মাহবুবুর রহমান জালাল, মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত বিশ্বকোষ
আবদুল্লাহ আল ইমরান
ক্ষমতার পালাবদলে পাঁচ বছর পর পর বদলে যায় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস। বছরের পর বছর ধরে সরকারের অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। '৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোতে ঘাপটি মেরে থাকা '৭১ সালের পরাজিত শক্তি ও প্রেতাত্দারা কৌশলে ধ্বংস করেছে অনেক মূল্যবান উপাদান। রাষ্ট্রীয় আর্কাইভগুলো থেকে সরিয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এখন প্রয়োজন সেই সময়কার পেপার কাটিং, সংবাদ, ছবি, প্রবন্ধ নিবন্ধ, চলচ্চিত্র, গান, পোস্টার, ভিডিও চিত্র, বিভিন্ন দূতাবাসের পাঠানো প্রেসনোট এবং বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রকাশিত সংবাদ; যাতে করে প্রমাণ করা যায় চিহ্নিত ব্যক্তিদের অপরাধ। অথচ সরকারি তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেনি সেই সময়কার মূল্যবান দলিলপত্রের কোনো সংগ্রহশালা।
দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিলগুলো সহজে খুঁজে পাওয়া আজ কষ্টকর। দেশে যে কাজটি সরকারের পক্ষেই করা সম্ভব হয়নি, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই দুরূহ কাজটিই বিদেশের মাটিতে করেছেন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জালাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস প্রবাসী এ মানুষটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত বিশ্বকোষ বলা যায় জালালকে, যিনি পরম মমতায় সংগ্রহ করে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিল ও ইতিহাস। দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহের অব্যবস্থাপনা এবং ক্রমে বিলুপ্ত হতে দেখে জালাল ভেতরে ভেতরে এগুলো সংরক্ষণের তাড়না অনুভব করেন। নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পেঁৗছে দিতে চান স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সে কারণেই নিজ অর্থ এবং পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন অপূর্ব এক সংগ্রহশালা। কী নেই তাঁর সংগ্রহে? বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত যাবতীয় খবর জালালের সংগ্রহে আছে, যার মাধ্যমে জানা যাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি এবং কখন, কোথায়, কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। একাত্তরে মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে যে শুনানি হয়, তার বিশদ বর্ণনাও সংরক্ষিত আছে তাঁর কাছে। কয়েক বছর আগে মার্কিন প্রশাসন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেছে গোপন প্রামাণ্য দলিল। সে দলিলও সংগ্রহ করেছেন জালাল। আছে বাংলা, ইংরেজি এবং উর্দু ভাষায় রচিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর পাঁচ শতাধিক বই। জালাল জানান, 'আমার কাছে সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত বই এবং লেখাগুলো। কেননা সেখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের সব বক্তব্য এবং দালাল, আলবদর ও আলশামসদের অপরাধের বিবরণ পাওয়া যায়।' মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত সাহিত্য, গান, পোস্টার, সিনেমা কিংবা দুর্লভ সব স্থিরচিত্র_যেখানে যা পেয়েছেন সংগ্রহ করেছেন তিনি। একজন প্রবাসী বাঙালি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে অবিকৃতভাবে তা জানানোতে যে বিশাল ভূমিকা পালন করছেন সেটি সত্যিই বিরল।
যেভাবে শুরু
জালাল জানালেন তাঁর সংগ্রহশালা তৈরির গোড়ার কথা। 'স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের বাসায় '৭১ সালের বই-পত্রিকা সংগ্রহ করা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আমার মেঝ ভাইয়ের মাধ্যমে আমেরিকা আসার সুযোগ পেলে সংগ্রহ কার্যক্রম আরো ব্যাপকতা পায়।' জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর যখন একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন তখন জালালের স্বপ্নগুলো ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল। তাঁর ভাষায়, 'বিরাশিতে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর মনে হলো বাংলাদেশ আর নিরাপদ নয়। অনেক উত্থান-পতন দেখলেও সুদিন যে আসবে সে বিশ্বাস হৃদয়ে ছিল। কিন্তু নতুন করে সামরিক শাসন শুরু হলে আশাবাদী হওয়ার আর কোনো কারণ অবশিষ্ট থাকল না। এরপর স্ত্রী-শিশুকন্যাকে নিয়ে মেঝ ভাইয়ের মাধ্যমে দেশান্তরী হই। আমেরিকায় বসতি স্থাপনের বাসনা আমার কোনোকালেই ছিল না।' সেখানে বসেই তিনি শুরু করেন স্বাধীনতার দলিল বা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মূল কাজ। ডালাসে নিজ বাসাতেই গড়ে তুলেছেন আর্কাইভ। এটি ছিল নেশার মতো। স্বল্প আয়ের মধ্যেও তিনি চালিয়ে গেছেন ব্যয়বহুল এ সংগ্রহ অভিযান। যেখানেই নতুন কোনো তথ্যের খোঁজ পেয়েছেন গুরুত্বের সঙ্গে সংগ্রহ করেছেন সেটি। এ সংগ্রহশালার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানো যেমন জালালের উদ্দেশ্য, তেমনি রয়েছে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, 'এ দলিলপত্রের মাধ্যমে শুধু বীরত্বের কথা নয়, বরং যেটি বিশেষ করে জানা যাবে সেটি হলো, কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, একাত্তরে কাদের সরাসরি মদদে শান্তি কমিটি, আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনীগুলো গঠিত হয়েছিল এবং মানবতার বিরুদ্ধে কী জঘন্য অপরাধ তারা করেছিল। হানাদারদের দোসর জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের নেতারা সেদিন দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কী ভূমিকা নিয়েছিল_সেসব তথ্য আজকের আলো-আঁধারিতে ঘেরা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে জানাতেই মূলত আমার এ কাজের সূচনা।' এ সংগ্রহের কাজে তাঁকে অনেক প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে। তাঁর ভাষায়_'আমার নজর সব সময় ছিল দুর্লভ তথ্যগুলোর দিকে। সেসব বই বা দলিল সংগ্রহ করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হতো। তা ছাড়া পাওয়াও যেত না সব সময়। এখানকার লাইব্রেরিগুলোয় (আমেরিকায়) একটা নিয়ম আছে। নাম 'ইন্টারলোন'। এ নিয়মে কোনো লাইব্রেরিতে কোনো বই না থাকলে অন্য লাইব্রেরি থেকে তারা কাঙ্ক্ষিত বই গ্রাহকদের সংগ্রহ করে দেয়। এভাবেই বইগুলো বা তথ্যগুলো জোগাড় করেছি।' তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'সবচেয়ে বেশি অসুবিধা বাংলাদেশ থেকে কোনো বই বা তথ্য সংগ্রহ করা। বাংলাদেশের কেউ আমার কাছে তথ্যসংক্রান্ত কোনো সাহায্য চাইলে আমি যেভাবেই পারি তা পাঠাই; কিন্তু আমি যখন কিছু চাই তা আর পাই না।' এত কিছুর পরও তিনি মনে করেন, দেশের প্রতিটি মানুষের জানা দরকার মুক্তিযুদ্ধে কাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ এবং কারা চায়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হোক। সে জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। আর এ তাগিদেই জাতীয় এই গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন এম এম আর জালাল।
ক্লান্তিহীন নিরলস প্রচেষ্টা
মাহবুবুর রহমান জালালের সংগ্রহশালা এতটাই সমৃদ্ধ যে শুধু প্রবাসীরাই নন, বাংলাদেশের বহু বরেণ্য ব্যক্তি, গবেষক ও প্রচারমাধ্যমের সংশ্লিষ্টরা প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত তথ্যের জন্য তাঁর শরণাপন্ন হন। তিনিও হাসিমুখে তাঁদের সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তাঁর নামটি প্রচার হোক সেটিও তিনি চান না। তাঁর কষ্ট করে গড়ে তোলা তথ্যভাণ্ডার দিয়ে অন্যরা নাম কামাচ্ছে এ নিয়েও তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই, আছে আনন্দ। সে আনন্দ আগামী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে পারার। দেশের কোনো সাংবাদিকের যেকোনো তথ্যের প্রয়োজনে তিনি সদা প্রস্তুত। নিজ তাগিদেই তিনি কাঙ্ক্ষিত দলিল ও তথ্য পিডিএফ ফাইল করে ই-মেইল করেন সাহায্যপ্রার্থী সাংবাদিকের কাছে। এভাবেই ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে এ দেশের মানুষকে রক্ষা করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। প্রতিদিন সকালে ইন্টারনেটে বাংলাদেশের খবর পড়ে তাঁর দিন শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেলে তিনি তা সংগ্রহশালায় আর্কাইভ করে রাখেন। প্রবাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি হাজির হন তাঁর বিপুল সংগ্রহশালা নিয়ে। একটা টেবিল নিয়ে বসে পড়েন তা প্রদর্শনে। তিনি বলেন, 'সবাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা শুনতে চায়। কেউ জানতে চায় না গণহত্যা কারা করেছিল, কারা নারীদের নির্যাতন করেছিল। আমার সংগ্রহটা সেসব মানুষকে চিনতে সাহায্য করবে। যখন কোনো মা তাঁর সন্তানকে এগুলো দেখিয়ে বলেন, দেখ বাবা, মানুষ নামের নরপশুগুলো কী ভয়ঙ্কর কাজ করেছিল, তখন খুব ভালো লাগে।' বিদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের গান, পোস্টার, সাহিত্য, সিনেমা, ছবি, পেপার কাটিং, দেশি-বিদেশি দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে সঠিক ইতিহাস বিতরণে তিনি রেখে চলেছেন অনবদ্য এক ভূমিকা। মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও তথ্য প্রদর্শনীর জন্য প্রবাসীদের কাছ থেকে পেয়েছেন 'সুচিন্তা স্বাধীনতা পদক ২০০৬'। এ ছাড়াও ওয়ার্ল্ড স্ট্যাম্প এক্সিবিশনে ব্রোঞ্জ পদক তাঁর কাজের আর একটি স্বীকৃতি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জালালের সংগ্রহশালা
সম্প্রতি সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে। চলছে অপরাধের সাক্ষী ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কার্যক্রম। তদন্তকারী সংস্থার প্রতিনিধিদল বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে তথ্য দিয়ে তদন্তে সহযোগিতা করছেন। চলছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত তথ্যের যাচাই-বাছাই। এ পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারী সংস্থার জন্য জালালের সংগ্রহশালা রাখতে পারে সহায়ক ভূমিকা। বাংলাদেশ সরকার চাইলে জালাল নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেবেন সহযোগিতার হাত। কেননা জালাল মনেপ্রাণে প্রার্থনা করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। সে বিচার কার্যক্রমে তাঁর সংগ্রহশালা বিন্দুমাত্র কাজে লাগলেও সার্থক হবে তাঁর পরিশ্রম।
আবদুল্লাহ আল ইমরান
ক্ষমতার পালাবদলে পাঁচ বছর পর পর বদলে যায় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস। বছরের পর বছর ধরে সরকারের অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। '৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোতে ঘাপটি মেরে থাকা '৭১ সালের পরাজিত শক্তি ও প্রেতাত্দারা কৌশলে ধ্বংস করেছে অনেক মূল্যবান উপাদান। রাষ্ট্রীয় আর্কাইভগুলো থেকে সরিয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এখন প্রয়োজন সেই সময়কার পেপার কাটিং, সংবাদ, ছবি, প্রবন্ধ নিবন্ধ, চলচ্চিত্র, গান, পোস্টার, ভিডিও চিত্র, বিভিন্ন দূতাবাসের পাঠানো প্রেসনোট এবং বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রকাশিত সংবাদ; যাতে করে প্রমাণ করা যায় চিহ্নিত ব্যক্তিদের অপরাধ। অথচ সরকারি তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেনি সেই সময়কার মূল্যবান দলিলপত্রের কোনো সংগ্রহশালা।
দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিলগুলো সহজে খুঁজে পাওয়া আজ কষ্টকর। দেশে যে কাজটি সরকারের পক্ষেই করা সম্ভব হয়নি, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই দুরূহ কাজটিই বিদেশের মাটিতে করেছেন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জালাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস প্রবাসী এ মানুষটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত বিশ্বকোষ বলা যায় জালালকে, যিনি পরম মমতায় সংগ্রহ করে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিল ও ইতিহাস। দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহের অব্যবস্থাপনা এবং ক্রমে বিলুপ্ত হতে দেখে জালাল ভেতরে ভেতরে এগুলো সংরক্ষণের তাড়না অনুভব করেন। নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পেঁৗছে দিতে চান স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সে কারণেই নিজ অর্থ এবং পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন অপূর্ব এক সংগ্রহশালা। কী নেই তাঁর সংগ্রহে? বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত যাবতীয় খবর জালালের সংগ্রহে আছে, যার মাধ্যমে জানা যাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি এবং কখন, কোথায়, কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। একাত্তরে মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে যে শুনানি হয়, তার বিশদ বর্ণনাও সংরক্ষিত আছে তাঁর কাছে। কয়েক বছর আগে মার্কিন প্রশাসন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেছে গোপন প্রামাণ্য দলিল। সে দলিলও সংগ্রহ করেছেন জালাল। আছে বাংলা, ইংরেজি এবং উর্দু ভাষায় রচিত মুক্তিযুদ্ধের ওপর পাঁচ শতাধিক বই। জালাল জানান, 'আমার কাছে সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত বই এবং লেখাগুলো। কেননা সেখানে স্বাধীনতাবিরোধীদের সব বক্তব্য এবং দালাল, আলবদর ও আলশামসদের অপরাধের বিবরণ পাওয়া যায়।' মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত সাহিত্য, গান, পোস্টার, সিনেমা কিংবা দুর্লভ সব স্থিরচিত্র_যেখানে যা পেয়েছেন সংগ্রহ করেছেন তিনি। একজন প্রবাসী বাঙালি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে অবিকৃতভাবে তা জানানোতে যে বিশাল ভূমিকা পালন করছেন সেটি সত্যিই বিরল।
যেভাবে শুরু
জালাল জানালেন তাঁর সংগ্রহশালা তৈরির গোড়ার কথা। 'স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের বাসায় '৭১ সালের বই-পত্রিকা সংগ্রহ করা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আমার মেঝ ভাইয়ের মাধ্যমে আমেরিকা আসার সুযোগ পেলে সংগ্রহ কার্যক্রম আরো ব্যাপকতা পায়।' জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর যখন একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন তখন জালালের স্বপ্নগুলো ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল। তাঁর ভাষায়, 'বিরাশিতে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর মনে হলো বাংলাদেশ আর নিরাপদ নয়। অনেক উত্থান-পতন দেখলেও সুদিন যে আসবে সে বিশ্বাস হৃদয়ে ছিল। কিন্তু নতুন করে সামরিক শাসন শুরু হলে আশাবাদী হওয়ার আর কোনো কারণ অবশিষ্ট থাকল না। এরপর স্ত্রী-শিশুকন্যাকে নিয়ে মেঝ ভাইয়ের মাধ্যমে দেশান্তরী হই। আমেরিকায় বসতি স্থাপনের বাসনা আমার কোনোকালেই ছিল না।' সেখানে বসেই তিনি শুরু করেন স্বাধীনতার দলিল বা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মূল কাজ। ডালাসে নিজ বাসাতেই গড়ে তুলেছেন আর্কাইভ। এটি ছিল নেশার মতো। স্বল্প আয়ের মধ্যেও তিনি চালিয়ে গেছেন ব্যয়বহুল এ সংগ্রহ অভিযান। যেখানেই নতুন কোনো তথ্যের খোঁজ পেয়েছেন গুরুত্বের সঙ্গে সংগ্রহ করেছেন সেটি। এ সংগ্রহশালার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানো যেমন জালালের উদ্দেশ্য, তেমনি রয়েছে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, 'এ দলিলপত্রের মাধ্যমে শুধু বীরত্বের কথা নয়, বরং যেটি বিশেষ করে জানা যাবে সেটি হলো, কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, একাত্তরে কাদের সরাসরি মদদে শান্তি কমিটি, আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনীগুলো গঠিত হয়েছিল এবং মানবতার বিরুদ্ধে কী জঘন্য অপরাধ তারা করেছিল। হানাদারদের দোসর জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের নেতারা সেদিন দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কী ভূমিকা নিয়েছিল_সেসব তথ্য আজকের আলো-আঁধারিতে ঘেরা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে জানাতেই মূলত আমার এ কাজের সূচনা।' এ সংগ্রহের কাজে তাঁকে অনেক প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে। তাঁর ভাষায়_'আমার নজর সব সময় ছিল দুর্লভ তথ্যগুলোর দিকে। সেসব বই বা দলিল সংগ্রহ করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হতো। তা ছাড়া পাওয়াও যেত না সব সময়। এখানকার লাইব্রেরিগুলোয় (আমেরিকায়) একটা নিয়ম আছে। নাম 'ইন্টারলোন'। এ নিয়মে কোনো লাইব্রেরিতে কোনো বই না থাকলে অন্য লাইব্রেরি থেকে তারা কাঙ্ক্ষিত বই গ্রাহকদের সংগ্রহ করে দেয়। এভাবেই বইগুলো বা তথ্যগুলো জোগাড় করেছি।' তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'সবচেয়ে বেশি অসুবিধা বাংলাদেশ থেকে কোনো বই বা তথ্য সংগ্রহ করা। বাংলাদেশের কেউ আমার কাছে তথ্যসংক্রান্ত কোনো সাহায্য চাইলে আমি যেভাবেই পারি তা পাঠাই; কিন্তু আমি যখন কিছু চাই তা আর পাই না।' এত কিছুর পরও তিনি মনে করেন, দেশের প্রতিটি মানুষের জানা দরকার মুক্তিযুদ্ধে কাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ এবং কারা চায়নি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হোক। সে জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। আর এ তাগিদেই জাতীয় এই গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন এম এম আর জালাল।
ক্লান্তিহীন নিরলস প্রচেষ্টা
মাহবুবুর রহমান জালালের সংগ্রহশালা এতটাই সমৃদ্ধ যে শুধু প্রবাসীরাই নন, বাংলাদেশের বহু বরেণ্য ব্যক্তি, গবেষক ও প্রচারমাধ্যমের সংশ্লিষ্টরা প্রায়ই মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত তথ্যের জন্য তাঁর শরণাপন্ন হন। তিনিও হাসিমুখে তাঁদের সহযোগিতা করেন। বিনিময়ে তাঁর নামটি প্রচার হোক সেটিও তিনি চান না। তাঁর কষ্ট করে গড়ে তোলা তথ্যভাণ্ডার দিয়ে অন্যরা নাম কামাচ্ছে এ নিয়েও তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই, আছে আনন্দ। সে আনন্দ আগামী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে পারার। দেশের কোনো সাংবাদিকের যেকোনো তথ্যের প্রয়োজনে তিনি সদা প্রস্তুত। নিজ তাগিদেই তিনি কাঙ্ক্ষিত দলিল ও তথ্য পিডিএফ ফাইল করে ই-মেইল করেন সাহায্যপ্রার্থী সাংবাদিকের কাছে। এভাবেই ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে এ দেশের মানুষকে রক্ষা করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। প্রতিদিন সকালে ইন্টারনেটে বাংলাদেশের খবর পড়ে তাঁর দিন শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেলে তিনি তা সংগ্রহশালায় আর্কাইভ করে রাখেন। প্রবাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি হাজির হন তাঁর বিপুল সংগ্রহশালা নিয়ে। একটা টেবিল নিয়ে বসে পড়েন তা প্রদর্শনে। তিনি বলেন, 'সবাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা শুনতে চায়। কেউ জানতে চায় না গণহত্যা কারা করেছিল, কারা নারীদের নির্যাতন করেছিল। আমার সংগ্রহটা সেসব মানুষকে চিনতে সাহায্য করবে। যখন কোনো মা তাঁর সন্তানকে এগুলো দেখিয়ে বলেন, দেখ বাবা, মানুষ নামের নরপশুগুলো কী ভয়ঙ্কর কাজ করেছিল, তখন খুব ভালো লাগে।' বিদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের গান, পোস্টার, সাহিত্য, সিনেমা, ছবি, পেপার কাটিং, দেশি-বিদেশি দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে সঠিক ইতিহাস বিতরণে তিনি রেখে চলেছেন অনবদ্য এক ভূমিকা। মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও তথ্য প্রদর্শনীর জন্য প্রবাসীদের কাছ থেকে পেয়েছেন 'সুচিন্তা স্বাধীনতা পদক ২০০৬'। এ ছাড়াও ওয়ার্ল্ড স্ট্যাম্প এক্সিবিশনে ব্রোঞ্জ পদক তাঁর কাজের আর একটি স্বীকৃতি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জালালের সংগ্রহশালা
সম্প্রতি সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে। চলছে অপরাধের সাক্ষী ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কার্যক্রম। তদন্তকারী সংস্থার প্রতিনিধিদল বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে তথ্য দিয়ে তদন্তে সহযোগিতা করছেন। চলছে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত তথ্যের যাচাই-বাছাই। এ পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকারী সংস্থার জন্য জালালের সংগ্রহশালা রাখতে পারে সহায়ক ভূমিকা। বাংলাদেশ সরকার চাইলে জালাল নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেবেন সহযোগিতার হাত। কেননা জালাল মনেপ্রাণে প্রার্থনা করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। সে বিচার কার্যক্রমে তাঁর সংগ্রহশালা বিন্দুমাত্র কাজে লাগলেও সার্থক হবে তাঁর পরিশ্রম।
No comments:
Post a Comment