Thursday, April 22, 2010

মঙ্গল-অমঙ্গলের পূর্বাভাস

মঙ্গল-অমঙ্গলের পূর্বাভাস
মামুনুর রশীদ
৯৭১ সালের মার্চ মাসের গোড়া থেকেই ঢাকা শহরে কুকুরের কান্না শোনা যেত। এই কান্না ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তীব্র আকার ধারণ করে মার্চের ২০ তারিখের পর। কুকুরের কান্না শুনতে শুনতে গা ছমছম করা এক রাতে আমরা তিন বন্ধু যাচ্ছিলাম গুলিস্তানের কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসের পাশ দিয়ে। মার্চের ১০ কি ১১ তারিখ। ইপিআর বাহিনীর একজন সিপাই আমাদের ডাকলেন। তাঁর কণ্ঠে উদ্বেগ_ 'শেখ সাহেবকে একটা খবর দেবেন ভাই? আমাগো হাতিয়ার কিন্তু ক্লোজ করা শুরু করছে। একটা কিছু তলে তলে, ভেতরে ভেতরে শুরু হইছে।' তাঁর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের কান্না মিলে কী রকম একটা ভয়ার্ত পরিবেশ শুরু হয়েছিল।

২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর চারদিকে ব্যারিকেড নির্মাণ শুরু হলো। জানলাম, ইয়াহিয়া-ভুট্টো চলে গেছে পাকিস্তানে। একটা কিছু আসন্ন; কিন্তু কোনো ধরনের রাজনৈতিক যুক্তি বা কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। কী হতে পারে? এর আগে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ আমরা দেখেছি। সে তো শুধু ছাউনি থেকে সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। তারপর কিছু মার্শাল ল শাসক তৈরি হয়, কিছু দ্রুত আদালত হয়। কালো আইন দেশের মানবাধিকার কেড়ে নেয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই এটা। এখনো সেই ব্যবস্থা ওই দেশে জারি আছে। এ দেশেও ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের পর তা-ই হয়েছে।
রাত নামছে। ওই রকমই আশঙ্কা আমাদের। কিন্তু সব পূর্বাভাসকে ম্লান করে দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এল ট্যাংক, সাঁজোয়া বাহিনী। বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল বারুদের ঘ্রাণ। এক সভ্যতাবিধ্বংসী কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সূচনায়ই তারা কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ফেলল, যারা ছিল বাজারে, পথে, স্টেশনে, পেট্রল পাম্পে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। টেলিফোন কাজ করছে না। সমগ্র যোগাযোগব্যবস্থা সেনাবাহিনীর হাতে। আমরা পাল্টা গোলাগুলি শুনলাম পিলখানা আর রাজারবাগে। কে কোথায় আছে, জানার কোনো উপায় নেই। ওই রাতে আমি আটকা পড়ে গেলাম সামাদ ভাইয়ের বাসায়। তখন চিত্রগ্রাহক সামাদ ভাই চিত্র পরিচালক হতে চলেছেন। তাঁর প্রথম ছবি 'সূর্য গ্রহণ'-এর চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখছি। মাঝেমধ্যেই ওখানে থেকে যাই। সামাদ ভাইয়ের স্ত্রী রোজী ভাবি তখন নাম করা নায়িকা। তাঁকে নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাসলত আমরা জানি। বাসাটা একেবারেই গ্রিন রোডের ওপরে। বারান্দায় যাওয়ার উপায় নেই। বারান্দার সামনেই নিচু একটা দেয়াল। ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি তখন ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় প্রবেশপথ তখন তিনটি_ ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার দিয়ে একটি, গ্রিন রোড দিয়ে একটি, অন্যটি মিরপুর রোড দিয়ে। তাই পিলখানা ও বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের পথ এটাই। আজকের দিনে অবশ্য সেই রাতের আক্রমণের নীলনকশা অনেকেই জানেন।
এরই মধ্যে রেডিওতে নরখাদক ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগ এবং শেখ সাহেবকে দোষারোপ করে হুঙ্কার ছাড়া হলো। স্পষ্টতই এক রক্তপায়ী দস্যুর গোঙানি শুনতে পেলাম আমরা। আজ এত বছর পর শুধু মনে আছে, একজন মদ্যপানরত জেনারেল রক্তের লালসায় কী যেন প্রলাপ বকে যাচ্ছে। তখন বার বার ৭ মার্চের শেখ সাহেবের বজ্রকণ্ঠ শুনে বাঁচার প্রেরণা পাচ্ছিলাম।
আমরা এমনিতেই প্রতি রাতে একটু বিলম্বে খেতাম। সেই রাতে আর খাওয়ার প্রশ্নই নেই। কোনো একটা জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতেই শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম আগুন আর ধোঁয়া। বাড়িটা বার বার কামানের গোলায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল। রোজী ভাবিকে পেছনের দেয়ালের পাশে একটা ঘরে রাখা হলো, যাতে সেনাবাহিনী ঢুকলে পেছনের দেয়াল টপকে দ্রুত অন্য বাড়িতে পার করে দেওয়া যায়। মেয়ে কবিতা তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও বার বার কেঁদে উঠছিল। আমরা প্রাণপণে ওকে থামানোর চেষ্টা করছিলাম। পুরান ঢাকার আত্দীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়ার কোনো উপায় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বন্ধুদের কী হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কী হলো, টাঙ্গাইল শহরে আমার বাবা-মা, ভাইবোনের কী হলো_ এসব ভাবতেও পারছিলাম না। কামানের গুলিতে সব ভাবনা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। ১ মার্চ থেকে টেলিভিশনের ঢাকা স্টেশন একেবারেই পাল্টে গিয়েছিল। সেই সময় ১ মার্চ আমার লেখা একটি নাটকও প্রচারিত হয়েছিল। নাটকটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু তো আমাকেও খুঁজবে। এমনি করেই সারা রাত না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি। আবার কুকুরের কান্না। এসব কুকুরের কান্নার মাঝে এক মহিলার বিলাপ শুনলাম। অনুমান করলাম, বস্তি পুড়িয়ে দেওয়ার পর নিশ্চয়ই ওর সব আপনজন হত্যা করেছে সেনাবাহিনী।
সকালের আজান শোনা গেল। ঠিক আজানের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের রক্ষক সেনাবাহিনীর কামানও গর্জে উঠল।
প্রাকৃতিক নিয়মে ভোর হলো। কিন্তু কারো ক্ষুধা নেই। বিনিদ্র রাতের ক্লান্তিও নেই। সামান্য চা-বিস্কুট জুটল। সেই সঙ্গে আবারও চলছে গোলাগুলি। কোনো যোগাযোগ নেই, শুধুই অনুমান। অনুমান করলাম, পিলখানা আর রাজারবাগের এখনো পতন হয়নি। মাইকে ভয়ঙ্কর সব উর্দুতে এলান শোনা যাচ্ছে। 'ঘর ছে বাহার আও তো গুলি মার দুঙ্গা' ইত্যাদি।
প্রতিটি গৃহ আলাদা আলাদা দ্বীপ। কারো সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ নেই। সব কল্পনা-অনুমান, সবই শুধু পরিবারের মধ্যে।
ইতিহাসে নাদির শাহের দিলি্ল লুণ্ঠনের কাহিনী পড়েছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর শহর পতন ঘটানোর কাহিনী পড়েছি। এগুলো ইতিহাসের পাঠ। কিন্তু যে ঘটনার মুখোমুখি আমরা ওই রাতে, তা আমাদের বুকের ওপর ঘটেছে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। হৃদয়ের মতো মারাত্দক আগ্নেয়াস্ত্রটি তখন জেগে উঠতে শুরু করেছে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম_ 'আর নয়, প্রতিশোধ নেব।' যুদ্ধের অনিবার্য পূর্বাভাস দেহের রক্তে বইতে শুরু করেছে।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বভ

No comments: