Thursday, April 22, 2010

বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-২

যুগের বাণীবাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-২
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
প্রিয় পাঠক, এই শিরোনামে চারটি ধারাবাহিক লেখার ইচ্ছার দ্বিতীয়টি আজ দ্বিপ্রহরে শুরু করেছি। ১৯ মার্চ ছাপা প্রথমটিতে লিখেছিলাম, সংবিধান সব দেশেরই জনগণের আদরের ধন_বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাদের সাধ-আহ্লাদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়।

আগের লেখাটিতে আদি সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছিলাম, যেটা এক সামরিক স্বৈরশাসক কর্তৃক সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য নয়। এ বক্তব্যের পক্ষে ঐতিহাসিক উদাহরণ হচ্ছে ইসলামের নবী কর্তৃক প্রণীত 'মদিনার সংবিধান', যার ২৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ইহুদি ও মুসলমানরা এক উম্মাহ বা জাতি। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। আজকের লেখাটিতে বাংলাদেশের সংবিধানের যে বৈশিষ্ট্য বিষয়ে আলোচনা করব, সেটা হচ্ছে 'গণতন্ত্র'। প্রিয় পাঠক, অনুমান করি আপনি ভাবছেন এটা এখন আলোচনার বিষয় নয়, কারণ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংসদ অধিবেশন নিয়মিত চলছে। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে সংসদে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। অতএব আমার আজকের লেখাটির বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দেওয়া যায় না। কিন্তু এটা সঠিক নয়। কেন নয়, সেটা লিখছি।
আপনার উপরোক্ত যুক্তি বোধ করি এই ধারণা থেকে উপনীত যে গণতন্ত্রে একজন নাগরিকের সর্বশেষ সর্বোচ্চ অধিকার হচ্ছে জাতীয় সংসদে তাঁর এলাকার সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার। এই ধারণাটি সঠিক কি না, আসুন সেটা যাচাই করা যাক যুক্তিবিজ্ঞানের আরোহ ও অবরোহ পদ্ধতি অনুসরণে। আপনি একটি ফলের দোকানে, ধরা যাক, আপেল কিনতে গেলেন। দোকানি আপনাকে সবুজ রঙের এক কেজি আপেল দিলেন। বাসায় ফিরে একটি আপেলে কামড় দিতেই টক স্বাদ পেলেন। আরেকটিতে, তারপর আরেকটিতে কামড় দিতে একই টক স্বাদ পেলেন। পরদিন সবুজ নয়, হলুদ রঙের আপেল কিনলেন। এবার প্রতিটিতে পেলেন মিষ্টি স্বাদ। এ দুটি অভিজ্ঞতায় অর্থাৎ আরোহ পদ্ধতিতে পেয়ে গেলেন যে আপনার কেনা সবুজ ও হলুদ রঙের আপেলগুলো যথাক্রমে টক ও মিষ্টি। অতঃপর অবরোহী যুক্তিধারায় আপনি একটি সাধারণ সূত্র পেলেন : সব সবুজ রঙের আপেল টক আর হলুদ রঙের আপেল মিষ্টি হয়।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রকে বিবেচনা করা যাক। উদাহরণ হিসেবে সংবাদপত্রে ছাপা পুরনো দুটি প্রতিবেদন উল্লেখ করছি। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি এলাকায় ২০০৪ সালে ওয়াপদার খালের ওপর একটি পাকা সেতুর কাজ শুরু হয়। সেতুটি এলাকার জনগণের যাতায়াতের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। সেটি নির্মাণের জন্য ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তিনটি পিলার নির্মাণ এবং তিনটি স্লাবের একটি ঢালাই করা হয়। ঠিকাদার স্থানীয় লোক ছিলেন না। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত করে বিলের টাকা তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যান। অতঃপর এলাকাবাসী পাকা সেতুর বদলে একটা বাঁশের সেতু নির্মাণের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দীর্ঘকাল আবেদন করে ব্যর্থ হয়। ওয়াপদার এই খালে বছরের আট মাসই মাথা-উঁচু পানি থাকে। অথচ এ এলাকার ২৫টি গ্রামের ১০ হাজার লোককে প্রতিদিন খালটি পার হয়ে যাতায়াত করতে হয়। অবশেষে এ এলাকার জনগণ নিজেদের উদ্যোগে একটি বাঁশের সাঁকো নির্মাণের উদ্দেশ্যে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির নেতৃত্বে এলাকাবাসীর কাছ থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয় এবং স্বেচ্ছাশ্রমে সাত দিনে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁশের সাঁকো নির্মিত হয়। এই সাঁকোর ওপর দিয়ে হেঁটে যাতায়াত করা ছাড়াও সাইকেল, মোটরসাইকেল ও রিকশা চলাচল করছে।
অন্য প্রতিবেদনটি এখন উল্লেখ করছি। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীর বরাবর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঘেঁষা ছয়টি গ্রাম এবং সেখানে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ তিনফসলি উর্বর জমিতে চাষাবাদ করে আসছে। যখনকার কথা লিখছি, তখন ৩০০ মিটার পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রবল জলস্রোতে ভেঙে গিয়েছিল এবং সেটি মেরামত ও আরো উঁচু করার উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প তৈরি করে খরচ বাবদ ৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অথচ ওই ৩০০ মিটার বাঁধ ভাঙার অজুহাতে ভাঙা অংশের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত অর্ধবৃত্তাকারে ৩ দশমিক ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বিকল্প বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। মূল বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে বিকল্প বাঁধটি আপনা-আপনি অনাবশ্যক হয়ে যাবে। বিকল্প বাঁধ নির্মিত হলে ওই ছয়টি গ্রামের বাসিন্দারা ভিটেমাটি, চাষাবাদের জমি হারিয়ে বাস্তুহারা হবে। অথচ এটা নির্মাণের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় জনগণ আন্দোলন করে সেটার নির্মাণ বন্ধ করেছিল।
প্রিয় পাঠক, উপরোউক্ত প্রতিবেদন দুটি পাঠের অভিজ্ঞতায় অর্থাৎ আরোহ পদ্ধতিতে আপনি একটি সিদ্ধান্তে পেঁৗছেছেন যে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের কাজ জনস্বার্থের তোয়াক্কা করে না। শুধু তা-ই নয়, কখনো জনগণকে বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে সে কাজ করতে হয়, কিংবা কখনো জনগণকে সরকারি কাজটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হয়। অতঃপর অবরোহী যুক্তিধারায় একটি সাধারণ সূত্রে আপনাকে পেঁৗছতেই হবে এবং সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে উচ্চারিত বাক্যটি 'জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক' একটি বিমূর্ত ধারণা। এই সূত্রটি একপেশে। কারণ সূত্রটি তৈরি হয়েছে সরকারের কাজের ভিত্তি কী হবে এই পরোক্ষ বিবেচনায়, কিন্তু প্রতিবেদন দুটিতে সরকারের কাজের বিপরীতে জনগণের প্রতিক্রিয়ার বিবেচনায় একটি বিপরীত সূত্র পাওয়া যাচ্ছে যে প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতা উপভোগের ক্ষমতা আছে এবং তিনি নিজেই তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টায় সেটি পেতে পারেন। এর সঙ্গে সহজেই দাবি করা যায়, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।
টলস্টয় তাঁর লেখা 'এ গ্রেট ইন্ইকুইটি' (চরম অবিচার) প্রবন্ধে রূপকাশ্রিত একটি গল্প বলেছেন : 'একদল মানুষ একপাল গরুকে, যাদের দুধে তৈরি খাদ্যে তাদের জীবনোপায়, একটি বেষ্টনীর ভেতরে তাদের তাড়িয়ে নিয়েছে। বেষ্টনীর ভেতরের বিচালি গরুরা খেয়ে ও পায়ে মাড়িয়ে শেষ করেছে, তারা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে একে অপরের লেজ চিবিয়েছে, তারা হাম্বা হাম্বা করছে আর বেষ্টনীর বাইরে অদূরে চারণভূমিতে যাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করছে। কিন্তু মানুষ, যারা ওই গরুদের দুধে বেঁচে আছে, বেষ্টনীর চারধারে পুদিনা, রঞ্জক ও তামাকের ক্ষেত করেছে; ফুলের আবাদ করেছে; ঘোড়দৌড়ের মাঠ, পার্ক, টেনিসের মাঠ তৈরি করেছে এবং তারা গরুগুলোকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না, পাছে এগুলো নষ্ট হয়।
অন্যদিকে গরুগুলো চিৎকার করছে, কৃশকায় হচ্ছে। অবশেষে মানুষ ভয় পেল, তারা আর দুধ পাবে না। সে কারণে গরুদের অবস্থা উন্নয়নে তারা নানা পরিকল্পনা নিল। তারা চাঁদোয়ার ব্যবস্থা করল, ভেজা বুরুশ দিয়ে গা মালিশ করল এবং দুধ দোয়ানোর সময় বদলে দিল। বৃদ্ধ ও রুগ্ণদের দেখাশোনা ও চিকিৎসায় তারা গুরুত্ব দিল। তারা দুগ্ধ-দোহনের আধুনিক পদ্ধতি বের করল। তা ছাড়া অতিরিক্ত পুষ্টিকর ঘাসের বীজ বপন করল। তারা এগুলো ও আরো বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করল, কিন্তু সরল কাজটি করল না_যেটা গুরু ও তাদের জন্যও অপরিহার্য_সেটা হচ্ছে, বেষ্টনীর বেড়াগুলো সরিয়ে ফেলা এবং গরুদের ইচ্ছামতো স্বাভাবিকভাবে চতুর্দিকের চারণভূমিকে ভোগ করতে দেওয়া।'
এই যে স্বাভাবিকভাবে জনগণকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করতে দেওয়া, তারই নকশা পাওয়া যাবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ দুটিতে, যেগুলোর নির্গলিতার্থ এই : ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যসাধনকল্পে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের দ্বারা অভিহিত ও নির্দিষ্ট-সংখ্যক জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রশাসনিক ইউনিটগুলোর দায়িত্বে থাকবে_(ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কাজ, (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং (গ) উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ৬০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিট বা স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা এই (ক) স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ (খ) বাজেট প্রস্তুতকরণ এবং (গ) নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করা, যা জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা ঠিক করা হবে। প্রিয় পাঠক, স্থানীয় সরকারের নকশাটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি বৈশিষ্ট্য এবং জাতীয় সংসদ কর্তৃক সেটি উপেক্ষিত হওয়াটাই বিচ্যুতি। জাতীয় সংসদ সেটা উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে এটা-ওটা আইন করছে, কিন্তু জনগণকে তাদের স্বাভাবিক সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে দিচ্ছে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগ, সুপ্রিমকোর্ট

No comments: