Wednesday, April 14, 2010

স্মরণ

"শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত"
__এম.আর. মাহবুব
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামটি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।
১৯৭১ সালে ১৪ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে নির্মম অত্যাচারের পর গুলি করে হত্যা করে। তিনি ১৮৮৬ সালের ২ নবেম্বর তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার রামবাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা পরীৰা পাস করার পর কলকাতায় রিপন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক কারণে তাঁকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। ১৯০৬ সালে কুমিলস্না কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এই বছরই আবারও রিপন কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯০৮ সালে বি.এ. পাস করেন।
১৯১০ সালে তিনি আইন পাস করে কিছুদিন কুমিলস্নায় শিক্ষকতা করেন এবং ১৯১১ সালে আইন ব্যবসা শুরু করেন। রাজনীতি ও আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও তিনি আমৃত্যু দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে নিজের এবং নিজ সন্তানের জীবনের বিনিময়ে তিনি আমাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়ে গেছেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাজনৈতিক জীবন। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য এবং ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের পৰে বিরোধী দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ ও ১৯৫৮ সালে তিনি আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কয়েকবার জেল খেটেছেন; বহু অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন; আইনসভায় তুলে ধরেছেন দেশ-মাতৃকার কল্যাণে সাহসী ও নির্ভীক বক্তব্য।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনের একটি উজ্জ্বল ও অন্যতম অধ্যায় বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ। তিনিই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি দৃপ্ত কণ্ঠে গণপরিষদে ইংরেজী ও উদর্ুর সাথে বাংলাকে সমান মর্যাদা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের সভায় প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। প্রস্তাব উত্থাপনকালে তিনি বলেন, "মি. প্রেসিডেন্ট স্যার, আমার সংশোধনী ২১ নং বিধির ১নং উপবিধির ২নং লাইনে 'ইংরেজী' শব্দের পরে 'অথবা বাংলা' শব্দ দু'টি যোগ করা হোক।... স্যার, এ জন্যই আমি সমগ্র দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোভাবের পৰে সোচ্চার হয়েছি। বাংলাকে কিছুতেই একটা প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করা যাবে না। তাই বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করতে হবে।" প্রস্তাবটির ওপর ২৫ ফেব্রুয়ারি আলোচনা হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও কয়েকজন প্রভাবশালী গণ-পরিষদ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে দেয়া হয় এবং তা বাতিল হয়ে যায়।
১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বাংলাকে সরকারী ভাষা ও শিৰার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করার জন্য একটি প্রস্তাব আনেন। ৮ এপ্রিল প্রসত্মাবটি সংশোধিত হয়ে গৃহীত হয়। সংশোধনী প্রসত্মাব এনেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এতে বলা হয়, "এ পরিষদ সংবিধান সভার সদস্যকে অনুরোধ জানাচ্ছে এবং পূর্ববাংলার প্রতিনিধিগণের নিকট বিশেষভাবে আবেদন করছে; যাতে তারা বাংলাকে পাকিসত্মানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করেন।" কিন্তু তাঁর প্রস্তাবিত সংশোধনী গৃহীত হয়নি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আইনসভায় বক্তব্য প্রদান ছাড়াও তিনি ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য নৈতিক ও আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।
১৯৫২ সালে একুশের রক্তাক্ত ঘটনার পর পরই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে আসেন। তখন ছাত্ররা পরিষদে বাংলা ভাষার সপৰে কথা বলার জন্য দাবি জানান। অধিবেশনের শুরুতে প্রথমে মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ও পরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন। এক পর্যায়ে তিনিসহ অন্য সদস্যরা অধিবেশন ত্যাগ করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চলে আসেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা বাস্তাবায়নে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনসহ নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।
১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ২৩ মার্চ থেকে তা কার্যকর হয়। সেখানে শর্তসাপেৰে বাংলাকে প্রথম রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। পরবর্তীকালে দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উল্লেখ করেন 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।' সেই থেকে বাংলা ভাষা পেল বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার প্রথম সাংবিধানিক স্বীকৃতি। সার্থক হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। তবে সর্বপ্রথম পদৰেপ হিসেবে আইনসভায় বাংলা ভাষার অধিকারের কথা বলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই ঐতিহাসিক পদৰেপ স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার স্বাপি্নক পুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চিরঅমর, চিরঅম্লান। যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জীবনদান করেছেন সে বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেননি। একাত্তরে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের যথার্থ মূল্যায়নের মাধ্যমেই তাঁর এ আত্মদান সার্থক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

No comments: