কেরানীগঞ্জের কুখ্যাত শাহিন এখন ভোলায় হাফিজের বাহিনীতে
ভোলা-৩ নির্বাচন
মামুন-অর-রশিদ / হাসিব রহমান, লালমোহন থেকে ॥ ভোলা-৩ লালমোহন তজুমদ্দিনের উপনির্বাচনকে ঘিরে চলছে গুজব, অপপ্রচার আর অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের খেলা। পরিত্যক্ত অবস্থায় অস্ত্র উদ্ধার হলেও বিরোধী মহল প্রচার করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতার গাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খোদ খালেদা জিয়া শাওনকে সন্ত্রাসী বললেও এখানে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে মেজর (অব) হাফিজের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা 'মৌমাছি বাহিনী'। গত দু'দিন যুবলীগের দু'জনকে কুপিয়েছে হাফিজের মৌমাছি বাহিনী। এছাড়া ঢাকার কেরানীগঞ্জের কুখ্যাত খুনী শাহীন ও হাফিজের মৌমাছি বাহিনীর প্রধান মার্শাল তারই বাসায় অবস্থান করছে। শাহীন আর মার্শালের স্থানীয় সহযোগীরা মিলে রেকি করছে। যে কোন রাতেই বড় ধরনের অপারেশন হতে পারে। বরিশালের এমপি মজিবুর রহমান সারোয়ার যেদিন এখানে এসেছিলেন সেদিন তিনি সাতটা শর্টগান নিয়ে এসেছিলেন বলে তার বহরের ড্রাইভার সূত্রে জানা গেছে। এলাকার সচেতন ভোটারদের কানে এসব খবর পৌঁছেছে। তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে কিনা এ ব্যাপারে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জয়-পরাজয় বড় কথা নয়, মূলকথা হচ্ছে, লালমোহন তজুমদ্দিনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিরোধী দল সরকারবিরোধী আন্দোলনের ইস্যু চায়। যে কথা বিএনপি চেয়ারপার্সন খোদ বেগম জিয়াই খুলনার জনসভায় বলেছেন। নাজিম উদ্দিন আলমের ওপর হামলার পর পরিস্থিতি শান্তই ছিল। কিন্তু গত দু'তিন দিনে বিএনপি মারাত্মক মারমুখী হয়ে উঠেছে। একের পর এক আঘাত হানছে সরকারী দলের নেতাকর্মীদের ওপর। নির্বাচন আর গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে দলীয় নেতাকর্মীদের একের পর এক কোপানোর পরও ধৈর্য ও সাহসিকতার চরম পরীক্ষা দিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। এদিকে র্যাব-পুলিশের টহলদারি জোরালো করা হয়েছে।
ম্যাকিয়াভ্যালির পথে হাফিজ ॥ নির্বাচন হোক বা না হোক তারা চায় একটি ইস্যু তৈরি করতে। নির্বাচনে জয় পরাজয় তাদের কাছে মুখ্য নয়, ইস্যু তৈরিই তাদের মূল লক্ষ্য । ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনলেও এলাকার চিত্র ভিন্ন। সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপি সমর্থকরা মিছিল করে ফেরার পথে যুবলীগ কর্মী জাকির হোসেনকে ওয়েস্টার্নপাড়ায় কুপিয়েছে, এর আগের দিন মানে রবিবার রাতে ছাত্রলীগ কর্মী ফরহাদকে ফরাশগঞ্জ ইউনিয়নে বিএনপি ক্যাডাররা কুপিয়েছে। ইতোমধ্যে বিএনপি প্রার্থী মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিনের কুখ্যাত মৌমাছি বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই বাহিনী সক্রিয় হওয়ার পর ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অজানা আতঙ্ক-শঙ্কা। অঘটন ঘটন পটিয়সী নেতা আমান উল্লাহ আমানের সকল অপারেশনের দক্ষিণ হস্ত পেশাদার খুনী শাহীন এখন হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে বিশ্রাম করছেন। হাফিজ উদ্দিনের দক্ষিণহস্ত তার ভাতিজা আরেক পেশাদার খুনী মার্শালও এখন এখন হাফিজ উদ্দিনের বাড়ির পাশে নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে অবস্থান করছে। ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুও যোগ দিয়েছে এই বাহিনীতে। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। গত ছয়বার এমপি থাকাকালীন হাফিজের মৌমাছি বাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী নতুন করে এই বাহিনীর আগমনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। দু'পক্ষেরই পেশী শক্তির কৌশলী মহড়ায় ভোট কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারদের আগমনের সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদীদের পরিকল্পিত অপপ্রচারে লালমোহন-তজুমদ্দিন এখন গুজবেরর শহরে রূপ নিয়েছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে দু'দলের কর্মী সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের অনেকের মধ্যে উত্তেজনাও বাড়ছে।
বিএনপি প্রার্থীর ভোটের হিসাব ॥ ভোটের হিসাবে মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন বীর প্রতীক মনে করছেন তাঁর বিজয় নিশ্চিত। টানা ছয়বার এই আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর ধারণা, প্রত্যেক বাড়িতে প্রত্যেক ঘরেই তাঁর ভোট রয়েছে। তাই তিনি শো-ডাউনের পরিবর্তে নিজে, তাঁর স্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনা করছেন। ক্ষমতা তত্ত্বেও সবগুলো উপাদানের সমন্বয় ঘটিয়ে অর্থ, অস্ত্র, ক্যাডারদের সমন্বয়ে খুব ঠান্ডা মাথায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে বিএনপি প্রার্থী। বিএনপির কয়েকটি টিম গতকাল বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ চালিয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোটের হিসাব ॥ অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন প্রতিদিনই ব্যাপক শো-ডাউন করছেন। বাংলা সিনেমায় নবাগত নায়কদের জাকজমক অভিষেকের মতই নতুন মুখ হিসাবে শাওনকে এলাকার নুরুনবী ও যুবকরা লুফে নিয়েছে। তবে দ্বারে দ্বারে শাওনের ক্যাম্পেইন কম। যদিও শাওন এ কথা অস্বীকার করেছেন। শাওনের বিশ্বাস, এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য হওয়ায় সবাই তাঁকে ভোট দেবে। বিরোধী প্রার্থীর সরকারদলীয় কর্মীদের ওপর একের পর এক হামলা প্রসঙ্গে শাওন বলেন, নেত্রীর নির্দেশে আমরা ধৈর্য ধরেছি। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করছি। প্রতিদিন আমাদের নেতাদের কোপানো কিংবা পেশাদার খুনীদের ভাড়ায় এনে জামাই আদরে পোষার জবাব ইচ্ছা করলে আমরা দিতে পারি। আমরা বিরোধী দলের শক্তি প্রয়োগের বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। লালমোহন-তজুমদ্দিনের জনগণ অনেক সচেতন। তারা ছ'বার একজনকে এমপি বানিয়ে দেখেছে। প্রত্যাশা প্রাপ্তির হিসাব মিলাতে পারেনি। তাই এবার তাঁরা নতুন মুখ চায়। যেটি বিজয়ের ব্যাপারে আমার মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন টিম জনসংযোগ অব্যাহত রেখেছে।
জ্যামিতিক সমীকরণে ভোটের হিসাব ॥ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ছয় বারের নির্বাচিত প্রার্থী হাফিজ উদ্দিন ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর (অব) জসিম পেয়েছিলেন ৯৬ হাজার ৩৪ ভোট। অন্যদিকে মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন পেয়েছিলেন ৮৩ হাজার ৯শ' ২৩ ভোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিশেষ বাহিনীর সহযোগিতায় হাফিজ উদ্দিন ৯৮ হাজার ৬শ' ৫৬ ভোট পেয়ে প্রায় ৪৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৭০ হাজার ৮শ' ৪৩ ভোট পেয়ে মাত্র ২৬ হাজার ভোটের ব্যাবধানে হাফিজ উদ্দিন জয়ী হন। এই পরিস্থিতে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনে হাফিজের ভোটের দুর্গে প্রথম পতন ঘটে।
লালমোহন এবং তজুমদ্দিন দু'টি আসন মিলিয়ে ভোলা-৩ আসন। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার ৯শ' ২৬। এর মধ্যে লালমোহনে ভোটারের সংখ্যা তজুমদ্দিনের চেয়ে অনেক বেশি। এই আসনে দু'উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে লালমোহনে রয়েছে ৯টি ইউনিয়ন। লালমোহনে মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮শ' ৯৩। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮১ হাজার ২শ' ৯২ এবং মহিলা ভোটার সংখ্যা ৮৬ হাজার ৬০১। লালমোহনে ভোট কেন্দ্র সংখ্যা ৫৬টি। অন্যদিকে তজুমদ্দিনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬৭ হাজার ৩৩। এখানে পুরুষ ভোটার ৩৩ হাজার ৫শ' ৮৮ এবং মহিলা ভোটার সংখ্যা ৩৩ হাজার ৪শ' ৪৫। তজুমদ্দিনে ৫টি ইউনিয়নে ৩০টি ভোট কেন্দ্র।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু'জন প্রার্থীর বাড়িই লালমোহনে। তজুমদ্দিনের কোন প্রার্থী নেই। লালমোহনের ৯টি ইউনিয়নে দু'দলের প্রার্থীই প্রায় সমান সমান ভোট পেতে পারেন বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। এ ক্ষেত্রে ফলাফল নির্ধারণের মুখ্য নিয়ন্ত্রক হবে তজুমদ্দিনের ভোট। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর (অব) জসিম উদ্দিন এই উপজেলায় বিপুল ভোট পাওয়ায় ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়। তজুমদ্দিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয়বার এমপি এবং জোট আমলে পানিমন্ত্রী থাকাকালে হাফিজ উদ্দিন তজুমদ্দিনের জন্য কিছু করেনি। এতে মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। ফলে ২৪ এপ্রিলের উপ-নির্বাচনে তজুমদ্দিনবাসী নৌকা প্রতীকে একচেটিয়া ভোট দিতে পারেন। যদি শেষ পর্যন্ত তা ঘটে তাহলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাওনের বিজয় সুনিশ্চিত। বিএনপির স্থানীয় নেতা এনায়েত কবির জোট আমলে যা করেছে তার খেসারত দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক আমলে। এখানে এনায়েত কবির নির্ভর হাফিজ উদ্দিনের নির্বাচনী প্রচারণা খুব গতি পাচ্ছে না।
সংখ্যালঘু ফ্যাক্টর ॥ এদিকে লালমোহন তজুমদ্দিনে কয়েকটি হিন্দু গ্রাম রয়েছে যেখানে শাওন একচেটিয়া ভোট পেতে পারেন। ২০০১ অক্টোবর নির্বাচনে হাফিজ উদ্দিনের বিজয়ের পর তার মৌমাছি বাহিনীর কাছে লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়ন, রায়চাঁদ, শম্ভূপুর, খালের হাট, দাশের হাট, সোনাপুর এলাকার সংখ্যালঘুরা সহায়-সম্পদ ও ইজ্জত সম্ভ্রম সর্বস্ব হারিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। সেদিন এ নিয়ে জনকণ্ঠ তখন ধারাবাহিক রিপোর্ট করেছিল। এই নির্যাতিত সম্ভ্রম হারাদের ভোটের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ হাজার। ভোট কেন্দ্রে না আসার জন্য বিএনপি প্রার্থীর পৰে এখনই তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে রাতের আঁধারে। সংখ্যালঘুদের ৩০ হাজার ভোটার ভোট দিতে পারলে তা পক্ষান্তরে শাওনের ব্যালট বাঙ্ ভারি করবে। লালমোহনের সচেতন নাগরিকদের অনেকের বক্তব্য, আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি ভোটের জন্য মিছিল, সমাবেশ, গণসংযোগ নির্বিঘ্নে করছে। অতীতের বিএনপি কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ এসে দাঁড়াতে পারত না। অবশ্য তোফায়েল আহমেদ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপির প্রার্থী পায়ে মাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চায়। আমরা গনতন্ত্রের স্বার্থে অনেক কিছুই সহ্য করে যাচ্ছি। তা ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির প্রকট অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মেজর (অব) জসিমের সঙ্গে বিরোধ নিরসন করা হয়েছে বর্তমান প্রার্থী শাওনের। তজুমদ্দিনে শাওন যাতে বেশি ভোট পায় তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর (অব) জসিমকে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার প্রচারনা পরিকল্পিত ও সমন্বিত।
এলাকাবাসীর বক্তব্য ॥ এদিকে লালমোহন সদরে মুচির কাজ করেন পরান বাবু, তার কাছে পরিস্থিতি জানতে চাইলে বলেন, ২৪ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কিন্তু কি ফল হতে পারে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, হাফিজ সাহেবকে ছয়বার দিয়ে দেখা হয়েছে। এবার মানুষ শাওন সাহেবকেই ভোট দেবে। সে নাকি প্রধানমন্ত্রীর খুব স্নেহধন্য। সে লালমোহনের গর্ব। একজন রিক্সাওয়ালার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যা খাই বাচি তা বাদ দিয়ে বৈঠা ধরে কি হবে। ঘুইঙ্গার হাটের এক মিস্টির দোকানী বলেন,দোকানে লালমোহন ও তজুমদ্দিনের যারা আসেন সবাই দেখছি শাওন সাহেবের কথা বলেন। নতুন মুখ হওয়ায় তার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের আগমন সংখ্যা হ্রাস পাবে সে ব্যাপারে কারও কোন সংশয় নেই।
ম্যাকিয়াভ্যালির পথে হাফিজ ॥ নির্বাচন হোক বা না হোক তারা চায় একটি ইস্যু তৈরি করতে। নির্বাচনে জয় পরাজয় তাদের কাছে মুখ্য নয়, ইস্যু তৈরিই তাদের মূল লক্ষ্য । ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনলেও এলাকার চিত্র ভিন্ন। সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপি সমর্থকরা মিছিল করে ফেরার পথে যুবলীগ কর্মী জাকির হোসেনকে ওয়েস্টার্নপাড়ায় কুপিয়েছে, এর আগের দিন মানে রবিবার রাতে ছাত্রলীগ কর্মী ফরহাদকে ফরাশগঞ্জ ইউনিয়নে বিএনপি ক্যাডাররা কুপিয়েছে। ইতোমধ্যে বিএনপি প্রার্থী মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিনের কুখ্যাত মৌমাছি বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই বাহিনী সক্রিয় হওয়ার পর ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অজানা আতঙ্ক-শঙ্কা। অঘটন ঘটন পটিয়সী নেতা আমান উল্লাহ আমানের সকল অপারেশনের দক্ষিণ হস্ত পেশাদার খুনী শাহীন এখন হাফিজ উদ্দিনের বাড়িতে বিশ্রাম করছেন। হাফিজ উদ্দিনের দক্ষিণহস্ত তার ভাতিজা আরেক পেশাদার খুনী মার্শালও এখন এখন হাফিজ উদ্দিনের বাড়ির পাশে নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে অবস্থান করছে। ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুও যোগ দিয়েছে এই বাহিনীতে। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। গত ছয়বার এমপি থাকাকালীন হাফিজের মৌমাছি বাহিনীর দোর্দণ্ড প্রতাপে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী নতুন করে এই বাহিনীর আগমনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। দু'পক্ষেরই পেশী শক্তির কৌশলী মহড়ায় ভোট কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারদের আগমনের সংখ্যা হ্রাস পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদীদের পরিকল্পিত অপপ্রচারে লালমোহন-তজুমদ্দিন এখন গুজবেরর শহরে রূপ নিয়েছে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে দু'দলের কর্মী সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের অনেকের মধ্যে উত্তেজনাও বাড়ছে।
বিএনপি প্রার্থীর ভোটের হিসাব ॥ ভোটের হিসাবে মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন বীর প্রতীক মনে করছেন তাঁর বিজয় নিশ্চিত। টানা ছয়বার এই আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর ধারণা, প্রত্যেক বাড়িতে প্রত্যেক ঘরেই তাঁর ভোট রয়েছে। তাই তিনি শো-ডাউনের পরিবর্তে নিজে, তাঁর স্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনা করছেন। ক্ষমতা তত্ত্বেও সবগুলো উপাদানের সমন্বয় ঘটিয়ে অর্থ, অস্ত্র, ক্যাডারদের সমন্বয়ে খুব ঠান্ডা মাথায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে বিএনপি প্রার্থী। বিএনপির কয়েকটি টিম গতকাল বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ চালিয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভোটের হিসাব ॥ অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন প্রতিদিনই ব্যাপক শো-ডাউন করছেন। বাংলা সিনেমায় নবাগত নায়কদের জাকজমক অভিষেকের মতই নতুন মুখ হিসাবে শাওনকে এলাকার নুরুনবী ও যুবকরা লুফে নিয়েছে। তবে দ্বারে দ্বারে শাওনের ক্যাম্পেইন কম। যদিও শাওন এ কথা অস্বীকার করেছেন। শাওনের বিশ্বাস, এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য হওয়ায় সবাই তাঁকে ভোট দেবে। বিরোধী প্রার্থীর সরকারদলীয় কর্মীদের ওপর একের পর এক হামলা প্রসঙ্গে শাওন বলেন, নেত্রীর নির্দেশে আমরা ধৈর্য ধরেছি। নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করছি। প্রতিদিন আমাদের নেতাদের কোপানো কিংবা পেশাদার খুনীদের ভাড়ায় এনে জামাই আদরে পোষার জবাব ইচ্ছা করলে আমরা দিতে পারি। আমরা বিরোধী দলের শক্তি প্রয়োগের বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। লালমোহন-তজুমদ্দিনের জনগণ অনেক সচেতন। তারা ছ'বার একজনকে এমপি বানিয়ে দেখেছে। প্রত্যাশা প্রাপ্তির হিসাব মিলাতে পারেনি। তাই এবার তাঁরা নতুন মুখ চায়। যেটি বিজয়ের ব্যাপারে আমার মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন টিম জনসংযোগ অব্যাহত রেখেছে।
জ্যামিতিক সমীকরণে ভোটের হিসাব ॥ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ছয় বারের নির্বাচিত প্রার্থী হাফিজ উদ্দিন ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর (অব) জসিম পেয়েছিলেন ৯৬ হাজার ৩৪ ভোট। অন্যদিকে মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন পেয়েছিলেন ৮৩ হাজার ৯শ' ২৩ ভোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিশেষ বাহিনীর সহযোগিতায় হাফিজ উদ্দিন ৯৮ হাজার ৬শ' ৫৬ ভোট পেয়ে প্রায় ৪৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৭০ হাজার ৮শ' ৪৩ ভোট পেয়ে মাত্র ২৬ হাজার ভোটের ব্যাবধানে হাফিজ উদ্দিন জয়ী হন। এই পরিস্থিতে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনে হাফিজের ভোটের দুর্গে প্রথম পতন ঘটে।
লালমোহন এবং তজুমদ্দিন দু'টি আসন মিলিয়ে ভোলা-৩ আসন। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার ৯শ' ২৬। এর মধ্যে লালমোহনে ভোটারের সংখ্যা তজুমদ্দিনের চেয়ে অনেক বেশি। এই আসনে দু'উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে লালমোহনে রয়েছে ৯টি ইউনিয়ন। লালমোহনে মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮শ' ৯৩। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৮১ হাজার ২শ' ৯২ এবং মহিলা ভোটার সংখ্যা ৮৬ হাজার ৬০১। লালমোহনে ভোট কেন্দ্র সংখ্যা ৫৬টি। অন্যদিকে তজুমদ্দিনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬৭ হাজার ৩৩। এখানে পুরুষ ভোটার ৩৩ হাজার ৫শ' ৮৮ এবং মহিলা ভোটার সংখ্যা ৩৩ হাজার ৪শ' ৪৫। তজুমদ্দিনে ৫টি ইউনিয়নে ৩০টি ভোট কেন্দ্র।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু'জন প্রার্থীর বাড়িই লালমোহনে। তজুমদ্দিনের কোন প্রার্থী নেই। লালমোহনের ৯টি ইউনিয়নে দু'দলের প্রার্থীই প্রায় সমান সমান ভোট পেতে পারেন বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। এ ক্ষেত্রে ফলাফল নির্ধারণের মুখ্য নিয়ন্ত্রক হবে তজুমদ্দিনের ভোট। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর (অব) জসিম উদ্দিন এই উপজেলায় বিপুল ভোট পাওয়ায় ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়। তজুমদ্দিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয়বার এমপি এবং জোট আমলে পানিমন্ত্রী থাকাকালে হাফিজ উদ্দিন তজুমদ্দিনের জন্য কিছু করেনি। এতে মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। ফলে ২৪ এপ্রিলের উপ-নির্বাচনে তজুমদ্দিনবাসী নৌকা প্রতীকে একচেটিয়া ভোট দিতে পারেন। যদি শেষ পর্যন্ত তা ঘটে তাহলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাওনের বিজয় সুনিশ্চিত। বিএনপির স্থানীয় নেতা এনায়েত কবির জোট আমলে যা করেছে তার খেসারত দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক আমলে। এখানে এনায়েত কবির নির্ভর হাফিজ উদ্দিনের নির্বাচনী প্রচারণা খুব গতি পাচ্ছে না।
সংখ্যালঘু ফ্যাক্টর ॥ এদিকে লালমোহন তজুমদ্দিনে কয়েকটি হিন্দু গ্রাম রয়েছে যেখানে শাওন একচেটিয়া ভোট পেতে পারেন। ২০০১ অক্টোবর নির্বাচনে হাফিজ উদ্দিনের বিজয়ের পর তার মৌমাছি বাহিনীর কাছে লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়ন, রায়চাঁদ, শম্ভূপুর, খালের হাট, দাশের হাট, সোনাপুর এলাকার সংখ্যালঘুরা সহায়-সম্পদ ও ইজ্জত সম্ভ্রম সর্বস্ব হারিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। সেদিন এ নিয়ে জনকণ্ঠ তখন ধারাবাহিক রিপোর্ট করেছিল। এই নির্যাতিত সম্ভ্রম হারাদের ভোটের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ হাজার। ভোট কেন্দ্রে না আসার জন্য বিএনপি প্রার্থীর পৰে এখনই তাদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে রাতের আঁধারে। সংখ্যালঘুদের ৩০ হাজার ভোটার ভোট দিতে পারলে তা পক্ষান্তরে শাওনের ব্যালট বাঙ্ ভারি করবে। লালমোহনের সচেতন নাগরিকদের অনেকের বক্তব্য, আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি ভোটের জন্য মিছিল, সমাবেশ, গণসংযোগ নির্বিঘ্নে করছে। অতীতের বিএনপি কর্মকাণ্ড বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগ এসে দাঁড়াতে পারত না। অবশ্য তোফায়েল আহমেদ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপির প্রার্থী পায়ে মাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চায়। আমরা গনতন্ত্রের স্বার্থে অনেক কিছুই সহ্য করে যাচ্ছি। তা ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির প্রকট অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মেজর (অব) জসিমের সঙ্গে বিরোধ নিরসন করা হয়েছে বর্তমান প্রার্থী শাওনের। তজুমদ্দিনে শাওন যাতে বেশি ভোট পায় তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর (অব) জসিমকে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার প্রচারনা পরিকল্পিত ও সমন্বিত।
এলাকাবাসীর বক্তব্য ॥ এদিকে লালমোহন সদরে মুচির কাজ করেন পরান বাবু, তার কাছে পরিস্থিতি জানতে চাইলে বলেন, ২৪ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কিন্তু কি ফল হতে পারে প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, হাফিজ সাহেবকে ছয়বার দিয়ে দেখা হয়েছে। এবার মানুষ শাওন সাহেবকেই ভোট দেবে। সে নাকি প্রধানমন্ত্রীর খুব স্নেহধন্য। সে লালমোহনের গর্ব। একজন রিক্সাওয়ালার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যা খাই বাচি তা বাদ দিয়ে বৈঠা ধরে কি হবে। ঘুইঙ্গার হাটের এক মিস্টির দোকানী বলেন,দোকানে লালমোহন ও তজুমদ্দিনের যারা আসেন সবাই দেখছি শাওন সাহেবের কথা বলেন। নতুন মুখ হওয়ায় তার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের আগমন সংখ্যা হ্রাস পাবে সে ব্যাপারে কারও কোন সংশয় নেই।
No comments:
Post a Comment