সংবাদ ভাষ্য গোলাম আযম তার কাজ করছেন সরকার কি তার কাজ করছে?
সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং সে কারণে অবশ্যই সরকার অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু, তারপরও প্রশ্ন আছে এবং এ প্রশ্নগুলো বিভিন্নভাবে মিডিয়ায় এসেছে। এর মূল কথা হলো সরকার কতটা প্রস্তুত?
এই সংবাদটি দৈনিক জনকণ্ঠ ছাড়া কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। খবরটির শিরোনাম 'হঠাৎ আসরে গোলাম আযম' [৭.৪.১০]। খবরের সারমর্ম এই যে গত সপ্তাহে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অনুমিতরা গোপনে একটি বৈঠক করে গোলাম আযমকে নিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামের ২৪ জন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন, বিএনপির মওদুদ আহমেদ। অবশ্য, তাকে বৈঠকে না ডাকলেও চলত। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেই হতো। বিএনপি জামায়াতের নির্দেশ অমান্য করবে না, করার সাহস বা সাধ্য কোনটিই নেই। পরে, একটি প্রতিনিধিদল বেগম জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাত করে। মওদুদ আহমদের উপস্থিতি ও তারপর বেগম জিয়াকে বৈঠকের ফলাফল জানানো দু'টি দিক তুলে ধরে। মওদুদ কোথাও থাকা মানে বিপর্যয় ঘটে যাওয়া বা ঘটানো। মূর্তিমান 'ইভিলে'র প্রতীক এই ব্যারিস্টার। অন্যদিকে, এটিও প্রমাণিত হলো, জামায়াতের মতো বিএনপিও ১৯৭১ সালের অপরাধসমূহের বিচারের বিরোধী। অর্থাৎ তাদের অবস্থান
সাধারণ মানুষের বিপক্ষে, পাকিস্তানীমনাদের পক্ষে। বিএনপিও রাজাকারদের দোসারদের দল হয়ে গেল! শুনেছি, বাচ্চা জামায়াতীরা এখন জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বলা পছন্দ করছে না। তেমনি বাচ্চা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরাও রাজাকার দোসর দল হিসেবে নিজেদের পছন্দ করছে না। কিন্তু তখন আর উপায় থাকবে না।
গোলাম আযমদের বৈঠকের মূল এজেন্ডা ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানো। চারটি কৌশলের বিষয়ে তারা একমত হয়েছে।
১. কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিচার ঠেকানো।
২. 'সরকারের বিভিন্ন দুর্বল দিকগুলি চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী সরকারকে ঘায়েল করা। এক্ষেত্রে রাজধানীতে পানি, বিদ্যুত ও গ্যাসকে প্রাধান্য দেয়া।'
৩. আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আইনবিদ যোগাড় করে প্যানেল গঠন করা
৪. এর কোনটিতে কাজ "না হলে সারাদেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে সরকারকে এবং পুরো দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে বিদেশী শক্তিকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।"
গোলাম আযমরা যা করছে তা খুবই স্বাভাবিক। গত তিন দশকে এই প্রথম একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তারা কখনই ভাবেনি ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিচারের সম্মুখীন হয়ত হতে হবে। এই 'হয়ত' যত সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে ততই জামায়াতের নেতারা শঙ্কিত হয়ে উঠছে। আমি এখানে 'অস্তিত্বের সঙ্কট' শব্দ দুটি ব্যবহার করিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে জামায়াতের প্রথম সারির সব নেতাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী ও খুনীদের দল হিসেবে এটি পরিচিত হয়ে উঠবে। এবং চিরতরে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কিন্তু, নতুন জামায়াতীরা থাকবে, দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে না সত্যি কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে তাদের দরকষাকষির যে সুযোগ তারা এত দিন পেয়ে আসছিল তা থাকবে না। সুতরাং এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য তারা যা যা দরকার তা করবে।
জামায়াতের ফ্রন্ট হিসেবে বিএনপিও নাজুক অবস্থায় পড়বে। বেগম জিয়া যতই আন্দোলনের হুমকি দেন না কেন বিচার শুরু হলে, যুদ্ধাপরাধীদের দায় বিএনপিকেও সামলাতে হবে কারণ বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব এই দায় নিজের কাঁধে নিয়েছে। বিভিন্ন কারণে যারা আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং বিএনপির সমর্থক তারা এই দায় নিতে নারাজ। সুতরাং সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠিক এই মুহূর্তে কতটা জোরদার হবে তাতে সন্দেহ আছে। জামায়াত-বিএনপি তাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে, এখন তারা তা কার্যকর করবে। কিন্তু, এর বিপরীতে সরকারের অবস্থান কি? বল এখন সরকারের কোর্টে। আমরা অনেকে ভেবেছিলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বললেও সরকার তাতে অগ্রসর হবে না। কিন্তু, সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং সে কারণে অবশ্যই সরকার অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু, তারপরও প্রশ্ন আছে এবং এ প্রশ্নগুলো বিভিন্নভাবে মিডিয়ায় এসেছে। এর মূল কথা হলো সরকার কতটা প্রস্তুত?
প্রথম কথা হলো, ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নে জামায়াতীরা আদালতে যেতে পারে। সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলবে। সেগুলো কুযুক্তি কী সুযুক্তি তার মধ্যে যাব না। কিন্তু, সাংবিধানিক প্রশ্নে কোন ফাঁকফোকর আছে কি-না তা কি সরকার ভালভাবে খতিয়ে দেখেছে?
দ্বিতীয়, অনেকের মনে হচ্ছে, এ বিচার সুচারুভাবে সম্পন্ন ও জামায়াত-বিএনপি কৌশল অকার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে সমন্বিত কোন কার্যক্রম নেয়া হয়নি। কারণ, সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হচ্ছে এবং এই সমন্বয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। তদনত্দ কমিটিও প্রসিকিউশন নিয়ে নানা খবর বেরুচ্ছে। অনেকের ধারণা, সরকারের অনেকের ধারণা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বোধহয় এক ধরনের ফৌজদারি মামলা। সরকার কি সম্পূর্ণভাবে এই ধারণা থেকে মুক্ত?
তৃতীয়, এই বিচার নস্যাতের জন্য জামায়াত বিএনপি ব্যাপক প্রচার করছে। বিচারের পক্ষে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছি। কিন্তু দল ও সরকার হিসেবে বিচারের পক্ষে সরকারের যে প্রবলভাবে নামা উচিত ছিল তা কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেন এই আড়ষ্টতা এর উত্তর কেউ খুঁজে পাচ্ছেন না।
জামায়াত-বিএনপির কর্মকৌশল আলোচনা করা যাক। কূটনৈতিক তৎপরতা জামায়াতীরা যে দীর্ঘদিন ধরে চালাচ্ছে এটা নতুন কোন কথা নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাংগঠনিকভাবে সে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। অন্তত দু' একটি দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন সদুত্তর পাইনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা বিবৃতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মন্তব্য করেছেন কিন্তু সেটিই কি যথেষ্ট? জামায়াত-বিএনপি সৌদি আরব এবং পাকিস্তানকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কিন্তু দু'টি দেশই স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছে এটি বাংলাদেশের ব্যাপার। এ দিকটায় মার খেয়েই জামায়াত খানিকটা বিচলিত। যুদ্ধ শুরু হলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, ব্যক্তি, রাষ্ট্র নানা বিষয়ে জানতে চাইবে। আমরা নিশ্চিত সরকার সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুত নয়।
সরকারের সব দিক সবল নয়_এটি সরকার না বুঝলেও আমরা বুঝি। আমলাতন্ত্র যে কাজ করছে না বা কাজ করানো যাচ্ছে না এটি মন্ত্রীরা না বুঝলেও আমরা বুঝি। গতানুগতিক একটি সরকার হয়েছে। মন্ত্রীরা এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয় বা এমন দক্ষ নয় যে, সরকারের নীতি তারা কার্যকর করতে চাইলেই পারবেন। পানি, বিদ্যুত, গ্যাস সমস্যায় সরকার বিপর্যসত্দ_এটি আমরা জানি। কিন্তু সমন্বিতভাবে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রী, দলের নেতারা কি তুলে ধরেছেন যে, পানির জন্য ২০০১-৮= সাত বছরে শোধনাগার হয়নি, বিদ্যুতের খাম্বা ছাড়া কিছুই লাগানো হয়নি এবং গ্যাস নেই, তারপরও এই নেই গ্যাসটুকু নিজামী খালেদা টাটাকে দিয়ে দিতে চেয়েছিল ভারতীয় পুঁজিপতিদের কাছে নতজানু হয়ে। না, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ সোচ্চার নন। গত আমলেও একই ব্যাপার ঘটেছে, অতি-কেন্দ্রিকরণ ও ভয় থেকেই বোধহয় সবাই চুপ থাকেন। প্রধানমন্ত্রী যদি এখন বলেন, যে এসব বিষয় যত সোচ্চারভাবে তুলে ধরবে, মন্ত্রিত্বের দিকে সে তত এগুবে এবং যে যত কম বলবে সে মন্ত্রিত্ব হারাবে, তা হলে হয়ত তা কোরামিনের কাজ করবে। তবে, নিজামী-খালেদা কিছু করেনি এটি জনমনের ক্ষোভ নিরসনে যথেষ্ট নয়। নিজামী-খালেদা অকর্মণ্য, লোভী দেখেই তো শেখ হাসিনাকে ভোট দেয়া হয়েছে। সরকার এই সঙ্কট নিরসনে কী করছে তাও তুলে ধরতে হবে।
জামায়াত-বিএনপি আইনী লড়াইয়ের কথা ভাবছে। তারা হাজার হাজার আইনবিদ নিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে। সেটি বাগাড়ম্বর। বাংলাদেশে জামায়াত করে এমন আইনজীবী হাজারও নেই। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় অনেক আইনজীবী হয়ত আসবে। আমাদের সরকার সে ক্ষেত্রে কী করছে? এক্ষেত্রে চিত্রটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কাগজে যা দেখেছি ও যা শুনেছি তাতে অনুমান করছি, আইন প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে একদিকে, আইনমন্ত্রী আরেক দিকে। প্রথমোক্তদের ধারণা, এ বিচার ফৌজদারি বিচারতুল্য সুতরাং নিম্ন আদালতের উকিলরাই যথেষ্ট। দ্বিতীয় পৰের ধারণা, এটি বিশেষ বিচার, বিশেষ আইনজীবী দরকার কিন্তু তার জন্য আনুষঙ্গিক কী কী উপাদান সে সব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে কী না সন্দেহ। প্রথমদিকে, আদালতের জায়গা নির্বাচন থেকেই তা স্পষ্ট। অবকাঠামোগত সুবিধাও প্রসিকিউটর, তদন্ত সংস্থা পায়নি। যারা দীর্ঘদিন এই আন্দোলন করেছেন তাদের নিয়ে বসে কী ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। তা নিয়েও সমন্বিত আলোচনা হয়নি। কেন যেন মনে হয় আমরা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত সরকার এতটাই গা-ছাড়া।
জামায়াত-বিএনপির শেষ কৌশল ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কাজ করা। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। বলার আছে এটুকু যে, এ দু'টি দল সবসময় ধ্বংসাত্মক কাজেই পারদর্শী, অভ্যস্ত। দেশ থেকে তাদের কাছে দল বড়, দল থেকে ব্যক্তি বড়। এদের ব্যারিস্টার, নেতা, জাঁদরেল নেতারা যেভাবে তারেক বন্দনা করেন তাতে লজ্জা হয়। তাদের অনেকের থেকে তো বটেই তাদের সনত্দানদের থেকেও হয়ত তারেক শিক্ষিত নয়, কোন গুণের কথাও শোনা যায়নি, অর্থ যোগাড় করা ছাড়া তাও তার মা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে। সরকার জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তা জোরদার করছে। কিন্তু ১৬ কোটির দেশে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারলেই নিরাপত্তা আসবে। অন্যথায় নয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিবাদ নির্মূল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রভাবহীন করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ে তোলা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো দৃঢ়করণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যারা বিশ্বাসী তাদের অস্তিত্ব রক্ষা_সবকিছু এই বিচারের ওপর নির্ভর করছে। নিছক ওয়াদা পূরণ ও জনচাপে কাজ করা এবং বিশ্বাস করে একবারের জন্য বিষয়টি মীমাংসা করা_এ দু'টির মধ্যে তফাৎ আছে। সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সত্ত্বেও প্রথম ধারণাটাই জনমনে এখনও রয়ে যাচ্ছে। এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি আমাদের অনেক দিনের, এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সহযোগী কিন্তু আমরা চাই না সরকারের কর্মকণ্ডে দ্বিতীয় বিষয়টি যেন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। ব্যর্থ হলে সরকার পতন অবশ্যম্ভাবী শুধু নয়, বিরাটসংখ্যক মানুষকে দেশত্যাগ করতে হবে এবং আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে বলে প্রায়ই দাবি করে তা চিরতরের জন্য বিলুপ্ত হবে।
সাধারণ মানুষের বিপক্ষে, পাকিস্তানীমনাদের পক্ষে। বিএনপিও রাজাকারদের দোসারদের দল হয়ে গেল! শুনেছি, বাচ্চা জামায়াতীরা এখন জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বলা পছন্দ করছে না। তেমনি বাচ্চা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীরাও রাজাকার দোসর দল হিসেবে নিজেদের পছন্দ করছে না। কিন্তু তখন আর উপায় থাকবে না।
গোলাম আযমদের বৈঠকের মূল এজেন্ডা ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানো। চারটি কৌশলের বিষয়ে তারা একমত হয়েছে।
১. কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বিচার ঠেকানো।
২. 'সরকারের বিভিন্ন দুর্বল দিকগুলি চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী সরকারকে ঘায়েল করা। এক্ষেত্রে রাজধানীতে পানি, বিদ্যুত ও গ্যাসকে প্রাধান্য দেয়া।'
৩. আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে আইনবিদ যোগাড় করে প্যানেল গঠন করা
৪. এর কোনটিতে কাজ "না হলে সারাদেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালিয়ে সরকারকে এবং পুরো দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে বিদেশী শক্তিকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।"
গোলাম আযমরা যা করছে তা খুবই স্বাভাবিক। গত তিন দশকে এই প্রথম একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তারা কখনই ভাবেনি ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, বিচারের সম্মুখীন হয়ত হতে হবে। এই 'হয়ত' যত সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে ততই জামায়াতের নেতারা শঙ্কিত হয়ে উঠছে। আমি এখানে 'অস্তিত্বের সঙ্কট' শব্দ দুটি ব্যবহার করিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে জামায়াতের প্রথম সারির সব নেতাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী ও খুনীদের দল হিসেবে এটি পরিচিত হয়ে উঠবে। এবং চিরতরে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে। দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। কিন্তু, নতুন জামায়াতীরা থাকবে, দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে না সত্যি কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে তাদের দরকষাকষির যে সুযোগ তারা এত দিন পেয়ে আসছিল তা থাকবে না। সুতরাং এই বিপর্যয় এড়াবার জন্য তারা যা যা দরকার তা করবে।
জামায়াতের ফ্রন্ট হিসেবে বিএনপিও নাজুক অবস্থায় পড়বে। বেগম জিয়া যতই আন্দোলনের হুমকি দেন না কেন বিচার শুরু হলে, যুদ্ধাপরাধীদের দায় বিএনপিকেও সামলাতে হবে কারণ বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব এই দায় নিজের কাঁধে নিয়েছে। বিভিন্ন কারণে যারা আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং বিএনপির সমর্থক তারা এই দায় নিতে নারাজ। সুতরাং সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠিক এই মুহূর্তে কতটা জোরদার হবে তাতে সন্দেহ আছে। জামায়াত-বিএনপি তাদের কৌশল নির্ধারণ করেছে, এখন তারা তা কার্যকর করবে। কিন্তু, এর বিপরীতে সরকারের অবস্থান কি? বল এখন সরকারের কোর্টে। আমরা অনেকে ভেবেছিলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বললেও সরকার তাতে অগ্রসর হবে না। কিন্তু, সরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ এবং সে কারণে অবশ্যই সরকার অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু, তারপরও প্রশ্ন আছে এবং এ প্রশ্নগুলো বিভিন্নভাবে মিডিয়ায় এসেছে। এর মূল কথা হলো সরকার কতটা প্রস্তুত?
প্রথম কথা হলো, ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নে জামায়াতীরা আদালতে যেতে পারে। সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলবে। সেগুলো কুযুক্তি কী সুযুক্তি তার মধ্যে যাব না। কিন্তু, সাংবিধানিক প্রশ্নে কোন ফাঁকফোকর আছে কি-না তা কি সরকার ভালভাবে খতিয়ে দেখেছে?
দ্বিতীয়, অনেকের মনে হচ্ছে, এ বিচার সুচারুভাবে সম্পন্ন ও জামায়াত-বিএনপি কৌশল অকার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে সমন্বিত কোন কার্যক্রম নেয়া হয়নি। কারণ, সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হচ্ছে এবং এই সমন্বয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। তদনত্দ কমিটিও প্রসিকিউশন নিয়ে নানা খবর বেরুচ্ছে। অনেকের ধারণা, সরকারের অনেকের ধারণা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বোধহয় এক ধরনের ফৌজদারি মামলা। সরকার কি সম্পূর্ণভাবে এই ধারণা থেকে মুক্ত?
তৃতীয়, এই বিচার নস্যাতের জন্য জামায়াত বিএনপি ব্যাপক প্রচার করছে। বিচারের পক্ষে আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছি। কিন্তু দল ও সরকার হিসেবে বিচারের পক্ষে সরকারের যে প্রবলভাবে নামা উচিত ছিল তা কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেন এই আড়ষ্টতা এর উত্তর কেউ খুঁজে পাচ্ছেন না।
জামায়াত-বিএনপির কর্মকৌশল আলোচনা করা যাক। কূটনৈতিক তৎপরতা জামায়াতীরা যে দীর্ঘদিন ধরে চালাচ্ছে এটা নতুন কোন কথা নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাংগঠনিকভাবে সে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে আমাদের জানা নেই। অন্তত দু' একটি দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন সদুত্তর পাইনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা বিবৃতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে মন্তব্য করেছেন কিন্তু সেটিই কি যথেষ্ট? জামায়াত-বিএনপি সৌদি আরব এবং পাকিস্তানকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কিন্তু দু'টি দেশই স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছে এটি বাংলাদেশের ব্যাপার। এ দিকটায় মার খেয়েই জামায়াত খানিকটা বিচলিত। যুদ্ধ শুরু হলে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, ব্যক্তি, রাষ্ট্র নানা বিষয়ে জানতে চাইবে। আমরা নিশ্চিত সরকার সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুত নয়।
সরকারের সব দিক সবল নয়_এটি সরকার না বুঝলেও আমরা বুঝি। আমলাতন্ত্র যে কাজ করছে না বা কাজ করানো যাচ্ছে না এটি মন্ত্রীরা না বুঝলেও আমরা বুঝি। গতানুগতিক একটি সরকার হয়েছে। মন্ত্রীরা এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয় বা এমন দক্ষ নয় যে, সরকারের নীতি তারা কার্যকর করতে চাইলেই পারবেন। পানি, বিদ্যুত, গ্যাস সমস্যায় সরকার বিপর্যসত্দ_এটি আমরা জানি। কিন্তু সমন্বিতভাবে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রী, দলের নেতারা কি তুলে ধরেছেন যে, পানির জন্য ২০০১-৮= সাত বছরে শোধনাগার হয়নি, বিদ্যুতের খাম্বা ছাড়া কিছুই লাগানো হয়নি এবং গ্যাস নেই, তারপরও এই নেই গ্যাসটুকু নিজামী খালেদা টাটাকে দিয়ে দিতে চেয়েছিল ভারতীয় পুঁজিপতিদের কাছে নতজানু হয়ে। না, প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ সোচ্চার নন। গত আমলেও একই ব্যাপার ঘটেছে, অতি-কেন্দ্রিকরণ ও ভয় থেকেই বোধহয় সবাই চুপ থাকেন। প্রধানমন্ত্রী যদি এখন বলেন, যে এসব বিষয় যত সোচ্চারভাবে তুলে ধরবে, মন্ত্রিত্বের দিকে সে তত এগুবে এবং যে যত কম বলবে সে মন্ত্রিত্ব হারাবে, তা হলে হয়ত তা কোরামিনের কাজ করবে। তবে, নিজামী-খালেদা কিছু করেনি এটি জনমনের ক্ষোভ নিরসনে যথেষ্ট নয়। নিজামী-খালেদা অকর্মণ্য, লোভী দেখেই তো শেখ হাসিনাকে ভোট দেয়া হয়েছে। সরকার এই সঙ্কট নিরসনে কী করছে তাও তুলে ধরতে হবে।
জামায়াত-বিএনপি আইনী লড়াইয়ের কথা ভাবছে। তারা হাজার হাজার আইনবিদ নিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে। সেটি বাগাড়ম্বর। বাংলাদেশে জামায়াত করে এমন আইনজীবী হাজারও নেই। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় অনেক আইনজীবী হয়ত আসবে। আমাদের সরকার সে ক্ষেত্রে কী করছে? এক্ষেত্রে চিত্রটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কাগজে যা দেখেছি ও যা শুনেছি তাতে অনুমান করছি, আইন প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে একদিকে, আইনমন্ত্রী আরেক দিকে। প্রথমোক্তদের ধারণা, এ বিচার ফৌজদারি বিচারতুল্য সুতরাং নিম্ন আদালতের উকিলরাই যথেষ্ট। দ্বিতীয় পৰের ধারণা, এটি বিশেষ বিচার, বিশেষ আইনজীবী দরকার কিন্তু তার জন্য আনুষঙ্গিক কী কী উপাদান সে সব বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে কী না সন্দেহ। প্রথমদিকে, আদালতের জায়গা নির্বাচন থেকেই তা স্পষ্ট। অবকাঠামোগত সুবিধাও প্রসিকিউটর, তদন্ত সংস্থা পায়নি। যারা দীর্ঘদিন এই আন্দোলন করেছেন তাদের নিয়ে বসে কী ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। তা নিয়েও সমন্বিত আলোচনা হয়নি। কেন যেন মনে হয় আমরা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত সরকার এতটাই গা-ছাড়া।
জামায়াত-বিএনপির শেষ কৌশল ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কাজ করা। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। বলার আছে এটুকু যে, এ দু'টি দল সবসময় ধ্বংসাত্মক কাজেই পারদর্শী, অভ্যস্ত। দেশ থেকে তাদের কাছে দল বড়, দল থেকে ব্যক্তি বড়। এদের ব্যারিস্টার, নেতা, জাঁদরেল নেতারা যেভাবে তারেক বন্দনা করেন তাতে লজ্জা হয়। তাদের অনেকের থেকে তো বটেই তাদের সনত্দানদের থেকেও হয়ত তারেক শিক্ষিত নয়, কোন গুণের কথাও শোনা যায়নি, অর্থ যোগাড় করা ছাড়া তাও তার মা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বলে। সরকার জানিয়েছে, তারা নিরাপত্তা জোরদার করছে। কিন্তু ১৬ কোটির দেশে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারলেই নিরাপত্তা আসবে। অন্যথায় নয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিবাদ নির্মূল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রভাবহীন করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ে তোলা, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো দৃঢ়করণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যারা বিশ্বাসী তাদের অস্তিত্ব রক্ষা_সবকিছু এই বিচারের ওপর নির্ভর করছে। নিছক ওয়াদা পূরণ ও জনচাপে কাজ করা এবং বিশ্বাস করে একবারের জন্য বিষয়টি মীমাংসা করা_এ দু'টির মধ্যে তফাৎ আছে। সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সত্ত্বেও প্রথম ধারণাটাই জনমনে এখনও রয়ে যাচ্ছে। এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবি আমাদের অনেক দিনের, এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সহযোগী কিন্তু আমরা চাই না সরকারের কর্মকণ্ডে দ্বিতীয় বিষয়টি যেন পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। ব্যর্থ হলে সরকার পতন অবশ্যম্ভাবী শুধু নয়, বিরাটসংখ্যক মানুষকে দেশত্যাগ করতে হবে এবং আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে বলে প্রায়ই দাবি করে তা চিরতরের জন্য বিলুপ্ত হবে।
No comments:
Post a Comment