Wednesday, April 21, 2010

দ্বিতীয় দফা রাজনৈতিক বলি হচ্ছেন হাফিজ?

দ্বিতীয় দফা রাজনৈতিক বলি হচ্ছেন হাফিজ?
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ভোলার উপনির্বাচনে বিজয়ের চেয়ে ভবিষ্যত রাজনীতির দিকেই বেশি নজর দিয়েছে বিএনপি। মেজর (অব) হাফিজকে দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিক বলি হচ্ছেন বলে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে চায় এই দলটি। রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় থাকলেও হাফিজ না পারছেন নির্বাচন ছেড়ে আসতে, না পারছেন নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে।
উপনির্বাচনের দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। সংখ্যাতাত্তি্বক বিচারে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের কাছে এই নির্বাচন শুধুই ১৪ মাস শাসনকালের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের প্লাটফরম। বিএনপির কাছে এটি আসন পুনরুদ্ধারের লড়াই। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত টানা তিনবার এই আসন থেকে জয়লাভ করলেও, ২০০১-এর নির্বাচনোত্তর সহিংসতা পরবর্তী নির্বাচনে মেজর হাফিজকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়। রাজনীতিতে নবীন মেজর জসীমের কাছে পরাজয়ে তিনি বর্তমানে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছেন। অপরদিকে নিজ দলে প্রার্থিতার লড়াইয়ে জিতে গিয়ে দলীয় কোন্দলবিহীন ভোলায় নুরুন্নবী শাওনের অবস্থান অনেকটাই সংহত। মেজর হাফিজ এবং তাঁর সতীর্থরা ভোলায় সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে আওয়াজ তুললেও হাফিজের দুশ্চিন্তার আরও অনেক কারণ আছে।
ভোলা উপনির্বাচনের বিষয়ে হাফিজের সঙ্গে তাঁর দলের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে। হাফিজের জন্য এ নির্বাচন তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নির্বাচনে পরাজিত হলে তিনি রাজনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। তাঁর এ নিঃস্বতা দলীয়ভাবে বিএনপিকে স্পর্শ করবে না বরং তাঁর রাজনৈতিক শেষকৃত্যকে পাথেয় হিসেবে নিয়ে বিএনপি আন্দোলনের পথ খুঁজবে। দলীয় সভাপতি এবং কিছু দক্ষ ও পরীক্ষিত নেতার দূরদর্শিতায়, সার্বিক বিজয়ের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ১/১১, রাজনৈতিক সংস্কার ইত্যাদি বিষয়কে দলীয় ফোরামে সীমাবদ্ধ রাখে। অন্যদিকে একই ইস্যুতে বিএনপি প্রায় বিভক্তির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সংসদ নির্বাচনে এ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে বিএনপির এক শ্রেণীর ভোটার এখনও হাফিজকে দেখেন সুবিধাবাদী নেতা হিসেবে।
হাফিজের আরও সমস্যা হচ্ছে তার ইলেকশন ক্যাম্পেনাররা। নাজিমুদ্দিন আলমের মতো জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও এখানে নিজেদের অপকৌশলের কারণে জনরোষের শিকার হচ্ছেন। শাওনের সমর্থকদের মতে শাওনের পরিবার এবং শাওন সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলায় তিনি গণরোষের শিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের এ ধরনের ব্যাখ্যা অদৌ গ্রহণযোগ্য না হলেও হাফিজের সমর্থকরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য অহেতুক জড়িয়ে পড়ছেন অনভিপ্রেত ঘটনায়। ফলে হাফিজের প্রচার ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া দলীয় কোন্দল এবং অপ্রতুল প্রচার মেজর হাফিজকে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে সরিয়ে দিয়েছে। মেজর হাফিজের গণসংযোগ এখন পর্যন্ত শুধু প্রেস কনফারেন্স, সাক্ষাতকার ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শাওনের পক্ষে যেখানে তোফায়েল আহমদের মতো কুশলী নেতাদের প্রচার জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে হাফিজের পক্ষের নেতারা সেদিকে না গিয়ে সরকার, প্রশাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এ ছাড়া জনশ্রুতি রয়েছে দেলোয়ার হোসেন, রিজভী আহমেদ প্রমুখ সংস্কার বিরোধী নেতারা হাফিজের জয়ের চেয়ে তাঁর পরাজয়ের ইস্যুতে দলকে আন্দোলনমুখী করার সম্ভাবনাকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন।
মেজর হাফিজের দুশ্চিন্তার আরও কারণ হচ্ছে ভোলা -৩ নির্বাচনী এলাকার ভৌগোলিক পরিস্থিতি। লালমোহন ও তজুমুদ্দিন উপজেলা নিয়ে গঠিত ভোলা-৩ আসনে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা নিহায়ত কম নয়। ২০০১-এর নির্বাচনের পর তাদের অনেকেই নির্যাতিত হয়েছেন। এই নির্বাচনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। তাছাড়া মৌমাছি বাহিনীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অত্যাচারের কথা এখনও সাধারণ ভোটারের স্মৃতিতে জাগরুক। যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের তোড়জোড়ে বিএনপির প্রধান মিত্র জামায়াত এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। তাছাড়া লালমোহনের জনপ্রিয় বিএনপি নেতা আনিসুল হকের আওয়ামী লীগে যোগদানের বিষয় অনেকটা পাকাপাকি হয়ে যাবার খবর বিএনপির ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া দেশের সাম্প্রতিককালের গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের সমস্যা উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের জেলা ভোলাকে সেভাবে স্পর্শ করেনি। বিদ্যুত কিংবা পানি নিয়ে রাজনীতির সুযোগ তার নিজের এলাকায় এ মুহূর্তে তিনি পাচ্ছেন না। নিরাপত্তার প্রয়োজনে ভোলা-৩ নির্বাচনী এলাকায় র্যাব মোতায়েন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত কোন অভিযোগ তিনি দাঁড় করাতে পারছেন না। অন্যদিকে অভিজ্ঞ তোফায়েল আহমদের মতো রাজনীতিবিদ শাওনের পক্ষে থাকায় তাঁর প্রচারণায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
২০০৮ পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে হাফিজ গড়ে ৫৩ শতাংশ ভোট পেলেও সর্বশেষ নির্বাচনে জসীমের ৫২.৮ শতাংশ ভোটের বিপরীতে তিনি পেয়েছিলেন ৪৫.৭ শতাংশ ভোট। দলীয় কর্মীদের গা-ছাড়া ভাবের কারণে এবার এখন পর্যন্ত তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা জমে ওঠেনি। উপরন্তু জামায়াতের নিষ্ক্রিয়তায় হাফিজ অন্তত আড়াই শতাংশ ভোট কম পাবেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর বিএনপি দলীয় কর্মীদের অগোছালো প্রচারে শেষ পর্যন্ত হাফিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়তে পারে!

No comments: