Wednesday, April 14, 2010

রণাঙ্গনের চিঠি

রণাঙ্গনের চিঠি

কোড়ইগাছি, ইয়ুথ ক্যাম্প,
পলাশী, নদীয়া, ভারত
তাংÑ ২৬-৫-১৯৭১ ইং

বাবা,
আমার সালাম নেবেন। মাকে আমার সালাম দেবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন, যাতে আমি মুক্তিযোদ্ধার সামরিক ও গেরিলা ট্রেনিং শেষ করে বীর যোদ্ধার বেশে দেশে প্রবেশ করে দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন করতে পারি। বাবা, তোমাকে ও মাকে না জানিয়ে গত ১২-৪-১৯৭১ ইং তারিখে আমদহের ওমর ও গাজীপুরের মারফতকে সঙ্গে নিয়ে ঝাউদিয়ার বাজারে আসি। পকেটে ছিল মাত্র কুড়িটি টাকা, একটি ভাঙ্গা ছাতা, একটি পুরনো শার্ট, ছেঁড়া গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া এবং একটি লুঙ্গি! মারফত একটু ভীত ও সিদ্ধান্তহীন ছেলে। সে ঝাউদিয়ার বাজার হতে রাজাকার ও পাক সেনাদের ভয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হতে বিরত হলো।
আমি ও ওমর দৃঢ় শপথ ঈমানি বলে বলীয়ান হয়ে যাত্রা শুরু করলাম। তুমি তো জানো বাবা এ বছর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়ে মাঠ-ঘাট, রাস্তা, ফসল ডুবে আছে। তারপর আমাদের বাড়িতে এখন অতিরিক্ত শরণার্থীর চাপ। ভেড়ামারার সাবান মামা, তার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু চার মেয়ের জনক ঢাকার বিজয়নগরের জাহাঙ্গীর সাহেবের পুরা পরিবার, আফতাব মামা, তাদের বংশের অন্যান্য নিকটাত্মীয়সহ প্রায় একশত জন, বাড়াদীর সাত্তার মামা ও অন্যান্যসহ পঞ্চাশজন একুনে দেড়শত জনের নিকটাত্মীয় শরণার্থীর পদভারে আমাদের বাড়ি এখন কানায়-কানায় পূর্ণ।
গ্রামের চারদিকে শুধু পানি আর পানি, নেই শোবার জায়গা, নেই রান্নার জায়গা, নাই পায়খানার স্থান। গোয়াল ঘরের দক্ষিণের বেড়া দিয়ে গেরা পচা পুকুর সংলগ্ন বট, শিমুল, কাঁঠাল, জাম, লেবু, সিম ও লাউয়ের বান আর দাতছোলা ও আকন্দে ভরা জঙ্গলরূপ জায়গাটিই ছিল অর্ধেক মেয়ে শরণার্থীদের নিরাপদ পায়খানাস্থল। বিশাল পাঁচ পুকুরের পাইডিলে ছিল বটগাছটির অসংখ্য শিকড়ের সমাহার আর মেয়ে শরণার্থীরা এই শিকড়গুলোর ওপর বসে পায়খানার কাজটি বেশ আরামের সহিত সম্পন্ন করতেন।
জানো বাবা, বর্ষা, ফসলহানি, আর্থিক মন্দা, সারাদেশে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারি ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার, খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের বাড়িতে আশ্রিত সকল শরণার্থী এক বেলাও পেট পুরে খেতে পারছে না। নাই কর্ম, নাই খাদ্য, নাই খড়ি, নাই বাসস্থান, তাঁবু আর টিনের ছাপরা করে আমাদের বাড়ির পাশের পায়ে হাঁটা একমাত্র রাস্তাঘাটও দখল হয়ে গেছে। আল্লাহর আশরাফুল মাখলুকাতের ভয়াবহ মানবিক এই বিপর্যয় মৌলিক অধিকার হরণ, দেশ ও ভিটা ছাড়া নিকটাত্মীয় শরণার্থীদের এই রূপ কষ্ট দেখে আমার মন বিদ্রোহী হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাবার পথ সুগম করল। আমার ভেতর প্রতিশোধের আগুন আরো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল, যখন শুনলাম ভেড়ামারার পিয়ার উদ্দিন ও সাবান উদ্দিন মামার টিনের বসতঘরে পেট্রোল ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই ভস্ম করে দিয়েছে। সাবান মামার এ্যালুমিনিয়ামের তৈরি হাঁড়ি পাতিলের বিরাট দোকান ছিল ভেড়ামারার বাবর আলি মার্কেটে। সে দোকানটাও জ্বালিয়ে দিয়েছে ভেড়ামারার পিস্ কমিটির ও রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীÑ বিহারি সম্প্রদায় ও পাক সেনাবাহিনীর সহায়তায়। সাবান মামার দশ সদস্যের পরিবার এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব সর্বস্বান্ত। সব হারিয়ে এখন সে নির্বাক, নিশ্চুপ। তার সব হারানোর বেদনায় আমার অন্তরাত্মা আরো বিদ্রোহী হয়ে উঠল এবং মুক্তিযুদ্ধে যাবার ক্ষেত্র প্রশস্ত করল।
জানো বাবা, ঝাউদিয়ার বাজার হতে বন্ধু মারফত, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে আমাদের ত্যাগ করে যখন বাড়িতে চলে গেল তখন আমি ও ওমর দুর্জয় সাহস নিয়া এগুতে শুরু করলাম। হাসানপুর থেকে শুরু হলো সাঁতারের প্রতিযোগিতা। ধানপাটের মাঠগুলো নদী হয়ে গেছে। পরনে জাঙ্গিয়া, ছাতার মধ্যে শার্ট, গেঞ্জি, স্যান্ডেল ও লুঙ্গি ঢুকায়ে এক হাত দিয়ে ছাতা উঁচু করে ধরে ও অপর হাত ও দুপা দিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। কোথাও বুক পানি, আবার কোথাও গভীর পানি।
দৌলতপুরে পাক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প আছে। তাই আমরা কোথাও সাঁতার আবার কোথাও বুক পানি মাড়িয়ে নারায়ণপুর, বাড়া গাংদিয়া, গোয়ালগ্রাম, শেয়ালা, বেতবাড়িয়া ও বাংলাদেশের পশ্চিমের শেষ সীমান্ত গ্রাম কাজীপুর পার হয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে গভীর ও প্রচ- খরস্রোতা হাইলি নদী যা ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে, সেই প্রমত্তাকে সাতরিয়ে পার হতে গিয়ে স্রোত ও ঢেউয়ের তা-বে পড়ে এক সময় হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। সন্ধ্যায় শিকারপুর ক্যাম্পে এসে ক্যাম্প ইনচার্জ আজিজুর রহমান আক্কাসের কাছে নাম লিখালাম। পরের চিঠিতে বিস্তারিত জানাব। মাকে আমার সালাম দেবেন।
ইতি তোমার মুক্তিযোদ্ধা সন্তান
রহিম
কোড়ইগাছি, ভারত


খোদা ভরসা

কোড়ইগাছি ইয়ুথ ক্যাম্প
পলাশী, নদীয়া, ভারত
০২-০৬-১৯৭১ ইং
বাবা,
গত ২৬-৫-১৯৭১ তারিখের চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার তীব্র বাসনায় কি দুরন্ত সাহস, দৃঢ় মনোবল, আত্মবিশ্বাস, ভয়ভীতিকে তুচ্ছজ্ঞান করে পানিতে ভরপুর মাঠঘাট, নদ-নদী, খালÑবিল, হাওর, বাওড়, দীঘি-নালার গভীর-অগভীর পানি, অসংখ্য নদীর প্রচ- স্রোতের প্রবাহকে দলিত মথিত করে, সাঁতারের পর সাঁতার দিয়ে অত্যন্ত ক্লান্ত শরীরে প্রায় চল্লিশ মাইল পথ পানি আর কাদা মাড়িয়ে যখন শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা অস্থায়ী ক্যাম্পে পৌঁছলাম তখন পশ্চিমের লাল সূর্য বিদায় নিয়ে গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে দিয়েছে।
ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থানার রাজা মিয়া ও তার সহযোগী এবং খাদ্যের দায়িত্বে ছিলেন ভেড়ামারার (মাঈন) মাংগন সাহেব। লাইনে দাঁড়িয়ে নাম ঠিকানা লেখানোর সময় পরিচয় হলো ভেড়ামারার আব্দুর রাজ্জাক, রাশেদ আজগর, আবু দাউদ, জয়নদ্দিন বিলাস, উজির, ইউনুছ, বাবলু, গোলাম মোস্তফা, লাল, আবু ইউনুছ, হান্নানসহ অনেকের সঙ্গে। নাম লেখানো সম্পন্ন হওয়ার পর নির্দিষ্ট তাঁবুতে জায়গা দিল। পেটে প্রচ- ক্ষুধা এক সময় বহু আকাক্সিক্ষত এক বাটি খিচুড়ি পেলাম ও খেয়ে কিছুটা ক্ষুধা নিবৃত্ত হলো। এরপর বিশ্রাম এবং কখন যে রাতটুকু ফাঁকি দিয়ে বিদায় নিয়েছে তা টের পাইনি। সহযোদ্ধা ইউনুছ ছিল অত্যন্ত বিড়িখোর। ভারতের টেন্ডুপাতার বিড়ি ছিল অত্যন্ত প্রিয় ও সহজলভ্য। এক সময় ইউনুছের তীব্র কাশির আওয়াজে ঘুম ভাঙল এবং দেখি পূর্ব দিগন্তের ‘রক্তিম’ সূর্যের মিষ্টি আলোয় তাঁবু ভরে গেছে। হাত মুখ ধুয়ে হালকা নাস্তার পর সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে আজিজুর রহমান আক্কাস সাহেব (পরবর্তীতে এমপি, দৌলতপুর থানা) সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন এবং বললেন হয় স্বাধীনতা নয়ত দেশের জন্য শহীদ, এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হলো। তিনি বললেন, আপনাদের আমি বেশি কিছু দিতে পারব না। মাথা পিছু আট আনা পয়সা নিয়ে আপনারা এখান থেকে পলাশীর পাশে কোড়ইগাছি ইয়ুথ ক্যাম্পে রওনা দেবেন।
প্রায় দুইশ জন মুক্তিসেনা সকাল দশটার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। দুপুরে করিমপুর বাজারে উপস্থিত হলাম। বাজারের কেন্দ্রস্থল ও রাস্তার পাশে এক বিশাল সিনেমা হল। প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম। ভারতের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবি চলছিল। করিমপুরে একটু বিশ্রাম ও শুকনা রুটি খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। ভাবলাম শিকারপুর থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত প্রায় ৬০-৭০ মাইল রাস্তায় নিয়মিত বাস চলাচল করছে। তারপরেও আমাদের হেঁটে যাওয়া কেন। পরে জানলাম এটা এক ধরনের রোড মার্চ; যা সৈনিক জীবনে কঠিন দৃঢ়তা সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
প্রায় কুড়ি মাইল রাস্তা অতিক্রমের পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো এবং পায়ের পাতা ফুলে গেল। সময় হাঁটছি, সময় বসছি, ব্যথায় সারা শরীর জরাজীর্ণ, ক্ষুদায় পেটে আগুন জ্বলছে। বাবা-মার আদরের ছোট ছেলে, ক্ষুধা ও কষ্ট কি বুঝিনি। আমি যেন চলৎহীন, শক্তিহীন অসাড় হয়ে যাচ্ছি। এক সময় শ্রদ্ধেয় জলিল ভাই সাহস দিয়ে বলল, রহিম, এই তো সামনে বেতাই। আর একটু কষ্ট কর। আমার কৈশোরের যুদ্ধে যাবার প্রথম কষ্ট এবং আল্লাহ্র কাছে সাহায্য কামনা করছি। রাত আনুমানিক আটটার দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চারটি ট্রাক (কনভয়) খালি অবস্থায় কৃষ্ণনগরে যাচ্ছিল। আমরা নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলাম এবং উনারা দয়া পরবশ হয়ে বেতাই পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হলেন। আমরা যার যার মতো গাড়িতে উঠে পড়লাম এবং প্রায় দশ মাইল রাস্তা গাড়িতে এসে রাত নয়টার দিকে বেতায় বাজারে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে আবার উত্তরের দিকে হাঁটা শুরু। হাঁটতে হাঁটতে আরো আট মাইল যাবার পর রাত এগারোটার দিকে কোড়ইগাছি ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছলাম।
আমাদের জন্য সংরক্ষিত তাঁবুতে জায়গা দিল। নির্দিষ্ট মাপের এক বাটি খিচুড়ি পেলাম। এই খেয়ে কি জীবন চলে? আমাদের আগে এখানে আরো আটশত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বিহারের উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছে। এক সুবিশাল আম বাগান। চারদিকে ছোট ছোট খাল, বিল, খানা-খন্দক। বর্ষায় চারদিকে পানিতে টৈটম্বুর, স্যাঁতসেতে ভিজা আমবাগান। এক হাজার মুক্তিসেনার পদভারে কোড়ইগাছির আম বাগান লোকে লোকারণ্য। নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, নেই স্যানিটেশনের ব্যবস্থা, নেই বিদ্যুৎ, নেই খাবারের ও খড়ির ব্যবস্থা। সকালের নাস্তা নিজের খরচে করতে হতো। ভিজা খড়ি দিয়ে এক হাজার যোদ্ধার খিচুড়ি রান্না করতে বিকাল চারটা বেজে যেত। খাবার সম্পন্ন হতো সন্ধ্যা ছয়টায়। সারাদিন উপোস থেকে এক বাটি খিচুড়ি তাও আবার একবার। মনটা খুব খারাপ লাগত। আর কত কষ্ট সইব?
ইংরেজদের তিনশত বছর আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের পঁচিশ বছরের পরাধীনতা ভাঙতে গিয়ে কত জীবন গেল, মা-বোনের ইজ্জত গেল, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল, ধন-সম্পদ লুণ্ঠিত হলো; হায়েনাদের নিষ্ঠুর ছোবলে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে আজ পরবাসী, শরণার্থী। স্বাধীনতা এত কষ্টের জিনিস! তার পরেও চাই স্বাধীনতা। এর সাধ কেমন তা দেখতে বড়ই ইচ্ছে করছে।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও এক বোঝা নীতির বিরুদ্ধেই আমাদের এই সংগ্রাম। শাসন আর শোষণ দিয়ে মানুষকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যায় না। যাক বাবা, তুমি পত্র পাওয়ার পর পরই আমার বাড়ির বিশ্বস্ত কিষান মসলেমের হাত দিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিও। এক বেলার এক বাটি খিচুড়ি খেয়ে তো জীবনের ক্ষুধা নিবৃত্ত হয় না। মাকে আমার সালাম দিও। আমার জন্য দোয়া করিও। ইতি তোমার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেÑ
রহিম
কোড়ইগাছি, ভারত


আল্লাহ্ মহান

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রণাঙ্গন থেকে
ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া
তাং- ১১-১২-১৯৭১
‘বেবী’
অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা নাই, যেন এক যুগ। তোমরা শরণার্থী হয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেশ কিছু দিন ছিলে। সেই সময়ই তোমার সঙ্গে হয় আমার গভীর প্রেমের সম্পর্ক। আমি তখন আঠারো বছরের দুরন্ত যুবক আর তুমি ছিলে অপূর্ব এক বারো বছরের চঞ্চলা হরিণী। একদিন দুপুরের নির্জন মুহূর্তে আমাদের গোয়াল ঘরের বেড়ার ওতে তোমার আমার অভিসার, দেখা-দেখি, চোখা-চোখি, আর ভালোবাসার কথার মাঝে আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলো নিয়ে ফুটাতে লাগলে আর বললে, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি! তোমাকে ছাড়া বাঁচব না!’ আমি তোমায় বলেছিলাম, ‘আমার এখন যৌবনকাল, যুদ্ধে যাবার এখনই উপযুক্ত সময় আমার।’ তুমি অপেক্ষায় থেক। দেশ স্বাধীন করে মুক্ত ও বীরবেশে তোমায় বিয়ে করে গড়ব সুখের সংসার।
জানো, গত ২৬-১১-৭১ তারিখে শেরপুরের যুদ্ধে আমি অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। পাক সেনা আর রাজাকারদের সঙ্গে আমাদের চতুর্থমুখী প্রচ- আক্রমণে তারা বেশিরভাগই মারা পড়েন। এক গুলিবিদ্ধ পাকসেনা মারাত্মক আহত হয়ে অত্যাধুনিক চাইনিজ এলএমজি হাতে মরার ভান করে পড়ে ছিল। আমার পাশ থেকে যুদ্ধের ক্রলিং অবস্থান থেকে শেরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা হবিবর এক হাতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও অন্য হাতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘জয় বাংলা’ বলে লাফিয়ে উঠে। অমনি ওঁৎ পেতে মরার ভান করা পাক সেনা তার অস্ত্র দিয়ে ব্রাশ মেরে হবিবরের বুকটা ঝাঁজরা করে দিল!! মুহূর্তের মধ্যে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল! আমরা তখন ব্রাশ মেরে ওই পাক সেনাকে খতম করে স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উড়ালাম ঠিকই কিন্তু চির জীবনের জন্য হারালাম এক সংগ্রামী, তেজদীপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হবিবরকে। ওখানে আমিও আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে উঠতে গিয়েই হঠাৎ থেমে গেলাম। হয়ত তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধব বলেই মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করেনি সেদিন।
বেবী! তোমার পিত্রালয় থেকে মাত্র ৪/৫ কিলোমিটার দূরে এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজের রণাঙ্গনে অবস্থান করছি এখন। এই রণাঙ্গনটা বড়ই কঠিন জায়গা। একদিকে প্রমত্তা পদ্মা, অপরদিকে সুউচ্চ রেললাইন আর অপরদিকে আমাদের অবস্থান। এই কঠিন অবস্থানের যুদ্ধে যদি বেঁচে থাকি তাহলে অচিরেই তোমার সঙ্গে হবে আমার বিয়ে। এরপর আমার যে অনাগত সন্তান আসবে তাকে তুমি আমি উভয়ে মিলে শুনাব আমার এই সফল রণাঙ্গনের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জীবনকথা। আগামীকাল ১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রোজ শনিবার যুদ্ধের জন্য আমরা ষোলো-দাগ ও উত্তরের গোলাপনগর প্রান্তে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছি। চারদিকে নীরব নিস্তব্ধতা। যেন জনমানবশূন্য এক বিভীষিকাময় জনপথ। কমান্ডার রাশিদুল আলম ও শহিদুল ইসলামের নির্দেশে আমরা এখন শত্রুর অবস্থানের দিকে অতি সতর্কতার সহিত এগুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। আজকের যুদ্ধের পর হার্ডিঞ্জ ব্রিজের যুদ্ধের বিস্তারিত ঘটনা পরবর্তী চিঠিতে জানাব বলে আশা করছি। বেবী! তোমাকে এক নজর দেখতে মনটা বড়ই আগ্রহী। জানি না এ আশা পূর্ণ হবে কিনা। আজ এ পর্যন্তই।
ইতি তোমার মনের যোদ্ধা
মোঃ আব্দুর রহিম


আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রণাঙ্গন থেকে
ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া
তাং- ১৬-১২-১৯৭১

প্রিয়তমা বেবী,
গত ১০-১২-১৯৭১ তারিখে হার্ডিঞ্জ সেতুর পশ্চিমের ভেড়ামারা অংশ, যা বারোদাগ, ষোলোদাগ, মুন্সীপাড়া, বাহিরচর, মসলেমপুর, পাম্প হাউস, পাওয়ার হাউস ইত্যাদি নামে খ্যাত। এলাকার খ- খ- যুদ্ধের ঘটনা ও অন্যান্য কিছু বর্ণনা দিয়ে লেখা চিঠিটা পেয়ে পড়ে কি ভাবছ আমাকে নিয়ে তা জানি না। জানো, দশই ডিসেম্বরের হার্ডিঞ্জ সেতুর যুদ্ধ ছিল বড়ই কঠিন। আমরা পাক সেনাদের উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে অবিরাম গোলাবর্ষণ, শেল, গ্রেনেট আর ব্রাশ ফায়ার করতে করতে পূর্বের প্রমত্তা পদ্মার পাড়ের পাক সেনা ক্যাম্পের দিকে অতি সতর্কতার সহিত এগুচ্ছি। আমাদের ত্রিমুখী আক্রমণে অনেকেই মারা পড়ল আর বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। তাদের পরাস্তের শেষ মুহূর্তে আমাদের এক সহযোদ্ধা জসীম ভাই জনৈক পাকসেনার গুলিতে শহীদ হলেন। এমনি এক বেদনা ও বিষাদময় পরিবেশে বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমান দিয়ে শক্তিশালী বোমের দ্বারা ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ সেতুর পাকশী অংশের তিন নম্বর গার্ডারটি ভেঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র পথটি রুদ্ধ করে দিল।
থাক, যুদ্ধের কাহিনী। এবার শোন আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। কুষ্টিয়া সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার বিহারি ওলি মোহাম্মদ, স্ত্রী, দুই ছেলে ও একমাত্র ষোড়শী সুন্দরী মেয়ে জুলেখা খাতুনকে নিয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু দিয়ে হেঁটে পাকশীতে পালিয়ে যাচ্ছে। তার স্ত্রী, দুই ছেলেকে নিয়ে যখন পাকশী অংশের তিন নম্বর গার্ডারের মাঝখানে, ঠিক তখনই শক্তিশালী পতিত বোমার প্রচ- বিস্ফোরণে তাদের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়ে প্রমত্তা পদ্মার অথৈ পানিতে সলিল সমাধি হলো। ম্যানেজার ওলি মোহাম্মদ ও তার মেয়ে জুলেখা খাতুন বোম্বিংয়ের সময় দুই নম্বর গার্ডারে থাকায় তারা বেঁচে গেল। ওলি পাকশীর পাক সেনা ক্যাম্পে আটক হলো আর তার সুন্দরী মেয়ে জুলেখা খাতুন নওদাপাড়ার শামছুদ্দিন মেম্বারের নৌকায় আশ্রয় নিয়ে তার মাধ্যমে ভেড়ামারা অংশে এল। পূর্ব নওদাপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুদ্দিন বিলাশ এই অবাঙালি সুন্দরী জুলেখাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাদের সহায়তায় ও তাদের উভয়ের সম্মতিতে বিজয়ের ঐ আনন্দ-বেদনার মাঝে বিয়ের কাজটি সম্পন্ন করে ফেলল। জানো বেবী, জুলেখার ঐ মুহূর্তটিতে তার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এ যেন চাঁদের মাঝে এক ফোটা কলঙ্ক। সেই মায়াবী মুখটার মাঝে যেমন আছে প্রাপ্তি, ঠিক তেমনি আছে প্রিয়জন হারানোর বেদনা। তাও আবার মা, দুই ভাইকে! তার বাবার ভাগ্যে কি ঘটেছে সে জানে না। সে উর্দু ও ইংরেজিতে বাকপটু। জানো বেবী, আমি জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আজ বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসের এই আনন্দ উল্লাসের মাঝে তুমি সব হারানোর পরও যেটুকু পেলে তাতে তোমার প্রতিক্রিয়া কি? উত্তরে, তার চাঁদের মতো স্বচ্ছ মুখে হাসি আর বেদনায় এক বিখ্যাত ব্রিটিশ কবির চারটি লাইন পাঠ করে শোনাল। বলল,
ঐধাব ুড়ঁ বাবৎ নববহ ষড়হবষু,
ঐধাব ুড়ঁ বাবৎ নববহ নষঁব!
ঐধাব ুড়ঁ বাবৎ ষড়াবফ ংড়সবড়হব,
অং সঁপয ধং ও ষড়াব ুড়ঁ!

(কখনো কি তুমি হয়েছ একা,
হয়েছ কি কখনো বেদনায় নীল!
এতটা ভালো বেসেছো কি কাউকে,
তোমাতে আমি যতটা হয়েছি লীন !!)
বেদনাবিধুর পরিবেশে যখন সহযোদ্ধা বন্ধুর বউকে নিয়ে আনন্দ করছি, ঠিক তখনই চোখে পড়ল ব্রিটিশের তৈরি বাংলাদেশের ঐতিহ্যম-িত বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ সেতুর ভগ্নদশা! মনে মনে বললাম, কি প্রয়োজন ছিল মূল্যবান সম্পদটি ঠিক বিজয়ের মুহূর্তে ভাঙার? জানো, ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর পেলাম, ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনী প্রধান জেনারেল নিয়াজী মিত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া চলছে। স্বাধীনতাপাগল জনতা, মিত্রবাহিনী ও আমরা ধীরে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় মিছিল নিয়ে এখন ভেড়ামারা শহরে আনন্দ উল্লাস করছি। হাজারো চেনা-অচেনা মুখের মাঝে আমার এ বিরহী মন শুধুই খুঁজে বেড়াচ্ছে বিলাশের বউয়ের মতো আরেকটি চাঁদমাখা মুখকে। সে কে জানো? সে একমাত্র তুমি!!
নয় মাসের রণাঙ্গনের এই লড়াকু সৈনিক আজ পরম প্রাপ্তি ‘স্বাধীনতার’ বিজয়ের দিনে বড়ই ক্লান্ত! তবে আমি সেই দিনই হবো শান্ত, যেদিন তোমাকে একান্ত আপন করে কাছে পাব। আজ এই পর্যন্তই। ইতি, তোমার মুক্তিযোদ্ধা মানুষটিÑ
মোঃ আব্দুর রহিম


আল্লাহ্ সহায়

শেরপুরের রণাঙ্গন থেকে
তাং- ২৫-১১-১৯৭১
দৌলতপুর, কুষ্টিয়া।

মা,

আজ থেকে সাত মাস আগে তোমাকে না বলে ভারতে গিয়েছিলাম মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিতে। পশ্চিমবঙ্গের শিকারপুর কোড়ইগাছির মুক্তিযোদ্ধা অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে বীরভূমের রামপুরহাট সেনানিবাসে এক মাসের সামরিক ও গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে গত ২-৭-৭১ তারিখে শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আট নম্বর সেক্টরের সহঅধিনায়ক মেজর এমএ মঞ্জুর আমাদের (৩০) ত্রিশ সদস্যের প্লাটুনের সকল মুক্তিযোদ্ধাকে কোরআনের উপর হাত রেখে শপথবাক্য পাঠ করিয়ে আমার নামে একটি এসএমজি ও ৩০০ রাউন্ড গুলি, তিনটি ম্যাগাজিন, কিছু গ্রেনেড ও যুদ্ধের বিভিন্ন ধরনের সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিল।
মা! ৩-৭-৭১ তারিখে কাজীপুরের যুদ্ধে তোমার দোয়ার বরকতে আমি অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। পাকসেনা আর রাজাকারদের নিঃশেষ ও পরাস্ত করে এখন আমি কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার শেরপুরের সহযোদ্ধা আজিজুলের বাড়িতে অবস্থান করছি।
মা! আমি তোমার একমাত্র আদরের সন্তান, তুমি আমাকে কখনো শাসন করনি, আমি ছিলাম স্বাধীনচেতা। পাকিস্তানিদের শাসন, শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার দীপ্ত শপথ নিয়েই আমি এখন শেরপুরের রণাঙ্গনে অবস্থান করছি।
মা, আজ ১৯৭১-এর নবেম্বরের ২৫ তারিখ। আগামীকাল ২৬-১১-১৯৭১ তারিখে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধের প্রস্তুতির ফাঁকে এই চিঠি লিখছি। মা! এই নবেম্বরে চরম শীত পড়ছে। এখন তো রস পিঠার সময়। তোমার হাতের খেজুরের রস পিঠা, আর কালাইয়ের রুটি ও ঢলঢলে হ্যাদানা (খিচুড়ি) ও ইলিশের মাথা ভাজা খেতে বড়ই ইচ্ছে করছে! কতদিন খাইনি, তোমার হাতের রান্না, আর কতদিন দেখিনি তোমার পবিত্র মুখটি! তোমার মন ও শরীর ভালো তো মা? মা! আমার সহযোদ্ধা আমাদের দেলু চাচার হাতে এই চিঠিটা দিলাম। তুমি আমার জন্য দোয়া করিও যাতে আগামীকালের যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারি। আমি যদি শেরপুরের যুদ্ধে বেঁচে থাকি তাহলে পরের দিনই ভেড়ামারার সাতবাড়িয়াতে অবস্থান নেব। ভেড়ামারার পাম্প হাউসের জিকে ক্যানেলের উপর নির্মিত এক নম্বর ব্রিজটি শক্তিশালী বোমা দিয়ে উড়িয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পাকসেনা ক্যাম্পে হানা দিয়ে তাদেরকে পরাস্ত করে বিজয়ের বেশেই তোমার কাছে ফিরব ইনশাল্লাহ্! মা, যুদ্ধের ঘটনাসমূহ বিস্তারিতভাবে পরের চিঠিতে জানাব। মা, তুমি ভালো থেকো, তোমার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায় তোমার মুক্তিযোদ্ধা ছেলেÑ
মোঃ আব্দুর রহিম


খোদা ভরসা

২৮ নবেম্বর, ১৯৭১ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রণাঙ্গন থেকে


মা,

আমার প্লাটুনের সহমুক্তিযোদ্ধা আমদহের দেলু চাচা গত রাতে অতি গোপনে তোমার সঙ্গে দেখা করে আমার অবস্থান ও শারীরিক-মানসিক খবরাখবর জানিয়ে এসেছে। গত ২৬-১১-৭১ তারিখে দুপুরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের শেরপুরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে ভয়াবহ, রক্তক্ষয়ী ও মরণপণ যুদ্ধের খবর শুনে তুমি নাকি চরম অসুস্থ হয়ে গেছ? উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা কাটছে না। না কাটাই স্বাভাবিক; কারণ দশজন পাকসেনা, কুড়িজন রাজাকার, আর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হবিবরসহ মোট একত্রিশ জনের মৃত্যু এক আতঙ্কেরই ব্যাপার! একটি যুদ্ধে এত প্রাণহানি খুব কমই হয়েছে। হয়ত ভাবছ, তোমার ছেলের কি পরিণতি হলো? হ্যাঁ মা, তোমাকে সব খুলে বলছি।
শেরপুরের যুদ্ধ শেষ করে ঐদিনই আমাদের রওনা দিতে হলো হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ভেড়ামারা পাড়ের পাক সেনা ক্যাম্পটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য। রেকি চলছে, পাকসেনা ও রাজাকার মিলে মোট কতজন সদস্য হবে তা নিশ্চিত হওয়ার পর পরিকল্পনা, আক্রমণের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে মতবিনিময় চলছে। জগন্নাথপুর, পিয়ারপুর ও ঝাউদিয়ার কিছু ছেলে রাজাকারে নাম লিখিয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছে। এরা নাকি আমার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। আমাকে পেলে মেরে ফেলবে? আমার সৎভাই ঘেদু ও লুৎফর, এরা নাকি রাজাকারদের সঙ্গে খুব মেলামেশা করছে? বাবার বিশাল সম্পত্তির মালিক তারা দু’ভাই হবে; যদি আমাকে রাজাকার দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে? তুমি তো বল, ‘আমার একটি জান।’
হ্যাঁ মা, অল্পদিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবে।
যাক মা, ২৬ তারিখের শেরপুরের যুদ্ধে পাকসেনারা এক ধরনের অগ্নি বোমা আমাদের ওপর প্রয়োগ করেছিল। জ্বলতে জ্বলতে এসে বাংকারে আমার উপরেই পড়ে। আমার হাত, বুক, ঘাড় ও মুখম-ল ঝলসে গেছে। ভেড়ামারার সিদ্দিক ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে এক সহযোদ্ধার বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করছি। ডান হাতটা একটু বেশি পুড়েছে। তবে অন্যান্য অংশ প্রায় শুকিয়ে গেছে। মা! যুদ্ধের ময়দান যে কত ভয়ঙ্কর, কত বিভীষিকাময়, কত দুর্গম, কত প্রতিকূল তা তোমাকে লিখে জানাতে পারব না।
প্লাটুন কমান্ডার জলিল ভাইয়ের নির্দেশে আমরা ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ২৫ নবেম্বর রাতেই শেরপুর গ্রামের একটু দূরে মাঠের মধ্যে অবস্থান নিয়ে বাংকার খুঁড়তে লাগলাম। আমাদের তো হেলমেট নাই। তাছাড়া পাক সেনাদের চাইনিজ রাইফেলের ব্রাশ ফায়ারের কাছে টেকা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। একমাত্র বাংকারই আমাদের শেষ ভরসা। রাত একটায় বাংকারের কাজ শেষ করে খুব ক্ষুধা লেগে গেল। শেরপুরের সহযোদ্ধা আজিজুল বাড়ি থেকে চিড়া, মুড়ি ও খেজুরের পাটালি গুড় নিয়ে এলো। সঙ্গে কয়েক গামলা পান্তা ভাত। খেয়ে শরীরটাকে বাংকারের মধ্যেই একটু জিরায়ে নিলাম। ভোরে একটু মুড়ি-পানি খেয়ে কঠোর অবস্থানে থেকে পাক সেনাদের জন্য অপেক্ষার পালা।
বেলা ১১টায় ১০ জন পাক সেনা ও ৬০ জন রাজাকার পিয়ারপুরের ভেতর দিয়ে শেরপুরে প্রবেশ করেই ৩/৪টি বাড়িতে আগুন ও লুটতরাজ শুরু করল। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত অবস্থান। আমাদের বাংকার থেকেই প্রথম ফায়ার দিলাম। পাক সেনারা অত্যাধুনিক চাইনিজ মেশিনগানের সাহায্যে আমাদের বাংকার লক্ষ্য করে ব্রাশ করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জানো মা, পাঞ্জাবি ও বেলুচরা আসলেই সাহসী! তারা খাড়া হয়ে গুলি করতে করতে আমাদের দিকে আসতে লাগল। আমরাও একটা একটা করে পাখির মতো মারতে লাগলাম। রাজাকাররা কুড়িজন মরল বাকি ৪০ জন ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেল। জনগণ কোদাল, খোন্তা, রড, ধারাল অস্ত্রের দ্বারা অনেককে কুপিয়ে মারল। পাক সেনারা নয়জন মারা গেল এবং একজন মরার ভান করে পড়েছিল। আমার বামে সহযোদ্ধা আজিজুল এবং ডানে ছিল শেরপুরের সহযোদ্ধা হবিবর। হবিবর বাংকার ছেড়ে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘জয় বাংলা’ বলে লাফিয়ে উঠল। আজিজুলকে বাংকার ছাড়তে নিষেধ করলাম। সে না শুনে বাংকার ত্যাগ করল। এমনি সময়ে একটি অগ্নি বোমা এসে আমার বাংকার পতিত হলো। আমি অগ্নিদগ্ধ হলাম। এমনি মুহূর্তে মৃত্যুর ভান করে পড়ে থাকা পাক সেনার মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁজরা করে দিল হবিবরের বুকটা আর আজিজুল হলো মারাত্মকভাবে আহত। আমার থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের একটি গুলি দিয়ে ওই পাক সেনাকে খতম করলাম। বাংকার ছেড়ে ক্রলিং করতে করতে হবিবরের কাছে গেলাম। দেখলাম, তার বুক থেকে ঝর ঝর করে রক্ত ঝরেই যাচ্ছে। প্রাণটা বেরিয়ে গেছে একটু আগেই। দেহটা নিথর, নিস্তব্ধ!
আজিজুলের হাতে পায়ে গুলি লেগে জবাই করা মুরগির মতো ছটফট করছে। জনগণ উল্লাস করতে করতে এগিয়ে এলো। আজিজুলকে মহিষের গাড়িতে করে দৌলতপুর হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা শেষে এক বাড়িতে রাখলাম। তখনো দৌলতপুর শত্রুমুক্ত পরিপূর্ণভাবে হয়নি। আমিও দৌলতপুরে প্রাথমিক চিকিৎসা অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে ঝাড়-জঙ্গলে থাকতে লাগলাম। এ গাছ ও গাছ, ঝোপ-ঝাড়, খাল-খন্দে কাটে আমাদের রাত। মা, আমার বোমে ঝলসে যাওয়া ডান হাতটায় চামড়া ও মাংসসহ বেশ গর্ত হয়ে পুড়ে গেছে। আমার ব্যথার সাথী, সহযোদ্ধা জলিল কমান্ডার দুবলা ঘাসের সবুজ ঠগা তার মুখের মধ্যে চিবিয়ে নিয়ে নরম করে আমার হাতে লাগিয়ে কলার পাতা দিয়ে জড়িয়ে কলা গাছের শক্ত সুতো দিয়ে বেঁধে দিল। জায়গায় জায়গায় ফোসকা পড়েছে। গত রাতটা খুব যন্ত্রণায় গেছে মা! পোড়ার যন্ত্রণা যে এত অসহনীয় তা জানতাম না। যন্ত্রণা নাশক, ব্যথানাশক, ঘা শুকানো ওষুধ ও একটি টিটেনাসের ইনজেকশন নিয়েছি সিদ্দিক ডাক্তারের নিকট হতে। শরীরের পোড়া অংশ হতে কষানি ঝরছে। নাই গজ, ব্যান্ডেজ, নাই তুলা-স্যাভলন। কলার পাতায় শুয়ে এখন আমার বিনিদ্র রজনী কাটছে। দৌলতপুর হাসপাতাল এখনো শত্রুমুক্ত হয়নি। তাই সেখানে থাকাও নিরাপদ মনে করছি না। প্লাটুন কমান্ডার জলিল ভাই আমাকে চিকিৎসার জন্য ছুটি দিতে চাচ্ছে।
ভাবলাম, কয়দিন তোমার কাছে থেকে আসি, তাতে শারীরিক, মানসিক সকল কষ্টই দূর হবে। কিন্তু ঘরে যে আছে বিভীষণ; তারা আমাকে বাঁচতে দেবে না মা! তুমি তো জানো মা, নবাব সিরাজকে মেরেছিল শুধুমাত্র ক্ষমতা আর সম্পদের কারণে এবং সবচেয়ে নিকটাত্মীয়দের দ্বারাই এই জঘন্য কাজটি দুশো বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। বাংলার শাসন ক্ষমতা চলে গেল ইংরেজদের হাতে। মীরজাফর, মীর মদন আর ঘসেটি বেগমদের ষড়যন্ত্রের কারণে। তারা নবাব সিরাজকে মারল এবং নিজেরাও মরল। লাভ হলো কি? তাই শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি চেন অব কমান্ডের আওতার বাইরে যেতে চাচ্ছি না। আমার শুভাকাক্সক্ষী খুব কম, শত্রু এত বেশি যে, বাধ্য হয়েই আফ্রিকার জঙ্গলের ‘গেরিলা’ হয়ে গেছি। যারা বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান, তারাই শুধু বুঝবে আমার যন্ত্রণার কথা। বাবার প্রথম পক্ষের সন্তানরা ভাবে যে, বাবার বিষয়-সম্পদ, জমিজমা, সোনা-দানা, দলিল-দস্তাবেজÑ সব কিছুর মালিক শুধু তারাই! ‘বাবা পাগলামি করে মাঝ বয়সে বিয়ে করে এক জঞ্জাল তৈরি করল; তাও আবার মুক্তিযোদ্ধা!’ এই নুতু (লুৎফর) দৌলতপুরের নূরু রাজাকারকে বলে, আয়, যাতে এই শালাকে মারতে তারা দলবল নিয়ে রেডি থাকে। শালা, শেরপুরের যুদ্ধে নাকি আহত হয়েছে। হবিবর মুক্তিযোদ্ধা না মরে ঐ শালা মরলে সব ল্যাঠা চুকে যেত। বাবার দুশো বিঘা সম্পত্তির মালিক হব শুধু আমরা দু’ভাই। নুতু, চোখ-কান খোলা রাখছি শালা, ভেড়ামারার আশপাশেই আছে। যে কোনো মুহূর্তে ও তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসবে এবং এলেই নুরু রাজাকারকে দিয়ে শালাকে ধরিয়ে কচুকাটা করতে হবে।
মা, আমার সৎ ভাইদের এই সকল ষড়যন্ত্রের কথা তুমি গোপনে সহমুক্তিযোদ্ধা আমদহের দেলু (দেলোয়ার) চাচার কাছে বলে ভালোই করেছ। আমি তো দু-এক দিনের মধ্যেই তোমার কাছে যাবার এবং কিছুদিন বিশ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু ঘেদু, নুতু সৎ ভাই হলেও বাপ তো এক। তারা আমাকে মেরে দুনিয়ার বুক থেকে চির বিদায় দিয়ে বাবার বিশাল সম্পত্তির একক দাবিদার হবার স্বপ্নে বিভোর। মা, আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পশ্চিম পাড়ের ভেড়ামারা অংশের পাক সেনা ক্যাম্পটি নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে দেদীপ্যমান। বিভিন্ন উৎস থেকে জানলাম, ইন্দিরা গান্ধী নাকি কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। আমরা মিত্র বাহিনীর সহায়তা পেলেই দেশ খুব তাড়াতাড়ি শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন হবে। মা, ৭/৮ মাস শুধু ঝাড়-জঙ্গলে কাটালাম।
পাক বাহিনী ও রাজাকারদের মেরুদ- ও আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে। মা, গোয়ালগাঁও ও কাজীপুর সীমান্ত যুদ্ধের পর যখন মরিনি তখন শেরপুরের যুদ্ধের ঝলসানো শরীরেও আমি মরছি না। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের যুদ্ধই হবে হয়ত শেষ যুদ্ধ। মা, আজ দু’তিন দিন ধরে আমরা খেমিড়দিয়াড়, ষোলোদাগ, বারদাগ হয়ে মুন্সিপাড়ায় তফেজ হাজীর বাড়িতে অবস্থান নিয়েছি। গোলাপনগর ও মসলেমপুরে দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা আছে। একই সঙ্গে আমরা ত্রিমুখী আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। মা, আর লিখতে পারছি না। ঝলসানো ডান হাতে ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের যুদ্ধে যদি বাঁচতে পারি তবে আর ঘেদু, নুতুরা মারতে পারবে না।
দেশ স্বাধীন করব, আরো লেখাপড়া শিখে ভালো একটি চাকরি করব। মা, আমার শরীরের যন্ত্রণা আর মনের কষ্টকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে শেষ যুদ্ধটির সফল সমাপ্তির প্রতীক্ষায় আছি।
মা, আমার জন্য দোয়া করবা, বাবাকে আমার সালাম দিও। চিঠিটা দেলু চাচার হাতে দিলাম। গোপনে পড়বা। তোমার মঙ্গল কামনায়, তোমার রণাঙ্গনের যোদ্ধা সন্তানÑ
রহিম
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রণাঙ্গন থেকে

http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=3328

No comments: