Tuesday, April 13, 2010

বাংলাদেশ সংবিধান ও পটভূমি (১)।। এম. আমীর-উল ইসলাম, আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা

বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি। এর মাঝে নিহিত আছে এদেশের মানুষের হাজারো বছরের লালিত আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা এবং তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম ও সুদূঢ় প্রত্যয়। আমাদের সংবিধান শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অসহায়ত্বের বেড়াজাল ভেদ করে জনগণের ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার দলিল_ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, শোষণ-শাসনের বাধা অতিক্রম করে মুক্তির জন্য যে ঐতিহাসিক সংগ্রাম, তার পথ ধরে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা। বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক দলিল_ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে জাতির জনকের স্বাধীনতার ঘোষণা। পৃথিবীর ইতিহাসে দুইটি মাত্র দেশ, যাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে। একটি আমেরিকার declaration of independence এবং অন্যটি বাংলাদেশের Proclamation of independence-এর ভিত্তিতে রচিত আমাদের সাংবিধান। বাংলাদেশের জনগণের হাজার বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাসে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার শাসকগোষ্ঠী বার বার ব্যাহত করেছে। জনগণ সে বাধা মেনে নেয়নি। এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে সংগ্রাম, আর সংগ্রামের পথে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতায়নের স্থানটি বলবত হয়েছে; যা ঠাঁই পেয়েছে আমাদের সংবিধানে। সকলকে জানান দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে "প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ (অনুচ্ছেদ-৭)।"
অষ্টম সংশোধনী মামলায় বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের রায়ে ৩২৫, ৩২৬ এবং ৩২৭ অনুচ্ছেদে (সংযুক্ত) এই ইতিহাসের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে তা উল্লেখযোগ্য। কারণ সেই পটভূমি না জানা থাকলে এবং আমাদের মুক্তির ইতিহাস অচেনা থাকলে একদিকে যেমন জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, তেমনি সংবিধানের ওপর বার বার যে আঘাত এসেছে (বিশেষ করে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে) সেগুলোর সূত্র বা প্রেক্ষিত আমরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হব।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিয়ে একদিকে বাঙালীর ভাষা ও ক্ষমতার ওপর আঘাত; অপরদিকে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। দ্বিতীয় আঘাত হানা হয় ১৯৫৪ সালে। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয় ও মুসলিম লীগের চরম ভরাডুবি হওয়ার পরও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ধূলিসাত করে নির্বাচিত আইনসভা, মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে গবর্নরের শাসন চালু করা হয়। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সবচেয়ে মারাত্মক স্খলন ঘটে ১৯৫৫ সালের মে মাসে ।। একমাত্র সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত গণপরিষদকে ভেঙ্গে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি পাকিসত্মান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সঙ্কটের প্রথম সূত্রপাত। ঐ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সিন্ধু হাইকোর্টে মৌলভী তমিজউদ্দিন খান একটি মামলা দায়ের করেন। সে মামলার রায়ে গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টের চীফ জাস্টিস মুনির যে রায় দেন, সেই রায়ে বলা হয়, রিট মামলা দায়ের করার কোন এখতিয়ার নেই। কারণ পাকিস্তানের গণপরিষদে ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনের ২২৩ (ক) ধারা সংযোজনের মাধ্যমে হাইকোর্টকে রিট মামলার যে এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল, সে এখতিয়ার প্রদান করাই ছিল অসাংবিধানিক কাজ। ত্রুটি হিসাবে উল্লেখ করা হয় ভারত শাসন আইনের উক্ত রূপ সংশোধনীতে গবর্নর জেনারেলের কোন দস্তখত নাই। শুধুমাত্র স্পীকারের দস্তখতে প্রণীত আইন বৈধ হতে পারে না মর্মে প্রধান বিচারপতি যুক্তি প্রদর্শন করেন। অথচ পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নসহ আইন প্রণয়নের সকল ক্ষমতা তৎকালীন গণপরিষদের ওপর ন্যন্ত ছিল। এছাড়া উল্লেখ্য, ঐ সময়কালে যে ৩৮টি আইন প্রণীত হয় তা একইভাবে গৃহীত ও স্বীকৃত ছিল। এমনকি প্রিভি কাউন্সিলের এখতিয়ার বিলুপ্ত আইন, যার দ্বারা পাকিস্তান ফেডারেল কোর্ট সর্বোচ্চ আদালত হিসাবে পরিগণিত হয়, সে আইনও একইভাবে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত ও স্পীকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত। ইতোমধ্যে ঐ সকল আইনের অধীনে বহু রিট মামলায় শুনানি ও নিষ্পত্তি ঘটেছে এবং ফেডারেল কোর্টের কোন রায়েই এই সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে কোনরূপ প্রশ্ন তোলা হয় নাই। জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার গণপরিষদ কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত থাকার কথা ছিল। পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করবার এখতিয়ার ও আইনানুগ সরকার গঠন করার ম্যান্ডেট ছিল গণপরিষদের ওপর। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন গবর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সার্বভৌম গণপরিষদকেই ভেঙ্গে দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির শুরুতেই এর সংবিধানের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করেন। আর সেই অসাংবিধানিক কাজকে ফেডারেল কোর্ট বৈধতা দেবার ফলে পাকিস্তানের জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকায় সাংবিধানিক শূন্যতা ও চরম হতাশার সৃষ্টি হয়। এর পর সাংবিধানিক স্খলনের একটার পর একটা পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে, যার পরিণতি থেকে পাকিস্তান আজও পরিত্রাণ পায়নি। এর পর থেকে জনগণ ও শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। পরবর্তীতে পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টের রেফারেন্স মামলার রায় অনুযায়ী সঙ্কট উত্তরণের পন্থা হিসাবে পাকিস্তানের বিভিন্ন এ্যাসেম্বলি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা নতুন গণপরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত গণপরিষদ ১৯৫৬ সনে পাকিস্তানের জন্য প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করে। প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার কথা ছিল ১৯৫৬ সালের নবেম্বরে। বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচন পেছাতে পেছাতে সর্বশেষ সময় নির্ধারিত হয় ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু ইতোমধ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মিজর্ ও সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান মিলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সামরিক শাসন জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ তথা পাকিস্তানের জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার হারালো। আবারও এক নতুন বঞ্চনার শিকার হলো।
এমনিভাবে বাংলাদেশের আপামর জনগণ বার বার আত্ননিয়ন্ত্রণ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয় পাকিস্তানের সর্বঅঞ্চলের জনগণ। সর্বাধিক বঞ্চনার শিকার বাংলার মানুষ। সামরিক আইনের দুঃশাসন, সেই সাথে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের সর্বগ্রাসী থাবা বাংলার মানুষের কাছে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়_ 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন?' আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম দফায় ছিল 'একটি মানুষ, একটি ভোট।' ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকারের আন্দোলন এবং তা থেকে আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। পাকিস্তানের ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়েরই পুনরাবৃত্তি ঘটলো ১৯৭১ সালে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না। নির্বাচিত গণপরিষদের পূর্বনির্ধারিত ৩ মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে নিরপরাধ মানুষের ওপর জিঘাংসা ও অত্যাচারী; সামরিক বাহিনী হিংস্র দমননীতির আশ্রয় নিল। একদিকে গণহত্যা, নরহত্যা, ধর্ষণ অপরদিকে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে নগরের সকল বস্তি এবং গ্রামকে গ্রাম জালিয়ে দেয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের বিরুদ্ধে যে বাধা, তা উন্মোচনের সংগ্রামই ছিল বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন। তা থেকেই সৃষ্টি হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্রোতধারা। ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও ১৯৬৬ সালে প্রণীত অঙ্গীকারনামায় বর্ণিত আত্ননিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞায়নে বাংলাদেশ হয়ে উঠল এক নতুন দৃষ্টান্ত। আত্ননিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানসহ নির্ণয় করতে পারবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পন্থা ও কৌশল_ এটাই পরিণত হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনগণের দৃঢ় ও অদম্য সঙ্কল্পে।
আমাদের সংবিধান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সৃষ্টি এক রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রেক্ষিতে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ তারিখ থেকে কার্যকর এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা দৃঢ়ভাবে অনুমোদন ও সমর্থন করা হয়। এই ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অস্থায়ী সংবিধান ঘোষণা করা হয়, যেখানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের স্বীকৃতি রয়েছে। একইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সমর্থন ও স্বীকৃতি মেলে সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম বাক্যে এবং সংবিধানের ১৫০ (৩) অনুচ্ছেদে। যেখানে বলা হয়েছে, "স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং তাহা আইন অনুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রযুক্ত ও কৃত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল।" সে কারণে ৮ম সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারপতি জনাব বদরুল হায়দার চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র-কে বলেছেন “Genesis of Constitution এবং এ কারণে আমাদের Constitution unique। ঐ রায়ে বলা হয়েছে, Bangadesh Constitution is an autochthonous Constitution.
কোন আন্তর্জাতিক দলিলে বা আইনে একই অনুচ্ছেদের পুনরাবৃত্তি বিরল। কিন্তু nternational Covenants on Civil and Political Rights I International Covenants on Economic Social and Cultural Right-এর দু'টি দলিলেরই প্রথম অনুচ্ছেদে একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও তাদের পছন্দমতো সরকার গঠনের অধিকার নিশ্চিত না হলে নাগরিক বা রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। জনগণ যাতে নিয়মমাফিক ও আইনানুগভাবে এই আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে পারে, সে লক্ষ্যে নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী আইনের শাসন তথা সকলের নাগরিক, মানবিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার যেন অক্ষুণ্ন রাখতে পারে তা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তথা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণয়নের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতা আংশিক জনগণ এবং পরবর্তীতে সংবিধানে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থান লাভ করেছে যেমন মানবিক মর্যাদা, তা অন্য কোন সংবিধানে এমনভাবে উল্লিখিত নেই। জনগণের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রাধান্য লাভ করে। তারই সফল পুনঃ উচ্চারণ ঘটে আমাদের সংবিধানে। এ সবই জনগণের দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল। বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল বার বার অসাংবিধানিক চোরাগলিতে ছিনতাই হবার বিপদ মাথায় নিয়ে বাংলার জনগণ জাগ্রত প্রহরীর মতো সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব নানাভাবে রক্ষা করে চলেছে। তাদের এ অধিকার সমুন্নত রাখতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তারা বার বার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে এবং বার বার রক্ত দিয়েছে। জীবন দিয়ে রক্ষা করেছে দেশের জনগণের সাংবিধানিক সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের মূল দলিলে এবং এর প্রস্তাবনায় যে মৌলিক মূল্যবোধের কথা বলা হয়েছে তা আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তি। সংবিধানের ভিত্তি দুই দুইবার সামরিক ডিক্রীর মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। এ সম্পর্কে অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে দেয়া আমার যুক্তি ও বক্তব্য সমর্থনমূলক ভাষায় প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তাঁর 8th Amendment Case Judgement, Para 324-এ উল্লেখ করেছেন :
“Mr. M. Amir-Ul Islam has referred to the Proclamation of Independence dated 10 April 1971 made when the War of Independence began. This document and the Constitution including its Preamble show the principles and ideals for which our national martyrs sacrified their lives and our brave people dedicated themselves to the said war. Essential features of these documents are People’s Sovereignty, Constitution’s supremacy, Independent Judiciary, Democratic Politics based on free election and justice. He has emphasized the fact that these fundamental principles were not followed, and the basic rights were denied to us, during the Pakistan regime and that is why the war of Independence was fought and won and consequently these rights and principles have been enshrined in the Constitution as the solemn expression of the people’s will and that these objectives are intended to last for all time to come and not to be scraped by any means including amendment of the Constitution.”
বাংলাদেশের অভু্যদয়ের মূল যুক্তি জনগণের আত্ননিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা। আমরা যদি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির পটভূমি স্মরণ করি, তাহলে সঠিকভাবে সংবিধান বুঝতে ও আত্মস্থ করতে সক্ষম হব। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণর লক্ষ্য ও চেতনা সংবিধানের প্রসত্মাবনা এবং তার প্রতিফলিত চেতনায় উদ্দীপ্ত ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সে ক্ষমতা সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হিসাবে জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার তথা ন্যায়ানুগ সরকার প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিশ্চিতকরণের জন্য প্রণীত হয়েছে আমাদের সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধানকে এমনভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে যে, এর প্রস্তাবনা ব্যতিরেকে এগারোটি ভাগে এটা বিভক্ত। প্রথম ভাগে প্রজাতন্তের চরিত্রের বিবরণ, ৭ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্তের মৌলিক চরিত্রের নির্দেশনা এবং ১১ অনুচ্ছেদে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ১১ অনুচ্ছেদের একটি বাক্যের মাধ্যমে অনেক প্রশ্নের জবাব মেলে। যেমন, প্রজাতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? উত্তর মেলে_ গণতন্ত্র। এ উত্তরের সাথে ৭ অনুচ্ছেদের একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে। ''প্রজাতনন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে ক্ষমতা প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।'' প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী, আইন প্রণয়ন এবং বিচারিক_ এই তিন ধরনের ক্ষমতা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব ক্ষমতা নয়। শুধু জনগণের পক্ষে এবং জনগণের কল্যাণে সংবিধানের অধীন আইনানুগভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থ বা কারণে ক্ষমতার অপব্যাবহার সংবিধানবহির্ভূত বলে বিবেচিত হবে। সংবিধান এবং আইনবহির্ভূত যে কোন কাজ অবৈধ বলে ঘোষিত হবে। এরূপ ঘোষণা প্রদানের সাংবিধানিক দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যাস্ত। সংবিধান অনুসারে আইনসভার আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংবিধানবহির্ভূত আইন বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে অবৈধ বলে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে।
সুবিন্যাস্ত ক্ষমতা বিভাজনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল কার্যধারা ও উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে যথাক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মৌলিক অধিকারসমূহ বিধৃত হয়েছে। চতুর্থ ভাগে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর উপর সংবিধান অনুসারে ন্যাস্ত থাকবে। মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকবে এবং নির্বাহী বিভাগ সংসদের মাধ্যমে জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে।
পঞ্চম ভাগে আইন বিভাগ এবং ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে সংবিধানে সহজাতভাবে নির্মিত ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতি নিশ্চিত করেছে। তাই সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃক মাসদার হোসেন মামলার রায়ে ক্ষমতা পৃথকীকরণ, তথা বিচার বিভাগ পৃথক থাকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি কার্যকর করা হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মাধ্যমে এর যাত্রা মাত্র শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। তবে গোষ্ঠী ও শ্রেণীস্বার্থের চোরাবালিতে এর যাত্রা বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই পথে নানা বাধা। এগুলো অতিক্রম করার কৌশল প্রক্রিয়া সন্ধানে সকল স্তরের জনগণের ঐক্য ও সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। ৭ম, ৮ম ও ৯ম ভাগে যথাক্রমে নির্বাচন কমিশন গঠন, মহা-হিসাব নিয়ন্ত্রক ও সরকারী কর্ম বিভাগ ও তার নিয়োগ-পদায়ন, পদোন্নতি এবং নীতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণের জন্য সরকারী কর্মকমিশন গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপরোক্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের ওপর তদারকি তথা মনিটরিং করবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন স্বাধীন থাকবে। সরকারী অর্থ, সরকারী হিসাব বা অনুরূপ হিসাব মহা-নিয়ন্ত্রক কর্তৃক তদারকি ও পরীক্ষিত হবে। পাশাপাশি সংসদ আইনের মাধ্যমে মহা-হিসাব নিয়ন্ত্রককে আরও ক্ষমতা প্রদান করতে পারে।
বাংলাদেশের কর্ম বিভাগে একটি নিরপেক্ষ সরকারী কর্মকমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করা হবে। উপরোক্ত তিনটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে তদারকির ভূমিকা ছাড়াও সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান রয়েছে। দুই যুগ পার হয়ে গেছে আইন পাস হয়েছে; কিন্তু ন্যায়পাল আজ পর্যন্ত নিয়োগ হয়নি। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে নবম (ক) বিভাগে জরুরী অবস্থার বিধান সংযোজিত হয়েছে।
(ক্রমশ)
লেখক : আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা

No comments: