁকে ছেড়ে দেয়। আরেফীন স্যার তখন শিক্ষক সমিতির সভাপতি। ৫ মার্চ তাঁরই সভাপতিত্বে শিক্ষকরা 'স্বাধীন বাংলাদেশের' প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৩ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস দখলে নেয়। শিক্ষকদের স্বাধীন চলাফেরা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৪ এপ্রিল সুখরঞ্জন সমাদ্দারকেও ধরে নিয়ে হত্যা করে সেনারা। ১৫ এপ্রিল অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
শহিদুল ইসলাম
২৫ মার্চ, ১৯৭১ ভয়াল কাল রাতের কথা হঠাৎ করেই লেখা যায় না। পেছনের ইতিহাস টানতে হয়। নিদেনপক্ষে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটি সামনে না রাখলে ২৫ মার্চের সে ভয়ংকর রাতের কথা ফোটানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমাকে ২৫ ও ২৬ মার্চের কথাই লিখতে বলা হয়েছে। তাই সে প্রেক্ষাপটটি এখানে লেখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রয়োজনও আছে বলে আমার মনে হয় না। আজকের সংবাদপত্রগুলো এবং টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো 'রক্তঝরা' মার্চের প্রতিদিনের ঘটনা যেভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরছে, তাতে সে সম্পর্কে আমার কিছু না লিখলেও চলবে। শুধু একটা কথাই বলব, ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে আগুন ধরে যায়। স্বাধীনতার কম কিছুতেই মানুষ আর মানতে নারাজ। '৭০-এর নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বাঙালির আসন পাকাপোক্ত করার জন্য, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানের প্রথম বাঙালি সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্য বানচালের চক্রান্তে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। সারাদেশ আন্দোলনে নেচে ওঠে।
আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তারাও সে আন্দোলনে পিছিয়ে ছিলাম না। বরং ১৮ ফেব্রুয়ারি জোহা স্যারের হত্যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অন্য ধরনের সম্মান এনে দেয়। তদুপরি ৫ মার্চ শিক্ষক সমিতি 'স্বাধীনতার' প্রস্তাব গ্রহণ করে বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হওয়ার সম্মান লাভ করে। ৩ মার্চ ছাত্র-শিক্ষকরা কলাভবনের সামনের শহীদ মিনারে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ান, প্রশাসনিক ভবনের মাথায় উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশের পতাকা। যাওয়া-আসার পথে ওই পতাকার দিকে চোখ পড়লে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যেত। সেদিন ঢাকায় কী হচ্ছে, তা আমরা আজকের মতো সহজেই জানতে পারতাম না। তাই একটি ঘটনা নানা ডালপালা মেলে আমাদের মুখে মুখে ফিরত। ইয়াহিয়ার ঘোষণা 'মুজিব ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী', ভুট্টোর 'দু'দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের' প্রস্তাব আমাদের মনে নানা ধরনের বার্তাবহন করে আনত। যাক সে কথা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। প্রতিদিনের মতো আমরা, বজলুল মোবিন চৌধুরী, খালেদ হাসান, আবদুর রাজ্জাক, সনৎ কুমার সাহা, নুরুদ্দীন আহমেদ, লুৎফর রহমান অনেক রাত পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশনের খবর সংগ্রহ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানারকম সম্ভাবনার কথা আলোচনা করতাম। ২৫ মার্চ ভয়াল রাত। ঢাকায় যা ঘটেছে আমরা ওই রাতে কোনো খবরই পাইনি। বরং একটা সমঝোতার সম্ভাবনা মনের ভেতর নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে যাই রাত বারোটার আগে নয়। ঢাকায় যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, আমরা সে রাতে কিছুই জানি না। আমাদের কাছে ২৬ মার্চ হচ্ছে ভয়াল দিন। ২৬ মার্চ আমার জন্য এক ভয়ঙ্কর দিন। সংক্ষেপে সে কথাই লিখি আজ।
৩ মার্চের পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে জুবেরি ভবনের সব শিক্ষক যে যার বাড়ি চলে যান। থাকি আমি, অজিত কুমার ঘোষ এবং মুজিবুর রহমান। রান্নাঘর সামলাত জয়নাল। অজিত ও আমি পাশাপাশি কক্ষে থাকতাম। শুভ রাত্রি বলে আমরা যে যার ঘরে ঢুকি। শুয়ে গভীর নিদ্রার কোলে আশ্রয় নিই। বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, জানার কোনো উপায় ছিল না। ঘুম ভাঙল দরজায় প্রবল আঘাতের শব্দে। ভালো করে ঠাহর করার আগেই স্যান্ডোগেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দরজা খুলি। সঙ্গে সঙ্গে দুইজন সৈন্য ঘরে ঢুকে পরল।পেছন থেকে লাথি মেরে বলল 'নিকালো শালে।' বাইরে বেরিয়ে দেখি মুজিবুর রহমান ও অজিতকে আগেই বের করে এনেছে। রাইফেল উঁচিয়ে তিন পাকিস্তানি সেনা আমাদের জুবেরি ভবন থেকে প্যারিস রোডের দিকে নিয়ে চলল। ডানে ঘুরে উপাচার্যের বাড়ির দিকে এগোলাম। হাতের বামে শিক্ষকদের ফ্লাটগুলো থেকে উঁকি মেরে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া দেখছিল শিক্ষকদের পরিবার। অজিতের মুখ শুকিয়ে চুন। মুজিবুর রহমানকে অতটা বিস্মিত হতে দেখলাম না। করাচিতে ছিলেন বহুদিন। উর্দুটা ভালোই জানতেন। উর্দুতে সৈন্যদের সঙ্গে কিছু কথা বলার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা কেউ কথা না বলে বন্দুক উঁচিয়ে উপাচার্য সাজ্জাদ হোসাইনের বাড়িতে নিয়ে গেল। সামনে দিয়ে জোরে আঘাত করলে মুজিবুর পড়ে যান। তারা এলোপাতাতি লাথি মারতে লাগল। তারপর টেনে তুলে উপাচার্যের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সাজ্জাদ হোসাইন বাগানে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁর সামনে আমাদের হাজির করলে তিনি বললেন 'এঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।' ওরা প্রশ্ন করল 'ছুটির মধ্যে গেস্ট হাউসে কী করে এঁরা।' সাজ্জাদ হোসাইন বললেন 'পড়াশোনা করার জন্য এরা থেকে গেছে।' তারপর তিনজন একত্রে কী আলাপ করল। তারপর আমাদের বলল 'চলিয়ে।' আমাদের ফের যে পথ দিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরে যার যার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল_'কেউ ঘর থেকে বেরুবে না। তাহলে গুলি করব।' আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকে একা একা অস্থির হয়ে গেলাম। আমার 'ন্যাশনাল তিন ব্যান্ডের রেডিওতে' আকাশবাণী শুনলাম খুব আস্তে। ভেসে এল দেবদুলাল বঙ্গোপাধ্যায়ের কাঁপা গলা। 'বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে।' মৃতদের মধ্যে জি সি দেবের নামও ছিল। খবর শুনে আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম। আমাদের ঘরের দরজায় ও পেছনের গ্রিলের বাইরে সেপাহি দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বাড়তে থাকলে ক্ষুধায় অস্থির হয়ে দরজা খুলে সেপাহিকে বললাম। সে জিজ্ঞেস করল 'তোমরা কোথায় খাও।' আমি খাবার ঘরটি দেখিয়ে দিলাম। তখন অজিতকে বের করে বন্দুকের নলের সামনে আমরা খাবার ঘরের দিকে এগুলাম। যাওয়ার সময় মুজিবুর রহমানকে বের করে নিলাম। খাবার ঘরে গিয়ে ডাকাডাকি করে বহু পরে জয়নালের সাড়া পেলাম। সে আমাদের গলা শুনে সাহস পেয়ে দরজা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে একজন সেপাহি তাকে লাথি মেরে গালাগাল দিল এবং আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি করতে বলল। আমরা খাবার টেবিল ঘিরে তিনজন বসে গেলাম। জয়নাল পরোটা ও ডিম ভাজি করে আমাদের দিল। ভদ্রতার খাতিরে আমি দাঁড়িয়ে থাকা সেপাহিকে আমাদের সঙ্গে খেতে আহ্বান জানালে সে জানাল 'অর্ডার নাই।' দুপুরেও বন্দুকের নলের মুখে আমরা আহার সারি।
ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা একাকী সারাটা দিন কাটিয়ে দি। মাঝেমধ্যে দরজায় টোকা। খুলেই দেখি পাকিস্তানি সেনা। ঘরের মধ্যে ঢোকে। এটা দেখে, ওটা দেখে। জিজ্ঞেস করে 'তোমার দুটো রেডিও?' আমি বলি না একটা রেকর্ড প্লেয়ার আর একটা রেডিও। রেকর্ড প্লেয়ারে এক লং-প্লে চড়িয়ে তাকে বোঝাই জিনিসটা কি? যাওয়ার সময় রেডিওটা নিয়ে গেল। বলে গেল ২টার সময় দিয়ে যাবে। না দিলেই বা কি করার ছিল। হাসিমুখে দিলাম। ঐদিন ৩ ব্যান্ডের ন্যাশনাল রেডিওটাই ছিল আমার সময় কাটানোর উপায়। আকাশবাণী ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাংলাদেশের খবর প্রচার করছে। সীমান্ত অঞ্চলে শরণার্থীদের গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ঢাকায় কারা কারা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের নাম। সেই রেডিওটাও নিয়ে গেল ওরা। পরে এক ফাঁকে অজিতের ঘরে গেলাম। শুনলাম, ওর রেডিওটাও নিয়ে গেছে। বুঝলাম কোনো খবর যেন আমরা শুনতে না পারি। যাহোক, অজিতকে বললাম 'খবরদার, তোমার আসল নাম বলবে না কখনো?' ও জিজ্ঞেস করল 'তাহলে কী বলব?' আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল 'ওয়াজেদ গাউস।' অজিত ঘোষের সঙ্গে মিল রেখে।
সন্ধ্যায় ওদের শিফট পরিবর্তনের সময় আমি ও অজিত গেস্ট হাউস থেকে পালাই। আসার সময় মুজিবুর রহমানকেও আমাদের সঙ্গে আসতে বলি। তিনি এলেন না। আমি আফতাবুর রহিম ও অজিত, প্রফেসর মুশাররফ হোসেনের বাসায় উঠি। এভাবে সমস্ত ২৬ মার্চ আমাদের কাটল। ২৭ মার্চ বিকেল থেকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস ত্যাগ করলে আমরা বাইরে বেরুতে সাহস পাই। সন্ধ্যার পর ক্লাবেও আসি। গল্প-গুজব হয়। ক্লাবেই শুনি ২৬ মার্চ ভোরের দৈনন্দিন হাঁটার সময় জোহা হলের প্রোভোস্ট ড. সিরাজুল আরেফীন, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তারা বিষয়টি বুঝে তাঁকে ছেড়ে দেয়। আরেফীন স্যার তখন শিক্ষক সমিতির সভাপতি। ৫ মার্চ তাঁরই সভাপতিত্বে শিক্ষকরা 'স্বাধীন বাংলাদেশের' প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৩ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পাস দখলে নেয়। শিক্ষকদের স্বাধীন চলাফেরা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৪ এপ্রিল সুখরঞ্জন সমাদ্দারকেও ধরে নিয়ে হত্যা করে সেনারা। ১৫ এপ্রিল অধ্যাপক মজিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments:
Post a Comment