যুগের বাণীবাংলাদেশের আদি সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও বিচ্যুতি-১
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের এক দফাটি ছিল এই : 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' উল্লেখ্য, এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শিরোনামের দ্বিতীয় ভাগ-এ অন্তর্ভুক্ত প্রথম অনুচ্ছেদ। সংবিধান সব দেশেরই নাগরিকদের আদরের ধন_বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সাধ-আহ্লাদ মূর্ত হয়। বিশেষ করে প্রথমে ইংরেজ ঔপনিবেশিক, অতঃপর পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনের মোকাবিলা করতে হয় বাংলাদেশের জনগণকে। ১৭৬০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ সতেরো বার বিদ্রোহ করে এবং ১৯৭১ সালে একই কারণে বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়। অতঃপর জনগণের বিজয় চূড়ান্ত লক্ষ্যে পেঁৗছে। এই বিদ্রোহ-যুদ্ধের সব কয়টিরই চরিত্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রত্যেকটির পেছনে ছিল কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো প্রকাশ্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। অবশেষে আহমদ ছফার ভাষায়_'এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্যদিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে।'
ইতিপূর্বে এই পৃষ্ঠায় 'আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্বেষণ' শিরোনামে আমার চারটি ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়েছে এবং অন্বেষণের ফলস্বরূপ যে চারটি সূত্র পাওয়া গেছে তার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ বংশপরম্পরাক্রমে যে স্বপ্ন দেখেছে, যে সংগ্রাম করেছে তার আবহ সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ লোকায়ত ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ ছিল এই : 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।'
একটি দেশ বলতে কী বোঝায়? প্রশ্নটির সরল উত্তর হচ্ছে_দেশ একটি ভৌগোলিক বাস্তবতা। জাতি কী? এরও সরল উত্তর হচ্ছে, বহু কোটি লোক যারা বংশপরম্পরায় ওই ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়েছে। তাই প্রতিটি মানুষ তার জন্মভূমিকে ভালোবাসে।
রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ হাতে হাত মিলিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু উভয়েই বাঙালি জাতি। মহরমের মিছিল কিংবা জন্মাষ্টমীর রথের মিছিল যেমন যথাক্রমে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দুর উৎসব, আবার পয়লা বৈশাখে নববর্ষের মিছিল ও অনুষ্ঠান তাদের উভয়ের মিলিত উৎসব। এবার অন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। শবেবরাত উৎসবের দিনের বিকেল বেলা যখন একজন বাঙালি মুসলমান তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দুকে এক বাটি হালুয়া দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। আবার বিজয়া দশমীর সকালবেলা যখন একজন বাঙালি হিন্দু তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমানকে এক থালা সন্দেশ দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। অর্থাৎ স্বতন্ত্র উৎসবে পরস্পরের যেমন সহনশীলতার, তেমনি যৌথ উৎসবে পরস্পরের ভালোবাসার কমতি ঘটে না।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ওই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকার কারণ হচ্ছে মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি বা গোষ্ঠী বা Race নন। ১৯৩৮ সালে 'মুত্তাহিদা কওমিয়াত আউর ইসলাম' (সম্মিলিত জাতীয়তা এবং ইসলাম) শিরোনামে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা হুসেন আহমদ মাদানী লিখেছিলেন, 'একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য উপাদান নয়। কারণ কোরআনের সব জায়গায় মুসলমানদের একই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে, কখনো একই কওমের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়নি। আরবি ভাষায়, বিশেষ করে কোরআনে মিল্লাত শব্দটি আইন ও ধর্ম অর্থে এবং কওম শব্দটি জাতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দ দুটির মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান। জাতিকে যদি তুলনা করা যায় জমিনের সঙ্গে, তাহলে মিল্লাত হচ্ছে আসমানের মতো।' এই নীতির কারণে ইসলামের নবী মদিনায় যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেন তার চরিত্র ছিল সেক্যুলার বা লোকায়ত। মদিনার সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ইহুদি ও মুসলমানরা এক উম্মাহ বা জাতি। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম।
ওই নীতির কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে সংগঠনের স্বাধীনতা_এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া ৩৮ অনুচ্ছেদটি শর্তযুক্ত ছিল, যার উদ্ধৃতি এই : '৩৮ জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে: তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, বাংলাদেশের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ছবিটি বংশপরম্পরায় দৃঢ় ও অম্লান ছিল এবং যা বাস্তবায়িত হয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে সেগুলোর পক্ষে ধর্মীয় ও সামাজিক যুক্তিগুলো দেওয়া গেল। রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা 'বাংলাদেশের ইতিহাস' বইটির চতুর্থ খণ্ড থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক : 'ইংরেজদের ওপর চাপ দিয়া যাহাতে তুরস্কের খলিফার শক্তি ও সাম্রাজ্য ফিরাইয়া আনা যায় এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানেরা একটি কমিটি গঠন করে। তাহাদের এই আন্দোলন 'খিলাফৎ আন্দোলন' নামে পরিচিত। গান্ধীর সাহায্যে ও সমর্থনে এই আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল। ... কিন্তু গান্ধী জাতীয়তাবাদের মূল সূত্রটি ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কোনো দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঐক্যে একটি জাতি গঠন করিতে হইলে তাহার সর্বপ্রথম উপাদান এই যে, এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটির সহিত অপরের যে সম্বন্ধ, দেশের বহির্ভূত অপর কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে একটিরও তদনুরূপ বা অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের বন্ধন থাকিবে না। যদি থাকে, তবে তাহারা এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে না।' উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের জাতীয় সংসদ খলিফার পদ বিলুপ্ত করে যে আইনটি প্রণয়ন করে তাতে বলা হয়, 'খেলাফতের দপ্তর বিলুপ্ত হয়েছে যেহেতু খেলাফত অপরিহার্যভাবে সরকার ও প্রজাতন্ত্রের উদ্দেশ্য ও ধারণার মধ্যেই আছে।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এখন ১৯৭৮ সালে একজন সামরিক প্রশাসক কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধানের বিচ্যুতি-অপকর্মগুলো উল্লেখ করব এবং আপনাকেই লক্ষ করতে হবে কী কায়দায় পদে পদে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নাশ করা হয়েছে এবং তার মূল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম' শব্দগুলো যোগ করা হয় এবং আট অনুচ্ছেদের এক মূল দফাটি বদলে লেখা হয় : '৮। (১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস... রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। ১(ক) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি।' একই সঙ্গে ওপরে উদ্ধৃত সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদটি এবং ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত দফাটি বিলুপ্ত করা হয়। এখানে অপকর্ম শেষ হয় না। 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' পার্শ্ব-শিরোনামযুক্ত ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশকে এক দফা করে নতুন দুই দফা যোগ করা হয়, সেটা এই : (২) রাষ্ট্র 'ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' এই দুই দফাটির সংযোজনও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদল করার আর একটি সূক্ষ্ম কৌশল, নতুবা ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশটি 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে যথেষ্ট ছিল।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
বাংলাদেশের আদি সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদের এক দফাটি ছিল এই : 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা_এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।' উল্লেখ্য, এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানের 'রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি' শিরোনামের দ্বিতীয় ভাগ-এ অন্তর্ভুক্ত প্রথম অনুচ্ছেদ। সংবিধান সব দেশেরই নাগরিকদের আদরের ধন_বংশপরম্পরায় পবিত্র দলিল, যাকে ঘিরে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সাধ-আহ্লাদ মূর্ত হয়। বিশেষ করে প্রথমে ইংরেজ ঔপনিবেশিক, অতঃপর পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনের মোকাবিলা করতে হয় বাংলাদেশের জনগণকে। ১৭৬০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ সতেরো বার বিদ্রোহ করে এবং ১৯৭১ সালে একই কারণে বাংলাদেশের জনগণকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়। অতঃপর জনগণের বিজয় চূড়ান্ত লক্ষ্যে পেঁৗছে। এই বিদ্রোহ-যুদ্ধের সব কয়টিরই চরিত্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রত্যেকটির পেছনে ছিল কখনো প্রচ্ছন্ন কখনো প্রকাশ্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। অবশেষে আহমদ ছফার ভাষায়_'এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্যদিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে।'
ইতিপূর্বে এই পৃষ্ঠায় 'আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অন্বেষণ' শিরোনামে আমার চারটি ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়েছে এবং অন্বেষণের ফলস্বরূপ যে চারটি সূত্র পাওয়া গেছে তার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশের জনগণ বংশপরম্পরাক্রমে যে স্বপ্ন দেখেছে, যে সংগ্রাম করেছে তার আবহ সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ লোকায়ত ছিল। এ কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ ছিল এই : 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।'
একটি দেশ বলতে কী বোঝায়? প্রশ্নটির সরল উত্তর হচ্ছে_দেশ একটি ভৌগোলিক বাস্তবতা। জাতি কী? এরও সরল উত্তর হচ্ছে, বহু কোটি লোক যারা বংশপরম্পরায় ওই ভৌগোলিক সীমানায় বাঁধা পড়েছে। তাই প্রতিটি মানুষ তার জন্মভূমিকে ভালোবাসে।
রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ হাতে হাত মিলিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু উভয়েই বাঙালি জাতি। মহরমের মিছিল কিংবা জন্মাষ্টমীর রথের মিছিল যেমন যথাক্রমে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দুর উৎসব, আবার পয়লা বৈশাখে নববর্ষের মিছিল ও অনুষ্ঠান তাদের উভয়ের মিলিত উৎসব। এবার অন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। শবেবরাত উৎসবের দিনের বিকেল বেলা যখন একজন বাঙালি মুসলমান তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দুকে এক বাটি হালুয়া দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। আবার বিজয়া দশমীর সকালবেলা যখন একজন বাঙালি হিন্দু তাঁর প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমানকে এক থালা সন্দেশ দেন, তখন প্রতিবেশী সেটা হাসিমুখে নেন। অর্থাৎ স্বতন্ত্র উৎসবে পরস্পরের যেমন সহনশীলতার, তেমনি যৌথ উৎসবে পরস্পরের ভালোবাসার কমতি ঘটে না।
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ওই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকার কারণ হচ্ছে মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি বা গোষ্ঠী বা Race নন। ১৯৩৮ সালে 'মুত্তাহিদা কওমিয়াত আউর ইসলাম' (সম্মিলিত জাতীয়তা এবং ইসলাম) শিরোনামে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা হুসেন আহমদ মাদানী লিখেছিলেন, 'একটি জাতি গঠনে ধর্ম অপরিহার্য উপাদান নয়। কারণ কোরআনের সব জায়গায় মুসলমানদের একই মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে, কখনো একই কওমের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়নি। আরবি ভাষায়, বিশেষ করে কোরআনে মিল্লাত শব্দটি আইন ও ধর্ম অর্থে এবং কওম শব্দটি জাতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দ দুটির মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান। জাতিকে যদি তুলনা করা যায় জমিনের সঙ্গে, তাহলে মিল্লাত হচ্ছে আসমানের মতো।' এই নীতির কারণে ইসলামের নবী মদিনায় যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেন তার চরিত্র ছিল সেক্যুলার বা লোকায়ত। মদিনার সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ইহুদি ও মুসলমানরা এক উম্মাহ বা জাতি। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম।
ওই নীতির কারণে বাংলাদেশের সংবিধানে সংগঠনের স্বাধীনতা_এই মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া ৩৮ অনুচ্ছেদটি শর্তযুক্ত ছিল, যার উদ্ধৃতি এই : '৩৮ জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে: তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, বাংলাদেশের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষায় যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ছবিটি বংশপরম্পরায় দৃঢ় ও অম্লান ছিল এবং যা বাস্তবায়িত হয়েছিল, বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলোতে সেগুলোর পক্ষে ধর্মীয় ও সামাজিক যুক্তিগুলো দেওয়া গেল। রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখা 'বাংলাদেশের ইতিহাস' বইটির চতুর্থ খণ্ড থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক : 'ইংরেজদের ওপর চাপ দিয়া যাহাতে তুরস্কের খলিফার শক্তি ও সাম্রাজ্য ফিরাইয়া আনা যায় এই উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানেরা একটি কমিটি গঠন করে। তাহাদের এই আন্দোলন 'খিলাফৎ আন্দোলন' নামে পরিচিত। গান্ধীর সাহায্যে ও সমর্থনে এই আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল। ... কিন্তু গান্ধী জাতীয়তাবাদের মূল সূত্রটি ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কোনো দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঐক্যে একটি জাতি গঠন করিতে হইলে তাহার সর্বপ্রথম উপাদান এই যে, এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটির সহিত অপরের যে সম্বন্ধ, দেশের বহির্ভূত অপর কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে একটিরও তদনুরূপ বা অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের বন্ধন থাকিবে না। যদি থাকে, তবে তাহারা এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে না।' উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের জাতীয় সংসদ খলিফার পদ বিলুপ্ত করে যে আইনটি প্রণয়ন করে তাতে বলা হয়, 'খেলাফতের দপ্তর বিলুপ্ত হয়েছে যেহেতু খেলাফত অপরিহার্যভাবে সরকার ও প্রজাতন্ত্রের উদ্দেশ্য ও ধারণার মধ্যেই আছে।'
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এখন ১৯৭৮ সালে একজন সামরিক প্রশাসক কর্তৃক বাংলাদেশের সংবিধানের বিচ্যুতি-অপকর্মগুলো উল্লেখ করব এবং আপনাকেই লক্ষ করতে হবে কী কায়দায় পদে পদে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নাশ করা হয়েছে এবং তার মূল স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। সংবিধানের শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম' শব্দগুলো যোগ করা হয় এবং আট অনুচ্ছেদের এক মূল দফাটি বদলে লেখা হয় : '৮। (১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস... রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। ১(ক) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি।' একই সঙ্গে ওপরে উদ্ধৃত সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদটি এবং ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত দফাটি বিলুপ্ত করা হয়। এখানে অপকর্ম শেষ হয় না। 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' পার্শ্ব-শিরোনামযুক্ত ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশকে এক দফা করে নতুন দুই দফা যোগ করা হয়, সেটা এই : (২) রাষ্ট্র 'ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।' এই দুই দফাটির সংযোজনও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বদল করার আর একটি সূক্ষ্ম কৌশল, নতুবা ২৫ অনুচ্ছেদের মূল অংশটি 'আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন' রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে যথেষ্ট ছিল।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
No comments:
Post a Comment