'মুক্তির পথটি জানা হলো না শত সংগ্রামেও'' কেন?
বেলাল বেগ
এ লেখার শিরোনামে 'কেন' শব্দটিই কেবল এ লেখকের সংযোজন; উদ্ধৃতিটি ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সালেহুদ্দীন আহমেদ সেলুর একটি লেখার শিরোনাম। আমার ই-মেইলের ভাগাড় পরিষ্কার করতে গিয়ে এমন ভারি শিরোনাম চোখে পড়ায় লেখাটি পড়েছিলাম।
''ইতিহাস গঙ্গাজলে বা আবেজমজমের পানি দিয়ে ধুলেও যা হয়ে গেছে, তা মুছে যাবে না- যেমনভাবে জনগণকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতারণার- দারিদ্র্যের ছাপ দগ দগ করছে তাদের চেহারায়- তারা প্রতারিত, বঞ্চিত এবং ব্যবহূত- তাদের মুক্তির পথটি জানা হলো না শত সংগ্রামে'' সম্পাদক কর্তৃক বাছাইকৃত এমন অংশ চোখে পড়লে কার না ইচ্ছা হবে লেখাটি পড়তে। আমার পড়ার বাড়তি ইচ্ছার ইন্ধন যুগিয়েছে লেখকের নিজের দেয়া তিনটি পরিচয়, প্রথমত: অবসরপ্রাপ্ত সেনা ক্যাপ্টেন, দ্বিতীয়ত: রাজনীতিক এবং তৃতীয়ত: কলামিস্ট। পড়া শেষ করে মনে হলো লেখক তাঁর তিনটি পরিচিতির কোনটির প্রতি সুবিচার করেননি। কথার আমাজন জঙ্গলে পথ হারালেও পাঠকের মনে হবে দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে লেখকের মনে গভীর ক্ষোভ আছে এবং এজন্যে ঢালাওভাবে বড় দুদলের রাজনীতি ও প্রচ্ছন্নভাবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেন। এমন জগাখিচুরি লেখার আলোচনা নিরর্থক। পরে মত পাল্টালাম। ইতিহাসবেত্তা ও নিরপেক্ষতার ভাণ ও পদ-পদবি ব্যবহার করে লেখা এ জাতীয় নিবন্ধগুলো সমালোচনা ছাড়া ছেড়ে দিলে নবীন পাঠকেরা কুমন্ত্রণা পাবে। তাই এ সমালোচনার অবতারণা।
শুরুতেই তাঁর রাজনীতিক পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হলো। ''ইতিহাসের যুগ সৃষ্টির বিশৃঙ্খল পরিবেশে এবং সময়ের প্রয়োজনেই দুই মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব, বাংলাদেশের বড় দুটি দলের রাজনীতিতে একমাত্র বিনিয়োগ তারাই''। উদ্ধৃতিতে লেখকের রাজনীতি-জ্ঞানের দীনতা প্রকাশ পেয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা পান্ডিত্যের মুখোশ পরে ইতিহাসের বর্জ্য, বাঙালীর স্বাধীনতার এক রহস্যময় খলনায়ককে ইতিহাসে বাঙালীর প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে এক কাতারে বসানোর অপচেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশের দু'টি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এদের জন্মের ইতিহাস বলে দেয় তাদের 'বিনিয়োগ' কি। মুসলিম লীগ বরাবরের মতোই মুসলমান রাজা, নবাব, জমিদার, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংগঠন ছিল। মুসলিম লীগের বিকল্প হিসেবে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার জন্য আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালে মওলানা ভাসানী ও হোসেন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। তখন 'মুসলিম লীগ'-এর আগে সর্বপাকিস্তান পটভূমিতে 'আওয়ামী' অর্থাৎ জনসাধারণ শব্দটি যোগ করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী নেতৃত্ব। কিছুদিন পরে নেতাদের উপলব্ধি হলো যে স্বাধীন দেশে একটি রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য অবারিত থাকা উচিত কারণ নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান। এ মানবিক সাম্য ও মর্যাদাবোধ বাঙালীর ঐতিহ্যও বটে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি ঝরা পাতার মতোই খসে পড়ল। এভাবে আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আধুনিক গণতন্ত্রের বীজ বপন করে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তখন গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও আওয়ামী লীগের 'মূলধন' হয়ে ওঠার প্রশ্নই ওঠেনা। বস্তুত জনগণের দ্বারা জনকল্যাণের আদর্শ নিয়েই আওয়ামী লীগের জন্ম ও যাত্রা শুরম্ন হয়েছে। সেখানে একজন মুজিব বা একজন ভাসানী বা সোহরাওয়ার্দী বা তাঁদের পরের সারির অসংখ্য নেতা কেউ 'বিনিয়োগ' ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন জনকল্যাণের আদর্শের সেবক মাত্র। ঐ জনকল্যাণের পথে পাকিস্তানের বাঙালী-জাতি-বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাধা হয়ে ওঠায়, আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার বিরোধিতা শুরু করে। সাধারণ মানুষ ও পূর্ববাংলার মুক্তিসংগ্রাম জোরদার করার জন্য ১৯৫৪ সনের নির্বাচনের পর প্রাদেশিক মন্ত্রিত্বের পদ ছেড়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি পদ গ্রহণ করেন এবং দ্রুত আপামর জনতাকে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমবেত করেন। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে প্রকাশ ঘটেছিল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সেটাকে এখন সংগ্রামমুখী করে দিল। তখনও শেখ মুজিব একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেননি। কিন্তু যখন তিনি ছয়দফা নিয়ে মাঠে নামলেন তখন একদিকে পাকিস্তান তাকে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' দিয়ে খতম করার চিন্তা করে, অন্যদিকে বাংলার মানুষ তাকে বরণ করে 'বঙ্গবন্ধু' হিসেবে। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালীর মুক্তিসংগ্রাম সমার্থবোধক হয়ে যায়। ঐ মুক্তিসংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপায়িত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে জাতির পিতা হয়ে গেলেন। বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা আছে এমন কোন ব্যক্তি কখনই তাঁর পাশে আর কোন ব্যক্তিকে বসানোর চিন্তাই করতে পারবেন না। রাজনীতিবিদ ক্যাপ্টেন সাহেব রাজনীতি বোঝেন না বলে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, গণমুখী আওয়ামী রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশটি দেখতে পাননি। দেখতে পেলে বুঝতেন, আওয়ামী রাজনীতির প্রকৃত মূলধন তার আদর্শ আর বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সে আদর্শের কান্ডারী।
অন্যদিকে জিয়া পাকিস্তানের প্রতি এতই অনুরক্ত ছিলেন যে একাত্তরে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ যে শুরু হয়ে গিয়েছিল, তার খবর রাখারই প্রয়োজনবোধ করেননি। সোয়াত নামক জাহাজ থেকে যে অস্ত্র খালাস রোধ করতে গিয়ে বহু মানুষ নিহত হয়েছিল, সে অস্ত্র ক্যান্টনমেন্টে আনার জন্যই তিনি যাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন খলিকুজ্জামান তাকে বাধাগ্রস্ত না করলে 'মহান' ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের কি দশা হতো কে জানে। তবে ইতিহাস বলে, জিয়া তাঁর বাহিনী নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ যে শুরু হয়েছে এবং তার জন্য বাঙালী সৈন্যরা লড়াই শুরু করে দিয়েছে, এমন একটা তথ্য একজন সামরিক অফিসার কর্তৃক তখনই প্রচারিত হলে যুদ্ধ দেশব্যাপী ছড়িয়ে যাবে, এমন একটি ধারণায় বিদ্রোহী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কাউকে খুঁজছিলেন। সেই কেউ একজন আমাদের এই মেজর জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার এবং শীর্ষ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শত্রুজোট গোপনে বাংলাদেশ দখল করে আবার পাকিস্তানী হুকুমাত কায়েম করে। এরই মাঝে সেনাবিদ্রোহের সুযোগে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন জিয়াউর রহমান। ইতিহাস বলে, জিয়া বঙ্গবন্ধু-হত্যার ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে জানতেন এবং তিনিও যে তার অংশ ছিলেন খুনীদের বিচার করা যাবে না বলে আইন প্রণয়ন করে তিনি তার প্রমাণও দিয়ে গেছেন। এহেন জিয়াই বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল করেন, যেটাকে দলে যোগদানের আগে রাজাকার শাহ আজিজ বলতেন 'বেসিক্যালি নো পলিটিকস।' সামরিক উর্দি পরা, ক্ষমতায় থাকা জিয়ার তৈরি দলের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল উর্দি ছেড়ে জনগণের কাছে যাবার একটা কৌশল এবং মুজিবের হত্যার পর একাত্তরের অর্জনগুলো ধ্বংসের একটা সিভিলিয়ান অস্ত্র হাতে রাখা। জিয়াকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তারাই তাঁকে 'স্বাধীনতার ঘোষক' বানিয়েছিল নবগঠিত পার্টির স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর স্বর্গ-মর্ত্য-আকাশ-পাতালব্যাপী ভাবমূর্তি ধ্বংস করার কুমতলবে। মজার কথা, সম্ভবত এ সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র সফল করার জন্যই সিআইএ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২৬ মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার সত্যটি প্রায় তিন দশক গোপন রেখেছিল। এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন সাহেবের পর্যবেক্ষণই ঠিক; জিয়াই বিএনপি রাজনীতির একমাত্র 'বিনিয়োগ'।
কলাম লেখক হিসেবে ক্যাপ্টেন সাহেব এক সঙ্গে অনেক বিষয়ের অবতারণা করে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের কাছে ধরা দিয়ে হোচিমিন, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, চে গুয়েভারা, প্রভাকরণদের মতো নেতা হবার অযোগ্যতা দেখিয়েছেন, কিংবা ভাসানীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় যথাযোগ্য সন্মান দিতে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি বহুমুখী প্রশ্ন তুলে সমালোচককে বিপদে ফেলেছেন। কারণ প্রতিটি প্রশ্নের জবাব পড়ার মতো ধৈর্য কলাম পাঠকদের থাকে না। লেখার কলেবর সীমিত রাখার স্বার্থে শুধু এটুকু বলা চলে যে যুদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক ঘটনাও বটে যেখানে জনমত সংগ্রহের প্রধান উপাদান গণতন্ত্র ও ন্যায়ের সংগ্রাম। নেলসন ম্যান্ডেলা এ পথেই বিশ্বজনমত সাথে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ ধ্বংস করেছিলেন। বাঙালীর চিরকালের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঐ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেই শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করে বিশ্বনেতা হয়েছিলেন।
লেখকের প্রতি উপদেশ : জানার জন্য পড়ুন এবং জানানোর জন্য লিখুন। প্রচারের জন্য লেখা বোকামির পরিচায়ক এবং মানবজীবনের অমূল্য সময়ের অপচয়।
''ইতিহাস গঙ্গাজলে বা আবেজমজমের পানি দিয়ে ধুলেও যা হয়ে গেছে, তা মুছে যাবে না- যেমনভাবে জনগণকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতারণার- দারিদ্র্যের ছাপ দগ দগ করছে তাদের চেহারায়- তারা প্রতারিত, বঞ্চিত এবং ব্যবহূত- তাদের মুক্তির পথটি জানা হলো না শত সংগ্রামে'' সম্পাদক কর্তৃক বাছাইকৃত এমন অংশ চোখে পড়লে কার না ইচ্ছা হবে লেখাটি পড়তে। আমার পড়ার বাড়তি ইচ্ছার ইন্ধন যুগিয়েছে লেখকের নিজের দেয়া তিনটি পরিচয়, প্রথমত: অবসরপ্রাপ্ত সেনা ক্যাপ্টেন, দ্বিতীয়ত: রাজনীতিক এবং তৃতীয়ত: কলামিস্ট। পড়া শেষ করে মনে হলো লেখক তাঁর তিনটি পরিচিতির কোনটির প্রতি সুবিচার করেননি। কথার আমাজন জঙ্গলে পথ হারালেও পাঠকের মনে হবে দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে লেখকের মনে গভীর ক্ষোভ আছে এবং এজন্যে ঢালাওভাবে বড় দুদলের রাজনীতি ও প্রচ্ছন্নভাবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেন। এমন জগাখিচুরি লেখার আলোচনা নিরর্থক। পরে মত পাল্টালাম। ইতিহাসবেত্তা ও নিরপেক্ষতার ভাণ ও পদ-পদবি ব্যবহার করে লেখা এ জাতীয় নিবন্ধগুলো সমালোচনা ছাড়া ছেড়ে দিলে নবীন পাঠকেরা কুমন্ত্রণা পাবে। তাই এ সমালোচনার অবতারণা।
শুরুতেই তাঁর রাজনীতিক পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হলো। ''ইতিহাসের যুগ সৃষ্টির বিশৃঙ্খল পরিবেশে এবং সময়ের প্রয়োজনেই দুই মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব, বাংলাদেশের বড় দুটি দলের রাজনীতিতে একমাত্র বিনিয়োগ তারাই''। উদ্ধৃতিতে লেখকের রাজনীতি-জ্ঞানের দীনতা প্রকাশ পেয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা পান্ডিত্যের মুখোশ পরে ইতিহাসের বর্জ্য, বাঙালীর স্বাধীনতার এক রহস্যময় খলনায়ককে ইতিহাসে বাঙালীর প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে এক কাতারে বসানোর অপচেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশের দু'টি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এদের জন্মের ইতিহাস বলে দেয় তাদের 'বিনিয়োগ' কি। মুসলিম লীগ বরাবরের মতোই মুসলমান রাজা, নবাব, জমিদার, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংগঠন ছিল। মুসলিম লীগের বিকল্প হিসেবে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার জন্য আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালে মওলানা ভাসানী ও হোসেন সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। তখন 'মুসলিম লীগ'-এর আগে সর্বপাকিস্তান পটভূমিতে 'আওয়ামী' অর্থাৎ জনসাধারণ শব্দটি যোগ করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী নেতৃত্ব। কিছুদিন পরে নেতাদের উপলব্ধি হলো যে স্বাধীন দেশে একটি রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য অবারিত থাকা উচিত কারণ নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান। এ মানবিক সাম্য ও মর্যাদাবোধ বাঙালীর ঐতিহ্যও বটে। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি ঝরা পাতার মতোই খসে পড়ল। এভাবে আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আধুনিক গণতন্ত্রের বীজ বপন করে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তখন গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও আওয়ামী লীগের 'মূলধন' হয়ে ওঠার প্রশ্নই ওঠেনা। বস্তুত জনগণের দ্বারা জনকল্যাণের আদর্শ নিয়েই আওয়ামী লীগের জন্ম ও যাত্রা শুরম্ন হয়েছে। সেখানে একজন মুজিব বা একজন ভাসানী বা সোহরাওয়ার্দী বা তাঁদের পরের সারির অসংখ্য নেতা কেউ 'বিনিয়োগ' ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন জনকল্যাণের আদর্শের সেবক মাত্র। ঐ জনকল্যাণের পথে পাকিস্তানের বাঙালী-জাতি-বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাধা হয়ে ওঠায়, আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার বিরোধিতা শুরু করে। সাধারণ মানুষ ও পূর্ববাংলার মুক্তিসংগ্রাম জোরদার করার জন্য ১৯৫৪ সনের নির্বাচনের পর প্রাদেশিক মন্ত্রিত্বের পদ ছেড়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি পদ গ্রহণ করেন এবং দ্রুত আপামর জনতাকে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমবেত করেন। ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে প্রকাশ ঘটেছিল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সেটাকে এখন সংগ্রামমুখী করে দিল। তখনও শেখ মুজিব একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেননি। কিন্তু যখন তিনি ছয়দফা নিয়ে মাঠে নামলেন তখন একদিকে পাকিস্তান তাকে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' দিয়ে খতম করার চিন্তা করে, অন্যদিকে বাংলার মানুষ তাকে বরণ করে 'বঙ্গবন্ধু' হিসেবে। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালীর মুক্তিসংগ্রাম সমার্থবোধক হয়ে যায়। ঐ মুক্তিসংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপায়িত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে জাতির পিতা হয়ে গেলেন। বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা আছে এমন কোন ব্যক্তি কখনই তাঁর পাশে আর কোন ব্যক্তিকে বসানোর চিন্তাই করতে পারবেন না। রাজনীতিবিদ ক্যাপ্টেন সাহেব রাজনীতি বোঝেন না বলে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, গণমুখী আওয়ামী রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশটি দেখতে পাননি। দেখতে পেলে বুঝতেন, আওয়ামী রাজনীতির প্রকৃত মূলধন তার আদর্শ আর বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সে আদর্শের কান্ডারী।
অন্যদিকে জিয়া পাকিস্তানের প্রতি এতই অনুরক্ত ছিলেন যে একাত্তরে চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ যে শুরু হয়ে গিয়েছিল, তার খবর রাখারই প্রয়োজনবোধ করেননি। সোয়াত নামক জাহাজ থেকে যে অস্ত্র খালাস রোধ করতে গিয়ে বহু মানুষ নিহত হয়েছিল, সে অস্ত্র ক্যান্টনমেন্টে আনার জন্যই তিনি যাচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন খলিকুজ্জামান তাকে বাধাগ্রস্ত না করলে 'মহান' ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের কি দশা হতো কে জানে। তবে ইতিহাস বলে, জিয়া তাঁর বাহিনী নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ যে শুরু হয়েছে এবং তার জন্য বাঙালী সৈন্যরা লড়াই শুরু করে দিয়েছে, এমন একটা তথ্য একজন সামরিক অফিসার কর্তৃক তখনই প্রচারিত হলে যুদ্ধ দেশব্যাপী ছড়িয়ে যাবে, এমন একটি ধারণায় বিদ্রোহী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কাউকে খুঁজছিলেন। সেই কেউ একজন আমাদের এই মেজর জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার এবং শীর্ষ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শত্রুজোট গোপনে বাংলাদেশ দখল করে আবার পাকিস্তানী হুকুমাত কায়েম করে। এরই মাঝে সেনাবিদ্রোহের সুযোগে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন জিয়াউর রহমান। ইতিহাস বলে, জিয়া বঙ্গবন্ধু-হত্যার ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে জানতেন এবং তিনিও যে তার অংশ ছিলেন খুনীদের বিচার করা যাবে না বলে আইন প্রণয়ন করে তিনি তার প্রমাণও দিয়ে গেছেন। এহেন জিয়াই বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল করেন, যেটাকে দলে যোগদানের আগে রাজাকার শাহ আজিজ বলতেন 'বেসিক্যালি নো পলিটিকস।' সামরিক উর্দি পরা, ক্ষমতায় থাকা জিয়ার তৈরি দলের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল উর্দি ছেড়ে জনগণের কাছে যাবার একটা কৌশল এবং মুজিবের হত্যার পর একাত্তরের অর্জনগুলো ধ্বংসের একটা সিভিলিয়ান অস্ত্র হাতে রাখা। জিয়াকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তারাই তাঁকে 'স্বাধীনতার ঘোষক' বানিয়েছিল নবগঠিত পার্টির স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর স্বর্গ-মর্ত্য-আকাশ-পাতালব্যাপী ভাবমূর্তি ধ্বংস করার কুমতলবে। মজার কথা, সম্ভবত এ সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র সফল করার জন্যই সিআইএ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ২৬ মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার সত্যটি প্রায় তিন দশক গোপন রেখেছিল। এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন সাহেবের পর্যবেক্ষণই ঠিক; জিয়াই বিএনপি রাজনীতির একমাত্র 'বিনিয়োগ'।
কলাম লেখক হিসেবে ক্যাপ্টেন সাহেব এক সঙ্গে অনেক বিষয়ের অবতারণা করে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের কাছে ধরা দিয়ে হোচিমিন, ফিদেল ক্যাস্ত্রো, চে গুয়েভারা, প্রভাকরণদের মতো নেতা হবার অযোগ্যতা দেখিয়েছেন, কিংবা ভাসানীকে মুক্তিযুদ্ধের সময় যথাযোগ্য সন্মান দিতে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি বহুমুখী প্রশ্ন তুলে সমালোচককে বিপদে ফেলেছেন। কারণ প্রতিটি প্রশ্নের জবাব পড়ার মতো ধৈর্য কলাম পাঠকদের থাকে না। লেখার কলেবর সীমিত রাখার স্বার্থে শুধু এটুকু বলা চলে যে যুদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক ঘটনাও বটে যেখানে জনমত সংগ্রহের প্রধান উপাদান গণতন্ত্র ও ন্যায়ের সংগ্রাম। নেলসন ম্যান্ডেলা এ পথেই বিশ্বজনমত সাথে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ ধ্বংস করেছিলেন। বাঙালীর চিরকালের শ্রেষ্ঠ নেতা বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঐ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেই শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করে বিশ্বনেতা হয়েছিলেন।
লেখকের প্রতি উপদেশ : জানার জন্য পড়ুন এবং জানানোর জন্য লিখুন। প্রচারের জন্য লেখা বোকামির পরিচায়ক এবং মানবজীবনের অমূল্য সময়ের অপচয়।
No comments:
Post a Comment