যুদ্ধপরিস্থিতির মুখে আওয়ামী লীগের করণীয়
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বর্তমানে একটি যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে এ কথা এখন বিনাদ্বিধায় বলা চলে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বটে, কিন্তু চারদিক থেকে আক্রান্ত একটি সরকার। বিদ্যুত পানি গ্যাসের সঙ্কট একদিক থেকে সরকারকে কাবু করে রেখেছে; আরেকদিকে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের চক্রান্তে খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার ও শাসত্মি দেয়া গেছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সরকার দেশী এবং বিদেশী জোটবদ্ধ চক্রান্তের সম্মুখীন। সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে তারা আওয়ামী লীগের চাইতে বহুগুণ এগিয়ে।
এটা আমি সব সময় দেখেছি। আওয়ামী লীগ যত গণভিত্তিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হোক, প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে সে কখনোই বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে পেরে ওঠে না। এটা আওয়ামী লীগের একটা ইনহারেন্ট উইকনেস। আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা-সেল অত্যন্ত দুর্বল, নেই বললেই চলে। এ দুর্বলতার জন্য আওয়ামী লীগ প্রমাণিত সত্যকেও সত্য বলে জনগণের সামনে অনেক সময়েই তুলে ধরতে পারে না। আর বিএনপি-জামায়াত জোট নিছক গলাবাজির জোরে একেবারে অসত্য এবং মনগড়া বিষয়কেও সত্য বলে জনগণের সামনে তুলে ধরে এবং তাদের অনেককে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়।
আমাদের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদেরও বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তুলতে আওয়ামী লীগ বেশিরভাগ সময় ব্যর্থ হয়। একেবারে দলীয় এবং ব্যক্তিগত পছন্দের লোক না হলে অনেক বুদ্ধিজীবীকে তারা পছন্দ করেন না। আওয়ামী লীগের কখনও কখনও একলা চলার নীতি দলটির জন্য এবং দেশের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাদের যখন সুমতি ফেরে তখন দেখা যায় অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আবার দেশে একটি তথাকথিত নিরপেক্ষতার বিপজ্জনক কুয়াশার জাল তৈরি করে রেখেছে একাধিক সাবেক বাম সাংবাদিক ও সংবাদপত্র। এ কুয়াশার জালে বন্দী হয়ে অনেক বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীও দিশেহারা। তাঁরা দলীয় নয়, বরং বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুতেও বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে মুখে খুলতে ভয় পান। যদি তাতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়া হয়ে যায়! অন্যদিকে আওয়ামী লীগও তেমনি চুয়ান্ন সাল ও একাত্তরের মতো স্বাধীনতার পক্ষের দলমত নির্বিশেষে সকল বুদ্ধিজীবীকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সরব সমর্থন আদায় করতে পারছে না। প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বাধীনতাবিরোধী জোটের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী কালচারাল ফ্রন্ট গড়ে তুলতে পারছে না। পারলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের শিবির থেকে এত হৈচৈ হৈহল্লা শোনা যেত না। তারা ভীত মূষিকের মতো নিজেদের গর্তে লুকিয়ে থাকত। মুখ বের করার সাহস পেত না।
চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয় বা একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে গণবিজয় কেবল কোন দলের রাজনৈতিক শক্তির জোরে অর্জিত হয়নি; এ বিজয়ের পেছনে ছিল কালচারাল ফ্রন্টের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও সাফল্য। সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো এখন আবার নতুনভাবে প্রচারিত হয়ে নতুন প্রজন্মকে নতুনভাবে কি উদ্বুদ্ধ করছে না? বর্তমানে গণশত্রুদের আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে সেই ঐক্যবদ্ধ কালচারাল ফ্রন্ট কোথায়? বিশাল বুদ্ধিজীবী সমাবেশ কোথায়? এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো জাতীয় জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও একশ্রেণীর মিডিয়ার স্বার্থবুদ্ধি ও কূটবুদ্ধিপ্রসূত ভূমিকার জন্য একটি 'বিতর্কিত টপিক', যা টকশোতে শ্রোতাদের বিনোদনের জন্য প্রায়ই প্রচার করা হয়।
এই যে চারদিকে অসত্যের এবং মিথ্যাচারের এত ডামাডোল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নজরুলের মতো এ প্রশ্নটি উচ্চারণের সাহস কি আজ মুষ্টিমেয় দু'একজন ছাড়া আর কোন বুদ্ধিজীবীর নেই?
"সত্যকে আজ হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়
নেই কিরে কেউ শক্তিসাধক বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়?"
এ শক্তিসাধক, সত্যসেবক মানুষ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নেই এ কথা বলব না, কিন্তু দূরবীন দিয়ে তাদের সংখ্যা আজ গুনতে হয়।
কথায় বলে 'প্রচার যুদ্ধে জয় আসল যুদ্ধ-জয়ের অর্ধেকটার বেশি।' দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ প্রচার যুদ্ধে আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই পিছিয়ে- নির্বাচনে ল্যান্ডস্লাইড ভিকটোরি সত্ত্বেও। এ বিজয়ের সাফল্য তারা কতদিন ধরে রাখতে পারবে তা আজ প্রশ্নবোধক। একটি শক্তিশালী প্রচার সেল, সম্মিলিত কালচারাল ফ্রন্ট এবং নিরপেক্ষ মিডিয়ার সমর্থন ছাড়া এ সাফল্য বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, আওয়ামী লীগের পক্ষের সাংস্কৃতিক সংস্থা এখন অনেক আছে। কিন্তু চুয়ান্ন ও একাত্তরের মতো তাদের ঐক্য ও সম্মিলিত কণ্ঠ এখন অনুপস্থিত। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ 'আননোন' নেতা ও মন্ত্রীরা মাঝে মাঝে যুদ্ধাপরাধীদের মিথ্যা প্রচারণার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন। তা যুক্তিতে যেমন দুর্বল, তেমনি সত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও যথেষ্ট অক্ষম।
এ পরিস্থিতিরই সুযোগ নিয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা। তারা স্বাধীনতার পক্ষের শিবিরের এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানগত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং এ সরকারকে একটি যুদ্ধপরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়ে তার চারপাশে বেষ্টন করে একটি শক্তিশালী বূ্যহ তৈরির চেষ্টা করছে। বেগম খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্য ঘোষণা না দিয়েও চট্টগ্রামের জনসভায় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার চরমপত্র দিয়েছেন এবং খুলনায় জনসভাতেও সেই রণবাদ্যই বাজিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এখন বোঝা উচিত, তিনি এবং তাঁর দল যতই জনসমর্থিত হোন, বর্তমান মুহুর্তে একলা চলার নীতি পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতেই হবে। বিদ্যুত-পানি-গ্যাস, দ্রব্যমূল্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সন্ত্রাস ইত্যাদি নানা সমস্যা জট পাকিয়েছে এবং সরকারকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। সরকারের পক্ষে পিছু হটার সুযোগ নেই, সময়ও নেই। যুদ্ধাপরাধীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। এই যুদ্ধপরিস্থিতির মুখে চার ফ্রন্টেই সরকারকে যুদ্ধ করতে হবে।
যুদ্ধ ছাড়া, কঠোর অবস্থান নেয়া ছাড়া সরকার যদি নমনীয় হয়, আপোস করতে চায়, তাহলে নব্বই ও ২০০১ সালের মতো ভুল করবে। প্রথমেই দরকার মহাজোটকে সক্রিয় করা, মন্ত্রিসভায় রদবদল ও সরকারকে শক্তিশালী করা। স্বাধীনতার পক্ষের সকল দল ও নেতাকে কাছে টানা এবং একাত্তরের মতো লড়াকু কালচারাল ফ্রন্ট গঠন করা। সরকারের দরকার একটি শক্তিশালী প্রচার সেল এবং নিরপেক্ষ মিডিয়ার সমর্থন। এ সম্মিলিত শক্তি নিয়ে সরকারকে যুদ্ধের সকল ফ্রন্টে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সরকার যদি এ ঐক্যবদ্ধ ও আপোসহীন অবস্থান থেকে যুদ্ধে নামে, তাহলে দেখবে গণশত্রু এবং যুদ্ধাপরাধী শিবির থেকে যত হুঙ্কারই শোনা যাক, তা ফাঁকা এবং কাপুরুষদের নিষ্ফল হুঙ্কার।
বিদ্যুত-পানি-গ্যাস, দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে সরকার সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো যদি নেয় এবং জনগণের কাছে প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করে, তাহলে পরিস্থিতি যত দুর্বিষহ হোক, জনগণ তা মেনে নেবে। এ রকম দুর্বিষহ অবস্থা আগেও তাদের জীবনে এসেছে। দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যত শক্তিশালী হোক, তাদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। একই কথা সন্ত্রাস দমন সম্পর্কেও প্রযোজ্য। সন্ত্রাসীরা যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হয়, তাহলে তাদের শাস্তি আরও দৃষ্টান্তমূলক হওয়া দরকার। কোন ছাত্রীকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করে তারা যেন থানা থেকে হাসিমুখে বুক চিতিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে।
দেশের সমস্যা-সঙ্কট আরও বাড়ানোর জন্য যুদ্ধাপরাধী শিবির যে অবিরাম চক্রান্ত চালাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দেশের প্রত্যেকটি সমস্যার পেছনে রয়েছে তাদের সাবোটাজ; সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে তার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সরকারকে কোনভাবেই নমনীয় হলে চলবে না। নমনীয় হলে যুদ্ধের কোন ফ্রন্টেই সরকার জয়ী হবে না। কারণ প্রতিটি ফ্রন্টেই যুদ্ধাপরাধীরা চক্রান্তরত। তাদের লক্ষ্য ক্ষমতা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির উচ্ছেদ এবং তাদের আধিপত্য আবার প্রতিষ্ঠা করা। আর তা যদি হয় তাহলে স্বাধীন ও সেকু্যলার বাংলার অস্তিত্ব কোনভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক শিবিরের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখালে, আপোসের ভাব দেখালে তার পরিণতি কী হয় তা আমরা পঁচাত্তর ও ২০০১ সালে দেখেছি। যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া যাক, বঙ্গবন্ধু এ ঘাতকচক্রকে ক্ষমা প্রদর্শন করেছিলেন। সেই ক্ষমার মর্যাদা এ যুদ্ধাপরাধীরা কি রক্ষা করেছে? ক্ষমা লাভের সঙ্গে সঙ্গে এরা দেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয় এবং পাকিস্তানের জল্লাদচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটাতে মদদ যোগায়।
শেখ হাসিনাও তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এদের প্রতি অনুকম্পা দেখিয়েছিলেন এবং কৌশলে সাময়িক মৈত্রীও করেছিলেন। তার ফল কী দাঁড়িয়েছিল? জামায়াতীদের সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের হামলা, এমনকি ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের হত্যাকান্ড কি শেখ হাসিনা ঠেকাতে পেরেছিলেন? দেশকে আরেকটি মধ্যযুগীয় তালেবানী রাষ্ট্র করার জন্য জামায়াতীদের অব্যাহত সন্ত্রাসী চক্রান্ত কি বন্ধ করা গিয়েছিল? যদি যেত তাহলে কি আজ শিবিরের সন্ত্রাস দমনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে চিরুনি অভিযান চালাতে হয়?
এবারেও যদি দেশের সমস্যা-সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে যুদ্ধাপরাধীরা আবার বিচার ও দন্ড থেকে আপাতত হলেও রেহাই পায়, কিংবা তাদের প্রতি আবার নমনীয় মনোভাব দেখানো হয়, তাহলে এ বিচ্ছু চরিত্রের দলটি কিছুমাত্র সেই মহত্ত্বের মর্যাদা রৰা করবে না। বরং নতুন সাহস ও শক্তি নিয়ে দেশের স্বার্থ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী চক্রান্তে মেতে উঠবে, যার পরিণতি হতে পারে বাংলাদেশেও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো স্থায়ী ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়া।
আওয়ামী লীগ সরকারকে এবার তাই পেছালে চলবে না। বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন 'চার্চিলিয়ান ডিটারমিনিসন' নিয়ে শত্রুকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করলেই মাত্র যুদ্ধ জয় ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষা নিশ্চিত হবে। আপোস ও পিছিয়ে আসা পরাজয়ও ধ্বংসকে অনিবার্য করে তুলবে। যেমন করে তুলেছিল পঁচাত্তর ও ২০০১ সালে। এবার হাসিনা সরকারের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা হোক- রবীন্দ্রনাথের একটি বহুল উদ্ধৃত কবিতার ভাষায়-
"ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।"
লন্ডন, ২০ এপ্রিল, মঙ্গলবার ॥ ২০১০
এটা আমি সব সময় দেখেছি। আওয়ামী লীগ যত গণভিত্তিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হোক, প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে সে কখনোই বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে পেরে ওঠে না। এটা আওয়ামী লীগের একটা ইনহারেন্ট উইকনেস। আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা-সেল অত্যন্ত দুর্বল, নেই বললেই চলে। এ দুর্বলতার জন্য আওয়ামী লীগ প্রমাণিত সত্যকেও সত্য বলে জনগণের সামনে অনেক সময়েই তুলে ধরতে পারে না। আর বিএনপি-জামায়াত জোট নিছক গলাবাজির জোরে একেবারে অসত্য এবং মনগড়া বিষয়কেও সত্য বলে জনগণের সামনে তুলে ধরে এবং তাদের অনেককে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়।
আমাদের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদেরও বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তুলতে আওয়ামী লীগ বেশিরভাগ সময় ব্যর্থ হয়। একেবারে দলীয় এবং ব্যক্তিগত পছন্দের লোক না হলে অনেক বুদ্ধিজীবীকে তারা পছন্দ করেন না। আওয়ামী লীগের কখনও কখনও একলা চলার নীতি দলটির জন্য এবং দেশের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাদের যখন সুমতি ফেরে তখন দেখা যায় অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আবার দেশে একটি তথাকথিত নিরপেক্ষতার বিপজ্জনক কুয়াশার জাল তৈরি করে রেখেছে একাধিক সাবেক বাম সাংবাদিক ও সংবাদপত্র। এ কুয়াশার জালে বন্দী হয়ে অনেক বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীও দিশেহারা। তাঁরা দলীয় নয়, বরং বৃহত্তর জাতীয় ইস্যুতেও বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে মুখে খুলতে ভয় পান। যদি তাতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়া হয়ে যায়! অন্যদিকে আওয়ামী লীগও তেমনি চুয়ান্ন সাল ও একাত্তরের মতো স্বাধীনতার পক্ষের দলমত নির্বিশেষে সকল বুদ্ধিজীবীকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সরব সমর্থন আদায় করতে পারছে না। প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বাধীনতাবিরোধী জোটের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী কালচারাল ফ্রন্ট গড়ে তুলতে পারছে না। পারলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের শিবির থেকে এত হৈচৈ হৈহল্লা শোনা যেত না। তারা ভীত মূষিকের মতো নিজেদের গর্তে লুকিয়ে থাকত। মুখ বের করার সাহস পেত না।
চুয়ান্ন সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয় বা একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে গণবিজয় কেবল কোন দলের রাজনৈতিক শক্তির জোরে অর্জিত হয়নি; এ বিজয়ের পেছনে ছিল কালচারাল ফ্রন্টের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও সাফল্য। সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো এখন আবার নতুনভাবে প্রচারিত হয়ে নতুন প্রজন্মকে নতুনভাবে কি উদ্বুদ্ধ করছে না? বর্তমানে গণশত্রুদের আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে সেই ঐক্যবদ্ধ কালচারাল ফ্রন্ট কোথায়? বিশাল বুদ্ধিজীবী সমাবেশ কোথায়? এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো জাতীয় জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও একশ্রেণীর মিডিয়ার স্বার্থবুদ্ধি ও কূটবুদ্ধিপ্রসূত ভূমিকার জন্য একটি 'বিতর্কিত টপিক', যা টকশোতে শ্রোতাদের বিনোদনের জন্য প্রায়ই প্রচার করা হয়।
এই যে চারদিকে অসত্যের এবং মিথ্যাচারের এত ডামাডোল, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নজরুলের মতো এ প্রশ্নটি উচ্চারণের সাহস কি আজ মুষ্টিমেয় দু'একজন ছাড়া আর কোন বুদ্ধিজীবীর নেই?
"সত্যকে আজ হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়
নেই কিরে কেউ শক্তিসাধক বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়?"
এ শক্তিসাধক, সত্যসেবক মানুষ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নেই এ কথা বলব না, কিন্তু দূরবীন দিয়ে তাদের সংখ্যা আজ গুনতে হয়।
কথায় বলে 'প্রচার যুদ্ধে জয় আসল যুদ্ধ-জয়ের অর্ধেকটার বেশি।' দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ প্রচার যুদ্ধে আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই পিছিয়ে- নির্বাচনে ল্যান্ডস্লাইড ভিকটোরি সত্ত্বেও। এ বিজয়ের সাফল্য তারা কতদিন ধরে রাখতে পারবে তা আজ প্রশ্নবোধক। একটি শক্তিশালী প্রচার সেল, সম্মিলিত কালচারাল ফ্রন্ট এবং নিরপেক্ষ মিডিয়ার সমর্থন ছাড়া এ সাফল্য বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, আওয়ামী লীগের পক্ষের সাংস্কৃতিক সংস্থা এখন অনেক আছে। কিন্তু চুয়ান্ন ও একাত্তরের মতো তাদের ঐক্য ও সম্মিলিত কণ্ঠ এখন অনুপস্থিত। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ 'আননোন' নেতা ও মন্ত্রীরা মাঝে মাঝে যুদ্ধাপরাধীদের মিথ্যা প্রচারণার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন। তা যুক্তিতে যেমন দুর্বল, তেমনি সত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও যথেষ্ট অক্ষম।
এ পরিস্থিতিরই সুযোগ নিয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা। তারা স্বাধীনতার পক্ষের শিবিরের এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানগত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং এ সরকারকে একটি যুদ্ধপরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়ে তার চারপাশে বেষ্টন করে একটি শক্তিশালী বূ্যহ তৈরির চেষ্টা করছে। বেগম খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্য ঘোষণা না দিয়েও চট্টগ্রামের জনসভায় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার চরমপত্র দিয়েছেন এবং খুলনায় জনসভাতেও সেই রণবাদ্যই বাজিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এখন বোঝা উচিত, তিনি এবং তাঁর দল যতই জনসমর্থিত হোন, বর্তমান মুহুর্তে একলা চলার নীতি পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতেই হবে। বিদ্যুত-পানি-গ্যাস, দ্রব্যমূল্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সন্ত্রাস ইত্যাদি নানা সমস্যা জট পাকিয়েছে এবং সরকারকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। সরকারের পক্ষে পিছু হটার সুযোগ নেই, সময়ও নেই। যুদ্ধাপরাধীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। এই যুদ্ধপরিস্থিতির মুখে চার ফ্রন্টেই সরকারকে যুদ্ধ করতে হবে।
যুদ্ধ ছাড়া, কঠোর অবস্থান নেয়া ছাড়া সরকার যদি নমনীয় হয়, আপোস করতে চায়, তাহলে নব্বই ও ২০০১ সালের মতো ভুল করবে। প্রথমেই দরকার মহাজোটকে সক্রিয় করা, মন্ত্রিসভায় রদবদল ও সরকারকে শক্তিশালী করা। স্বাধীনতার পক্ষের সকল দল ও নেতাকে কাছে টানা এবং একাত্তরের মতো লড়াকু কালচারাল ফ্রন্ট গঠন করা। সরকারের দরকার একটি শক্তিশালী প্রচার সেল এবং নিরপেক্ষ মিডিয়ার সমর্থন। এ সম্মিলিত শক্তি নিয়ে সরকারকে যুদ্ধের সকল ফ্রন্টে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সরকার যদি এ ঐক্যবদ্ধ ও আপোসহীন অবস্থান থেকে যুদ্ধে নামে, তাহলে দেখবে গণশত্রু এবং যুদ্ধাপরাধী শিবির থেকে যত হুঙ্কারই শোনা যাক, তা ফাঁকা এবং কাপুরুষদের নিষ্ফল হুঙ্কার।
বিদ্যুত-পানি-গ্যাস, দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে সরকার সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো যদি নেয় এবং জনগণের কাছে প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করে, তাহলে পরিস্থিতি যত দুর্বিষহ হোক, জনগণ তা মেনে নেবে। এ রকম দুর্বিষহ অবস্থা আগেও তাদের জীবনে এসেছে। দ্রব্যমূল্যের ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যত শক্তিশালী হোক, তাদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। একই কথা সন্ত্রাস দমন সম্পর্কেও প্রযোজ্য। সন্ত্রাসীরা যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হয়, তাহলে তাদের শাস্তি আরও দৃষ্টান্তমূলক হওয়া দরকার। কোন ছাত্রীকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করে তারা যেন থানা থেকে হাসিমুখে বুক চিতিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে।
দেশের সমস্যা-সঙ্কট আরও বাড়ানোর জন্য যুদ্ধাপরাধী শিবির যে অবিরাম চক্রান্ত চালাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দেশের প্রত্যেকটি সমস্যার পেছনে রয়েছে তাদের সাবোটাজ; সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে তার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সরকারকে কোনভাবেই নমনীয় হলে চলবে না। নমনীয় হলে যুদ্ধের কোন ফ্রন্টেই সরকার জয়ী হবে না। কারণ প্রতিটি ফ্রন্টেই যুদ্ধাপরাধীরা চক্রান্তরত। তাদের লক্ষ্য ক্ষমতা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির উচ্ছেদ এবং তাদের আধিপত্য আবার প্রতিষ্ঠা করা। আর তা যদি হয় তাহলে স্বাধীন ও সেকু্যলার বাংলার অস্তিত্ব কোনভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক শিবিরের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখালে, আপোসের ভাব দেখালে তার পরিণতি কী হয় তা আমরা পঁচাত্তর ও ২০০১ সালে দেখেছি। যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া যাক, বঙ্গবন্ধু এ ঘাতকচক্রকে ক্ষমা প্রদর্শন করেছিলেন। সেই ক্ষমার মর্যাদা এ যুদ্ধাপরাধীরা কি রক্ষা করেছে? ক্ষমা লাভের সঙ্গে সঙ্গে এরা দেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয় এবং পাকিস্তানের জল্লাদচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটাতে মদদ যোগায়।
শেখ হাসিনাও তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এদের প্রতি অনুকম্পা দেখিয়েছিলেন এবং কৌশলে সাময়িক মৈত্রীও করেছিলেন। তার ফল কী দাঁড়িয়েছিল? জামায়াতীদের সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের হামলা, এমনকি ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের হত্যাকান্ড কি শেখ হাসিনা ঠেকাতে পেরেছিলেন? দেশকে আরেকটি মধ্যযুগীয় তালেবানী রাষ্ট্র করার জন্য জামায়াতীদের অব্যাহত সন্ত্রাসী চক্রান্ত কি বন্ধ করা গিয়েছিল? যদি যেত তাহলে কি আজ শিবিরের সন্ত্রাস দমনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে চিরুনি অভিযান চালাতে হয়?
এবারেও যদি দেশের সমস্যা-সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে যুদ্ধাপরাধীরা আবার বিচার ও দন্ড থেকে আপাতত হলেও রেহাই পায়, কিংবা তাদের প্রতি আবার নমনীয় মনোভাব দেখানো হয়, তাহলে এ বিচ্ছু চরিত্রের দলটি কিছুমাত্র সেই মহত্ত্বের মর্যাদা রৰা করবে না। বরং নতুন সাহস ও শক্তি নিয়ে দেশের স্বার্থ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী চক্রান্তে মেতে উঠবে, যার পরিণতি হতে পারে বাংলাদেশেও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো স্থায়ী ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়া।
আওয়ামী লীগ সরকারকে এবার তাই পেছালে চলবে না। বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন 'চার্চিলিয়ান ডিটারমিনিসন' নিয়ে শত্রুকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করলেই মাত্র যুদ্ধ জয় ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষা নিশ্চিত হবে। আপোস ও পিছিয়ে আসা পরাজয়ও ধ্বংসকে অনিবার্য করে তুলবে। যেমন করে তুলেছিল পঁচাত্তর ও ২০০১ সালে। এবার হাসিনা সরকারের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা হোক- রবীন্দ্রনাথের একটি বহুল উদ্ধৃত কবিতার ভাষায়-
"ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।"
লন্ডন, ২০ এপ্রিল, মঙ্গলবার ॥ ২০১০
No comments:
Post a Comment