Sunday, April 18, 2010

বিচার শুরুর আগেই আসামি বলছে, 'আমি কলা খাইনি'।। যুদ্ধাপরাধীর বিচার

বিচার শুরুর আগেই আসামি বলছে, 'আমি কলা খাইনি'
যুদ্ধাপরাধীর বিচার
বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বানচাল করতে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা এককাট্টা। ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, এখনও তদন্ত শেষ বা বিচার শুরু হয়নি। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাইনি। '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, তারা এবং তাদের দোসররা বিচার হওয়ার আগেই হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে।
আইনের অপব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেছে। দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীগণ বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে, দেশীয় আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধকারীদের বিচার হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে এই আইন কোনভাবেই সাংঘর্ষিক নয়। বিচারে অপরাধীদের সাজা হলে অবশ্য তারা আপীল করতে পারবে। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সাজাপ্রাপ্তরা আপীল করতে পারবে। বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা বিচার শুরুর আগেই মনগড়া বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বিদেশে অবস্থান করায় এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেছেন, '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, তাদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। যারা এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কথাবার্তা বলে তারা জ্ঞানপাপী। বুঝে শুনেই তারা অসত্য কথাবার্তা বলছে। তাদের দোসর রাজাকার আলবদরদের বাঁচাতেই এমন কথাবার্তা বলছে। উল্লেখ্য, ১৬ এপ্রিল স্থানীয় এক হোটেলে দি ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস, সম্মেলনে সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলে আমরা ২৬ হাজার আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করব। এ প্রসঙ্গে আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে আইনজীবীই আছে ২৬ হাজার। এই সমস্ত আইনজীবী তাদের সমর্থক বা দালাল নয়। বরং ২৬ হাজার আইনজীবী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে। তাদের সঙ্গে হয়ত হাতেগোনা কয়েকজন আইনজীবী আছেন। তিনি আরও বলেন, বিচার শুরুর আগেই নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। কাজেই জামায়াতের অধীনে যে সমস্ত অর্থকরী প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক অতিসত্বর সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা সৃষ্টি করবে। '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতা বিরোধী অপরাধকারীদের বিচারের জন্য ২৫ মার্চ সরকার ট্রাইব্যুনালে বিচারক, তদন্তকারী সংস্থা এবং প্রসিকিউটর প্যানেল ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ নিজামুল হককে ২ জন সদস। নিয়োগ দেয়া হয়। এরা হলেন, বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ কেএম জহির আহমদ। তদন্তকারী সংস্থায় ৭ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রধান করা হয় প্রাক্তন অতিরিক্ত সচিব আবদুল মতিনকে, অন্যদিকে সরকার চীফ প্রসিকিউর হিসেবে নিয়োগ দেয় গোলাম আরীফ টিপুকে। ১২ সদস্য বিশিষ্ট প্রসিকিউটর প্যানেল ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত ৫ জন নিয়োগ পেয়েছেন। একইভাবে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রারও নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ হত্যাকারী এবং ২ লাখ নারী সম্ভ্রম হরণকারীদের যখন বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, ঠিক তখনই একটি মহল সুপরিকল্পিতভাবে এর বিরোধিতায় মাঠে নেমে পড়েছে। তারা বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক গল্প বাতলিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। অথচ তাদের মুখের কথায় কিছুই আসে যায় না। '৭১ সালের তাদের অপকীর্তি তখনকার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। শুধু নিউজই নয়, অপরাধীদের ছবিও রয়েছে, এগুলো কিভাবে অস্বীকার করতে পারবে। আবার বিচারের জন্য যে আইন করা হয়েছে, তা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলেছে। এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, যে আইনে অপরাধীদের বিচার হবে, বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে এই আইন কোনভাবেই সাংঘর্ষিত নয়। এই আইনটি সংবিধান অনুযায়ীই হয়েছে। বিচারকার্য সাংবিধানিক পন্থাতেই হবে। আইনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই হবে। আসামি কারা, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হচ্ছে, সেটা এখনও ঠিক হয়নি। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। আসামিকে দেখছি না। দালিলিক কি প্রমাণ হবে, সেটা না দেখেই অপরাধী ও তার দোসররা হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, তারা ধরেই নিয়েছে, তারা অপরাধ করেছে। তাদের বিচার হতে যাচ্ছে। এটা ঠিক ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাইনি। ঠিক এমন প্রবাদ বাক্যের মতোই এদের কথাগুলো মিলে যাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করতে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের অধীনে তদন্তকারী সংস্থা ইতোমধ্যে তাদের কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। তদন্তকারী সংস্থার প্রধান আব্দুল মতিন বলেছেন, আমাদের হাতে যে সমস্ত তথ্য উপাত্ত আছে, তা নিয়েই কাজ শুরু করেছি। তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই বলা যাবে না। তিনি বলেছেন, তদন্ত নিজস্ব গতিতে চলছে। সময়মতো রেজাল্ট পাওয়া যাবে।
শুক্রবারের সেমিনারে টিএইচ খান বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস্ এ্যাক্টের কোন মিল নেই। আকাশ পাতাল তফাৎ। এ প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরীফ টিপু জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমাদের দেশীয় আইনেই অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এই বিচার হবে। অপরাধীদের সাজা হলে সুপ্রীমকোর্টে তারা আপীল করতে পারবে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু না হতেই তারা গরম ঠাণ্ডা সব রকম কথাবার্তা বলছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেছেন, সংবিধানে কিছুটা সংশোধনী আনলে ভাল হবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, গণহত্যাজনিত অপরাধ মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বালিয়া গণ্য হইবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২৯ জানুয়ারি (২০০৯) জাতীয় সংসদে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার বিষয়ে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়েছে। জনগণ এখন '৭১ সালের রাজাকার আলবদরদের বিচার দেখতে চায়। আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইবুনালস) ১৯৭৩ আইনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। বিচারের প্রক্রিয়া দেখে '৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীর এখন অনেকটাই চিন্তিত। একের পর এক দেশী-বিদেশী মিত্র হারাচ্ছে। সে জন্য এখন উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে।

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2010-04-18&ni=15213

No comments: