যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরম্নদ্ধে প্রতিপক্ষের বহুমাত্রিক চক্রান্ত
শাহরিয়ার কবির
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২-এর জানুয়ারিতে আমরা যখন প্রথম সংগঠিতভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করি তখনই '৭১-এর ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী আমাদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ এনেছে আমরা নাকি ভারতের দালাল, ঠিক যেমনটি তারা বলত '৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগকে। জামায়াত আরও বলেছে_ যুদ্ধাপরাধী বলে দেশে নাকি কেউ নেই, জামায়াতের কেউ নাকি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, বঙ্গবন্ধু নাকি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন ইত্যাদি।
গত দেড় যুগেরও অধিককাল জামায়াতের '৭১-এর ভূমিকা আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরেছি, তৃণমূল থেকে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন যাবতীয় দুষ্কর্মের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছি, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি, কর্মশালা-শোভাযাত্রা, সমাবেশ প্রভৃতির আয়োজন করেছি; জামায়াতীদের এলাকায় পাঠাগার স্থাপন করেছি এবং এভাবেই জামায়াতের প্রকৃত চেহারা দেশবাসী, বিশেষভাবে তরম্নণ প্রজন্মের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের এসব তৎপরতা শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের প্রত্যনত্ম অঞ্চল অবধি বিসত্মৃত। একই সঙ্গে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি'র তৎপরতা বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ১২টি দেশে আমাদের শাখা রয়েছে।
আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে জামায়াত যেসব অপপ্রচার করেছে, যেসব প্রশ্ন তুলেছে_ দেশবাসী যে তা প্রত্যাখ্যান করেছে তার প্রমাণ হচ্ছে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে, শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে খালেদা-নিজামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের। গত নির্বাচনে জামায়াতের একজন যুদ্ধাপরাধীও নির্বাচিত হতে পারেনি, অথচ এর আগের নির্বাচনে বিএনপির বদৌলতে জামায়াতের ডজনখানেক যুদ্ধাপরাধী জাতীয় সংসদের আসন কলঙ্কিত করেছে, যাদের দু'জনকে খালেদা জিয়া মন্ত্রী পর্যনত্ম বানিয়েছিলেন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মহাজোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রানত্মে উপনীত হয়েছে। এ বিজয়ের জন্য আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়েছে, বহু চড়াই-উৎরাই পেরম্নতে হয়েছে। আন্দোলনের নেতাকমর্ীদের হত্যা, নির্যাতন, চাকরিচু্যতি, মিথ্যা মামলাসহ বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামাল থেকে আরম্ভ করে বিচারপতি কেএম সোবহান পর্যনত্ম বহু নেতাকে আমরা হারিয়েছি, তারপরও এ আন্দোলন থেমে থাকেনি। সত্যকে কখনও প্রতিহত করা যায় না। কিছু সময়ের জন্য মিথ্যার কালো মেঘ সত্যকে আচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু সত্য সব সময় আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়।
২০০৯ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার যখন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখন থেকে '৭১-এর ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, পায়ের তলার মাটিতে ধস নেমেছে। গত এক বছরে জামায়াতের বহু কমর্ী দলত্যাগ ও দেশত্যাগ করেছে। ধ্বংস অনিবার্য জেনে জামায়াত এখন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত তাদের দেশী-বিদেশী মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে বঙ্গবন্ধুর সরকার কতর্ৃক প্রণীত 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন ১৯৭৩' অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইবু্যনালে। এ আইনে অপরাধের সংজ্ঞা, বিচার পদ্ধতি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও শাসত্মি সম্পর্কে সবই বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, জাপান ও ফিলিপিন্সসহ বহু দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এসব ট্রাইবু্যনালে কখনও চিরাচরিত সাক্ষ্য আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার বিচার সম্ভব নয় বলেই জার্মানির নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় নুরেমবার্গের বিশেষ আদালতে বিশেষ নীতি ও বিধান প্রণীত হয়েছিল। বাংলাদেশের '৭৩-এর আইন অতীতের এসব নীতি ও বিধানের নির্যাস গ্রহণ করে ঋদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের আগে পৃথিবীর কোন দেশ মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ, শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা বিচারের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নিজস্ব আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি।
নুরেমবার্গ বা টোকিও ট্রাইবু্যনালের জন্য প্রণীত নীতি ও বিধানের চেয়ে বাংলাদেশের 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন' যে অনেক উন্নতমানের এ কথা আনত্মর্জাতিক অঙ্গনের বহু খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের সেরা আইনজ্ঞরাসহ নুরেমবার্গ ট্রাইবু্যনালের সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরা এবং ভারতের দু'জন শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞ এ আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন যেটি আমাদের সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বিঘি্নত করার জন্য জামায়াত ও বিএনপির আইনজীবীরা '৭৩-এর আইন সম্পর্কে, অপরাধের সংজ্ঞা সম্পর্কে অদ্ভুত সব প্রশ্ন তুলেছেন। সমপ্রতি তাঁরা বলছেন, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ক্ষমতায় এসে এখন বলছে মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধের বিচার করবে। তাঁরা বিভিন্ন সেমিনারে বা গণমাধ্যমে এমনভাবে বিষয়টি উত্থাপন করছেন যেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। '৭৩-এর আইনে এসব অপরাধের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা এতদসংক্রানত্ম যাবতীয় আনত্মর্জাতিক আইনসম্মত। আমাদের আইনজ্ঞরা '৭৩-এর আইনে যেভাবে এসব অপরাধের সংজ্ঞা দিয়েছেন তার সঙ্গে প্রচুর মিল রয়েছে ২০০২ সালে গৃহীত রোমের আনত্মর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনের।
বাংলাদেশে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি' গত ১৮ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে। '৭৩-এর আইনে 'যুদ্ধাপরাধ', 'মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'গণহত্যা' প্রভৃতির পৃথক সংজ্ঞা দেয়া আছে। তবে সাধারণভাবে আমরা বলি যুদ্ধাপরাধ, অর্থাৎ যুদ্ধাকালীন সময়ে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগি্নসংযোগ, অপহরণ ও লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধ। বাংলাদেশে 'রাজাকার' বলতে শুধু মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াত কতর্ৃক গঠিত রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের বোঝায় না; সকল স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সামপ্রদায়িক ব্যক্তিকেই এ দেশে রাজাকার বলা হয়। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের একটি টেলিভিশন সিরিয়ালে 'তুই রাজাকার' বলে এটিকে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদীদের সমার্থক শব্দে পরিণত করা হয়েছে। একইভাবে 'যুদ্ধাপরাধী' বলতে আমরা '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ ঘাতক, দালাল, রাজাকার, আলবদর সবাইকে বুঝি।
জামায়াতের নেতারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে গত কয়েক বছর ধরে যেসব প্রলাপোক্তি করছেন তাতে বার বার সেই বাংলা প্রবাদটির কথা মনে হয় 'ঠাকুরঘরে কে? আমি কলা খাই না!' জামায়াতের নেতারা একবার বলেন, '৭১-এ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের কোন ঘটনা ঘটেনি। আবার বলেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধ করেনি। কখনও বলেন, জামায়াতকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হচ্ছে। কখনও বলেন, ইসলাম ধ্বংসের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে এবং এটা ভারতের ষড়যন্ত্র। জামায়াত যেমন '৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলেছে; তাদের পাকিসত্মানী প্রভুরা '৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যনত্ম বাঙালীর সকল আন্দোলন-সংগ্রামকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলেছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি এসব বিশ্বাস করত তাহলে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কিংবা ২০০৯-এর ভোটযুদ্ধে পাকিসত্মান এবং তাদের এদেশীয় খেদমতগারদের এত শোচনীয় পরাজয় ঘটত না।
জামায়াতপ্রধান মতিউর রহমান নিজামী সমপ্রতি জামায়াতের জেলা আমিরদের এক সমাবেশে বলেছেন, জামায়াতের নেতারা '৭১-এ যুদ্ধাপরাধ করেননি, তারা শুধু পাকিসত্মানের অখ-তা রক্ষার জন্য কাজ করেছেন। নিজামীর এলাকার ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদশর্ীরা আমাকে বলেছেন পাকিসত্মান রক্ষার জন্য তিনি '৭১-এ কীভাবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে হত্যা-নির্যাতন-লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যার কিছু অংশ আমার প্রামাণ্যচিত্র 'যুদ্ধাপরাধ ৭১'-এ বিধৃত হয়েছে। ট্রাইবু্যনালই বলবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজামীদের পাকিসত্মান রক্ষার তৎপরতা কোন্ ধরনের অপরাধ।
জামায়াতের কোন নেতা যদি '৭১-এ কোন অপরাধ না করে থাকেন তাহলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা কেন করছেন? কেন বলছেন বিচার আরম্ভ হলে এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে, দেশ অচল করে দেয়া হবে? তারা যদি সত্যিকার অর্থেই কোন অপরাধ না করে থাকেন তাদের উচিত এ বিচারকে স্বাগত জানানো। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাসত্মি দেয়ার সাধ্য কোন আদালতের নেই। নবগঠিত আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন, আদালতের রায় তাদের পছন্দ না হলে সুপ্রীমকোর্টে তারা আপীল করতে পারবেন। বিচার ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা প্রত্যক্ষ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যবেক্ষক আসবেন। এদের সামনে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে কীভাবে অপরাধী সাব্যসত্ম করে শাসত্মি দেয়া হবে এটা আমাদের বোধগম্যের অতীত।
হালে জামায়াতের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বিএনপি। দুই দল কোরাসে বলছে, সরকার বিদু্যত-পানি-গ্যাসের সমস্যার সমাধান না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। বিদু্যত, পানি, গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধ কোথায় আমরা জানি না। তাদের কথা শুনে মনে হতে পারে পিডিবি, ওয়াসা বা তিতাস গ্যাস বুঝি তাদের কাজ বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে ব্যসত্ম হয়ে পড়েছে! নাকি আনত্মর্জাতিক ট্রাইবু্যনালের বিচারক ও আইনজীবীরা এতদিন বিদু্যত, পানি, গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন! আমজনতার কাছে বিদু্যত যেমন জরম্নরী, বিচারও জরম্নরী। যে ট্রাইবু্যনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বিদু্যত, পানি ও গ্যাসসহ জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের নয়। তবে পিডিবি বা ওয়াসায় যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কেউ থাকতেই পারেন। তারা জামায়াতের অনত্মর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বিদু্যত, পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন কিনা এটা তদনত্ম করে দেখা দরকার।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াত তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের সহযোগিতা পাচ্ছে। বিভিন্ন আনত্মর্জাতিক ফোরামে পাকিসত্মান বলছে, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যরা বাংলাদেশে কোন গণহত্যা, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ করেনি, বরং বাঙালীরা পাকিসত্মানীদের, বিশেষভাবে অবাঙালী বিহারীদের হত্যা করেছে। এসব কাজে ক্ষেত্রবিশেষে পাকিসত্মান কোথাও বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রবাসী ভারতীয়দেরও ব্যবহার করেছে। শর্মিলা বসু নামে জনৈক আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয়, বছর দুই আগে লিখেছেন, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যদের দ্বারা বাঙালী নারী নির্যাতনের অভিযোগ নাকি নির্জলা মিথ্যা, বরং বাঙালীরা যে অবাঙালী নারীদের নির্যাতন করেছে তার নাকি অনেক প্রমাণ আছে। সরকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা দুই লাখ, বেসরকারী হিসেবে চার লাখেরও বেশি। এ দাবি কোন বাঙালীর নয়, অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ভেডিসের, যিনি '৭২-এর জানুয়ারিতে রেডক্রসের চিকিৎসক দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য। তাদের দল প্রথম তিন মাসে দেড় লাখ নারীর গর্ভপাত করেছিল। লন্ডনে ফিরে গিয়ে ডা. ডেভিস বলেছিলেন, '৭১-এ নির্যাতিত নারীর সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। অথচ গবেষক শর্মিলা বসু তাদের একজনকেও নাকি খুঁজে পাননি!
সমপ্রতি ইউরোপ ও আমেরিকা সফরের সময় দেখেছি জামায়াতীদের প্ররোচনায়, নাকি পাকিসত্মানীদের অর্থের বিনিময়ে (!) আইনজীবীদের একটি আনত্মর্জাতিক সংগঠন 'ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন' ধুয়া তুলেছে_ '৭৩-এর আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না। তারা এ আইনের অনেক সংশোধনীর প্রসত্মাব করেছে। আমাদের ট্রাইবু্যনালে তিনজন বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 'আইবিএ' বলছে, ট্রাইবু্যনালের বিচারপতি নাকি অভিযুক্তের পছন্দের হতে হবে এবং তিনজন বিচারপতি একমত না হলে নাকি রায় দেয়া যাবে না। পৃথিবীর কোন্ দেশে এমন অসম্ভব, উদ্ভট বিচারব্যবস্থা আছে আমাদের জানা নেই, তবে 'আইবিএ' এবং তাদের তল্পিবাহকদের মতে এসব সংশোধনী না করা হলে এ বিচার নাকি তাদের গ্রহণযোগ্য হবে না। 'আইবিএ'র সুপারিশ আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে গুরম্নত্ব পাবে না। কারণ উকিলরা সব সময় মক্কেলের স্বার্থই দেখবে। যুদ্ধাপরাধীরা যদি আইবিএ-র মক্কেল হয় তাহলে এমন উদ্ভট দাবি তারা করতে পারে বৈকি। বিষয়টি উলেস্নখ করছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে জামায়াত এবং তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের বহুমাত্রিক তৎপরতা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা প্রদানের জন্য। তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, আমেরিকান কংগ্রেসে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায়। ধর্ণা দিচ্ছে জাতিসংঘের সামনে, হুমকি দিচ্ছে সৌদি আরবে কর্মরত বাঙালী শ্রমিকদের ফেরত পাঠাবার; দেশের ভেতরে নাশকতামূলক কাজের জন্য সংগঠিত করছে জঙ্গী মৌলবাদীদের। জামায়াত এবং তাদের প্রভুদের এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। জাতিকে মুক্ত করতে হবে দীর্ঘ চার দশকের বিচারহীনতার অভিশাপ থেকে।
২২ এপ্রিল, ২০১০
গত দেড় যুগেরও অধিককাল জামায়াতের '৭১-এর ভূমিকা আমরা জনগণের সামনে তুলে ধরেছি, তৃণমূল থেকে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন যাবতীয় দুষ্কর্মের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছি, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি, কর্মশালা-শোভাযাত্রা, সমাবেশ প্রভৃতির আয়োজন করেছি; জামায়াতীদের এলাকায় পাঠাগার স্থাপন করেছি এবং এভাবেই জামায়াতের প্রকৃত চেহারা দেশবাসী, বিশেষভাবে তরম্নণ প্রজন্মের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের এসব তৎপরতা শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের প্রত্যনত্ম অঞ্চল অবধি বিসত্মৃত। একই সঙ্গে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি'র তৎপরতা বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ১২টি দেশে আমাদের শাখা রয়েছে।
আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে জামায়াত যেসব অপপ্রচার করেছে, যেসব প্রশ্ন তুলেছে_ দেশবাসী যে তা প্রত্যাখ্যান করেছে তার প্রমাণ হচ্ছে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট জাতীয় সংসদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে, শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে খালেদা-নিজামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের। গত নির্বাচনে জামায়াতের একজন যুদ্ধাপরাধীও নির্বাচিত হতে পারেনি, অথচ এর আগের নির্বাচনে বিএনপির বদৌলতে জামায়াতের ডজনখানেক যুদ্ধাপরাধী জাতীয় সংসদের আসন কলঙ্কিত করেছে, যাদের দু'জনকে খালেদা জিয়া মন্ত্রী পর্যনত্ম বানিয়েছিলেন।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মহাজোট ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রানত্মে উপনীত হয়েছে। এ বিজয়ের জন্য আমাদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে হয়েছে, বহু চড়াই-উৎরাই পেরম্নতে হয়েছে। আন্দোলনের নেতাকমর্ীদের হত্যা, নির্যাতন, চাকরিচু্যতি, মিথ্যা মামলাসহ বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও কবি সুফিয়া কামাল থেকে আরম্ভ করে বিচারপতি কেএম সোবহান পর্যনত্ম বহু নেতাকে আমরা হারিয়েছি, তারপরও এ আন্দোলন থেমে থাকেনি। সত্যকে কখনও প্রতিহত করা যায় না। কিছু সময়ের জন্য মিথ্যার কালো মেঘ সত্যকে আচ্ছন্ন করতে পারে, কিন্তু সত্য সব সময় আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়।
২০০৯ সালে বর্তমান মহাজোট সরকার যখন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখন থেকে '৭১-এর ঘাতক-দালাল-যুদ্ধাপরাধীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, পায়ের তলার মাটিতে ধস নেমেছে। গত এক বছরে জামায়াতের বহু কমর্ী দলত্যাগ ও দেশত্যাগ করেছে। ধ্বংস অনিবার্য জেনে জামায়াত এখন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত তাদের দেশী-বিদেশী মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে বঙ্গবন্ধুর সরকার কতর্ৃক প্রণীত 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন ১৯৭৩' অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইবু্যনালে। এ আইনে অপরাধের সংজ্ঞা, বিচার পদ্ধতি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও শাসত্মি সম্পর্কে সবই বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি, জাপান ও ফিলিপিন্সসহ বহু দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। এসব ট্রাইবু্যনালে কখনও চিরাচরিত সাক্ষ্য আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার বিচার সম্ভব নয় বলেই জার্মানির নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় নুরেমবার্গের বিশেষ আদালতে বিশেষ নীতি ও বিধান প্রণীত হয়েছিল। বাংলাদেশের '৭৩-এর আইন অতীতের এসব নীতি ও বিধানের নির্যাস গ্রহণ করে ঋদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের আগে পৃথিবীর কোন দেশ মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ, শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যা বিচারের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নিজস্ব আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি।
নুরেমবার্গ বা টোকিও ট্রাইবু্যনালের জন্য প্রণীত নীতি ও বিধানের চেয়ে বাংলাদেশের 'আনত্মর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) আইন' যে অনেক উন্নতমানের এ কথা আনত্মর্জাতিক অঙ্গনের বহু খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের সেরা আইনজ্ঞরাসহ নুরেমবার্গ ট্রাইবু্যনালের সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরা এবং ভারতের দু'জন শীর্ষস্থানীয় আইনজ্ঞ এ আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন যেটি আমাদের সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বিঘি্নত করার জন্য জামায়াত ও বিএনপির আইনজীবীরা '৭৩-এর আইন সম্পর্কে, অপরাধের সংজ্ঞা সম্পর্কে অদ্ভুত সব প্রশ্ন তুলেছেন। সমপ্রতি তাঁরা বলছেন, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ক্ষমতায় এসে এখন বলছে মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধের বিচার করবে। তাঁরা বিভিন্ন সেমিনারে বা গণমাধ্যমে এমনভাবে বিষয়টি উত্থাপন করছেন যেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। '৭৩-এর আইনে এসব অপরাধের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা এতদসংক্রানত্ম যাবতীয় আনত্মর্জাতিক আইনসম্মত। আমাদের আইনজ্ঞরা '৭৩-এর আইনে যেভাবে এসব অপরাধের সংজ্ঞা দিয়েছেন তার সঙ্গে প্রচুর মিল রয়েছে ২০০২ সালে গৃহীত রোমের আনত্মর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনের।
বাংলাদেশে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি' গত ১৮ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে। '৭৩-এর আইনে 'যুদ্ধাপরাধ', 'মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'শানত্মির বিরম্নদ্ধে অপরাধ', 'গণহত্যা' প্রভৃতির পৃথক সংজ্ঞা দেয়া আছে। তবে সাধারণভাবে আমরা বলি যুদ্ধাপরাধ, অর্থাৎ যুদ্ধাকালীন সময়ে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগি্নসংযোগ, অপহরণ ও লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধ। বাংলাদেশে 'রাজাকার' বলতে শুধু মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াত কতর্ৃক গঠিত রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের বোঝায় না; সকল স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সামপ্রদায়িক ব্যক্তিকেই এ দেশে রাজাকার বলা হয়। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের একটি টেলিভিশন সিরিয়ালে 'তুই রাজাকার' বলে এটিকে স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদীদের সমার্থক শব্দে পরিণত করা হয়েছে। একইভাবে 'যুদ্ধাপরাধী' বলতে আমরা '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ ঘাতক, দালাল, রাজাকার, আলবদর সবাইকে বুঝি।
জামায়াতের নেতারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে গত কয়েক বছর ধরে যেসব প্রলাপোক্তি করছেন তাতে বার বার সেই বাংলা প্রবাদটির কথা মনে হয় 'ঠাকুরঘরে কে? আমি কলা খাই না!' জামায়াতের নেতারা একবার বলেন, '৭১-এ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের কোন ঘটনা ঘটেনি। আবার বলেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধ করেনি। কখনও বলেন, জামায়াতকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হচ্ছে। কখনও বলেন, ইসলাম ধ্বংসের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে এবং এটা ভারতের ষড়যন্ত্র। জামায়াত যেমন '৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলেছে; তাদের পাকিসত্মানী প্রভুরা '৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যনত্ম বাঙালীর সকল আন্দোলন-সংগ্রামকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলেছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি এসব বিশ্বাস করত তাহলে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কিংবা ২০০৯-এর ভোটযুদ্ধে পাকিসত্মান এবং তাদের এদেশীয় খেদমতগারদের এত শোচনীয় পরাজয় ঘটত না।
জামায়াতপ্রধান মতিউর রহমান নিজামী সমপ্রতি জামায়াতের জেলা আমিরদের এক সমাবেশে বলেছেন, জামায়াতের নেতারা '৭১-এ যুদ্ধাপরাধ করেননি, তারা শুধু পাকিসত্মানের অখ-তা রক্ষার জন্য কাজ করেছেন। নিজামীর এলাকার ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদশর্ীরা আমাকে বলেছেন পাকিসত্মান রক্ষার জন্য তিনি '৭১-এ কীভাবে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে হত্যা-নির্যাতন-লুণ্ঠন প্রভৃতি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যার কিছু অংশ আমার প্রামাণ্যচিত্র 'যুদ্ধাপরাধ ৭১'-এ বিধৃত হয়েছে। ট্রাইবু্যনালই বলবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজামীদের পাকিসত্মান রক্ষার তৎপরতা কোন্ ধরনের অপরাধ।
জামায়াতের কোন নেতা যদি '৭১-এ কোন অপরাধ না করে থাকেন তাহলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা কেন করছেন? কেন বলছেন বিচার আরম্ভ হলে এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবে, দেশ অচল করে দেয়া হবে? তারা যদি সত্যিকার অর্থেই কোন অপরাধ না করে থাকেন তাদের উচিত এ বিচারকে স্বাগত জানানো। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে শাসত্মি দেয়ার সাধ্য কোন আদালতের নেই। নবগঠিত আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে অভিযুক্তরা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন, আদালতের রায় তাদের পছন্দ না হলে সুপ্রীমকোর্টে তারা আপীল করতে পারবেন। বিচার ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা প্রত্যক্ষ করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যবেক্ষক আসবেন। এদের সামনে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে কীভাবে অপরাধী সাব্যসত্ম করে শাসত্মি দেয়া হবে এটা আমাদের বোধগম্যের অতীত।
হালে জামায়াতের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বিএনপি। দুই দল কোরাসে বলছে, সরকার বিদু্যত-পানি-গ্যাসের সমস্যার সমাধান না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। বিদু্যত, পানি, গ্যাসের সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধ কোথায় আমরা জানি না। তাদের কথা শুনে মনে হতে পারে পিডিবি, ওয়াসা বা তিতাস গ্যাস বুঝি তাদের কাজ বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে ব্যসত্ম হয়ে পড়েছে! নাকি আনত্মর্জাতিক ট্রাইবু্যনালের বিচারক ও আইনজীবীরা এতদিন বিদু্যত, পানি, গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন! আমজনতার কাছে বিদু্যত যেমন জরম্নরী, বিচারও জরম্নরী। যে ট্রাইবু্যনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বিদু্যত, পানি ও গ্যাসসহ জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের নয়। তবে পিডিবি বা ওয়াসায় যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন কেউ থাকতেই পারেন। তারা জামায়াতের অনত্মর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বিদু্যত, পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন কিনা এটা তদনত্ম করে দেখা দরকার।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াত তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের সহযোগিতা পাচ্ছে। বিভিন্ন আনত্মর্জাতিক ফোরামে পাকিসত্মান বলছে, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যরা বাংলাদেশে কোন গণহত্যা, মানবতার বিরম্নদ্ধে অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ করেনি, বরং বাঙালীরা পাকিসত্মানীদের, বিশেষভাবে অবাঙালী বিহারীদের হত্যা করেছে। এসব কাজে ক্ষেত্রবিশেষে পাকিসত্মান কোথাও বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রবাসী ভারতীয়দেরও ব্যবহার করেছে। শর্মিলা বসু নামে জনৈক আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয়, বছর দুই আগে লিখেছেন, '৭১-এ পাকিসত্মানী সৈন্যদের দ্বারা বাঙালী নারী নির্যাতনের অভিযোগ নাকি নির্জলা মিথ্যা, বরং বাঙালীরা যে অবাঙালী নারীদের নির্যাতন করেছে তার নাকি অনেক প্রমাণ আছে। সরকারী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা দুই লাখ, বেসরকারী হিসেবে চার লাখেরও বেশি। এ দাবি কোন বাঙালীর নয়, অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ভেডিসের, যিনি '৭২-এর জানুয়ারিতে রেডক্রসের চিকিৎসক দলের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য। তাদের দল প্রথম তিন মাসে দেড় লাখ নারীর গর্ভপাত করেছিল। লন্ডনে ফিরে গিয়ে ডা. ডেভিস বলেছিলেন, '৭১-এ নির্যাতিত নারীর সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। অথচ গবেষক শর্মিলা বসু তাদের একজনকেও নাকি খুঁজে পাননি!
সমপ্রতি ইউরোপ ও আমেরিকা সফরের সময় দেখেছি জামায়াতীদের প্ররোচনায়, নাকি পাকিসত্মানীদের অর্থের বিনিময়ে (!) আইনজীবীদের একটি আনত্মর্জাতিক সংগঠন 'ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন' ধুয়া তুলেছে_ '৭৩-এর আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না। তারা এ আইনের অনেক সংশোধনীর প্রসত্মাব করেছে। আমাদের ট্রাইবু্যনালে তিনজন বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 'আইবিএ' বলছে, ট্রাইবু্যনালের বিচারপতি নাকি অভিযুক্তের পছন্দের হতে হবে এবং তিনজন বিচারপতি একমত না হলে নাকি রায় দেয়া যাবে না। পৃথিবীর কোন্ দেশে এমন অসম্ভব, উদ্ভট বিচারব্যবস্থা আছে আমাদের জানা নেই, তবে 'আইবিএ' এবং তাদের তল্পিবাহকদের মতে এসব সংশোধনী না করা হলে এ বিচার নাকি তাদের গ্রহণযোগ্য হবে না। 'আইবিএ'র সুপারিশ আনত্মর্জাতিক অঙ্গনে গুরম্নত্ব পাবে না। কারণ উকিলরা সব সময় মক্কেলের স্বার্থই দেখবে। যুদ্ধাপরাধীরা যদি আইবিএ-র মক্কেল হয় তাহলে এমন উদ্ভট দাবি তারা করতে পারে বৈকি। বিষয়টি উলেস্নখ করছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে জামায়াত এবং তাদের পাকিসত্মানী প্রভুদের বহুমাত্রিক তৎপরতা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা প্রদানের জন্য। তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, আমেরিকান কংগ্রেসে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায়। ধর্ণা দিচ্ছে জাতিসংঘের সামনে, হুমকি দিচ্ছে সৌদি আরবে কর্মরত বাঙালী শ্রমিকদের ফেরত পাঠাবার; দেশের ভেতরে নাশকতামূলক কাজের জন্য সংগঠিত করছে জঙ্গী মৌলবাদীদের। জামায়াত এবং তাদের প্রভুদের এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। জাতিকে মুক্ত করতে হবে দীর্ঘ চার দশকের বিচারহীনতার অভিশাপ থেকে।
২২ এপ্রিল, ২০১০
No comments:
Post a Comment