Wednesday, April 21, 2010

৭ শহীদের রক্তে ভেজা কারাকক্ষ

খাপড়া ওয়ার্ড
৭ শহীদের রক্তে ভেজা কারাকক্ষ
আনু মোস্তফা
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল দিনটি দেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিরুদ্ধে এ দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ছিলেন সোচ্চার। তাই প্রতিবাদী ও সক্রিয় বাম নেতাকর্মীদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে দেশের জেলখানা ভরে ফেলা হয়েছিল। তবে নিরাপত্তা ও অন্য সব কারণে বিপ্লবীদের নিয়ে রাখা হতো রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। নিরাপত্তার দিক থেকে রাজশাহী জেল ছিল শাসকদের অনুকূলে। এই কারাগারেই ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন সাত বামপন্থী রাজবন্দি। আহত হন আরো ৩১ জন। তাঁরা জেলের ভেতরে বন্দিদের ওপর চালিত নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের যে ওয়ার্ডে এসব বিপ্লবী নিহত হন, সেই ওয়ার্ডটির নাম ছিল খাপড়া ওয়ার্ড। সেই ওয়ার্ডের নামানুসারে বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড দিবস পালন করেন। রাজশাহী জেলের মধ্যে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহতদের স্মরণে স্বাধীনতার পর তৈরি হয় একটি শহীদ মিনার ও স্মৃতি ফলক। স্মৃতি ফলকে লেখা রয়েছে সাত শহীদের নাম। আহতদের নামও এখানে খোদাই করা রয়েছে। এই দিনে বাম রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে কারাগারের ভেতরে গিয়ে শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পালন করেন অন্য সব কর্মসূচিও।
জানা যায়, ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশের জেলখানাগুলোতে বন্দিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জেলের ভেতরে বন্দিদের ওপর জুলুম-নির্যাতন বাড়ছিল সেই সময়টায়। রাজশাহী জেলও তখন বিনা অপরাধে আটক বন্দিদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। বন্দিদের মধ্যে অনেক নারী কর্মীও তখন জেলে আটক ছিলেন। এসব রাজবন্দির প্রতি জেলখানায় নির্দয় আচরণ ও তাঁদের ওপর জুলুম-নির্যাতনসহ তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদিদের মর্যাদায় রাখা নিয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিরা আন্দোলন করে আসছিলেন অনেক দিন ধরে। এই সময়ে নাচোলের কৃষক আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রকেও রাজশাহী কারাগারে আনা হয়। ইলা মিত্রের ওপর রাজশাহী জেলেও চলে অমানবিক নির্যাতন। তা ছাড়া এই জেলে কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে মুসলমান ও হিন্দুসহ আদিবাসী বন্দিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে থাকে। রাজবন্দিরা এসব বুঝতে পেরে অনশনের হুমকি দেন কর্তৃপক্ষকে। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিরা ১৫ দিনের নোটিশে জেলখানায় নির্যাতন বন্ধসহ সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে উসকানি দেওয়ার প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠান। কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে বন্দিরা ১৯৫০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অনশন শুরু করেন। পরে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিলে বন্দিরা সেবারের মতো অনশন প্রত্যাহার করেন।
এদিকে রাজবন্দিদের দিয়ে ঘানি টানানো, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সেলে রাখাসহ নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫০ জন বন্দি ১৯৫০ সালের ৫ এপ্রিল অনশন শুরু করেন। পরে এক হাজারের বেশি বন্দি তাঁদের সঙ্গে অনশনে যোগ দেন। এই অনশন চলাকালীন ১৫ জন রাজবন্দিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের জন্য নির্ধারিত সেল বা ১৪ নম্বর সেলে রাখার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। এ খবর জানাজানি হলে বন্দিরা সেখানে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁরা প্রতিবাদ করেন। এ সময় বন্দিরা কারাগারে অনশনের পাশাপাশি ধর্মঘটও শুরু করেন। বলতে গেলে ওই সময় জেলখানার পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে জেল কর্তৃপক্ষও। তখন তারা আরো দমননীতি চালাতে শুরু করে।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল দিনটি ছিল বন্দিদের কাছে এক ভয়াবহ বেদনার দিন। এদিন সকাল ৯টার দিকে অবাঙালি জেল সুপার বিল, জেলার আবদুল মান্নান কারারক্ষীদের নিয়ে জেলের ভেতরে প্রবেশ করেন। জেল সুপার রাজবন্দিদের ১৪ নম্বর সেলে যেতে চাপপ্রয়োগ করেন। রাজবন্দিরা কনডেম সেলে যাওয়ার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি করলে জেল সুপার বিল হাতের ছড়ি দিয়ে বন্দিদের প্রহারে উদ্যত হন। এ সময় কয়েকজন বন্দি বিলের হাতের ছড়ি ধরে ফেলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন জেল সুপার। খাপড়া ওয়ার্ড প্রাঙ্গণে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন হানিফ শেখ, সুখেন ভট্টাচার্য, দেলওয়ার হোসেন, সুধীন ধর, বিজন সেন, কম্পরাম সিং ও আনোয়ার হোসেন। তাঁরা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী। জেলে পুলিশের গুলিতে আহত হন আরো ৩১ জন। আহতদের মধ্যে ছিলেন মনসুর হাবিব, নুরুন্নবী চৌধুরী, আবদুল হক, অমূল্য লাহিড়ী, বাবর আলী প্রমুখ। রাজশাহী জেলের বন্দিদের ওপর পুলিশের গুলির প্রতিবাদে সারা দেশে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। এই আন্দোলন দমনে শাসকগোষ্ঠী আরো মরিয়া হয়ে ওঠে।
জানা যায়, স্বাধীনতার পর কমরেড মণি সিং রাজশাহী জেলের মধ্যে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিফলক ও শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং এরশাদের সামরিক শাসনামলে জেলের ভেতরে খাপড়া ওয়ার্ড দিবসের সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি পালনের অনুমতি ছিল না। তবে ১৯৯৬ সালে সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা অনেক দিন পর প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড দিবস পালনে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশের অনুমতি লাভ করেন। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য ও রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আমরা প্রতিবছরই ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ড দিবসের কর্মসূচি পালন করি। এবারও করা হবে। মাঝে বেশ কয়েক বছর জোট সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জেলের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। এবার যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

No comments: