Wednesday, April 14, 2010

গো. আযমের পরামর্শেই রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠন ।। সেই রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী



শুক্রবার, ২ এপ্রিল ২০১০, ১৯ চৈত্র ১৪১৬
গো. আযমের পরামর্শেই রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠন ।। সেই রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী
মামুন-অর-রশিদ ॥ পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েই গোলাম আযম ২৫ মার্চের কালরাতে পাকবাহিনীর গণহত্যা স্বাগত জানিয়েছে। '৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, গোলাম আযমের নেতৃত্বে পাকবাহিনীকে স্বাগত জানিয়ে মিছিলে স্লোগান দেয়া হয়, 'পাক আর্মি জিন্দাবাদ'। গোলাম আযমের পরামর্শেই গঠিত হয় মৃত্যুদূত রাজাকার বাহিনী। একাত্তরের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠনে প্রধান উদ্যোগটি নিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম। লাহোরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে তিনি এই কুপ্রস্তাবটি দেন। কুখ্যাত শান্তি কমিটি গঠনের পরামর্শও দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী।
একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামায়াত নেতা গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন তাই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরও তিনি বিদেশে বসে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। উলেস্নখ্য, গোলাম আযম, সৌদি আরব ছাড়াও দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, বৈরম্নত সফর করেন এবং অর্থ সংগ্রহ ও বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালান। ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে তিনি লন্ডনে চলে যান। লন্ডনে জামায়াতীরা বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার একটি শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে তোলেন। একাত্তরে পূর্ব পাকিসত্মান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রতিবেদনে (ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিসত্মান) হুবহু এ কথাই বলা হয়েছে। পাকিসত্মানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়াকে প্রতি মাসে দুই বার পূর্ব পাকিসত্মান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গোপন এই প্রতিবেদন পাঠাত। এপ্রিল পর্যনত্ম এই প্রতিবেদনে স্বার আছে তখনকার স্বরাষ্ট্র সচিব এম এম হকের। এরপর থেকে স্বরাষ্ট্র সচিব এম এম কাজমির স্বার দেখা যায়। গোপন ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো সময় জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিসত্মানের আমির গোলাম আযমের নেতৃত্বে তৎকালীন জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা পাকিসত্মান সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেন। গোলাম আযম সারাদেশ ঘুরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সংগঠিত করার কাজ করেন।
শানত্মি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী বাংলাদেশে নারকীয় গণহত্যায় পাক সেনাদের শুধু সহযোগিতাই করেনি, এ নৃশংসতায় প্রত্যভাবে শরিকও হয়েছিল। রাজাকার বাহিনীর 'অংশ হিসেবে' আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনে এই দলটিই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর তরম্নণ ক্যাডারদের নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনী নৃশংসতায় পাক বাহিনীর ডার্টি ব্যাটালিয়নের সমকতা অর্জন করেছিল। সামরিক ছত্রছায়ায় প্রদেশের রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা নিতে অভিলাষী দলটি এ বাহিনীকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী ছকও কষেছিল। এ জন্য তাদের প্রথম কাজ ছিল বাংলাদেশকে মৃতু্য-উপত্যকায় পরিণত করা। জামায়াতে ইসলামী শানত্মি কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল একাত্তরের ৬ এপ্রিল। ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যার নীলনকশা 'অপারেশন সার্চলাইট' বাসত্মবায়ন শুরম্ন করার মাত্র ১০ দিন পর (৪ এপ্রিল) গোলাম আযম, নুরম্নল আমীন, খাজা খয়ের উদ্দিনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে নস্যাত করতে তৎপর ১২ জন নেতা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সঙ্গে সাাত করে তাকে 'পূর্ব পাকিসত্মানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পূর্ণ সহযোগিতার' আশ্বাস দেন। এই ঘটনার তিনদিন পরই ৭ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামী পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে 'স্বাভাবিক জীবনযাত্রা' শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখা হয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় গুরম্নত্বপূর্ণ নেতা আখতার ফারম্নক সম্পাদিত এ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়। বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের সমন্বয়ে শানত্মি কমিটি গঠন এ েেত্র খুবই সহায়ক হতে পারে। এ ধরনের শানত্মি কমিটি দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে শানত্মিকামী নাগরিকদের জানমাল রা করতে পারবে।' সে সময় আল বদর বাহিনীর পুরো পাকিসত্মান শাখার কমান্ডার ছিলেন জামায়াতে বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর ১৯৭১ সালের বিভিন্ন সংখ্যায় তাঁর এই পরিচয় পাওয়া যায়। নিজামী তখন জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতিও ছিলেন। ১৯৭১ সালের দৈনিক সংগ্রাম-এর বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর পূর্ব পাকিসত্মান শাখার প্রধান ছিলেন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে দেখা যায়, মতিউর রহমান নিজামী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসত্মান সেনাবাহিনীকে সব রকমের সাহায্য করতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে আল বদর বাহিনী গড়ে তুলতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসত্মান সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য এ দেশীয় সহযোগিতাদের নিয়ে গঠিত হয় শানত্মি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকায় শানত্মি কমিটি গঠিত হয়। জুন মাসে সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান 'পূর্ব পাকিসত্মান রাজাকার অর্ডিন্যান্স' জারি করে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। জামায়াতের নেতাকর্মীরাই মূলত এসব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীসহ ডানপন্থী অন্যান্য দলেরও কিছু সদস্য এসব বাহিনীতে যোগ দেন। আল বদর ও আল শামস বাহিনী ছিল জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ আছে এই দুটি বাহিনীর বিরম্নদ্ধে।
গোলাম আযমের প্রসত্মাব ও তত্ত্বাবধানে শানত্মি বাহিনী গঠন জামায়াতে ইসলামীর এ নসিহতের ৪ দিন পরই ১০ এপ্রিল ঢাকায় শানত্মি কমিটি গঠন করা হয় কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে। গোলাম আযম ছিলেন এর কেন্দ্রীয় কমিটির গুরম্নত্বপূর্ণ সদস্য। এর একদিন পরই জামায়াতের প্রাদেশিক আমির গোলাম আযম ঢাকা রেডিওতে ভাষণ দিয়ে শানত্মি কমিটি গঠনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অন্যান্য শহরেও পাক বাহিনীর সমর্থনে এ ধরনের কমিটি দ্রম্নত গঠনের জন্য তিনি তাগিদ দেন। ১৩ এপ্রিল ঢাকায় স্বাধীনতাকামী জনগণের মনে নতুন করে ত্রাস আর শঙ্কা জাগিয়ে একটি জঙ্গী মিছিল বের করে শানত্মি কমিটি। তার অগ্রভাগে ছিলেন গোলাম আযম। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে নারী-পুরম্নষ এমনকি বৃদ্ধ ও শিশুদেরও হত্যার জন্য পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিতে দেশের সর্বত্র সক্রিয় ছিল এ কমিটির সদস্যরা। রাজাকাররা হয়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম।
গোলাম আযমের প্রসত্মাবে রাজাকার বাহিনী গঠন গণহত্যায় পাক সেনাদের সক্রিয় সহযোগিতা করতে রাজাকার বাহিনী গঠনের প্রসত্মাবটি গোলাম আযম দিয়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাাত করে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে তিনি বেশ নাটকীয়তা সৃষ্টি করেন। দৈনিক পাকিসত্মান পত্রিকায় ১৯ জুন লেখা হয় ' গোলাম আযম লাহোরে বলেছেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাাত করে তিনি পূর্ব পাকিসত্মান সম্পর্কে কিছু সুপারিশ রাখবেন। তবে এগুলো আগেভাগে প্রকাশ করা ভাল হবে না।' পরদিন সাাতের সময় তিনি যে কুখ্যাত রাজাকার বাহিনী গঠনের সুপারিশই করেছিলেন সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় ২১ জুন দৈনিক সংগ্রামে একটি সংবাদে। এতে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাাত করে পূর্ব পাকিসত্মান জামায়াতে ইসলামীর আমির 'দুষ্কৃতকারীদের মোকাবেলার জন্য দেশের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার আহ্বান জানিয়েছেন।' এর পরদিনই সংগ্রামে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ' দেশপ্রেমিকদের অস্ত্র সজ্জিত করা হলে অল্প সময়েই দুষ্কৃতকারীদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে।' জামায়াতে ইসলামীর কাছে দুষ্কৃতকারীর অর্থ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক রাজনৈতিক শক্তি প্রধানত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং মুক্তিবাহিনী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। আর 'শানত্মিকামী' জনগণ বলতে তারা বুঝিয়েছে পাকিসত্মানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযানের সমর্থকদের। লাহোরে গোলাম আযমের 'পূর্ব পাকিসত্মানে সামরিক হসত্মেেপর কোন বিকল্প ছিল না' মনত্মব্য থেকেই তার কুমতলব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে নিজের স্বাধীন অসত্মিত্ব ঘোষণা করে। জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে এই ঘোষণাকে শুধু চ্যালেঞ্জই জানায়নি, 'দুষ্কৃতকারীদের দমনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।' [লাহোরে গোলাম আযমের সংবাদ সম্মেলন, ২১ জুন, ১৯৭১]
গোলাম আযমের জবানিতে স্বাধীনতাবিরোধিতার কথা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের কাছে 'পাকিসত্মান বিভক্তি ও বাংলাদেশের অভু্যদয়ের বিষাদময় কাহিনী'। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ জীবনে যা দেখলাম-এর তৃতীয় খ-ের ২১১ পৃষ্ঠায় গোলাম আযম এমনটিই লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের সাফাই গেয়ে গোলাম আযম লেখেন, '... এ পরিস্থিতিতে জনগণের সামান্য খিদমত করতে হলে সামরিক সরকারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমেই তা সম্ভব' (তৃতীয় খ-, পৃ-১৪৩)। গোলাম আযম নিজেই লিখেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগকে ভোট না দেয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামী। তাঁর বইয়ের তৃতীয় খ-ের ১০৮ পৃষ্ঠায় তিনি ওই সময় জামায়াত কী বক্তব্য তুলে ধরত তা উলেস্নখ করেছেন। নিজের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, 'তারা মতা পেলে পাকিসত্মান থেকে পূর্ব পাকিসত্মানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) আলাদা করে ফেলতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে আপনারা পাকিসত্মানের নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগই হয়ত পাবেন না।' মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আযম ছিলেন পূর্ব পাকিসত্মান জামায়াতের আমির। তাঁর তিন খ-ের আত্মজীবনীমূলক এ গ্রন্থটি ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। বইটির তৃতীয় খ-ে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ গুরম্নত্বপূর্ণ সময়ে তাঁর ও জামায়াতের ইসলামীর অবস্থান তুলে ধরেছেন তিনি।
তারিখভিত্তিক গোলাম আযমের বক্তব্য ১৯৭১ সালে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন উপল েবিবৃতি দিয়ে জামায়াত নেতা গোলাম আযম যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তেমনি বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনেও ছিল তার প্রধান ভূমিকা। ১৯৮১ সালের ১৭ এপ্রিল সাপ্তাহিক বিচিত্রার এক প্রচ্ছদ কাহিনীতে বলা হয়, অধ্যাপক গোলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যারও অন্যতম নায়ক। '৭১-এর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে অধ্যাপক গোলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যার একটা নীলনক্সা পেশ করেন। সে নীলনক্সা অনুযায়ীই পরবর্তীকালে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যা সংক্রানত্ম যে দলিলপত্র পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, পূর্ব পাকিসত্মানকে টিকিয়ে রাখা হয়ত সম্ভব হবে না। তবে একটা কাজ করতে হবে, এখানকার বুদ্ধিজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, ডাক্তারকে চিরতরে 'শেষ' করে দিতে হবে, যাতে পাকিসত্মান হারালেও তারা দেশ চালাতে না পারে। গোলাম আযম এই নীলনক্সা বাসত্মবায়নের জন্য তার দলীয় ক্যাডার অর্থাৎ আলবদর ও আল শামসকে নির্দেশ দেন। একাত্তরের বিভিন্ন সময় দেয়া গোলাম আযমের আরও কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি উদ্ধৃত করা হলো ৯ এপ্রিল '৭১-এদিন রেডিও পাকিসত্মান থেকে তার একটি বেতার ভাষণ প্রচারিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় লোকসভায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য দেয়ার আশ্বাসের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি পূর্ব পাকিসত্মানীদের প্রতি যে সমর্থন ও সমবেদনা জানিয়েছেন তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিসত্মানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে ভারত প্রকৃতপ েআমাদের অনুপ্রবেশ ও প্রদেশের মুসলমানদের কোন কাজেই আসবে না।
১২ এপ্রিল '৭১-গোলাম আযম এদিন একটি বেতার ভাষণে বলেন, ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিসত্মানের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। পূর্ব পাকিসত্মানের নিরস্ত্র জনগণকে সেনাবাহিনীর দাসে পরিণত করতে চায়। শানত্মি কমিটি গঠিত হবার পর এর ব্যাপক প্রশংসা করে মনত্মব্য করা গো. আজম বলেন, অন্যান্য শহরেও কেন্দ্রীয় শানত্মি কমিটি পথ অনুসৃত হবে এবং গোটা দেশে পূর্ণ স্বাভাবিকতা ও দেশ রাবোধ দেখা দেবে। এর ফলে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও পঞ্চম বাহিনীর সব চক্রানত্ম ব্যর্থ হতে বাধ্য।
২ জুন '৭১-একটি সাাতকারে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিসত্মানের মুসলমানরা ইসলামকে কখনও পরিত্যাগ করতে পারবে না। এ কারণে তারা পাকিসত্মানকেও ত্যাগ করতে পারবে না। পূর্ব পাকিসত্মান ইসলাম ও পাকিসত্মানের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে। আরও কোরবানি দেয়ার জন্য তারা প্রস্তুত রয়েছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল এদেশে সব সময়ই গণতন্ত্রের বিরম্নদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। বিগত নির্বাচনে জাতি অনেক কিছু আশা করে আসছিল। কিন্তু নির্বাচনে যারা জয়লাভ করেছিল তারা নিজেদের গণতন্ত্রপ্রিয় বলে দাবি করলেও প্রকৃতপ েতারা ছিল ফ্যাসিস্ট। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কোন দেশের নিরাপত্তা ও ইসলামী আদর্শ রার্থে একটি আইনগত কাঠামো দান করেন। কিন্তু নির্বাচনে তখন যে সব দল জয়লাভ করল তাদের আদর্শ, কর্মসূচী, সেস্নাগান সবই আইনগত কাঠামোর পরিপন্থী ছিল।
২২ জুন' ৭১-পূর্ব পাকিসত্মান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম করাচীতে বলেন, পূর্ব পাকিসত্মানের জনগণ নিজেদের অসত্মিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সমসময়ই তাদের পশ্চিম পাকিসত্মানী ভাইদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করবে।
৩ আগস্ট '৭১-মাদ্রাসা শিা সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, 'এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, আদর্শিক যুদ্ধ। আলস্নাহর দীনকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এ দেশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ, আমাদের জয়ী হতেই হবে।'
১৪ আগস্ট '৭১-আজাদী দিবস উপল েতিনি একটি বিবৃতি দেন। এতে বলেন, আমাদের আদর্শের প্রতি অপরাধমূলক চরম বিশ্বাসঘাতকতাই আজকের জাতীয় সঙ্কটাবস্থার আসল কারণ। পাকিসত্মান রার ডাক দিয়ে তিনি আরও বলেন, এ চেষ্টা ব্যর্থ হলে আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হব এবং যতদিন আমরা বেঁচে থাকব পঙ্গু জাতি হিসেবে বেঁচে থাকব। আজাদী দিবস কেন্দ্রীয় শানত্মি কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সভার আয়োজন করে। ওই সভায় তিনি বলেন, পাকিসত্মানের দুশমনদের মহলস্নায় মহলস্নায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অসত্মিত্ব বিলোপ করার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শানত্মি কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি আরও উলেস্নখ করেন, আলস্নাহ না করম্নক, যদি পাকিসত্মান না থাকে তাহলে বাঙালী মুসলমানদের অপমানে মৃতু্যবরণ করতে হবে।
১ সেপ্টেম্বর '৭১-পূর্ব পাকিসত্মান জামায়াতে ইসলামী প্রধান অধ্যাপক গোলাম আযম পাকিসত্মানকে রা ও জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি পাকিসত্মান সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। অধ্যাপক আযম জানান, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের খতম করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিসত্মানের সব একমনা ও দেশপ্রেমিক জনগণ এক সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে রাজাকাররা ভাল কাজ করছে বলে তিনি মনত্মব্য করেন।
১১ সেপ্টেম্বর '৭১- মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃতু্যবার্ষিকী উপল েকার্জন হলে ইসলামী ছাত্রসংঘের স্মৃতি প্রদর্শনীতে ইসলামী ছাত্রসংঘকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, পাকিসত্মান আন্দোলনের সময়ের মতো আজকে আবার পাকিসত্মানকে রা করার জন্য নতুন বাহিনীর প্রয়োজন। ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী বাহিনী অখ- পাকিসত্মানকে চিরস্থায়ী করতে সম হবে।
১৭ সেপ্টেম্বর '৭১-ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ ছিল আল বদরের হেড কোয়ার্টার এবং রাজাকার বাহিনীর প্রশিণ কেন্দ্র। প্রশিণরত রাজাকার আলবদরদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ইসলাম ও পাকিসত্মানের দুশমনদের বিরম্নদ্ধে বদর বাহিনী জয়ী হবেই।
২৯ আগস্ট '৭১-করাচীতে পূর্ব পাকিসত্মান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম বলেছেন যে, পূর্ব পাকিসত্মানী জনগণের মনে আস্থার ভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আরও পদপে গ্রহণ করা দরকার। এখানে আগমনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, দুষকৃতকারীদের দ্বারা সৃষ্ট কয়েকটি ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি দ্রম্নত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
২৩ নবেম্বর '৭১ লাহোরে পূর্ব পাকিসত্মান জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক গোলাম আযম বলেছেন, আত্মরামূলক যুদ্ধ কৌশল শত্রম্নকে উৎসাহী ও উদ্যমশীল হতে সাহায্য করে মাত্র। তিনি বলেন, বর্তমান মুহূর্তে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করাই হবে দেশের জন্য আত্মরার সর্বোত্তম ব্যবস্থা। তিনি বলেন, একটি মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চাইলে পাকিসত্মানের প েআক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। পূর্ব পাকিসত্মানে শানত্মি রার উদ্দেশ্যে সব দেশপ্রেমিক শানত্মি কমিটির সদস্য এবং রাজাকারদের উন্নতমানের ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম দাবি জানান।
'১৬ ডিসেম্বরে আমার অনুভূতি' শীর্ষক অধ্যায়ে গোলাম আযম লেখেন (পৃ-২৪১), ডিসেম্বরের মধ্যেই চূড়ানত্ম ফয়সালা হয়ে যাবে তা ধারণা করিনি বলে মনের দিক দিয়ে প্রস্তুত ছিলাম না।'

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2010-04-02&ni=13416

No comments: