Sunday, April 18, 2010

আজ প্রেরণার দিন সামনে এগিয়ে চলার দিন

আজ প্রেরণার দিন সামনে এগিয়ে চলার দিন
সিমিন হোসেন রিমি
প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিশেষ কোন দিন বা তারিখের গুরুত্ব থাকে অপরিসীম। কিন্তু কখনও কখনও কোন তারিখ শুধু ব্যক্তিকেই অতিক্রম করে না; ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমাজ, সমাজকে ছাড়িয়ে রাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যায়। একই মালায় গেঁথে দেয় একটি দেশের সমস্ত মানুষকে। বাংলাদেশের জন্য ঠিক তেমনই একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী তারিখ ১৭ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই তারিখে বিশ্বের বুকে এক বিশেষ মর্যাদায় বাংলাদেশ নামের এই শ্যামল সুন্দর ভূখন্ড আলোকিত হয়েছিল রক্ত আর বীরত্বের এক অপূর্ব আলোকবন্যায়।
আজ থেকে ৩৯ বছর আগে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের ভবেরপাড়ার বিশাল সবুজে ঘেরা নিবিড় আম্রকাননে ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে চোখ মেলেছিল নবজাতক শিশু বাংলাদেশ। ভূমিষ্ঠ হয়েই যে শিশুটি জন্ম-ক্রন্দনে সচকিত করেছিল বিশ্বকে, যে শিশুটি সূর্য-শপথে, রক্তে আর বারুদের গন্ধে পৃথিবীকে সবলে ঝাঁকুনি দিয়ে শুনিয়েছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা, স্বাধীনতার কথা, সেই শিশুটিই আজ ৩৯ বছরের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৭ এপ্রিল শুধু পেছনে ফিরে দেখার দিন নয়। প্রেরণার দিন, সামনে এগিয়ে চলার দিন। পেছনের ভুল-ভ্রান্তি মুছে ফেলার দিন, নতুন শপথে, উদ্দীপনায় এগিয়ে চলার শুভক্ষণ। যতদিন বিশ্বব্রহ্মান্ডে আমাদের এই সৌরজগতে পৃথিবী নামক গ্রহটি থাকবে, ততদিন এই বাংলাদেশের বুকে প্রতিবছরই ১৭ এপ্রিল আসবে। কিন্তু এই তারিখটির গুরুত্ব এবং তাৎপর্য আদৌ কি আমাদের সমাজে বিশেষভাবে প্রতিফলিত? দিবসের গন্ডিতে বেঁধে দেয়া বিশেষ কিছু মানুষের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর এবং আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী যেন তারিখটি। আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি যা ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে জাতিকে স্পর্শ করে, তা হয়ে যায় সর্বজনীন। যে জিনিস সর্বজনীন বা সরল অর্থে সবার, সেটির প্রতি মায়া বা দরদ থাকে অন্য রকম। এই দরদের পেছনে থাকে প্রাণের অনুভূতি। গভীরতম শিক্ষা। যে শিক্ষা প্রতিনিয়ত প্রেরণা দেয় এগিয়ে চলার। আমাদেরকে ১৭ এপ্রিল থেকে প্রেরণা নিতে হবে। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। স্বাধীনতা লাভ এ দেশের মানুষের জীবনের সর্বেশ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালীদের প্রতি বৈষম্যমূলক, স্বার্থপর আচরণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সংগ্রাম, যা ১৯৭১ সালে এসে চূড়ানত্ম রূপ লাভ করে মুক্তির সংগ্রামে, সেই সংগ্রামের মধ্যমণি ছিলেন বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণতন্ত্র আর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনার এই সংগ্রামের মুখে '৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের স্বার্থের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের গণরায় ছিল এক মারাত্মক আঘাত। তাই তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার বদলে আলোচনার ছদ্মাবরণে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়নের কাজ করতে থাকে। তার চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটে ২৫ মার্চ গভীর রাতে এই দেশের নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হত্যাকা- শুরুর মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানী শাসকরা যেন মেতে ওঠে এক পৈশাচিক মানুষ হত্যায়। একই রাতে বঙ্গবন্ধু পাকিসত্মানীদের হাতে বন্দী হন। ২৫ মার্চ রাতের এই ভয়াবহ আক্রমণ এবং তৎপরবর্তী বর্বরতা এবং ধ্বংসযজ্ঞের ফলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্তা বন্ধন ছিন্ন হলো। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠল বাংলার সমস্তা দিকে। এই প্রতিরোধকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে মুক্তির চরম লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ চূড়ান্ত গণরায়ের অধিকারী আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিগণ। এই লক্ষ্যে গঠিত হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, যে সরকার ১৭ এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশের মাটিতে প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা লাভ করে। এই সরকার প্রতিষ্ঠা লাভের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। বাঙালীর অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা সহজবোধ্য হয়। এই সরকারের দৃঢ় প্রত্যয়, সঙ্কল্প ও সফল নেতৃত্বের ফলেই দেশের সর্বস্তরের মানুষের একত্রিত শক্তি সমস্ত প্রতিকূলতাকে ভেঙ্গে একমাত্র লক্ষ্য স্বাধীনতার দিকে দ্রুত এগিয়ে যায় এবং লাখো শহীদের রক্তের চরম মূল্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ শেষে উপরাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর ভাষণে বলেন, "আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল।... পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে।"
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ করেন 'মুজিবনগর'।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার পটভূমি ব্যাখ্যা করেন বিশদভাবে। তিনি বললেন, "পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।...স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন-পালন করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান করে দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।"
আজকের সময়ে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪-এর মুজিবনগর দিবসে প্রদত্ত ভাষণের কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি। ১৯৭৩ সালে তিনি বলেছেন, "আমরা সাফল্যের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছি, এখন আমরা জাতীয় পুনর্গঠনের সংগ্রাম করছি। স্বাধীনতা অর্জন অপেক্ষা স্বাধীনতা রক্ষা করাই কঠিন কাজ। বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা যায় না।"
(সূত্র : দৈনিক বাংলা, ১৮-৪-৭৩)
১৯৭৪-এ তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, "আর হতাশা নয়, আসুন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই অগ্নিসম্ভব দিনগুলোতে যে দুর্জয় শপথ নিয়ে আমরা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, আজ সেই একই শপথ নিয়ে আবার আমরা নতুন সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, শোষণহীন একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য।... দেশ আজ যে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তা সমাধানের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো সমাধানের জন্য সমস্যাগুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বেছে নিয়ে সর্বশ্রেণীর জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পর্যায়ক্রমে সেগুলোর সমাধান করা। দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য প্রতিটি নাগরিককেই স্থির সঙ্কল্প নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যেতে হবে। রক্তাক্ত বিপ্লবের মাঝ দিয়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, সেই বাংলাদেশ আজ নানা সমস্যায় পরিবেষ্টিত, কিন্তু তাতে হতাশ হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই।... দেশ তার অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যেতে পারে যদি সকল শ্র্রেণীর মানুষ, দেশের প্রতিটি নাগরিক নিঃস্বার্থভাবে তার দায়িত্ব পালন করে, যদি আমরা আমাদের শিল্প কারখানা আর ক্ষেত খামারগুলোর উৎপাদন বাড়াতে পারি তবেই।" (সূত্র : দৈনিক বাংলা, ১৮-৪-৭৪)
প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল আসবে, আবার চলে যাবে। এই দিনটির সঙ্গে মিশে থাকবে এই দেশের কোটি কোটি মানুষের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার সুখ। ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতি, লাখ লাখ মা-বোনের লাঞ্ছনা আর করুণ কাহিনীতে ভরা এই মহান স্বাধীনতার চিরজাগ্রত পবিত্র স্মৃতি অন্তর থেকে অন্তরে, বর্তমান থেকে আগামী প্রজন্মে সমুন্নত রাখার স্বার্থে এই দিনটির মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের যাঁরা রূপকার তাঁদেরও স্বীকৃতি প্রয়োজন।
লেখক : তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2010-04-17&ni=15008

No comments: