Tuesday, April 20, 2010

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু- এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা (১)

বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু- এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা
মোঃ এনায়েত হোসেন
ঊনসত্তর ও একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিন, দ্রোহ ও বেদনাবিধুর স্মৃতি আমাদের আজও আন্দোলিত করে, ব্যথিত করে, সর্বোপরি হাজার বছরে বাঙালীর শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা লাভের গৌরবে গৌরবান্বিত করে। আমরা '৬৯-এ শহীদ আসাদের রক্তভেজা লাল শার্ট দেখেছি, আমরা একাত্তরে আগুনের লেলিহান শিখায় গ্রাম থেকে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হতে দেখেছি, সন্তানহারা মায়ের কান্না আমরা শুনেছি, মেহেরজান বিবি কিংবা হরিদাসীর মতো লাখ লাখ জায়াকে স্বামীহারা হতে দেখেছি। মহান স্বাধীনতা দিয়েছে আমাদের অনেক। এ স্বাধীনতার জন্য আবার অকাতরে জীবনও দিয়েছে এ বঙ্গমাতার লাখ লাখ সন্তান। মানুষের জীবন তার কাছে অতি মূল্যবান। কিন্তু কখনও কখনও সে জীবন দ্রোহ, সংগ্রাম ও মুক্তিচেতনার কাছে হয়ে দাঁড়ায় অতি তুচ্ছ- অতি সামান্য। বাঙালীর জীবনে সে সময় এসেছে বার বার। ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১- এ সবই আমাদের জীবনে এক অনন্য সাধারণ সময়, মহাকাব্যিক অধ্যায়। বাঙালীর জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্যিক অধ্যায় রচিত হয় ঊনিশ শ' একাত্তরে। সেই মহাকাব্যের অমর কবি আমরা জানি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু একেবারে অবিচ্ছেদ্য।
১৯৭১ সালে যে মহাকাব্য রচিত হলো- তা একদিনে রচনা করা সম্ভব হয়নি। অনেক ত্যাগ, অনেক তিতিক্ষা, অনেক সংগ্রাম, অনেক রক্ত এবং অনেক জীবনের বিনিময়ে ঐ মহাকাব্যখানি রচিত হলো। সে মহাকাব্যের অপর নাম 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা'। ঐ অমর কাব্যের অমর কবি যেমন বঙ্গবন্ধু, তেমনি এ মহাকাব্যের অবিস্মরণীয় মহানায়কও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু কিভাবে ঐ অমর কাব্যের মহানায়ক হলেন তার জন্য আমাদের অবশ্যই তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে।
১৯২০ সাল। ১৭ মার্চ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্ম, মাতা সায়েরা বেগম, পিতা শেখ লুৎফর রহমান। বঙ্গবন্ধুর পিতা ছিলেন ব্রিটিশ সৃষ্ট আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এ পরিবারের অষ্টম পূর্বপুরুষ শেখ আবদুল আউয়াল ১৮৫৪ সালে একটি পাকা বাড়ি তৈরি করে টুঙ্গিপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। সেই সময় থেকে টুঙ্গিপাড়ার 'শেখ' পরিবারের অভিযাত্রা শুরু হয়।
ব্রিটিশ সৃষ্ট আধুনিক মধ্যবিত্ত অবশ্য ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ব্রিটিশ-ভারতের পূর্বে এখানে ভূ-স্বামীদের ও ভূমি মালিকদেরই বসবাস। ভূমিই তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উপায় ছিল। ভারতীয় সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনামলে তাদের সৃষ্ট ভারতীয় অপুষ্ট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ দু'য়ের সমন্বয়ে বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের তরঙ্গাভিঘাত সৃষ্টি করলেও তা সর্বব্যাপী হয়ে উঠতে পারেনি। এ অবস্থায় একদিকে সামন্তবাদের জীবন্মৃত অবস্থা, অন্যাধারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও পরিপূর্ণ রূপলাভ করতে ব্যর্থ হয়। লর্ড কর্নওয়ালিশের ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমি 'বেচাকেনার পণ্যে' পরিণত হয়। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে আদিম উৎপাদন ব্যবস্থা টিকে থাকে। ব্রিটিশ আনুকূল্যপ্রাপ্ত লোকজন একাধারে পেশাজীবী কিংবা ব্যবসাজীবী এবং ঐ সুবাদে উঠতি অর্থে ভূ-মালিকানারও অধিকারী হয়। এ সম্পর্কে B.B. Misra যথার্থই বলেছেন "Calcutta, naturally monopolized the benefit of trade & commerce as well. The new middle class arose here and spread gradually." ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল সমগ্র ভারতের রাজধানী। ফলে এখানে ব্রিটিশ সৃষ্ট মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটে। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা (১) বাণিজ্যিক মধ্যবিত্ত, (২) শিল্পশ্রেণী মধ্যবিত্ত, (৩) ভূমি নির্ভর মধ্যবিত্ত ও (৪) পেশাজীবী ও ভূ-মালিক মধ্যবিত্ত। বঙ্গবন্ধুর পিতা ছিলেন ব্রিটিশ সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পেশাজীবী ভূ-মালিক মধ্যবিত্ত।
১৯০৫ সালে 'বঙ্গভঙ্গ' আন্দোলন শুরু হয়। ঐ আন্দোলনে কলাকাতাকেন্দ্রিক ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় একটি বিরাট ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়। ঢাকা প্রাচীন নগরী হলেও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত তা দৃষ্টিগ্রাহী নগরীর রূপলাভ করতে ব্যর্থ হয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে ঢাকার প্রতি দেশবাসী ও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর দৃষ্টি নিপতিত হয়। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে ঢাকা আবার তার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। এরই মধ্যে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু এবং ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব (রুশ বিপ্লব) সংঘটিত হয় এবং ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা- এ ঘটনাত্রয়ের পর ঢাকা আধুনিক নগরীর রূপ লাভ করতে শুরু করে। উপরের ঘটনাত্রয় বাঙালীর ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। এখানে স্মরণযোগ্য যে উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত বাঙালী মধ্যবিত্ত স্বদেশভূমি ও জাতীয় মুক্তি অন্বেষার চেতনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথম দিকে এ প্রচেষ্টা রাজনৈতিক সংগঠনের রূপ লাভ করে। ব্রিটিশ শাসনামলে যে আধুনিক মধ্যবিত্তের উদ্ভব হয়, ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতা এবং হিন্দুদের ব্রিটিশ আনুকূল্যের ফলে হিন্দুরাই সেখানে প্রাধান্য লাভ করে। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ পর্যায়ে খাঁটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ৯০%-এর বেশি সদস্য ছিল হিন্দু মধ্যবিত্তের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই এটা স্পষ্ট যে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার মুসলমান সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকাশ লাভ করেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভ করার পর এখানে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবের একটি সম্ভাবনা ও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু সে আশাও বাংলার মুসলমানদের পূরণ হয়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পূর্বে ও পরে পূর্ব বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। হিন্দুদের পরিত্যক্ত জমাজমি ও ব্যবসাবাণিজ্য বিশেষত, হিন্দু মধ্যবিত্তের শূন্যস্থানটি পূর্ব বাংলার মুসলমাদের হস্তগত হবার কথা ছিল। এ সহজ-সরল অঙ্কের সমীকরণটি অবশেষে মেলেনি। হিন্দুদের পরিত্যক্ত জায়গাটি এবং ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর পরিত্যক্ত রাজনৈতিক মঞ্চটি দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। আদমজী, বাওয়ানী, ইস্পাহানী ইত্যাদি ২২টি পরিবারের হাতে চলে যায় সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা আবার আশাভঙ্গের ইতিহাসের করুণার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়।
উপরের ইতিহাসের এ উল্লেখ এজন্য যে, বঙ্গবন্ধু যে সময় টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর শৈশব ও যৌবনকাল যে সময় নিয়ন্ত্রিত তার উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর জন্মের প্রাক্কালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবে বিশ্ব মানবেতিহাসে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর প্রভাবে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালীর মানসালোক চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এছাড়া বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন রদ, বিভিন্ন সংঘ, সভা ও রাজনৈতিক দলের জন্ম, বিশ শতকের তৃতীয় দশকজুড়ে স্বদেশী আন্দোলন এবং হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত, সামপ্রদায়িক দাঙ্গা এবং ধর্মভিত্তিক জাতীয় চেতনার উন্মেষকালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাংলার তখনকার ইতিহাস শুধু বঞ্চনা, সংগ্রাম ও জীবনদানের ইতিহাস। তখন তারা নিঃস্ব, সর্বহারা। ব্রিটিশ শাসিত সমাজে হিন্দু জমিদার, মহাজন, মুৎসুদ্দিদের হাতে এখানকার মানুষ নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছে। মুক্তির সন্ধানে পূর্ববাংলার বাঙালীরা পাগল হয়ে ওঠে। এ মুক্তির অনুসন্ধানে এবং আকাঙ্ক্ষা পূর্ব বাংলার মানুষ যখন অধীর, তখন তারা আবার নতুন করে রাজনৈতিক কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হলো। জন্ম হলো পাকিসত্মানের। নতুন শাসকগোষ্ঠী গ্রাস করল বাংলা ও বাঙালীকে। দ্বিজাতিতত্ত্বের অভিশপ্ত পরিণতিতে এখানকার মানুষ আবার নতুন শাসকযন্ত্রের হাতে শৃঙ্খলিত ও শোষিত হতে লাগল। পরাধীনতার জিঞ্জির তার দু'পায়ে বাঁধাই থাকল। অসহায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী কিংবা সে সময়ের রাজনৈতিক নেতৃবর্গ। ঠিক এ সময়ে বাঙালীর আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকবর্তিকা হাতে যে মানুষটির আবির্ভাব, যার ধ্যান-জ্ঞান, জীবন স্বপ্ন বাংলাদেশ ও বাংলার মানুষ, তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। (ক্রমশ)
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাবন্ধিক।

No comments: