মুজিবনগর সরকার ও কিছু স্মৃতি
এম. আমীর-উল ইসলাম
(গতকালের পর)
ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সপ েসমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্য সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। আমি তার লেখা কিছু নিবন্ধ পড়েছি বলে মনে হলো। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর ঠিকানা জেনে নিলাম। টেলিফোনে তাকে যোগাযোগ করি। বললাম তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন। বালিগঞ্জে তার বাসা। আমার পরিচয়, 'রহমত আলী' নামে। সুব্রত রায় চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে তাকে আমার প্রণীত ঘোষণাপত্রর খসড়াটি দেখালাম। খসড়াটি দেখে তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। এই খসড়া আমি করেছি কি-না জিজ্ঞাসা করলেন। আমি হঁযা সূচক জবাব দেই। তিনি বলেন, একটা কমা বা সেমিকোলন বদলাবার কোন প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটি কপি তাকে দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এরপর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরম্ন করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে 'জেনেসিস অব বাংলাদেশ' আন্তর্জাতিকভাবে অধ্যয়নের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন তা পড়ানো হচ্ছে। এটা ছিল সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাকে বড় ভাইয়ের মতো সময়ে অসময়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। আমার জন্য তার দুয়ার সর্বদাই ছিল খোলা।
এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোন পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তার জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার ছিল আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল আমরা দু'জনে কলকাতা প্রেসকাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প থেকে দু'জন প্রতিনিধি বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসকাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সার্চ লাইটের অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবদ্ধ। কাবের সেক্রেটারি উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের প্রথম অনুরোধ জানাই আমাদের উপস্থিতির কথা গোপন রাখতে হবে। এরপর বললাম, আমরা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা নিয়ে এসেছি।
সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাক ডাকা ভোরে এই প্রেসকাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদের আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেয়া হবে। তাদের কেউ কেউ আরও কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। আমরা কোন উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করি। এতে তারা কেউ কেউ হতাশও হন। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। আওয়ামী লীগের এমপি এমএলএ এবং নেতাদের খবর পাঠিয়ে দেই রাত ১২টার মধ্যে লর্ড সিনহা রোডে সমবেত হওয়ার জন্য। বিএসএফের চট্টপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসকাবে সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানো হবে। রাত ১২টা থেকে নেতাদের আমি গাড়িতে তুলে দেই। বলে দেয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলা আমরা একত্রিত হবো। গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইকোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম। হাতে লেখা কিছু সংশোধনী রয়েছে। কয়েক জনকে এগুলো সংশোধন করার জন্য দেই।
১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন। সারারাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী কলকাতা প্রেসকাবে যাই। সেই ভোরেও কাবে লোক ধরেনি। কাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমি সাংবাদিকদের ল্ক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করবেন। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসকাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০/৬০টা গাড়িযোগে রওনা হলাম গন্তব্য স্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্না দু'জনই দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সঙ্গে অনেক কথা হলো।
শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌঁছতে ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তওফিক এলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন। এদিকে পাক হানাদার বাহিনীর চাপের মুখে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটতে হয়েছে। সম্মুখ সমরে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নির্দেশ সত্ত্বেও দেশ মাতৃকার মুক্তিপাগল যোদ্ধারা বাঙ্কার ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না। মাহবুব ও তওফিক তাদের সৈন্যসহ পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়েছিলেন। তারা সুকৌশলে পিছু হটে আসেন। মনোবল ঠিক রেখে পশ্চাদপসরণ করা একটা কঠিন কাজ। কান্ত শ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার থেকে উঠে আসে। ওদের চোখে মুখে বিশ্বাসের দীপ্তি বিদ্যমান ছিল।
কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানের নাম 'মুজিবনগর' নামকরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী।
সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তার সঙ্গে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি তা অস্বীকার করে তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতর থেকে যুদ্ধের নেতৃত্বে দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দী আছেন। আম বাগানের অনুষ্ঠানে ভর দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পাশ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়।
কলকাতার বাসায় ফিরে তাজউদ্দীন ভাইকে জিজ্ঞাসা করি কলকাতায় পাকিস্তান মিশনের হোসেন আলীকে আমাদের পক্ষে আনা যায় কি না। ফরিদপুরের আত্মীয় শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে হোসেন আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। হোসেন আলী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে রাজি হলেন। গঙ্গার ধারে একটি হোটেলে দু'জনের সাক্ষাত হলো। হোসেন আলী আমাদের পক্ষে আসতে রাজি হলেন। ইতোমধ্যে বিশ্বে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য লন্ডনে ফোন করি। লন্ডনের গেনজেজ হোটেলের মালিক তসদ্দুক আহমদ আমার পুরাতন বন্ধু। এককালে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ফোন নাম্বার পেলাম। বিচারপতি চৌধুরী যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ থেকেই লন্ডনে ছিলেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
বিচারপতি চৌধুরীর মাধ্যমে লন্ডনের তৎকালীন কাউন্টি কাউন্সিলের সদস্য এলভারস্যান, শ্রমিক নেতা ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ডোনাল্ড আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয় সূত্রেই বন্ধুত্ব। ডোনাল্ড ও অন্যদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করার আবেদন জানাই। লন্ডনে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ডোনাল্ডের যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। সে সময় রকিব সাহেব সিলেট থেকে কলকাতা আসেন। তিনি লন্ডন যাবেন। তার কাছে আবু সাঈদ চৌধুরীকে একটা চিঠি দিলাম। চিঠিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে মত গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে আহ্বান জানাই। চৌধুরীর সঙ্গে আমার ফোনেও যোগাযোগ হলো।
১৮/১৯ তারিখের দিকে ওয়াশিংটন থেকে হারুন অর রশীদ এলেন। তিনি বিশ্বব্যাংকে চাকরি করেন। তার কাছে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালীদের মনোভাব জানতে পারলাম। ওয়াশিংটনে এএমএ মুহিত ও অন্যদের সহযোগিতায় তারা একটা গ্রুপ গঠন করেছেন। তিনি তাদের পক্ষে সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। দিল্লী থেকে কলকাতা ফিরে আমরা খবর পেয়েছিলাম প্রফেসর নূরুল ইসলাম কলকাতায় আছেন। ৪৫ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের পরদিন (১৮ এপ্রিল) স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আরও একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন সকাল বেলা কলকাতা পাক মিশনের হোসেন আলীসহ মিশনে প্রায় সব কর্মকর্তা বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। সার্কাস এভিনিউতে অবস্থিত পাক দূতাবাস এতদিন ধরে যেখানে পাকিস্তানের পাতকা উড়ত, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হলো। এই ঘটনায় দেশে বিদেশে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দূতাবাসে সেদিন জনতার ঢল নামে। বিভিন্ন সংগঠন মিছিল করে সার্কাস এভিনিউতে এসে হোসেন আলীকে স্বাগত সম্ভাষণ জানায়। ফুলের মালায় মিশনের প্রাঙ্গণ ভরে যায়।
বাংলাদেশ সরকারের প থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্ব প্রথম আমাকে প্রেরণ করেন হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। হোসেন আলীর স্ত্রী, দুই কন্যা এবং এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো। তারা সবাই স্বাধীনতাযুদ্ধে শরিক হলেন। হোসেন আলীর স্ত্রী খুবই সাহসী মহিলা এ ব্যাপারে স্বামীকে তিনি প্রচ- সাহস যুগিয়েছেন। বিদেশী বেতারের সঙ্গে বাংলাদেশের পাক দস্যুদের অত্যাচারের করুণ কাহিনী তিনি বর্ণনা করেন। কান্নাজড়িত তার এই বক্তব্য কলকাতা বেতারে প্রচারিত হয়। এই মহিলার হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য যারা শুনেছেন তারাই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।
১৮ এপ্রিলের পূর্ব রাত বেগম হোসেন আলী ও তার এক মেয়ে মিলে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি করেন। আমি থাকতে সেখানে বহু লোক এল হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। বেশিণ সেখানে আমি অবস্থান করিনি। বহু গণ্যমান্য লোককেও আসতে দেখলাম। বাংলাদেশের বহু লোক পাক বাহিনীর অত্যাচারে কলকাতায় শরণার্থী হয়েছে। তাদের জন্য সাহায্য প্রয়োজন। ১৯ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ মিশনে কাপড়, অর্থ ইত্যাদি সাহায্য আসতে থাকে। হোসেন আলী আগেই পাক মিশনের অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে রেখেছিলেন। এই অর্থে মিশন পরিচালনা করা হবে।
পাক মিশনের একজন মাত্র কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য পোষণ করেননি। তিনি তার বাসায় রয়ে গেলেন। মিশনে আসেন না। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে তার বাসায় গেলাম। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। ১৯৬৪ সাল, তখন মোনায়েম খানের রাজত্ব। এই ভদ্রলোক সে সময় পাবনার পুলিশ সুপার ছিলেন। তার নাম আর আই চৌধুরী। সরকারবিরোধী এক মিছিল করায় পাবনায় সে সময় বহু লোককে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের দলের নেতা মনসুর আলী তখন জেলে। আমি ও নাইমুদ্দিন পাবনা গিয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করি এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ করি। জেলে আমাদের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার পর আদালতে তাদের জামিনের আবেদন করি। ১৯ এপ্রিল থেকেই বাংলাদেশের মিশনের একটি ভবনে তিন তলায় আমি অফিস করছি। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন তৈরি করা। কয়েকজন টাইপিস্ট আমার সঙ্গে রাত দিন কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর ১০ এপ্রিল ও ১৭ এপ্রিলের বক্তৃতা বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতে হবে। স্বীকৃতির আবেদনপত্রসহ বক্তৃতার বহু কপি তৈরি করা হলো।
(সমাপ্ত)
লেখক : আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2010-04-18&ni=15132
ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সপ েসমর্থন দিয়েছেন। এদের মধ্য সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। আমি তার লেখা কিছু নিবন্ধ পড়েছি বলে মনে হলো। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর ঠিকানা জেনে নিলাম। টেলিফোনে তাকে যোগাযোগ করি। বললাম তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন। বালিগঞ্জে তার বাসা। আমার পরিচয়, 'রহমত আলী' নামে। সুব্রত রায় চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে তাকে আমার প্রণীত ঘোষণাপত্রর খসড়াটি দেখালাম। খসড়াটি দেখে তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। এই খসড়া আমি করেছি কি-না জিজ্ঞাসা করলেন। আমি হঁযা সূচক জবাব দেই। তিনি বলেন, একটা কমা বা সেমিকোলন বদলাবার কোন প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার তা মানবাধিকারের একটা অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখবেন। এই ঘোষণাপত্রের একটি কপি তাকে দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন। এরপর আইন ব্যবসা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরম্ন করেন। তার রচিত বইটির নাম হচ্ছে 'জেনেসিস অব বাংলাদেশ' আন্তর্জাতিকভাবে অধ্যয়নের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন তা পড়ানো হচ্ছে। এটা ছিল সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাকে বড় ভাইয়ের মতো সময়ে অসময়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। আমার জন্য তার দুয়ার সর্বদাই ছিল খোলা।
এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক প্রয়োজন। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য এক সেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোন পোশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে, দর্জি ডেকে তার জন্য পোশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার ছিল আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল আমরা দু'জনে কলকাতা প্রেসকাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প থেকে দু'জন প্রতিনিধি বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসকাব লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সার্চ লাইটের অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবদ্ধ। কাবের সেক্রেটারি উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের প্রথম অনুরোধ জানাই আমাদের উপস্থিতির কথা গোপন রাখতে হবে। এরপর বললাম, আমরা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা নিয়ে এসেছি।
সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাক ডাকা ভোরে এই প্রেসকাবে হাজির হতে অনুরোধ জানাই। বললাম, তখন তাদের আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেয়া হবে। তাদের কেউ কেউ আরও কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। আমরা কোন উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করি। এতে তারা কেউ কেউ হতাশও হন। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম। আওয়ামী লীগের এমপি এমএলএ এবং নেতাদের খবর পাঠিয়ে দেই রাত ১২টার মধ্যে লর্ড সিনহা রোডে সমবেত হওয়ার জন্য। বিএসএফের চট্টপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসকাবে সাংবাদিকদের বহন করার জন্য। অবশিষ্ট ৫০টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছানো হবে। রাত ১২টা থেকে নেতাদের আমি গাড়িতে তুলে দেই। বলে দেয়া হলো, কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না। সকালবেলা আমরা একত্রিত হবো। গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন। সাইকোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলো গুছিয়ে নিলাম। হাতে লেখা কিছু সংশোধনী রয়েছে। কয়েক জনকে এগুলো সংশোধন করার জন্য দেই।
১৭ এপ্রিল জাতীয় ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন। সারারাত ঘুম হয়নি। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান এবং ওসমানী একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নান ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচী অনুযায়ী কলকাতা প্রেসকাবে যাই। সেই ভোরেও কাবে লোক ধরেনি। কাবের বাইরেও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমি সাংবাদিকদের ল্ক্ষ্য করে বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করবেন। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি, আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলো তখন প্রেসকাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাদের অনেকের কাঁধে ক্যামেরা। ৫০/৬০টা গাড়িযোগে রওনা হলাম গন্তব্য স্থানের দিকে। আমি ও আবদুল মান্না দু'জনই দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক ছিলেন। পথে তাদের সঙ্গে অনেক কথা হলো।
শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌঁছতে ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তওফিক এলাহী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন। এদিকে পাক হানাদার বাহিনীর চাপের মুখে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটতে হয়েছে। সম্মুখ সমরে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নির্দেশ সত্ত্বেও দেশ মাতৃকার মুক্তিপাগল যোদ্ধারা বাঙ্কার ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না। মাহবুব ও তওফিক তাদের সৈন্যসহ পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়েছিলেন। তারা সুকৌশলে পিছু হটে আসেন। মনোবল ঠিক রেখে পশ্চাদপসরণ করা একটা কঠিন কাজ। কান্ত শ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার থেকে উঠে আসে। ওদের চোখে মুখে বিশ্বাসের দীপ্তি বিদ্যমান ছিল।
কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলো। একটি ছোট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী আবদুল মান্নান ও আমি। আবদুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানের নাম 'মুজিবনগর' নামকরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী।
সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তার সঙ্গে আমাদের চিন্তার (বিস্তর) যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাক বাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি তা অস্বীকার করে তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিনি দেশের ভেতর থেকে যুদ্ধের নেতৃত্বে দিচ্ছেন তখন হানাদাররা বলে বসবে তিনি বন্দী আছেন। আম বাগানের অনুষ্ঠানে ভর দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পাশ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়।
কলকাতার বাসায় ফিরে তাজউদ্দীন ভাইকে জিজ্ঞাসা করি কলকাতায় পাকিস্তান মিশনের হোসেন আলীকে আমাদের পক্ষে আনা যায় কি না। ফরিদপুরের আত্মীয় শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে হোসেন আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। হোসেন আলী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে রাজি হলেন। গঙ্গার ধারে একটি হোটেলে দু'জনের সাক্ষাত হলো। হোসেন আলী আমাদের পক্ষে আসতে রাজি হলেন। ইতোমধ্যে বিশ্বে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য লন্ডনে ফোন করি। লন্ডনের গেনজেজ হোটেলের মালিক তসদ্দুক আহমদ আমার পুরাতন বন্ধু। এককালে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ফোন নাম্বার পেলাম। বিচারপতি চৌধুরী যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ থেকেই লন্ডনে ছিলেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
বিচারপতি চৌধুরীর মাধ্যমে লন্ডনের তৎকালীন কাউন্টি কাউন্সিলের সদস্য এলভারস্যান, শ্রমিক নেতা ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ডোনাল্ড আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয় সূত্রেই বন্ধুত্ব। ডোনাল্ড ও অন্যদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করার আবেদন জানাই। লন্ডনে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ডোনাল্ডের যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। সে সময় রকিব সাহেব সিলেট থেকে কলকাতা আসেন। তিনি লন্ডন যাবেন। তার কাছে আবু সাঈদ চৌধুরীকে একটা চিঠি দিলাম। চিঠিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে মত গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাকে আহ্বান জানাই। চৌধুরীর সঙ্গে আমার ফোনেও যোগাযোগ হলো।
১৮/১৯ তারিখের দিকে ওয়াশিংটন থেকে হারুন অর রশীদ এলেন। তিনি বিশ্বব্যাংকে চাকরি করেন। তার কাছে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালীদের মনোভাব জানতে পারলাম। ওয়াশিংটনে এএমএ মুহিত ও অন্যদের সহযোগিতায় তারা একটা গ্রুপ গঠন করেছেন। তিনি তাদের পক্ষে সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। দিল্লী থেকে কলকাতা ফিরে আমরা খবর পেয়েছিলাম প্রফেসর নূরুল ইসলাম কলকাতায় আছেন। ৪৫ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের পরদিন (১৮ এপ্রিল) স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আরও একটি স্মরণীয় দিন। এই দিন সকাল বেলা কলকাতা পাক মিশনের হোসেন আলীসহ মিশনে প্রায় সব কর্মকর্তা বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। সার্কাস এভিনিউতে অবস্থিত পাক দূতাবাস এতদিন ধরে যেখানে পাকিস্তানের পাতকা উড়ত, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হলো। এই ঘটনায় দেশে বিদেশে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দূতাবাসে সেদিন জনতার ঢল নামে। বিভিন্ন সংগঠন মিছিল করে সার্কাস এভিনিউতে এসে হোসেন আলীকে স্বাগত সম্ভাষণ জানায়। ফুলের মালায় মিশনের প্রাঙ্গণ ভরে যায়।
বাংলাদেশ সরকারের প থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্ব প্রথম আমাকে প্রেরণ করেন হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। হোসেন আলীর স্ত্রী, দুই কন্যা এবং এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো। তারা সবাই স্বাধীনতাযুদ্ধে শরিক হলেন। হোসেন আলীর স্ত্রী খুবই সাহসী মহিলা এ ব্যাপারে স্বামীকে তিনি প্রচ- সাহস যুগিয়েছেন। বিদেশী বেতারের সঙ্গে বাংলাদেশের পাক দস্যুদের অত্যাচারের করুণ কাহিনী তিনি বর্ণনা করেন। কান্নাজড়িত তার এই বক্তব্য কলকাতা বেতারে প্রচারিত হয়। এই মহিলার হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য যারা শুনেছেন তারাই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন।
১৮ এপ্রিলের পূর্ব রাত বেগম হোসেন আলী ও তার এক মেয়ে মিলে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি করেন। আমি থাকতে সেখানে বহু লোক এল হোসেন আলীকে অভিনন্দন জানাতে। বেশিণ সেখানে আমি অবস্থান করিনি। বহু গণ্যমান্য লোককেও আসতে দেখলাম। বাংলাদেশের বহু লোক পাক বাহিনীর অত্যাচারে কলকাতায় শরণার্থী হয়েছে। তাদের জন্য সাহায্য প্রয়োজন। ১৯ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ মিশনে কাপড়, অর্থ ইত্যাদি সাহায্য আসতে থাকে। হোসেন আলী আগেই পাক মিশনের অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে রেখেছিলেন। এই অর্থে মিশন পরিচালনা করা হবে।
পাক মিশনের একজন মাত্র কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য পোষণ করেননি। তিনি তার বাসায় রয়ে গেলেন। মিশনে আসেন না। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে তার বাসায় গেলাম। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। ১৯৬৪ সাল, তখন মোনায়েম খানের রাজত্ব। এই ভদ্রলোক সে সময় পাবনার পুলিশ সুপার ছিলেন। তার নাম আর আই চৌধুরী। সরকারবিরোধী এক মিছিল করায় পাবনায় সে সময় বহু লোককে গ্রেফতার করা হয়। আমাদের দলের নেতা মনসুর আলী তখন জেলে। আমি ও নাইমুদ্দিন পাবনা গিয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করি এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশ করি। জেলে আমাদের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার পর আদালতে তাদের জামিনের আবেদন করি। ১৯ এপ্রিল থেকেই বাংলাদেশের মিশনের একটি ভবনে তিন তলায় আমি অফিস করছি। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন তৈরি করা। কয়েকজন টাইপিস্ট আমার সঙ্গে রাত দিন কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর ১০ এপ্রিল ও ১৭ এপ্রিলের বক্তৃতা বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতে হবে। স্বীকৃতির আবেদনপত্রসহ বক্তৃতার বহু কপি তৈরি করা হলো।
(সমাপ্ত)
লেখক : আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2010-04-18&ni=15132
No comments:
Post a Comment