যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
একাত্তরে তাঁরা কে কোন দলে ছিলেন, কী করেছেন
প্রতীক ইজাজ ও উম্মুল ওয়ারা সুইটিএ
একাত্তরে নেতৃস্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিরা ছিলেন কয়েকটি ডানপন্থী দলের। দলগুলো হলো_জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) এবং মুসলিম লীগের কয়েকটি অংশ। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে এসব দলের নেতারাই গঠন করেছিলেন শান্তি কমিটি। জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে দেশব্যাপী গঠন করা হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। পাকিস্তানের সামরিক সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে রাজাকার বাহিনীকে আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করেছিল। এ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের জন্য মাসিক মাসোহারা নির্ধারিত ছিল এবং তা সরকারি কোষাগার থেকেই দেওয়া হতো। আলবদর ও আলশামস ছিল রাজাকার বাহিনীরই দুটি বিশেষ ব্রিগেড।
বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ একাত্তরে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা থেকে ওই নেতাদের তৎকালীন অবস্থান সম্পর্কে জানা গেছে।
গোলাম আযম : মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। একাত্তরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত এক সভায় পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য নতুন কর্মী বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। তাঁর ব্যক্তিগত পরামর্শ ও সক্রিয় সহযোগিতায় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর উদ্যোগে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। গোলাম আযম একাত্তরের ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানি আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার আহ্বান জানান। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের পর ১০ দিনের মধ্যে নুরুল আমিন, গোলাম আযম, ফরিদ আহমদ, খাজা খায়েরউদ্দীন, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ নেতা সামরিক প্রশাসক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মতিউর রহমান নিজামী : একাত্তরে ছিলেন নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই গঠন করা হয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির। আলবদর বাহিনীর গঠন প্রসঙ্গে একাত্তরের ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে এক নিবন্ধে নিজামী বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও ৩১৩ যুবকের সমন্বয়ে একেকটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ : একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর অপতৎপরতার ছবিও প্রকাশিত হয় একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে। ছবির ক্যাপশন ছিল_'গতকাল গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি প্রদান করিয়া আলবদর আয়োজিত পথসভায় বক্তৃতা করিতেছেন আলবদর প্রধান জনাব মুজাহিদ।' এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান। জামালপুরে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে, যার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' শীর্ষক বইয়ের ১১১-১১২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে জানা যায়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বেই ময়মনসিংহ জেলার সব ছাত্রসংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ কে এম ইউসুফ : একাত্তরের মে মাসে তিনিই প্রথম জামায়াতের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। খুলনার তৎকালীন ভূতেরবাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টার) ছিল তাঁর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য গঠিত ডা. মালেক মন্ত্রিসভার রাজস্ব মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
মাওলানা হাবিবুর রহমান : চুয়াডাঙ্গার হাবিবুর রহমান একাত্তরে ছিলেন জেলার জীবননগর উপজেলা শান্তি কমিটির সদস্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে যাঁদের শাস্তি হয়েছিল তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। অভিযোগ আছে, তাঁর নেতৃত্বেই কয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাককে হাসাদহ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়।
রিয়াছাত আলী বিশ্বাস : তিনি ছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে কালীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইউনুসকে হত্যা করার। তাঁর তত্ত্বাবধানেই একাত্তরের জুলাই মাসে পাকিস্তানি সেনারা গানবোটে চড়ে প্রতাপনগর গ্রামে হানা দিয়েছিল বলে গণআদালতে সাক্ষ্য দেন সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক আহ্বায়ক মহিয়ার রহমান।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের সিলেট জেলা সভাপতি এবং সিলেট আলবদর বাহিনীর কমান্ডার। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের খাদিমপাড়ার ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে সভা করে ফরিদ উদ্দিন আলবদর বাহিনী গঠন করেন এবং পাকিমআনি সেনাদের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন ও সম্পদ লুটপাটে অংশ নেন।
অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুস : একাত্তরে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির ২৩ নম্বর সদস্য। ছিলেন রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক ও আলবদর বাহিনীর নেতা। বাগেরহাটের একটি কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর নেতা হিসেবে বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন।
আবদুল আলীম : জয়পুরহাট মহকুমা (বর্তমান জেলা) শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িটি তখন ছিল জয়পুরহাটের রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প। আবদুল আলীমই ওই এলাকায় রাজাকার রিক্রুট করেছিলেন। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা গেছে, একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনারা সড়ক থেকে ২৬ নিরীহ গাড়োয়ালকে আবদুল আলীমের বাড়ির চাতালে তিন-চার দিন আটকে রাখার পর খঞ্জনপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল আলীম ও তাঁর সহযোগীরা জয়পুরহাটের মঙ্গলবাড়ী গ্রাম থেকে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে দুটি ট্রাকে করে জয়পুরহাটের শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছিল। পরে তাঁর নির্দেশে ওখানেই ২৬ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী : মুসলিম লীগের ব্যানারে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করেন এ দুই ভাই। তাঁদের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী (মৃত) ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক শামসুল আরেফিনের প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে সালাউদ্দিন কাদেরদের বাসায় (গুডস হিল) পাকিস্তানি বাহিনীর এক প্লাটুন সেনা মোতায়েন থাকত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সাকার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজাফফর ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে সড়ক থেকে ধরে হাটহাজারী ক্যাম্পে নিয়ে মেরে ফেলা হয়। গুডস হিল নামের ওই বাড়িটি ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ওই বাড়িতেই একাত্তরের ১৭ জুলাই ছাত্রনেতা ফারুককে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় হত্যা করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষকে ধরে এ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো। মেয়েদের তুলে দেওয়া হতো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।
মাওলানা আব্দুস সোবহান : একাত্তরে তিনি পাবনা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন। তিনি পাবনা শান্তি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাবনায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত গ্রন্থ 'একাত্তরের রাজাকারদের ২০০১ নির্বাচনে বর্জন করুন' থেকে জানা গেছে, ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাবনায় সোবহানের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী : ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা যায়, পিরোজপুরে নিজ এলাকায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠনে সার্বিক সহযোগিতা করেন সাঈদী। চার সহযোগী নিয়ে 'পাঁচ তহবিল' নামে একটি সংগঠন গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুদের বাড়িঘর দখল ও সম্পদ লুট করতেন। লুণ্ঠিত এসব সম্পদ 'গণিমতের মাল' আখ্যা দিয়ে সাঈদী নিজে ভোগ এবং পাড়েরহাট বন্দরে এসব বিক্রি করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি এলাকার পাড়েরহাট বন্দরের বিপদ সাহার বাড়ি দখল করে সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে বসেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারের তালিকা তৈরিসহ মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে সেনা ক্যাম্পে দিয়ে আসতেন।
আব্দুল কাদের মোল্লা : একাত্তরে ঢাকার মিরপুরে বিহারিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ওই সময় মিরপুরের বাসিন্দাদের কাছে তিনি 'জল্লাদ' ও 'কসাই' নামে পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ আছে, শিয়ালবাড়ী, রূপনগরসহ মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন কাদের মোল্লা।
এ বি এম খালেক মজুমদার : একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর অফিস সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি আলবদর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ডা. এম এ হাসানের বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খালেক মজুমদারের নেতৃত্বে একদল আলবদর পুরান ঢাকার ২৯ নম্বর কায়েতটুলী থেকে সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
মীর কাসেম আলী : আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি ক্যাম্প গঠন করে আলবদর ও রাজাকার রিক্রুট শুরু করেন। একাত্তরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে জানা গেছে, তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ১০টিরও বেশি গণহত্যা হয়েছিল। বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম সংগ্রহ এবং তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাদের তথ্য দিতেন। চট্টগ্রামের কুমিরায় এক রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ৪৫ জনকে হত্যা করা হয়।
একাত্তরে তাঁরা কে কোন দলে ছিলেন, কী করেছেন
প্রতীক ইজাজ ও উম্মুল ওয়ারা সুইটিএ
একাত্তরে নেতৃস্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিরা ছিলেন কয়েকটি ডানপন্থী দলের। দলগুলো হলো_জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) এবং মুসলিম লীগের কয়েকটি অংশ। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে এসব দলের নেতারাই গঠন করেছিলেন শান্তি কমিটি। জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে দেশব্যাপী গঠন করা হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। পাকিস্তানের সামরিক সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে রাজাকার বাহিনীকে আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করেছিল। এ বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের জন্য মাসিক মাসোহারা নির্ধারিত ছিল এবং তা সরকারি কোষাগার থেকেই দেওয়া হতো। আলবদর ও আলশামস ছিল রাজাকার বাহিনীরই দুটি বিশেষ ব্রিগেড।
বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থ এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ একাত্তরে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা থেকে ওই নেতাদের তৎকালীন অবস্থান সম্পর্কে জানা গেছে।
গোলাম আযম : মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। একাত্তরের ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত এক সভায় পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য নতুন কর্মী বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। (সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। তাঁর ব্যক্তিগত পরামর্শ ও সক্রিয় সহযোগিতায় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর উদ্যোগে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। গোলাম আযম একাত্তরের ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানি আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার আহ্বান জানান। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতের পর ১০ দিনের মধ্যে নুরুল আমিন, গোলাম আযম, ফরিদ আহমদ, খাজা খায়েরউদ্দীন, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ নেতা সামরিক প্রশাসক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
মতিউর রহমান নিজামী : একাত্তরে ছিলেন নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই গঠন করা হয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির। আলবদর বাহিনীর গঠন প্রসঙ্গে একাত্তরের ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে এক নিবন্ধে নিজামী বলেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও ৩১৩ যুবকের সমন্বয়ে একেকটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।'
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ : একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর অপতৎপরতার ছবিও প্রকাশিত হয় একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে। ছবির ক্যাপশন ছিল_'গতকাল গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি প্রদান করিয়া আলবদর আয়োজিত পথসভায় বক্তৃতা করিতেছেন আলবদর প্রধান জনাব মুজাহিদ।' এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের ময়মনসিংহ জেলার প্রধান। জামালপুরে প্রথম আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে, যার প্রধান সংগঠক ছিলেন তিনি। এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত 'একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়' শীর্ষক বইয়ের ১১১-১১২ নম্বর পৃষ্ঠা থেকে জানা যায়, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বেই ময়মনসিংহ জেলার সব ছাত্রসংঘ কর্মীকে আলবদর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এ কে এম ইউসুফ : একাত্তরের মে মাসে তিনিই প্রথম জামায়াতের ৯৬ জন ক্যাডার নিয়ে খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। খুলনার তৎকালীন ভূতেরবাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেডকোয়ার্টার) ছিল তাঁর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য গঠিত ডা. মালেক মন্ত্রিসভার রাজস্ব মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
মাওলানা হাবিবুর রহমান : চুয়াডাঙ্গার হাবিবুর রহমান একাত্তরে ছিলেন জেলার জীবননগর উপজেলা শান্তি কমিটির সদস্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে যাঁদের শাস্তি হয়েছিল তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। অভিযোগ আছে, তাঁর নেতৃত্বেই কয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাককে হাসাদহ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়।
রিয়াছাত আলী বিশ্বাস : তিনি ছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে কালীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইউনুসকে হত্যা করার। তাঁর তত্ত্বাবধানেই একাত্তরের জুলাই মাসে পাকিস্তানি সেনারা গানবোটে চড়ে প্রতাপনগর গ্রামে হানা দিয়েছিল বলে গণআদালতে সাক্ষ্য দেন সাতক্ষীরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক আহ্বায়ক মহিয়ার রহমান।
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী : একাত্তরে তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের সিলেট জেলা সভাপতি এবং সিলেট আলবদর বাহিনীর কমান্ডার। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণায় দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটের খাদিমপাড়ার ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে সভা করে ফরিদ উদ্দিন আলবদর বাহিনী গঠন করেন এবং পাকিমআনি সেনাদের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন ও সম্পদ লুটপাটে অংশ নেন।
অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুস : একাত্তরে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির ২৩ নম্বর সদস্য। ছিলেন রাজাকার বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক ও আলবদর বাহিনীর নেতা। বাগেরহাটের একটি কলেজে শিক্ষকতা করার সময় তিনি রাজাকার বাহিনীর নেতা হিসেবে বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন।
আবদুল আলীম : জয়পুরহাট মহকুমা (বর্তমান জেলা) শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িটি তখন ছিল জয়পুরহাটের রাজাকার রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প। আবদুল আলীমই ওই এলাকায় রাজাকার রিক্রুট করেছিলেন। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা গেছে, একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনারা সড়ক থেকে ২৬ নিরীহ গাড়োয়ালকে আবদুল আলীমের বাড়ির চাতালে তিন-চার দিন আটকে রাখার পর খঞ্জনপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল আলীম ও তাঁর সহযোগীরা জয়পুরহাটের মঙ্গলবাড়ী গ্রাম থেকে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে দুটি ট্রাকে করে জয়পুরহাটের শহর প্রদক্ষিণ করিয়েছিল। পরে তাঁর নির্দেশে ওখানেই ২৬ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী : মুসলিম লীগের ব্যানারে পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে কাজ করেন এ দুই ভাই। তাঁদের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী (মৃত) ছিলেন কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক শামসুল আরেফিনের প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে সালাউদ্দিন কাদেরদের বাসায় (গুডস হিল) পাকিস্তানি বাহিনীর এক প্লাটুন সেনা মোতায়েন থাকত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সাকার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজাফফর ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে সড়ক থেকে ধরে হাটহাজারী ক্যাম্পে নিয়ে মেরে ফেলা হয়। গুডস হিল নামের ওই বাড়িটি ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে নির্যাতনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ওই বাড়িতেই একাত্তরের ১৭ জুলাই ছাত্রনেতা ফারুককে সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় হত্যা করেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষকে ধরে এ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো। মেয়েদের তুলে দেওয়া হতো পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।
মাওলানা আব্দুস সোবহান : একাত্তরে তিনি পাবনা জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির ছিলেন। তিনি পাবনা শান্তি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাবনায় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গড়ে ওঠে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত গ্রন্থ 'একাত্তরের রাজাকারদের ২০০১ নির্বাচনে বর্জন করুন' থেকে জানা গেছে, ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাবনায় সোবহানের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী : ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির গবেষণা থেকে জানা যায়, পিরোজপুরে নিজ এলাকায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠনে সার্বিক সহযোগিতা করেন সাঈদী। চার সহযোগী নিয়ে 'পাঁচ তহবিল' নামে একটি সংগঠন গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী বাঙালি হিন্দুদের বাড়িঘর দখল ও সম্পদ লুট করতেন। লুণ্ঠিত এসব সম্পদ 'গণিমতের মাল' আখ্যা দিয়ে সাঈদী নিজে ভোগ এবং পাড়েরহাট বন্দরে এসব বিক্রি করে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি এলাকার পাড়েরহাট বন্দরের বিপদ সাহার বাড়ি দখল করে সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে বসেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারের তালিকা তৈরিসহ মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে সেনা ক্যাম্পে দিয়ে আসতেন।
আব্দুল কাদের মোল্লা : একাত্তরে ঢাকার মিরপুরে বিহারিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ওই সময় মিরপুরের বাসিন্দাদের কাছে তিনি 'জল্লাদ' ও 'কসাই' নামে পরিচিত ছিলেন। অভিযোগ আছে, শিয়ালবাড়ী, রূপনগরসহ মিরপুর এলাকায় হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন কাদের মোল্লা।
এ বি এম খালেক মজুমদার : একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর অফিস সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি আলবদর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ডা. এম এ হাসানের বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খালেক মজুমদারের নেতৃত্বে একদল আলবদর পুরান ঢাকার ২৯ নম্বর কায়েতটুলী থেকে সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।
মীর কাসেম আলী : আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি ক্যাম্প গঠন করে আলবদর ও রাজাকার রিক্রুট শুরু করেন। একাত্তরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রকাশিত পুস্তিকা থেকে জানা গেছে, তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ১০টিরও বেশি গণহত্যা হয়েছিল। বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নাম সংগ্রহ এবং তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাদের তথ্য দিতেন। চট্টগ্রামের কুমিরায় এক রাতে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে ৪৫ জনকে হত্যা করা হয়।
No comments:
Post a Comment