Wednesday, April 14, 2010

স্মৃতির পাতায় অপ্রকাশিত একাত্তর ।। সাপ্তাহিক।

স্মৃতির পাতায় অপ্রকাশিত একাত্তর

চার দশক ছুঁই ছুঁই বয়সী বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল এক উজ্জ্বল আত্মত্যাগী আর রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের সেই মহিমান্বিত অগ্নিময় দিনগুলোতে সমস্ত বিপদ, সমস্ত সর্বনাশ মাথায় নিয়েই জাতি নেমেছিল এক সুগভীর আদর্শদীপ্ত, জীবনবাজি রাখা প্রত্যয়ে। যার নাম ‘স্বাধীনতা’। যার নাম ‘বাংলাদেশ’।
কেমন ছিল সেই রক্তময়, আত্মোৎসর্গের মহান যুদ্ধময় দিনগুলো?
কেমন ছিল চারপাশের দুর্যোগ আর দুর্ভাবনা ঢেলে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাবার সেই উদ্দীপনাময় ভালোবাসাঘন, জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনের ঘন মুহূর্তগুলো?

মোঃ আব্দুর রহিম একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। স্কুল পড়–য়া জীবনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান যুদ্ধে। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’Ñ এ মন্ত্রে দীক্ষা নেয়া। কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার রিফাইতপুর ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের হারান ম-লের পুত্র রহিম, তখন আর শুধু একজন কিশোর নন। একজন দেশপ্রেমিক, তেজোদীপ্ত বলিয়ান ‘মানুষ’।
কুষ্টিয়ার প্রাগপুর সীমান্ত পেরিয়ে শিকারপুর, বড়ইগাছি, বীরভূমের রামপুরহাট সেনানিবাস পর্যন্ত যার যাওয়া ওই একই মন্ত্রজপে।
ট্রেনিং শেষে যোদ্ধা বনে ৮ নম্বর সেক্টরে
মেজর এম এ মঞ্জুরের কাছে জোর আবদার জানিয়ে এসএমজি যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে দেশে ফেরা।
কাজীপুর সীমান্ত যুদ্ধ, শেরপুরের যুদ্ধ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ এসব এখন স্মৃতিময় অভিজ্ঞতার বর্ণাঢ্য ঝুলি আব্দুর রহিমের জন্য।

স্কুল পড়–য়া কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনের সেই বিস্ময়-বিপদÑবিজয় মাখা সময়ের কথা লিখে রেখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ আর রণাঙ্গনের লড়াইয়ের অবসর মুহূর্তে। ডায়েরির সঙ্গে সঙ্গে চিঠিও লিখেছেন বাবা, মা এবং প্রিয়তমাকে। চার দশকের ধূলি-ময়লা আর ধুসরতার পাতা ঘেঁটে এই ডায়েরির উদ্ধারকৃত অংশের উজ্জ্বল কিছু অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো প্রকাশ করছে সাপ্তাহিক।

চ্যানেল আই এবং আমীরুল ইসলামের সৌজন্যে পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের এই মূল্যবান দলিল, পঠনের সুবিধার্থে আধুনিক বানানরীতি- ভাষারীতিতে প্রকাশিত হচ্ছে। জব্বার হোসেন-এর সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঘেরা এই অপ্রকাশিত
চিঠি ও ডায়েরি গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন শুভ কিবরিয়া

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম-এর রণাঙ্গনের ডায়েরি

রাত ১২ টায় তাঁবুতে শয়ন করলাম। মাথার নিচে আছে পোঁটলা। শরীরটা বড়ই ক্লান্ত! ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো কভু”Ñ। তবুও ক্ষমা নাই! মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমানোর পর ভোর ৪টায় বেজে উঠল হাবিলদারের বাঁশির গর্জন। রুম থেকে উঠতে আমার একটু দেরি হলো। হঠাৎ বুঝলাম, শক্ত কিছু আমার পিছনের দিকে আঘাত দিচ্ছে। চেয়ে দেখি উস্তাদজির জুতার লাথি। বিছানা ছেড়ে দে দৌড়। হাত, মুখ ধৌত করে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা শেষে নাস্তা। তারপরই মার্চ পাস্ট করে অনুষ্ঠান স্থানে যাত্রা। আজ প্রশিক্ষণের তিরিশতম দিন এবং মিস্টার শর্মার বক্তব্যের পরই শুরু হবে আমাদের নিয়ে যাবার প্র¯ুÍতি। আমরা ২৫০০ প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা যোদ্ধা সৃশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে এসে পড়লাম। আটটার কিছু পর মেজর জেনারেল শর্মা এসে মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন।
সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে মিঃ শর্মা ভাষণ দিতে লাগলেন। তিনি উর্দুতে ভাষণ দিলেন। তিনি একজন শিখ জেনারেল। তার বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছিল ‘আপনারা সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেছেন এই সেনানিবাসে মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা যোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিতে। আপনাদের ১৮ দিনে ২৮টি অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শেখানো হয়েছে গেরিলা যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল। যে ট্রেনিং শেষ করতে কমপক্ষে এক বছর লাগে তা আপনাদের শেখানো হলো মাত্র আটাশ দিনে। এ এক দুরূহ কাজ। আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর অনুশীলন দ্বারা যেভাবে এই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করলেন ঠিক তেমনিভাবে আপনারা আপনাদের দেশে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করবেন। আর আপনাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করবেন। আমাদের দেশমাতা প্রিয় নেত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেকশ-এর পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। কষ্টকর প্রশিক্ষণের প্রতিটি কর্ম যেন কাজে লাগে।’
আমরা যথাসময়ে আপনাদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাব। আপনাদের দেশ স্বাধীন হবেই হবে। এই বলে আমাদের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ হোক, এই আশাবাদ ব্যক্ত করে জয় বাংলা, জয় ভারত, জয় হিন্দ, জয় শেখ মজিব, জয় ইন্দিরা গান্ধী বলে ভাষণ শেষ করলেন। আমরাও হাততালি ও স্যালুট দিয়ে তাকে সম্মান দেখালাম। অনুষ্ঠান শেষে স্ব স্ব তাঁবুতে ফিরে এলাম। মনে হচ্ছে জেল থেকে মুক্তি পেলাম। ৩০ দিনের কারাবাস শেষ হলো। আবার শুরু হবে এখান থেকে যাত্রা অন্য কোথাও। আজ তিরিশতম দিনের বাকি দিনের অংশটুকু ছুটি। আগামীকাল সকাল সাতটায় আমাদের কল্যাণীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু হবে। ইউনুছ, শাহজাহান, দাউদ, আজগার এদের নিয়ে পুরা ক্যান্টনমেন্টটাকে ঘুরে দেখলাম। দেখলাম এয়ারপোর্ট সেনানিবাসের প্রায় ১০/১২ মাইল এলাকায় গড়ে উঠেছে। বড় বড় বিল্ডিং, ফায়ারিং এরিয়া, অবসটেকল ফিল্ড, খেলার মাঠ, পিটি প্যারেড মাঠ। সেনানিবাসের কয়েকটি সিনেমা হলে শুধুমাত্র হিন্দি ছবি চলছে। একটি হলে ‘সোলে’ চলছিল। আজগার, দাউদ, উজির, জলিল ভাই, ইউনুছ, জয়নুদ্দিন বিলাস আঃ রাজ্জাক এদের নিয়ে ‘সোলে’ দেখে মনটা ভরে গেল। যেন এক দুঃসাহসিক অভিযান, প্রতিশোধ জিঘাংসার এক বাস্তব চিত্র।

২.
সিনেমা শেষে তাঁবুতে ফিরে এলাম। রাতের খানা শেষ করে পোঁটলাটা মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে গেছি। ৪টায় বাঁশির শব্দে যার যার মতো উঠে সকল কর্ম সেরে যাবার প্রস্তুতি। নাস্তা শেষে পোঁটলাটা ঘাড়ে করে আবার ফলিং। ওস্তাদ সুবেদার বাদল রায়, আব্দুল লতিফ, ক্যাপ্টেন হোসিয়ারী ও ক্যাপ্টেন অধিকারী সিং বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করল এবং এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলো। বলল, আমাদের কষ্টার্জিত প্রশিক্ষণ, গেরিলা কৌশল, যুদ্ধ কৌশলগুলো তোমরা দেশে গিয়ে পাক সেনাদের ওপর প্রয়োগ করবে। তারা পরাজিত হবেই। আর হয়ত হবে না দেখা কোনোদিন। বহমান নদী বইতে বইতে কোথায় শেষ হবে কেউ জানে না, ঠিকানাও হারিয়ে যাবে একদিন ! ব্যস আমরা তোমাদের মঙ্গল কামনা করছি। তোমাদের চলার পথ যেন কুসুমাস্তীর্ণ হয় এবং যার জন্য এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, হেতায় করেছে। আগমনÑ সেই দু®প্রাপ্য ‘স্বাধীনতা’ যেন তাড়াতাড়ি অর্জিত হয় এই কামনাই রইলÑ তোমাদের যাত্রা পথ সুগম হোক, ‘জয় বাংলা’, জয় হিন্দ, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় ইন্দিরা গান্ধী বলে বিদায় দিলেন। আমরাও দেশে ফেরার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে লাইন ধরে স্ব স্ব আর্মির পরিবহন গাড়িতে উঠলাম।

৩.
আবার সেই রামপুর হাট স্টেশনে এসেই দেখি আমাদের জন্য রিজার্ভ ট্রেন। আড়াই হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত (বিষষ ঃৎধরহবফ) মুক্তিযোদ্ধা। এদের উপরেই নির্ভর করছে পাকসেনা ও রাজাকারদের খতম ও দেশকে শত্রুমুক্ত এবং স্বাধীন করা। গর্বিত ট্রেনটা! কারণ, এ দেশের বীর ও সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের বহন করছে। আবার শুরু হলো পথ চলা, সেই পথে, যে পথে এসেছিলাম একদিন। আবার দেখা হলো বিশ্ব কবির স্মৃতি বিজড়িত ‘বোলপুর’ স্টেশন। যেখানে আছে ‘শান্তি নিকেতন’, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই আছে কবির স্মৃতিবিজড়িত দু®প্রাপ্য নোবেল পুরস্কারের সেই ক্রেস্ট যা স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত। আজ আবার দেখা হয়ে গেল, কত দিনের কত স্মৃতি মনে পড়ে গেল, তুমি ভালো আছ তো। যে পথে এলাম, আবার সেই পথেই গেলাম। যাওয়া আর আসা, ওই তো দুনিয়ার খেলা। ব্যান্ডেল, আসানসোল, বাতাসপুর, হাওড়া, রানাঘাট। তারপরই থেমে গেল আমাদের বহনকারী ট্রেনটির গতি। শিয়ালদহ হবার পর এখন রানাঘাটের জৌলুস অনেকটা কমে গেছে। বোম্বে এক্সপ্রেস, মাদ্রাজ, দিল্লি এক্সপ্রেস, রাজধানী এক্সপ্রেস, আগ্রা, জবলপুর, কেরালা, দেরাদুন, মাদ্রাজ প্রভৃতি দূরপাল্লার ট্রেনগুলো এখান থেকেই ছাড়ে।
আমরা রানাঘাট থেকে বাসে চড়ে কল্যাণী ক্যাম্পে হাজির হলাম। আবার সেই তাঁবুতে বাস। এখানে এসে ক্যাম্প ইনচার্জ বললেন, দৌলতপুর থানায় অনেক বেশি মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য থানায় পাঠানো মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যায় এখনো সমতা আসেনি। যে কয়দিন সমতা না আসবে ততদিন আপনাদের এখানে অপেক্ষা করতে হবে। আবার কি! খাওয়া আর ঘুমানো। প্রত্যেক দিনই মাংস পেতাম, সঙ্গে থাকত সবজি, মাছ, ডাল। কল্যাণীকে সেকেন্ড কলকাতা বলা হয়। অনেক বড় শহর। বিশাল এরিয়া, আমরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো সারা শহর ঘুরতাম। দেখতাম হিন্দুদের জীবনমান, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিধিবিধান, পূজাম-প আর মেয়েদের খোলামেলা বিচরণ। তাঁবুতে বসে শুনতাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল অনুষ্ঠান। এম আর আকতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠান ছিল অত্যন্ত প্রিয়। উনার খুঁদা খুঁদা উচ্চারণ’, বিভিন্ন রণাঙ্গন পাক সেনাদের পরাজয়, নিহত হওয়ার খবর, থানা আক্রমণ, রাজাকার প্রধানের মৃত্যু, মুক্তিযোদ্ধাদের মারের চোটে ছেড়ে দে-মা পালিয়ে বাঁচি ইত্যাদি কথা শুনে চরম পুলকিত হচ্ছি। উজ্জীবিত হচ্ছি। এ ছাড়া দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আকাশ বাণীর খবরও বেশ ভালো লাগছে। কণ্ঠ শিল্পী আব্দুল জব্বারের ‘মজিব বাইয়া যাওরে..., সালাম সালাম হাজার সালাম, আপেল মাহমুদের ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘সোনা সোনা, সোনা লোকে বলে সোনা, ‘তোরা সব জয়োধ্বনি কর’ ইত্যাদি গান বেশ মজা লাগছে। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের কিছু অংশ নিয়ে ‘বজ্রকণ্ঠ’ শুনে চরমভাবে উজ্জীবিত ও পুলকিত হচ্ছি। জল্লাদের দরবারও বেশ ভালো লাগছে। কল্যাণীর পাশেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহী কবিতা ‘বল বীর, চির উন্নত মমশির, ওই শরি নেহারী শিখর হিমাদ্রীর’ Ñশুনে কি যে আত্ম বিশ্বাস বাড়ছে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয়ে।
দু’সপ্তাহ হেসে খেলেই খাটল কল্যাণীতে। এখানে বেশ সুখেই আছি। জলিল, পলান, ইদ্রিস, ইউনুছ, দাউদ, আজগর, রাজ্জাক, শাহজাহানসহ আরো অনেকেই আছি পাশাপাশি তাঁবুতে যেন প্রতিবেশীর মতো, সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে।

৪.
ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে এখন শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। কল্যাণীর কিছু শরণার্থী ক্যাম্পে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কি নিদারুণ মানবিক বিপর্যয়! নারী, শিশু ও বৃদ্ধাদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তাঁবুতে ঠাঁই হয়েছে ঠিকই কিন্তু খাদ্যের তীব্র অভাব। সারাদিনে এক বাটি খিচুড়ি। এ যেন ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। ডায়রিয়া, আমাশয়, ইনফ্লুয়েঞ্জ, জন্ডিস, টাইফয়েড, পুষ্টিহীনতা, নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে বহু শিশু ও বৃদ্ধ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। যেন কঙ্কাল সার। শরণার্থী শিবিরের হাহাকার সব হারানোর কান্না, ক্ষুধা ও মৃত্যুর যন্ত্রণা দেখে মনটা এতই বেদনাহত হলো যে, পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ওরা মানুষ না, ওরা নিষ্ঠুর দানব। রাজাকারদের দিয়ে আমাদের যুবতী মেয়েদের জোরপূর্বক ধরে ক্যাম্পে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ, গর্ভবতী করা। এটা পশুদের দ্বারাও সম্ভব হয় না। ধর্ষণের পর মেরে ফেলা কি নিষ্ঠুরতা! পাক বাহিনীর মানবতা বলতে কিছুই নেই।
বাঙালির ওপর এত প্রচ- আক্রোশ, আঘাত, নিষ্ঠুরতা, মানবতাকে পদদলিত করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশটাকে মেধাশূন্য করে দিচ্ছে। শরণার্থীদের করুণ দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি রণাঙ্গনে গিয়ে প্রতিশোধের আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করে তীব্র প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার আসছে বারে বারে। অনেক শরণার্থী শিবির দেখে দেখে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণকারী পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মাল এই কারণে যে, এক কোটি বাংলাদেশি আজ ভারতে। শুধুমাত্র তাদের অত্যাচার নির্যাতনের আর স্বাধীনতা চাওয়ার অপরাধে!!

৫.
দু’সপ্তাহ কাটালাম কল্যাণীতে বেশ খোশ মেজাজেই! কলকাতার বৌÑবাজার, শিয়ালদহ, দমদম এয়ারপোর্ট, পাতালরেল, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি জায়গা ঘুরে আদেশ হলো শিকারপুর এ্যাকশন ক্যাম্পে যাওয়ার। তড়িঘড়ি করে পোঁটলা ঘাড়ে আবার যাত্রা হেতা হতে সেথা। রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, বেতাই, করিমপুর পেরিয়ে শিকারপুর পৌঁছে গেলাম একাত্তরের জুলাই মাসের দুই তারিখে। আট নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এমএ মঞ্জুর আমাদের বরণ করে নিলেন অতি সম্মান ও আদরের সহিত। তিনি ওইদিনই সন্ধ্যায় শপথ, অস্ত্র বণ্টন ও বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে বললেন। তড়িঘড়ি করে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাত আটটায় অস্ত্র বণ্টন শুরু হলো। ২৫ সদস্যের প্লাটুনের কমান্ডার হলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের সলুয়াগ্রামের আব্দুল জলিল ও পিয়ারপুরের পলান আলী। এই প্লাটুনে চারটি এসএমজি, চারটি এলএমজি, চারটি এসএলআর ও বাকি তেরোটি রাশিয়ান চৌদ্দ কেজি ওজনের থ্রি-নটÑথ্রি রাইফেল, যার তিনশত রাউন্ড গুলিসহ ওজন হবে প্রায় কুড়ি কেজি।
দলে আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা; পনের বছরের কিশোর যোদ্ধা অস্ত্র বণ্টনেও কিছুটা সুবিধাবাদীর আশ্রয় গ্রহণ করা হলো। প্রভাবশালী ও বয়স্করা তাদের সুবিধামতো হালকা ওজনের অস্ত্র তাদের নামে বণ্টন করে নিল আর আমার নামে দিল রাইফেল। একদিকে অল্প বয়স ও ক্ষীণ স্বাস্থ্য। অপরদিকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, গুলি, গ্রেনেড, বিভিন্ন প্রকারের বোম ও পোঁটলাসহ ওজন হলো প্রায় আটত্রিশ কেজি। এত ওজন বহন করে রণাঙ্গনে গিয়ে সঠিকভাবে যুদ্ধ করা কঠিন ভেবে আমি কান্না শুরু করে দিলাম। এক সময় আমার স্নেহপরায়ণ, দরদি ও অত্যন্ত উদার মনের অধিনায়ক মেজর এম এ মঞ্জুর আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে বৎস তোমার? চোখ আর নাকের জলে সিক্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, স্যার আমার প্লাটুনের ২৪ জনই আমার থেকে সিনিয়র অথচ আমার নামে এ্যালোট করেছে রাইফেল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোন অস্ত্র চাও’? কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘স্টেনগান’। তিনি তৎক্ষণাৎ কমান্ডার জলিলকে আমার নামের রাইফেল বরাদ্দ বাতিল করে পুনঃ বরাদ্দ করলেন একটি স্টেনগান ও দুটি ম্যাগাজিন, যার মধ্যে ধরে ২৮টি গুলি। যে স্টেনগানটির নং-৯১৫৪। আরো দিল ৩০০ রাউন্ড গুলি।
পাঁচ কেজি ওজনের স্টেনগান! অর্থাৎ এসএমজি মানে শর্ট মেশিনগান। যার ওজন ৩-৪ কেজির অধিক নয়। মনটা আনন্দে নেচে উঠল ঠিকই, তবে সমস্যা একটা থেকেই গেল। আর তা হলো, স্টেনগানের রেঞ্জ (জধহমব) হলো ৪০ গজ। নিকটের শত্রুকে ব্রাশ ফায়ারে মারা খুব সহজ। অস্ত্রের বণ্টননামা শেষে শপথ অনুষ্ঠান। টেবিলের ওপর পবিত্র কোরআন শরীফের ওপর হাত রেখে অধিনায়ক স্যার মেজর এম এ মঞ্জুর শপথ বাক্য পাঠ করালেন। বললেন, ‘আমি বাংলাদেশে ঢুকে যুদ্ধ করে শত্রুকে খতম করে দেশকে স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জানমাল, নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করব এবং অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করব না। আমার জীবন, অস্ত্র, গোলাবারুদ সযতেœ সংরক্ষণ করব এবং বেসামরিক নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করব না। চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণসহ যে কোনো অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকব।
শপথ অনুষ্ঠান শেষে খানা খেয়ে রাত এগারোটার দিকে অধিনায়ক স্যার মেজর এম এ মঞ্জুর আমাদের ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিদায় দিলেন এবং বললেন, ‘দেশ শুত্রুমুক্ত ও স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের এই দুর্গম পথ চলা বন্ধ হবে না। মনে রেখ, ‘দুর্গম গিরি নিশা তো রাতেই পার হতে হয়।’ ‘তোমরা আফ্রিকার জঙ্গলের গেরিলা না হলেও শ্যামল-সবুজ বাংলার দুরন্ত গেরিলা। শত্রুকে মারবে কিন্তু নিজে মরবে না। পালিয়ে আসবে কৈৗশলে এবং এটাই হলো গেরিলা যুদ্ধের মূল ও একমাত্র নীতি’।
আমাদের যাত্রা হলো শুরু রণাঙ্গনের দিকে রাতের আঁধারে। শিকারপুর থেকে কিছু দূরেই হাইলি নদী; পাকিস্তান ও ভারতকে বিভক্ত করেছে এ নদী দুটো দেশে। এই প্রচ- স্রোতবাহী নদীটি সাঁতরিয়ে পার হতে হবে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও পোঁটলাসহ। কি কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। অস্ত্র হারালেই কোয়ার্টার গার্ড শাস্তি!! এই নদীর পরই শুরু হলো কাজিপুর মাঠ ও গ্রাম; যা বাংলাদেশ অংশ। অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তান অংশ। মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখায়ে শিকারপুর থেকে কোড়ইগাছি এবং সেখান থেকে সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বীরভূমের রামপুরহাট সেনানিবাসে গমন ও প্রশিক্ষণ শেষে কল্যাণী হয়ে শিকারপুর এ্যাকশন ক্যাম্প এই পর্যন্তই প্রশিক্ষণ অধ্যায়।

৬.
কাজীপুর সীমান্ত যুদ্ধ
১৯৭১ সালে ভারতের বীরভূমের রামপুরহাট সেনানিবাসে অস্ত্রযুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে কল্যাণীতে এসে কিছুদিন বিশ্রাম শেষে শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাকশন ক্যাম্পে হাজির হলাম আমাদের এলাকার সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার পিয়ারপুর ইউপির সলুয়া গ্রামের সাহসী, তেজোদীপ্ত, সুশিক্ষিত ও যুক্তিবাগীশ ব্যক্তিত্ব আব্দুল জলিল ভাইয়ের নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীর দল গঠিত হলো। ওই দলে আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। সপ্তম শ্রেণীতে পড়–য়া ১৫ বছরের কিশোর যোদ্ধা। আমাদের দলে বরাদ্দকৃত একটি মেশিনগান, দুটি এলএমজি ও চারটি এসএমজি ছিল সবচেয়ে হালকা ও পাতলা অস্ত্র। বাকিগুলো সবই রাশিয়ান থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল।
পাক-সীমান্ত সংলগ্ন হাইলি নদীর ভারত অংশে এক বিশাল আম্রকাননের পশ্চিম অংশে পৌঁছানোর পর সঙ্কেত পেলাম যে এই বাগানের পূর্ব অংশে শত্রুবাহিনী আমাদের পুরো প্লাটুনকে নিঃশেষ করার জন্য অবস্থান নিয়েছে। আম্রবাগানে গাঢ় অন্ধকার আর ঝি ঝি পোকার আওয়াজ আর অতি সতর্কতার সহিত আমাদের যাত্রা। এক সময় শত্রুবাহিনীর মুখোমুখি হওয়ায় অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু হলো। আমরা হঠাৎ আক্রমণে একটু ছত্রভঙ্গ হয়ে যার যার অবস্থান থেকে ফায়ার করতে লাগলাম। অন্ধকারে ক্রলিং করতে করতে এক সময় একটি নিচু গর্ত খুঁজে পেলাম। সেটাকেই নিরাপদ বাংকার মনে করে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলাম। এ সংবাদ শিকারপুর ক্যাম্পে পৌঁছে গেল। আমাদের সহযোগিতার জন্য সেখান থেকে শেল বম্বিং শুরু করল। আমরা অন্ধকারে শুধু অনুমানে গুলি ছুড়ছি। এক সময় পূর্ব আকাশে আলোর ঝলকানি দেখে বুঝলাম ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। আস্তে আস্তে গোলাগুলি থেমে আসতে লাগল। অন্ধকার কেটে যখন ভোরের আলো জেগে উঠল তখন দেখি আমার নিরাপদ ব্যাংকারটি একটি দেবে যাওয়া পুরনো কবর। আর সারারাত আমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করলাম, তারা পাকবাহিনী নয়। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাড়াগাংদিয়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পালুর বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হলো। কি মারাত্মক ভুল বুঝাবুঝি! যদিও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি কিন্তু পালু বাহিনী বাড়াগাংদিয়া পাকসেনা ক্যাম্প থেকে ১০-১২ জন রাজাকার ধরে শিকারপুর এ্যাকশন ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিল। যাত্রার শুরুতেই বিভ্রাট!! আমি, ওমর, আজগর, কাশেম, শাজাহান, দেলুচাচা, রহমতউল্লাহ, ইছমাইলসহ আরো অনেকে আতঙ্কে খরস্রোতা হাইলি নদী সাঁতরিয়ে পার হতে গিয়ে সহযোদ্ধা আজগার তার রাইফেল নদীতে স্রোতের তোড়ে পড়ে ফেলে দিতে বাধ্য হয়। সকালে এক জেলেকে ডেকে এনে জালের সাহায্যে অনেক চেষ্টার পর সেই রাইফেল উদ্ধার হলো। ভুল সিগন্যালে একটা বিশাল ক্ষতি থেকে রক্ষা পেলাম দু’দলই। যুদ্ধে আহত হওয়া ছাড়া কেউ মারা যায়নি।

No comments: