Friday, April 23, 2010

বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-৩

যুগের বাণী বাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-৩
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
প্রিয় পাঠক, প্রথম কিস্তির লেখাটির শুরুতে উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশের আদি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের প্রথম দফাটি : 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' ইতিপূর্বে প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির আলোচ্য বিষয় ছিল যথাক্রমে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। এবার তৃতীয় কিস্তির বিষয় হচ্ছে জাতীয়তা। প্রথমেই যে প্রশ্নটি হাজির হয়, সেটা হচ্ছে জাতি এই বিশেষার্থবোধক শব্দ বা পরিভাষাটির সংজ্ঞা কী? বর্তমানকালের নৃবিজ্ঞান কর্তৃক দেওয়া সংজ্ঞাটি এই : একদল লোক যাদের নিজস্ব সাধারণ ভাষা আছে এবং একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা আছে। অবশ্য তাদের একক কোনো সংস্কৃতি থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে এবং জাতি বর্ণগত উৎস এক নাও হতে পারে। সাধারণত তাদের একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকে, যাদের বৈধ, সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে।

দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে এ সংজ্ঞাটির হুবহু মিল নেই। বাংলাদেশে একাধিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়েছেন বাঙালি ছাড়া আরো রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুর-বগুড়া অঞ্চলের সাঁওতাল, ওরাওঁ ও রাজবংশী, সিলেটের মণিপুরি, পাঙন ও খাসিয়া, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের গারো ও হাজং এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মগ বা মারমা, কুকি, লুসাই, মুরং, টিপরা, সেন্দুজ, পাংখো, বনজোগি ও খুমি।
তবে এদের আদি পেশা চাষাবাদ এবং একাধারে তাঁরা কারুশিল্পী। তাঁরা ফসল উৎপাদন ও পরিচর্যা করেন কিংবা কারুকাজ করেন আপন আনন্দে, অন্তরের তাগিদে অর্থাৎ তাঁরা শ্রমকে ভালোবাসেন উত্তরাধিকার সূত্রে, অন্য কারণে নয় এবং সেই মতো অনুশীলন করেন। কায়িক শ্রম ও বুদ্ধি এবং বৃত্তিমূলক শ্রম তাঁদের কাছে বংশপরম্পরায় সমমর্যাদার।
ঐতিহাসিক ই এইচ কার বলেন, এ নামহীন লাখ লাখ ব্যক্তি হচ্ছেন মোটামুটি অচেতনভাবে একক ক্রিয়াশীল ব্যক্তি মানুষ এবং তাঁরা গড়ে তোলেন একটি সামাজিক শক্তি। সাধারণ পরিস্থিতিতে একটি অসন্তুষ্ট কৃষক বা একটি অসন্তুষ্ট গ্রামকে ঐতিহাসিকরা হিসাবে ধরবেন না। কিন্তু হাজার হাজার গ্রামে লাখ লাখ অসন্তুষ্ট কৃষক এমন একটি উপাদান, সেটিকে কোনো ঐতিহাসিক অগ্রাহ্য করবেন না। চিন্তাবিদ, লেখক আহমদ ছফা বলেন, 'আসল ব্যাপার হলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে ফেলার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছে।...কারণ, শুরু থেকেই এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে। সে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী তারা মুসলিম হোক, হিন্দু হোক, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী হোক সকলের জন্য সমান অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।'
প্রিয় পাঠক, উপরিউক্ত জাতীয়তার দর্শনের দৃষ্টিতে আসুন বাংলাদেশের আদি সংবিধান বিবেচনা করা যাক। অতএব পড়তে হয় সংবিধানের চারটি অনুচ্ছেদ, যাদের উদ্ধৃতি এই : 'জাতীয় সংস্কৃতি-২৩। রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তারাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারে।' 'জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন প্রভৃতি-২৪। বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিবৃতি, বিনাশ বা অপসরাণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।' জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধে জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় স্মৃতিনিদর্শনগুলোর প্রতি পরস্পর মমত্ববোধ, যার মাধ্যমে প্রতিটি জাতিসত্তা নিজেকে প্রকাশ করে, নিজেকে খুঁজে পায়। উপরিউক্ত অনুচ্ছেদ দুটি একত্রে একটি বিরাট মানবিক পরিকল্পনা, যার ফলস্বরূপ একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে নানা জাতির সম্মিলন ঘটে।
এখন আর দুটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। 'ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য-২৮। (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। (২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবে। (৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। (৪) নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।' 'সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা-২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবে না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। (৩) এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই_(ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে, (খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধানসংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে, (গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে, রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।'
প্রিয় পাঠক, লেখাটির শুরুতে জাতীয়তার যে সংজ্ঞা দিয়েছিলাম সেটাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা যাক ইতিহাসের এবং বাংলাদেশের সংবিধানের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোর সাহায্যে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে একটি লোকায়ত রাষ্ট্র গড়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ধারাবাহিক সংগ্রাম করেছেন। এই সংগ্রাম কখনো কখনো রক্তক্ষয়ী ছিল তাদের ও পেছনে এই আকাঙ্ক্ষা কার্যকরী ছিল, ধর্ম কিংবা জাতিসত্তা নির্বিশেষে সবার জন্য সর্বক্ষেত্রে সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেগুলোর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে। এটা আমাদের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং তারই ধারাবাহিকতায় সংবিধানের যে খসড়া বা বিল প্রণীত হয়েছিল সেখানে ৬ অনুচ্ছেদটি ছিল এই : 'বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। এটাই একটি লোকায়ত সমাজবাদী রাষ্ট্র কর্তৃক তার সকল নাগরিকদেরকে দেয়া সার্বজনীন স্বীকৃতি। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের তেরতম সংশোধনীর ১ অনুচ্ছেদ : সকল ব্যক্তি যারা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছেন কিংবা বৈধ অভিবাসী তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।'
একই কথা বলা হয়েছে ভারত রাষ্ট্রের সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে। উভয় দেশেই বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠী বাস করেন। কিন্তু সংবিধানে বিচ্যুতি দেখা গেল যখন চূড়ান্তভাবে সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ প্রণীত হলো : 'নাগরিকত্ব-৬। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবেন।' ৬ অনুচ্ছেদের শেষাংশটি প্রিয় পাঠক, একটু লক্ষ করলেই আপনার কাছে স্পষ্ট হবে, সংবিধানের উপরোক্ত ২৩, ২৪, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতঃপর এক সামরিক স্বৈরশাসক মূঢ়তার পরিচয় দিলেন ১৯৭৮ সালে ৬ অনুচ্ছেদের শেষাংশটি পরিবর্তন করে : 'বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।' বাংলাদেশ একটি ভৌগোলিক বাস্তবতা। অপরদিকে একই রাষ্ট্রে বহুমাত্রিক গোষ্ঠী বাস করে এবং তাদের বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া সত্ত্বেও তাদের বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি বলার অর্থ জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য অস্বীকার করা, অন্য অর্থে মুক্তিযুদ্ধকে উপেক্ষা করা।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ,
সুপ্রিম কোর্ট

No comments: