সাকার গুডস হিল ছিল মুক্তিযোদ্ধা টর্চারের বিশেষ সেল
সেই রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী
১১.০৪.২০১০
মোয়াজ্জেমুল হক/মামুন-অর-রশিদ ॥১১.০৪.২০১০
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত চট্টগ্রামের কুখ্যাত ফকা চৌধুরীর ছেলে সাকা চৌধুরী। চালিয়েছে ব্যাপক লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ। চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৭২টি মামলা। সেই সাকা দেশে সেনাশাসন ও গণতান্ত্রিক অপশাসনের ধারায় মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়ে নিজের গাড়িতে লাখো শহীদের রক্তস্নাত লাল সবুজের পতাকা ওড়ায়। ওআইসিতেও যেতে চেয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে। টেলিভিশন চ্যানেল খুলে মিডিয়াব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চায়। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের গুডস হিল ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের ধরে এনে পৈশাচিক নির্যাতনের অন্যতম কেন্দ্র। আর এ ঘৃণিত গুডস হিলের মালিক হচ্ছেন (পৈত্রিক সূত্রে) কুখ্যাত রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও তার সহোদররা। সাকা চৌধুরী বর্তমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় রীতিমতো বেপরোয়া মনোভাবের এ রাজাকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামে বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের হত্যা, নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালাও পোড়াওসহ নানা অপকর্মের মহানায়ক ছিলেন। ঐ সময়ে খোকন নামে সর্বাধিক পরিচিত এ রাজাকার সাকা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা, মানুষ হত্যা, লুণ্ঠনসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লন্ডনে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এমন একজন ধিক্কৃত ও ঘৃণিত ব্যক্তিকে স্বাধীন বাংলাদেশে মন্ত্রিত্বের আসীন করেছিল এরশাদ সরকার এবং পরবতর্ীতে বিএনপি সরকার। সাকা চৌধুরীর অপকর্ম শুধু চট্টগ্রাম শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তাঁর গ্রামের বাড়ি রাউজানে তিনি জন্ম দিয়েছেন বীভৎস নানা ঘটনার। এ রাউজানের ঊনসত্তরপাড়া এলাকাটি মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ নির্মমতার শিকার হয়ে বধ্যভূমির পরিচিতি লাভ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাকার বাবা ফকা দেড় টন স্বর্ণ নিয়ে নৌপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েন। পরে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রৰাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়।
একাত্তরে সাকার গতিবিধি ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণকারী পাকবাহিনীর অন্যতম দোসর ছিলেন সাকার বাবা তৎকালীন মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতা ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরী। পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ ঐ সময়ের যুবক সাকাচৌর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগকারীদের অনেকে এখনও বেঁচে আছে। দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে নারকীয় ঘটনার জন্ম দেয়ার অন্যতম নায়ক সাকাচৌ যখন এ দেশের পতাকা উড়িয়ে মন্ত্রিত্বের স্বাদ গ্রহণ করে রীতিমতো আস্ফালনের উন্মত্ততা প্রদর্শন করে তখন নির্যাতিত ও তিগ্রস্ত এবং স্বজন হারানো বেদনাহত মানুষজনদের গুমরে ক্রন্দন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এখন সময় এসেছে এ কুখ্যাত রাজাকার, মানুষ হত্যাকারী, নির্যাতনকারী, লুণ্ঠনকারী ও অগ্নিসংযোগে নেতৃত্বদানকারী যুদ্ধাপরাধী সাকাচৌর বিচার করার।
মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান তাঁর 'বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম : মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম' গ্রন্থের ৪৬৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, রাউজানে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাহিনী ব্যাপকভাবে হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়ায়। নূতন চন্দ্র সিংহসহ অসংখ্য জনকে হত্যা করে। রাউজানে শহীদদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল মান্নান, পঙ্কজ বড়ুয়া, জাফর আলম চৌধুরী, বিকাশ বড়ুয়া, শামসুল আলম, মুসা খান, সফিকুল আলম, রুহুল আমিন, সুবেদার আবুল কাশেম, বাদশা মিয়া, সুবেদার নুরুল আমিন, সুবেদার আবুল বশর ও এজাহার মিয়া। চট্টগ্রাম শহরে এবং রাউজানে সাকা চৌধুরী ১৯৭১ সালে রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সংগঠিত করে। মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন, হত্যাসহ নানা অপকর্মে নেতৃত্ব দেয়। চট্টগ্রামের কৃতীসন্তান দানবীর কুণ্ডশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ, নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা শেখ মোজাফফর আহমদ, ব্যবসায়ী ফজলুল হক সওদাগর, মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারম্নক, ছাত্র দয়াল হরি বিশ্বাস প্রমুখকে সাকার নেতৃত্বে হত্যা করার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সাকার নেতৃত্বে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়া এলাকায় অসংখ্য মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। একাত্তরের ১৩ এপ্রিল ঊনসত্তরপাড়ার সতীশ মহাজনের পুকুর সত্তর বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত হয়। এ ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যার শিকার হয়েছেন এমন যাঁদের নাম রয়েছে তাঁরা হলেন_ যোগেশ চন্দ্র মহাজন, রঞ্জিত কুমার মহাজন, নিরোধ বরণ ঘোষ, শক্তিপ্রদ, মনীন্দ্র লাল, রঞ্জিত কুমার রুদ্র, উমেষ চন্দ্র, ত্রেমোহন, স্বপন কুমার, শ্রী কৃষ্ণ চৌধুরী, মনিকুন্তলা, বাবুল, নিরঞ্জন, প্রতিমা, মধুসূধন, নির্মল চন্দ্র, ধীরেন্দ্র লাল, হেমন্ত কুমার, নুপুল চন্দ্র, উত্তম বালা, নিকুঞ্জ বিহারী, পুলিন বিহারী, তারাচরণ, বলরাম, ফণীন্দ্র লাল, শ্রীরাম চন্দ্র কুমার, শক্তিবালা, দুর্গাচরণ, সুপ্রিয় পাল, সতীশ চন্দ্র পাল, হিমাংশু, বিমল, বিরজাবালা, গোপাল চন্দ্র ও বাবুল চন্দ্র।
স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো দানবরূপে আবিভর্ূত সাকা চৌধুরী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লন্ডনে পালিয়ে যান। '৭৫ সাল পর্যন্ত সাকা চৌধুরী লন্ডনে আত্মগোপন করে থাকেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে তিনি খোন্দকার মোশতাকের কৃপায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাকাচৌর কর্মকাণ্ডের জন্য তার বিরুদ্ধে ৪টি মামলা হয়। কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে এসব মামলার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, সাকা চৌধুরীর হস্তক্ষেপ অনেক মামলার নথি গায়েব হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী দানবীর নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। যুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন উপাচার্যসহ ৪৭ অধ্যাপক পরিবার পরিজন নিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহের রাউজানস্থ কুণ্ডেশ্বরী ভবনে আশ্রয়গ্রহণ করেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হাটহাজারী হতে রাউজানের দিকে অভিযান শুরু করলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক ও তাঁদের পরিবারবর্গ ভারতীয় সীমান্তের উদ্দেশ্যে কুণ্ডেশ্বরী ভবন ত্যাগের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় তাঁরা নূতন চন্দ্র সিংহকে তাঁদের সঙ্গে নিরাপদে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এ সময় তিনি একা হয়ে গেলে '৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ৪টি আর্মড ট্রাক ও দুটি জীপে করে একদল পাকিস্তানী সৈন্যকে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে যাওয়া হয় কুণ্ডেশ্বরী ভবনে। নূতন চন্দ্র সিংহ তাঁর স্বভাবসুলভ অমায়িক ব্যবহার করে পাকিস্তানী সেনাদলকে অভ্যর্থনা জানান। তাদের সামনে তিনি কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়, স্কুল- কলেজের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। নূতন চন্দ্র সিংহের কথাবার্তায় সন্তুষ্ট হয়ে পাকিস্তানী বালুচ ক্যাপ্টেন নাকি তাঁর সঙ্গী সেনাদলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন। এ সময় নূতন চন্দ্র সিংহ মন্দিরে প্রবেশ করে প্রার্থনায় রত হন। তখন বালুচ ক্যাপ্টেনকে নাকি পরামর্শ দেয়া হয় নূতন সিংহকে মেরে ফেলার জন্য। ক্যাপ্টেন ইতস্তত বোধ করেন। অভিযোগ রয়েছে, সাকার মদদে বালুচ ক্যাপ্টেন এক পর্যায়ে মন্দিরে প্রবেশ করে নূতন চন্দ্র সিংহকে টেনেহিঁচড়ে বের করে। বালুচ ক্যাপ্টেনের গুলি করতে বিলম্ব দেখে সাকা নিজেই নাকি গুলি করে নূতন সিংহকে হত্যা করে বলে কথিত আছে। '৭২ সালের জানুয়ারি মাসে নূতন সিংহের পুত্র সত্য রঞ্জন সিংহ পিতা হত্যার বিরুদ্ধে ফকা চৌধুরী ও তার পুত্র সাকা চৌধুরীকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-৪১ (১) ৭২ ধারা ৩২০/১২০/১৯৮ বিপিসি)।
একই দিন ১৩ এপ্রিল '৭১-এ রাউজান থানার গহিরার নিজ বাড়ির সামনে অবস্থিত হিন্দুপাড়ায় অভিযান চালায় সাকা চৌধুরী। চিত্তরঞ্জন প্রসাদের কলেজপড়ুয়া ছেলে দয়াল হরি বিশ্বাসকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে হত্যা করা হয়। '৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সাকা চৌধুরী ২০ বালুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম হতে রাউজান যাওয়ার সময় হালদা নদীর ওপর স্থাপিত সাগরঘাট ব্রিজ এলাকা হতে অপহরণ করা হয় চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমেদকে। পরে তাঁকেও হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের বিশিষ্ট কাগজ ব্যবসায়ী রাউজানের বিনাজুরী ইউনিয়নের লেলেঙ্গরা গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আলহাজ ফজলুল হক সওদাগরকে তাঁর জেল রোডস্থ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় গুডস হিলে। সেখানে চালানো হয় নির্যাতন। দেশ মুক্ত হবার পর সাকা চৌধুরীকে আসামি করে রাউজান থানায় মামলা হয়। ফজলুল হক সাকা চৌধুরীর জল্লাদখানায় ১ মাস বন্দী ছিলেন বলে উল্লেখ করেন।
সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ। চট্টগ্রামের রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি থানায় স্বাধীনতার পর হতে তার বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা হয়। তবে কোন মামলায় তিনি এ পর্যন্ত গ্রেফতার হননি কিংবা আদালতে হাজির হননি। এছাড়া নানা অপকর্মের কারণে বিএনপি সরকারের আমলেই তার বিরুদ্ধে দায়ের হয় অন্তত ডজনখানেক মামলা। রাউজান থানায় মামলাসমূহ হচ্ছে ২৩-২-৯১ ধারা ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৪২৭/৪৩৫ ও ৩০২ দ-বিধি, মামলা নং ৭ (৯) ৯১ ধারা ১৪৩/৪৩৫/৪২৭ ও ৩০৭ দ-বিধি মামলা নং ২২ (৩-৩-৯১) ধারা ৩৬৪/৩২৩/১১৪ দ-বিধি। এ মামলাসমূহের প্রাথমিক অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশীটও দাখিল করা হয়। যার নম্বর ৬৪ তাং ৮-৬-৯১ চার্জশীট ৫৫ (১৯-৫-৯১), চার্জশীট ৮৮ (৩১-৭-৯১)।
প্রত্যক্ষদর্শী-স্বজনহারাদের বক্তব্য ॥ অশ্রম্নসিক্ত নয়নে পিতার মৃত্যুর করম্নণচিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহের ছেলে পিআর সিংহ বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল। নিজের প্রতিষ্ঠিত রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ে কাজ করছিলেন তাঁর বাবা নূতন চন্দ্র সিংহ। তাঁর প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ ঢুকে পড়ে একদল পাকসেনা। তবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের জন্য নূতন সিংহের কল্যাণমুখী কার্যক্রম দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যান ক্যাপ্টেন বালুচ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এক রাজাকার ফের নিয়ে আসেন ওই পাকসেনাদের। ঘটনা আঁচ করতে পেরে প্রাণ বাঁচাতে মন্দিরে ঢুকে প্রার্থনায় বসে যান নূতন চন্দ্র সিংহ। এ সময় ওই রাজাকার তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। এরপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় পাকসেনাদের সামনে। উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে থাকা বৃদ্ধ নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করতে পাকসেনাদের বিলম্ব দেখে নিজের পিস্তল থেকে ওই রাজাকার তাঁকে বুকে, পাঁজরে, বাম চোখের নিচে ও বাহুতে উপর্যুপরি গুলি করে। নিজ প্রতিষ্ঠানেই মৃত্যু ঘটে নূতন চন্দ্র সিংহের। '৭১-এর সেই হত্যাকারী এখনকার সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে আরও বলেছেন, সাকা বাহিনীর হাতে খুন হওয়া ব্যক্তি কেবল আমার বাবাই নন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কেবল রাউজানেই এভাবে খুন করা হয়েছে ৬৭ জনকে। এরপরও রাজাকার সাকা স্বাধীন বাংলাদেশে ঘুরেছেন বীরদর্পে। যে জাতীয় পতাকার জন্য প্রাণ দিয়েছে ৩০ লাখ বাঙালী, সেই পতাকা গাড়িতে ঝুলিয়ে যখন সাকাচৌ ঘুরে বেরিয়েছেন তখন বাবার মৃত্যুটা আমাদের আরও বেশি কষ্ট দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরম্ন হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এআর মল্লিক, শিক ড. জাকির উদ্দিন, ড. আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আলী আহসান, ড. শামসুল হক, ড. আলী ইমদাদ খান ও তাঁদের পরিবারের প্রায় ৪৭ জন কুণ্ডেশ্বরী ভবনে আশ্রয়গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে থাকলে সবাই অন্যত্র চলে যেতে থাকেন। এ সময় নূতন চন্দ্র সিংহকে তাঁদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলে তিনি প্রিয় প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আমি এ দেশের মাটিকে ভালবাসি। মৃত্যু যদি আসে তবে দেশের মাটিই হবে আমার চিরনিদ্রার স্থান। আমি এ দেশ, এ মাটি ত্যাগ করে কোথাও যাব না। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে নূতন চন্দ্র সিংহের পুত্র-পরিবার দেশে ফিরে আসে।
হালের প্রভাবশালী এক নেতার নাম সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এ নামে তাকে খুব কম লোকই চিনত। সে সময় খোকন নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। যে নাম শুনলেই আঁতকে উঠতেন সবাই। একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানান, এ সেই সাকা। মুক্তিযুদ্ধে খোকন নাম ধারণ করেই চালিয়েছে হত্যা ও নির্যাতন। চট্টগ্রাম মহানগরী ও রাউজানে রাজার, আলবদর ও আলশামসকে সংগঠিত করেছিল। খোকন অনেক কিলিং অপারেশনেও নেতৃত্ব দিয়েছে। এসব ঘটনায় স্বাধীন বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলাও দায়ের করা হয়।
শুধু রাউজানেই সীমাবদ্ধ ছিল না সাকার হিংস্রতা; নগরীতে তার পারিবারিক বাসভবন গুডস হিলও পরিণত করা হয়েছিল টর্চার সেলে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সপরে লোকজনকে ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো। এদের একজন রয়টার্সের সাংবাদিক নিজামউদ্দিন। সাকার নির্যাতনের চিহ্ন যিনি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে ভয়াবহ সেই চিত্র তুলে ধরেন নিজামউদ্দিন। তিনি বলেন, একাত্তরের জুলাইয়ে আমি, মুক্তিযোদ্ধা জুনু পাগলা, সৈয়দ ওয়াহিদ ও মিরাজ নগরীর হাজারী লেনের একটি পোড়া বাড়িতে বসে বৈঠক করছিলাম। সাকা এ খবর পেয়ে সাঙ্গোপাঙ্গদের দিয়ে পুরো বাড়ি ঘেরাও করে আমাদের বন্দী করে গুডস হিলে নিয়ে যায়। টানা ১৪ দিন আমাদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। গুডস হিলে বন্দী ছিল আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা। নির্যাতনের ফলে ওষ্ঠাগত বন্দীরা পানি পান করতে চাইলে সালাহউদ্দিন কাদের প্রস্রাব করে মুক্তিযোদ্ধাদের তা পান করতে বাধ্য করত।
তিনি আরও বলেন, গুডস হিলের নির্যাতন ক েছিল একটি টেবিল। ওই টেবিলের ওপর গাঁথা ছিল তিন ইঞ্চি মাপের অসংখ্য পেরেক। আর বন্দীদের সেই পেরেকের ওপর শুইয়ে ওপর থেকে কাঠের তক্তা দিয়ে চেপে ধরা হতো। ফলে বন্দীর সারা শরীর ত-বিত ও রক্তাক্ত হয়ে পড়ত। এভাবে নির্যাতিত হওয়া ফজলুল হক সওদাগর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাকার বিরুদ্ধে রাউজান থানায় মামলাও দায়ের করেছিলেন। তবে ১৯৮০ সালে ফজলুল হক সওদাগর মারা গেলে তার ভাগ্য সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মে থেকে নবেম্বর মাস পর্যনত্ম দীর্ঘ সাত মাস সালাহউদ্দিন কাদর চৌধুরী চট্টগ্রাম শহরের গুডস হিলে একটি বেসরকারী জেলাখানা ও জলস্নাদখানা স্থাপন করেন। প্রতিদিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বা তাদের আশ্রয়, চিকিৎসা, ওষুধপত্র ইত্যাদি দিয়ে সহায়তাকারী বলে যাদেরই সন্দেহ করা হতো তাদের ধরে এনে গুডস হিলের এ জল্লাদখানায় অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। প্রতিদিনই জল্লাদখানায় দু'একজনকে হত্যা করা হতো এবং তাদের লাশ রাতে কার্ফু চলাকালে গাড়িতে করে কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়ে আসা হতো।
সংক্ষেপে সাকার হত্যাকাহিনী ॥ একাত্তরের ১৭ এপ্রিল ২০ বালুচ রেজিমেন্টের একদল পাকসেনা দিয়ে সাকা চট্টগ্রাম থেকে রাউজান যাচ্ছিল। হালদা সেতু পার হওয়ার সময় পেয়ে যান বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোজাফ্ফর আহমেদকে। এ সময় তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে আর কোন সন্ধান মেলেনি। এর আগে ১৫ এপ্রিল সাকা এক প্লাটুন পাকসেনাসহ রাউজানের পথেরহাটে আওয়ামী লীগ কর্মী মোহাম্মদ হানিফকে গুলি করে হত্যা করে। জ্বালিয়ে দেয় নোয়াপড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সম্পাদক ইজহারুল হকের পৈতৃক বাড়ি। পরে সাকার সাঙ্গোপাঙ্গরা রাউজানের ৯ নং পাহাড়তলী ইউনিয়নের কলেজ (বর্তমানে বিআইটি) ছাত্রাবাসে তল্লাশি চালিয়ে চবির ভিপি আবদুল রব এবং জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র ছাত্রলীগ নেতা সালাউদ্দিনকে ধরে কলেজ গেটে নিয়ে হত্যা করে। এক গ্রাম থেকে ১৭০ শিশু ও নারী-পুরুষকে পুকুরপারে জড়ো করে হত্যা করে। তবে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় দু'টি শিশু; যারা এখানও সেই ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ডের কথা শুনলে নির্বাক হয়ে পড়ে। এছাড়া রাউজানের হোড়াপাড়া বিহার ও বিহারসংলগ্ন অনাথ আশ্রমে হানা দিয়ে তারা স্বর্ণনির্মিত বৌদ্ধ মূর্তি, গৌতমবুদ্ধের মূর্তির স্বর্ণের অস্থি লুট করে নিয়ে যায়। ধর্ষণের পর হত্যা করে কয়েক বৌদ্ধ অনাথ কিশোরীকেও। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে রাউজানে হামলা চালিয়ে প্রায় ২শ' নারী-পুরুষকে হত্যা করে সাকা।
স্বাধীনতা-পরবর্তীর সাকা ॥ ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী পরাজিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে আত্মগোপন করেন সাকা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে খোন্দকার মোশতাকের সহযোগিতায় বীরদর্পে দেশে ফেরেন সাকাচৌ। এরশাদ মতায় এলে তিনি যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। এরপর রাতারাতি বনে যান স্বাস্থ্য ও গণপূর্তমন্ত্রী। এরশাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টে যোগ দেন বিএনপিতে। সর্বশেষ ২০০১ সালে জোট সরকার মতায় গেলে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হন। সময়ের সঙ্গে দেশে সরকার পরিবর্তন হলেও এতটুকুও কমেনি সাকার প্রভাব। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চট্টগ্রাম ও রাউজানে রয়েছে সাকার একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী। যাদের হাতে খুন হতে হয়েছে অনেক নিরীহ মানুষকে। বিশেষ করে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সাকার সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর হাতে জিম্মি ছিল গোটা রাউজান। এমনকি স্মরণকালের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের চোরাচালান 'দশ ট্রাক অস্ত্র' চোরাচালানের সঙ্গে সাকার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
সাকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় দায়ের করা মামলা ॥ ১. রাউজান থানার মামলা নং ২২, তারিখ ২৩ (২) ৯১, ধারা ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৪২৭/৪৩৫/ ও ৩০২; মামলাটির চার্জশীট দেয়া হয়। অভিযোগপত্র নং ৬৪, তারিখ ৮/৬/৯১ ইং, আসামি সাকাচৌ. গিকাচৌসহ ৯ জন। হাইকোর্ট রিভিশন পিটিশন নং ৭৯৭/৯৮ দায়েরের পরিপ্রেেিত ১৭-৫-৯৯ ইং ......থেকে মামলার কার্যক্রম স্থগিত ছিল।
২. রাউজান থানা মামলা নং ৭, তারিখ ২/৯/৯১, ধারা ১৪৭/৪৩৫/৪২৭/৩০৭, সাকাচৌসহ আসামি ১২ জন। অভিযোগপত্র নং ৫৫, তারিখ ১৯/৫/৯১ ইং। ১৯৯৯ সালের ১৮ নবেম্বর মামলাটির চার্জ গঠন না করে খারিজ করে দিলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের বিরম্নদ্ধে সে সময় এডিএম কোর্টে মোশান করা হয়।
৩. রাউজান থানার মামলা নং-২, তারিখ ৩/৩/৯১, ধারা ৩৬৪/৩২৩/ ১১৪, অভিযোগপত্র নং ৮৮, তারিখ ৩১/৭/৯১ইং। অপহরণ মামলা। মামলাটি ১ম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল।
৪. কোতোয়ালি থানার মামলা নং ৮৭, তারিখ ২৯/৫/২০০১ ইং। ধারা ১৪৭/ ১৪৮/ ১৪৮/৩০২/১১৪। ছাত্রদল ক্যাডার নিটোল হত্যা মামলায় সকাচৌসহ ২৬ জনকে আসামি করা হয়। মামলা থেকে সকাচৌসহ ১২ জনের নাম প্রত্যাহার করে নিলেও অক্টোবর ০৬-এর প্রথম সপ্তাহে আদালত অন্য আসামিদের খালাস করে দেয়।.... গ্রেফতার ২৯/৫/০১ রাতে এবং সিএমএম আদালত হতে জামিন ৩০/০৫/০১ দুপুরে।
৫. কোতোয়ালি থানার মামলা নং ১২, তারিখ ১১/১১/৯৭; সাকচৌ-গিকাচৌকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় ২২/৯/৯৮; ধারা ১৪৭/১৪৮/১৪৯/ ৩২৫/ ৩২৬/৩০২/৩০৭। আসামি প মোশান করে, নং ৩০৯/৯৯। ১ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে ২৮/৫/২০০১ পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল।
৬. পাঁচলাইশ থানার মামলা নং ৩৫, সাকাচৌ- গিকাচৌ. কর্নেল অলি আহমেদ, মোরশেদ খান, মীর নাছিরসহ আসামি ২৩ জন। (চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে হত্যাকা-) তারিখ ২৭/১১/৯৭, ধারা ১৪৭/১৪৮/ ১৪৯/৩২৩/৩২৪/৩২৬/৩০৭/৩০২, চার্জশীট ২১/৯/৯৮। আসামি কর্তৃক মিস কেস নং ৪৪২/৯৮, ১ম অতিরিক্ত মহানগর জজ আদালতে বিচারাধীন।
৭. চান্দগাঁও থানায় মামলা নং ২২, তারিখ ২৭/১১/৯৭; ধারা ১৪৭/১৪৮/ ৪৪৭/৩৩২/৪২৭/১০৯। আসামি সাকাচৌসহ ৯ জন। হাইকোর্টে ফৌজদারি মিস কেস নং ৪৫৩৩/৯৭ দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত ছিল।
সোনা চোরাচালান মামলা চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্ট পুলিশ ফাঁড়ি হতে ২ কি.মি. দণি-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে নোঙ্গররত অবস্থায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মালিকানাধীন জাহাজ কিউসি টিল থেকে ১৬৮টি পিস (প্রতিপিস ১০ তোলা) ১ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। বন্দর থানায় মামলা নং ১৪; তারিখ ১৪/১০/৯৬ ইং। শুল্ক আইনের ১৫৬ (৮) ধারা এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ মতা আইনের ২৫ (বি) ধারায় কিউসি শিপিং-এর ম্যানেজার স্বপন ঘোষসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্র নং ৫৩; তারিখ ২৪/৩/৯৭। মামলাটি স্পেশাল ট্রাইবু্যনাল নং ১৫৩১/৯৯ জিআর নং ২০১০/৯৬; ১ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
http://www.blogger.com/post-create.g?blogID=8612024939408691729
No comments:
Post a Comment