মুজিবনগর সরকার ও কিছু স্মৃতি
এম. আমীর-উল ইসলাম
১০ এপ্রিল। বিমানে আমাদের আগরতলা রওনা হওয়ার কথা। তাজউদ্দীন ভাই, মনসুর ভাই, শেখ মণি, তোফায়েল আহমদ ও আমি লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দরে যাই। অন্যান্যের মধ্যে মি. নগেন্দ্র সিং আমাদের সঙ্গী হলেন। বিমানটি খুবই ছোট এতে বসার মতো ৫/৬টি আসন ছিল। খুব নিচু দিয়ে বিমান উড়ে যাচ্ছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৈরি অব্যবহৃত বিমানবন্দরগুলোর কয়েকটিতে আমরা নামি। এগুলো বাংলাদেশ সীমানত্মের খুব কাছাকাছি। ছোট ছোট বিমানবন্দরগুলো বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছাকাছি। একটি বিমানবন্দরে আমরা দুপুরের খাবার খাই।
উত্তরবঙ্গ তথা রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনা অঞ্চলের কোন নেতা খুঁজে পাওয়া গেল না। এদের বেশিরভাগ কলকাতা এসে গেছেন। কিছুণ পর আমরা বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামি। সেখান থেকে জিপে করে শিলিগুড়ি যাই। শহর থেকে অনেক ভেতরে সীমান্তের খুব কাছাকাছি একটি বাংলোতে উঠলাম। গোলক মজুমদার এখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এখানে কোন একটি জঙ্গল থেকে গোপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারিত হবে। এ সময় তোফায়েল আহমদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মণি বলে, তোফায়েল আহমদের কলকাতা যাওয়া দরকার। শেখ মণি কিছু নির্দেশসহ তোফায়েল আহমদকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন।
মনসুর ভাইয়ের জ্বর এসে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন। আমি তার পাশে বসে আছি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি মত দিলেন তাজউদ্দীন ভাই প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোন আপত্তি করবেন না। এরপর মনসুর ভাই বা কামরুজ্জামান ভাই প্রধানমন্ত্রীর পদের ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন তোলেননি। পাঁচজন নেতার মধ্যে তিনজনের সঙ্গে আলাপের পর আমার খুব বিশ্বাস হয়েছিল যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে কোন আপত্তি করবেন না। তাছাড়া তাকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বাকি রইল খন্দকার মোশতাক আহমদ। শুধু তিনি আপত্তি করতে পারেন। তবুও চারজন এক থাকলে খন্দকার মোশতাককে রাজি করানো যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রথম বক্তৃতা প্রচার করার পালা। তাজউদ্দীন ভাই প্রচারের জন্য চোখে অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করার বক্তৃতার ক্যাসেট গোলক মজুমদারের কাছে দেয়া হলো। শেখ মণি তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে চাইলেন। আমি বাইরের ঘরে বিএসএফের আঞ্চলিক কর্মকর্তার সঙ্গে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা ও শত্রুদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করলাম। শেখ মণির সঙ্গে কথাবার্তা শেষে তাজউদ্দীন ভাই আমাকে ডাকেন। তিনি জানান, শেখ মণি এখন সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজি নন। আগরতলা গিয়ে দলীয় এমপি, এমএল ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে শেখ মণি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। আর এটা না করা হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আমি সরকার গঠনের পক্ষে পুনরায় যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে বিলম্ব হলে সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তো নতুন কিছু নয়। মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান ভাই তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের তখনও দেখা নেই। তাঁরা কোথায়, কি অবস্থায় আছেন, সে খবর এখনও আসেনি। ইতোমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সরকার গঠনে বিলম্ব হলে তাও নস্যাৎ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভারত সরকারকে আমরা আশ্বাস দিয়েছি। তাতে বিলম্ব হলে আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহ পোষণ করবেন। আমাদের মধ্যে যে কোন্দল রয়েছে কোন অবস্থাতেই তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া উচিত নয়। ভারত সরকারও জানেন, আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচারিত হবে। আমার এসব কথা শেখ মণি মানতে রাজি নন। বেশি করে বোঝাতে চাইলে শেখ মণি জানান, তাঁরা বঙ্গবন্ধু থেকে মতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারও প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। এ সময় তাজউদ্দীন ভাই আমাকে বলেন, আমি যেন গোলাম মজুমদারকে জানিয়ে দেই যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা আজ প্রচার করা হবে না। এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাকে যথাসময়ে জানানো হবে।
গোলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে আজ বক্তৃতা প্রচার করা হবে না। এ কথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিলম্ব করা ঠিক হবে? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব কিছু ঠিকঠাক সে মুহূর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে, তা আমরা ভেবে দেখছি কি-না। ইতোমধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌঁছে গেছে।
আমি গোলক মজুমদারকে বললাম, ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলাম। এই দিন ছিল ১০ এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দীন ভাই ও শেখ মণি আছেন। রাত তখন সাড়ে ৯টা। সেই আকাঙ্ৰিত মুহূর্ত এল। প্রথমে আমার কণ্ঠ ভেসে এল। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হলো। সারা বিশ্ববাসী শুনল স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল।
বক্তৃতা প্রচারিত হলো। আমাদের তিনজনের কারও মুখে কোন কথা নেই। আমি শুধু বললাম, গোলক মজুমদার শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা প্রচার বন্ধ করতে পারেননি। মনসুর ভাই খেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা শুনতে পাননি। পরে একক সিদ্ধান্তে বক্তৃতা প্রচারের জন্য তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে মা ও শাস্তি প্রার্থনা করি। তিনি বলেছিলেন, সে সময় আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। সেদিন বক্তৃতা প্রচার না করলে গোলমাল আরও বৃদ্ধি পেত বৈকি।
শেখ মণি তাজউদ্দীন ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি আগরতলা গিয়ে সব প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আগরতলা গিয়ে শেখ মণি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কসবাতে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে চলে যান।
তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারের পর অনেক রাতে কর্নেল (অব.) নুরুজ্জামান (সেক্টর কমান্ডার) ও আবদুর রউফ (রংপুর) আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সেক্টর রয়েছে। একটা সেক্টরের দায়িত্বে রয়েছেন কর্নেল জামান। তারা জানান, গেরিলা কায়দায় আকস্মিক হামলায় শত্রুদের পর্যুদন্তু করা হচ্ছে।
পরদিন ১১ এপ্রিল নাসত্মা করে আমরা বিমানে উঠি আগে রাতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর থেকেই শেখ মণি চুপচাপ রয়েছেন। বক্তৃতার কথা শুনে মনসুর ভাই উৎফুল্লু। রাতের বিশ্রামের পর মনসুর ভাই কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছেন। যুদ্ধের শেষ পর্যনত্ম মনসুর ভাই অবিশ্রান্ত কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কের অবসান হওয়ায় মনসুর ভাই যেন বেশি খুশি।
খুব নিচু দিয়ে আমাদের বিমান উড়ছে। দু'দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ছোট ছোট বিমানবন্দরে আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরম্নল ইসলামকে বিশেষভাবে খোঁজ করার জন্য ময়মনসিংহ সীমান্তে আমরা খবর দিয়ে রেখেছিলাম। সৈয়দ নজরুলকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটি স্থানে গিয়ে প্রথমে শুনলাম, নেতৃস্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে বিএসএফের স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নিচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। একথা শুনে আমরা 'ইউরেকা' বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে তাঁরা দু'জন এলেন। নজরুল ভাই জিপ থেকে প্রথমে নামেন। আমার সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে জানলাম ২৫ মার্চের পর থেকে মান্নান সাহেব খুব কষ্টে দিনকাল কাটিয়েছেন। পাক বাহিনীর ভয়ে তিনি দু'দিন পায়খানায় পালিয়ে ছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে সড়ক পথে হেঁটে ময়মনসিংহ এসেছেন। তিনি একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই ও তার ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে তাজউদ্দীন ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী তাকে অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোবারকবাদ জানান। এই দৃশ্য দেখে আমরা সবাই উৎফুল্ল হই। আমরা আবার বিমানে উঠি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল আগরতলা। আমরা বিমানে আসন গ্রহণ করি। সামনের আসনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর ভাই। নজরুল ভাই বিমানে বসে ঢাকা থেকে পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি ডা. আলীম চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। তিনি ছিলেন নজরুল ভাইয়ের আত্মীয়। সেই বাসা থেকে পরচুলা ও মেয়েদের কাপড় পরিধান করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মনসুর ভাই একথা নিয়ে এমনভাবে ঠাট্টা করলেন যে বিমানে কেউ না হেসে থাকতে পারলেন না। আমাদের আগরতলা পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ইতোমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা এসে পৌঁছেছেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো। তার চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো গোঁফ তিনি কেটে ফেলেছেন। প্রথমে তাকে চিনতেই পারছিলাম না। আমার নিজেরও দাড়ি কেটে ফেলেছি। দু'জনেই দু'জনকে ডেকে হাসি ঠাট্টা করলাম। আগের রাতে খন্দকার মোশতাক এসেছেন। ড. টি. হোসেন ঢাকা থেকে তাকে নিয়ে এসেছেন। এম আর সিদ্দিকী কয়েকদিন আগে আগরতলা এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সিলেট থেকে আবদুস সামাদও এসে গেছেন। তাছাড়া সেখানে তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলী চাষী ছিলেন।
আগরতলা সার্কিট হাউসের পুরোটা আমাদের দখলে। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং ভিন্ন একটি ঘরে অবস্থান করছেন। ওসমানী যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরি করে ফেলেন। আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিসত্মানের সামরিক বাহিনীকে সম্মুখযুদ্ধে আমাদের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব ভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজ সরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন। রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। খন্দকার মোশতাক খুবই মনক্ষুন্ন। নাটকীয়ভাবে তিনি বললেন, আমরা যেন তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেই। আর মৃত্যুকালে তার লাশ যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মোশতাক ড. টি হোসেনের মধ্যে তাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। দু'জনেই এক জেলার লোক। পারিবারিক পর্যায়েও তাদের সম্পর্ক খবুই মধুর। তিনিই তাকে নিয়ে এসেছেন আগরতলায়। ড. টি হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। সিনিয়র হিসেবে এই পদ তারই প্রাপ্য বলে তিনি জানান। সারারাত শলাপরামর্শ হলো। অনিদ্রা ও দীর্ঘ আলোচনায় আমি খুবই ক্লান্ত অনুভব করি। এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হলেন। তবে একটা শর্ত হলো, তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। তাজউদ্দীন ভাই আমাকে একথা জানান। সবাই এতে রাজি হলেন। কেননা, একটা সমঝোতার জন্য এই ব্যবস্থাটা একেবারে খারাপ নয়। অবশেষে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিষয়টির সুরাহা হলো। একজন হেসে খবর দিলেন, তিনি যোগদানে রাজি হয়েছেন। উপস্থিত সবাই এক বাক্যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। সবাই জহুর ভাইকে মোনাজাত করতে অনুরোধ করলেন। তিনি কয়েকদিন পূর্বে পবিত্র হজব্রত পালন করে এসেছেন। তার মাথায় তখনও মক্কা শরিফের টুপি। তিনি আধা ঘণ্টা ধরে আবেগ প্রবণভাবে মোনাজাত পরিচালনা করেন। তার মোনাজাতে বঙ্গবন্ধুর কথা, পাক দস্যুদের অত্যাচার, স্বজন হারানো, দেশবাসীসহ শরণার্থীদের কথা এল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেকের চোখে পানি এসে গেল। এই মোনাজাতের মাধ্যমে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। তাজউদ্দীন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বৈঠকে সবগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়। এ দিকে ওসমানী ও নগেন্দ্র সিংয়ের বৈঠকে যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। বৈঠকের পর এক পর্যায়ে আমি অংশ নেই। এর আগে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লী কলকাতাসহ দেশের বাইরে ভেতরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়েছে। সবক'টিতে আমি গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। যুদ্ধের ব্যাপ্তি, প্রকৃতি, সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝার চেষ্টা করি। ১৩ এপ্রিল ছোট বিমানে কলকাতা ফিরে গেলাম। মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও আবদুস সামাদ আজাদ ও কর্নেল ওসমানী কলকাতা আসেন। অন্যরা রয়ে গেলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার ব্যাপারে আমরা ২টি প্রবেশপথ ঠিক করি। এর একটি হচ্ছে আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লোকজনের জন্য প্রবেশ পথ করা হয় কলকাতা। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য ডাউকি, ময়মনসিংহের জন্য তোরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভূরম্নঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকি-এরকম বেশ কয়টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবেশ পথ ঠিক করা হয়।
মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো। এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সঙ্গে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, গোলক মজুমদার এবং বিএসএফের চট্টপাধ্যায় জানতেন। ইতোমধ্যে দ্রুত কতগুলো কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।
অনুষ্ঠানের কর্মসূচী নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী প্রথম যে ভাষণ দেন, তার কপি ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় করা হয়েছিল। ইংরেজী কপি বিদেশী সাংবাদিকদের দেয়া হয়। সবচেয়ে বড় কাজ হলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা। আমি আর তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকতাম সে ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে লেখার কাজ করি। আমার কাছে কোন বই নেই, নেই অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোন কপি।
আমেরিকার ইন্ডিপেনডেন্স বিল অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। সেই অরিজিনাল দলিল চোখের সামনে ভাসছে। আর সেই বড় বড় হাতের স্বারগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছুই মনে নেই। তবে বেশি কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম না। শুধু মনে করলাম। কি কি প্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার রয়েছে। এমনি চিন্তা করে ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া তৈরি করলাম। স্বাধীনতার ঘোষণার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়া হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন। আমি বললাম, আমরা সবার এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ। এই দলিলের খসড়াটি কোন একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভাল হতো। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে কাকে আর পাবেন। যদি সম্ভব হয় কাউকে দেখিয়ে নিন।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
লেখক : আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2010-04-17&ni=15006
উত্তরবঙ্গ তথা রাজশাহী, বগুড়া ও পাবনা অঞ্চলের কোন নেতা খুঁজে পাওয়া গেল না। এদের বেশিরভাগ কলকাতা এসে গেছেন। কিছুণ পর আমরা বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামি। সেখান থেকে জিপে করে শিলিগুড়ি যাই। শহর থেকে অনেক ভেতরে সীমান্তের খুব কাছাকাছি একটি বাংলোতে উঠলাম। গোলক মজুমদার এখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এখানে কোন একটি জঙ্গল থেকে গোপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারিত হবে। এ সময় তোফায়েল আহমদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মণি বলে, তোফায়েল আহমদের কলকাতা যাওয়া দরকার। শেখ মণি কিছু নির্দেশসহ তোফায়েল আহমদকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন।
মনসুর ভাইয়ের জ্বর এসে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন। আমি তার পাশে বসে আছি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি মত দিলেন তাজউদ্দীন ভাই প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোন আপত্তি করবেন না। এরপর মনসুর ভাই বা কামরুজ্জামান ভাই প্রধানমন্ত্রীর পদের ব্যাপারে আর কোন প্রশ্ন তোলেননি। পাঁচজন নেতার মধ্যে তিনজনের সঙ্গে আলাপের পর আমার খুব বিশ্বাস হয়েছিল যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে কোন আপত্তি করবেন না। তাছাড়া তাকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বাকি রইল খন্দকার মোশতাক আহমদ। শুধু তিনি আপত্তি করতে পারেন। তবুও চারজন এক থাকলে খন্দকার মোশতাককে রাজি করানো যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রথম বক্তৃতা প্রচার করার পালা। তাজউদ্দীন ভাই প্রচারের জন্য চোখে অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করার বক্তৃতার ক্যাসেট গোলক মজুমদারের কাছে দেয়া হলো। শেখ মণি তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে চাইলেন। আমি বাইরের ঘরে বিএসএফের আঞ্চলিক কর্মকর্তার সঙ্গে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা ও শত্রুদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করলাম। শেখ মণির সঙ্গে কথাবার্তা শেষে তাজউদ্দীন ভাই আমাকে ডাকেন। তিনি জানান, শেখ মণি এখন সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজি নন। আগরতলা গিয়ে দলীয় এমপি, এমএল ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে শেখ মণি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। আর এটা না করা হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আমি সরকার গঠনের পক্ষে পুনরায় যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে বিলম্ব হলে সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তো নতুন কিছু নয়। মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান ভাই তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের তখনও দেখা নেই। তাঁরা কোথায়, কি অবস্থায় আছেন, সে খবর এখনও আসেনি। ইতোমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সরকার গঠনে বিলম্ব হলে তাও নস্যাৎ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভারত সরকারকে আমরা আশ্বাস দিয়েছি। তাতে বিলম্ব হলে আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহ পোষণ করবেন। আমাদের মধ্যে যে কোন্দল রয়েছে কোন অবস্থাতেই তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া উচিত নয়। ভারত সরকারও জানেন, আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচারিত হবে। আমার এসব কথা শেখ মণি মানতে রাজি নন। বেশি করে বোঝাতে চাইলে শেখ মণি জানান, তাঁরা বঙ্গবন্ধু থেকে মতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারও প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। এ সময় তাজউদ্দীন ভাই আমাকে বলেন, আমি যেন গোলাম মজুমদারকে জানিয়ে দেই যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা আজ প্রচার করা হবে না। এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাকে যথাসময়ে জানানো হবে।
গোলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে আজ বক্তৃতা প্রচার করা হবে না। এ কথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, বিলম্ব করা ঠিক হবে? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব কিছু ঠিকঠাক সে মুহূর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে, তা আমরা ভেবে দেখছি কি-না। ইতোমধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌঁছে গেছে।
আমি গোলক মজুমদারকে বললাম, ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলাম। এই দিন ছিল ১০ এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দীন ভাই ও শেখ মণি আছেন। রাত তখন সাড়ে ৯টা। সেই আকাঙ্ৰিত মুহূর্ত এল। প্রথমে আমার কণ্ঠ ভেসে এল। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হলো। সারা বিশ্ববাসী শুনল স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল।
বক্তৃতা প্রচারিত হলো। আমাদের তিনজনের কারও মুখে কোন কথা নেই। আমি শুধু বললাম, গোলক মজুমদার শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা প্রচার বন্ধ করতে পারেননি। মনসুর ভাই খেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা শুনতে পাননি। পরে একক সিদ্ধান্তে বক্তৃতা প্রচারের জন্য তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে মা ও শাস্তি প্রার্থনা করি। তিনি বলেছিলেন, সে সময় আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। সেদিন বক্তৃতা প্রচার না করলে গোলমাল আরও বৃদ্ধি পেত বৈকি।
শেখ মণি তাজউদ্দীন ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি আগরতলা গিয়ে সব প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আগরতলা গিয়ে শেখ মণি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কসবাতে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে চলে যান।
তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারের পর অনেক রাতে কর্নেল (অব.) নুরুজ্জামান (সেক্টর কমান্ডার) ও আবদুর রউফ (রংপুর) আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে আলোচনা করি। উত্তরবঙ্গে কয়েকটি সেক্টর রয়েছে। একটা সেক্টরের দায়িত্বে রয়েছেন কর্নেল জামান। তারা জানান, গেরিলা কায়দায় আকস্মিক হামলায় শত্রুদের পর্যুদন্তু করা হচ্ছে।
পরদিন ১১ এপ্রিল নাসত্মা করে আমরা বিমানে উঠি আগে রাতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর থেকেই শেখ মণি চুপচাপ রয়েছেন। বক্তৃতার কথা শুনে মনসুর ভাই উৎফুল্লু। রাতের বিশ্রামের পর মনসুর ভাই কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছেন। যুদ্ধের শেষ পর্যনত্ম মনসুর ভাই অবিশ্রান্ত কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কের অবসান হওয়ায় মনসুর ভাই যেন বেশি খুশি।
খুব নিচু দিয়ে আমাদের বিমান উড়ছে। দু'দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ছোট ছোট বিমানবন্দরে আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরম্নল ইসলামকে বিশেষভাবে খোঁজ করার জন্য ময়মনসিংহ সীমান্তে আমরা খবর দিয়ে রেখেছিলাম। সৈয়দ নজরুলকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটি স্থানে গিয়ে প্রথমে শুনলাম, নেতৃস্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে বিএসএফের স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নিচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। একথা শুনে আমরা 'ইউরেকা' বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে তাঁরা দু'জন এলেন। নজরুল ভাই জিপ থেকে প্রথমে নামেন। আমার সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে জানলাম ২৫ মার্চের পর থেকে মান্নান সাহেব খুব কষ্টে দিনকাল কাটিয়েছেন। পাক বাহিনীর ভয়ে তিনি দু'দিন পায়খানায় পালিয়ে ছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে সড়ক পথে হেঁটে ময়মনসিংহ এসেছেন। তিনি একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই ও তার ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে তাজউদ্দীন ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী তাকে অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোবারকবাদ জানান। এই দৃশ্য দেখে আমরা সবাই উৎফুল্ল হই। আমরা আবার বিমানে উঠি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল আগরতলা। আমরা বিমানে আসন গ্রহণ করি। সামনের আসনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর ভাই। নজরুল ভাই বিমানে বসে ঢাকা থেকে পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি ডা. আলীম চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। তিনি ছিলেন নজরুল ভাইয়ের আত্মীয়। সেই বাসা থেকে পরচুলা ও মেয়েদের কাপড় পরিধান করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মনসুর ভাই একথা নিয়ে এমনভাবে ঠাট্টা করলেন যে বিমানে কেউ না হেসে থাকতে পারলেন না। আমাদের আগরতলা পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ইতোমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা এসে পৌঁছেছেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলো। তার চেহারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো গোঁফ তিনি কেটে ফেলেছেন। প্রথমে তাকে চিনতেই পারছিলাম না। আমার নিজেরও দাড়ি কেটে ফেলেছি। দু'জনেই দু'জনকে ডেকে হাসি ঠাট্টা করলাম। আগের রাতে খন্দকার মোশতাক এসেছেন। ড. টি. হোসেন ঢাকা থেকে তাকে নিয়ে এসেছেন। এম আর সিদ্দিকী কয়েকদিন আগে আগরতলা এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সিলেট থেকে আবদুস সামাদও এসে গেছেন। তাছাড়া সেখানে তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলী চাষী ছিলেন।
আগরতলা সার্কিট হাউসের পুরোটা আমাদের দখলে। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং ভিন্ন একটি ঘরে অবস্থান করছেন। ওসমানী যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরি করে ফেলেন। আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত পাকিসত্মানের সামরিক বাহিনীকে সম্মুখযুদ্ধে আমাদের পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব ভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজ সরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন। রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। খন্দকার মোশতাক খুবই মনক্ষুন্ন। নাটকীয়ভাবে তিনি বললেন, আমরা যেন তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেই। আর মৃত্যুকালে তার লাশ যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মোশতাক ড. টি হোসেনের মধ্যে তাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। দু'জনেই এক জেলার লোক। পারিবারিক পর্যায়েও তাদের সম্পর্ক খবুই মধুর। তিনিই তাকে নিয়ে এসেছেন আগরতলায়। ড. টি হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, মোশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী। সিনিয়র হিসেবে এই পদ তারই প্রাপ্য বলে তিনি জানান। সারারাত শলাপরামর্শ হলো। অনিদ্রা ও দীর্ঘ আলোচনায় আমি খুবই ক্লান্ত অনুভব করি। এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হলেন। তবে একটা শর্ত হলো, তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। তাজউদ্দীন ভাই আমাকে একথা জানান। সবাই এতে রাজি হলেন। কেননা, একটা সমঝোতার জন্য এই ব্যবস্থাটা একেবারে খারাপ নয়। অবশেষে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিষয়টির সুরাহা হলো। একজন হেসে খবর দিলেন, তিনি যোগদানে রাজি হয়েছেন। উপস্থিত সবাই এক বাক্যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন। সবাই জহুর ভাইকে মোনাজাত করতে অনুরোধ করলেন। তিনি কয়েকদিন পূর্বে পবিত্র হজব্রত পালন করে এসেছেন। তার মাথায় তখনও মক্কা শরিফের টুপি। তিনি আধা ঘণ্টা ধরে আবেগ প্রবণভাবে মোনাজাত পরিচালনা করেন। তার মোনাজাতে বঙ্গবন্ধুর কথা, পাক দস্যুদের অত্যাচার, স্বজন হারানো, দেশবাসীসহ শরণার্থীদের কথা এল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অনেকের চোখে পানি এসে গেল। এই মোনাজাতের মাধ্যমে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলায় অনুষ্ঠিত বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। তাজউদ্দীন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যে সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বৈঠকে সবগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়। এ দিকে ওসমানী ও নগেন্দ্র সিংয়ের বৈঠকে যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। বৈঠকের পর এক পর্যায়ে আমি অংশ নেই। এর আগে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লী কলকাতাসহ দেশের বাইরে ভেতরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়েছে। সবক'টিতে আমি গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। যুদ্ধের ব্যাপ্তি, প্রকৃতি, সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝার চেষ্টা করি। ১৩ এপ্রিল ছোট বিমানে কলকাতা ফিরে গেলাম। মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও আবদুস সামাদ আজাদ ও কর্নেল ওসমানী কলকাতা আসেন। অন্যরা রয়ে গেলেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পৌঁছার ব্যাপারে আমরা ২টি প্রবেশপথ ঠিক করি। এর একটি হচ্ছে আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও সিলেটের লোকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লোকজনের জন্য প্রবেশ পথ করা হয় কলকাতা। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য ডাউকি, ময়মনসিংহের জন্য তোরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভূরম্নঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকি-এরকম বেশ কয়টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবেশ পথ ঠিক করা হয়।
মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। শপথের স্থানের জন্য আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা প্রথমে চিন্তা করি। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলো। এই নিয়ে গোলক মজুমদারের সঙ্গে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন পাক বাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের জন্য নির্বাচিত স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, গোলক মজুমদার এবং বিএসএফের চট্টপাধ্যায় জানতেন। ইতোমধ্যে দ্রুত কতগুলো কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।
অনুষ্ঠানের কর্মসূচী নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী প্রথম যে ভাষণ দেন, তার কপি ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় করা হয়েছিল। ইংরেজী কপি বিদেশী সাংবাদিকদের দেয়া হয়। সবচেয়ে বড় কাজ হলো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা। আমি আর তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকতাম সে ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে লেখার কাজ করি। আমার কাছে কোন বই নেই, নেই অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোন কপি।
আমেরিকার ইন্ডিপেনডেন্স বিল অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। সেই অরিজিনাল দলিল চোখের সামনে ভাসছে। আর সেই বড় বড় হাতের স্বারগুলো। কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছুই মনে নেই। তবে বেশি কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম না। শুধু মনে করলাম। কি কি প্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার রয়েছে। এমনি চিন্তা করে ঘোষণাপত্রের একটা খসড়া তৈরি করলাম। স্বাধীনতার ঘোষণার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়া হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন। আমি বললাম, আমরা সবার এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ। এই দলিলের খসড়াটি কোন একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভাল হতো। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে কাকে আর পাবেন। যদি সম্ভব হয় কাউকে দেখিয়ে নিন।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
লেখক : আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2010-04-17&ni=15006
No comments:
Post a Comment