মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ ২০১০, ১৬ চৈত্র ১৪১৬
মামুন-অর-রশিদ ॥ 'সেই রাজাকার'থেকে যুদ্ধাপরাধী।
বর্তমান সরকার নির্বাচনপূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিচারিক আদালতের স্থান নির্ধারণ, ট্রাইব্যুনাল গঠন, তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রসিকিউশন গঠনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সোমবার থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। তিনজন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চীফ প্রসিকিউটর নিয়োগসহ ১১ প্রসিকিউটর নিয়োগ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে সাত জন। শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে এখনও কোন তালিকা দেয়নি। প্রসঙ্গত. বিশেষভাবে উল্লেখ্য, দৈনিক জনকণ্ঠ তার আদর্শিক অবস্থান থেকে ২০০১ সালে সারাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী '৭১-এর ঘাতক দালাল রাজাকার জামায়াত শিবির চক্রের বিরুদ্ধে 'সেই রাজাকার' সিরিজ প্রকাশ করেছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে রাজাকারদের ঔদ্ধত্য আর আস্ফালন তুলে ধরেছিল জনকণ্ঠ। এমন সাহসী ভূমিকার জন্য জনকন্ঠকে হামলা মামলাসহ নানা রকম হয়রানি সহ্য করতে হয়েছে। 'সেই রাজাকার' সিরিজ প্রকাশের প্রায় এক দশকের ব্যবধানে ২০১০ সালে এসে সেই রাজাকাররাই এখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে যাচ্ছে। জনকণ্ঠ সারাদেশের দেড় শতাধিক রাজাকারের বৃত্তান্ত প্রকাশ করেছিল। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বিভিন্ন সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা এবং স্থানীয় পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করেছে। 'সেই রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী' শিরোনামে এখন থেকে ধারাবাহিকভাবে জনকণ্ঠের পাঠকদের জন্য শুরু হচ্ছে আরেকটি ধারাবাহিক রিপোর্ট। এতে থাকবে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে কুখ্যাত রাজাকারদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড, বর্তমানে বাংলাদেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র-তৎপরতা এবং বিগত জোট আমলে দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে হৃষ্টপুষ্ট হওয়ার কাহিনী। এই সিরিজ চলবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত।
জনকণ্ঠের 'সেই রাজাকার' সিরিজ জনকণ্ঠের তখনকার 'সেই রাজাকার' সিরিজে সারাদেশের ১শ' ৪০ রাজাকারের '৭১-এর অপকর্মের বিবরণ এবং বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে নানা ক্ষেত্রে তাদের আস্ফালন তুলে ধরেছিল। সেদিন জনকণ্ঠকে হয়রানি করতে পাকবাহিনীর এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর আলশামস বাহিনী একের পর এক মামলা ঠুঁকে দিয়েছিল জনকণ্ঠের বিরম্নদ্ধে। সেই মামলার ঘানি এখনও জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষকে টানতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনকণ্ঠের অবস্থান দেশে অদ্বিতীয়। এ কারণে বিভিন্ন সময় জনকণ্ঠকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু আপোসের চোরাবালিতে কখনোই জনকণ্ঠ সমঝোতা করেনি। কিংবা চাপিয়ে দেয়া কোনকিছু মেনে নেয়নি। এমনকি যা কিছু মুক্তিযুদ্ধ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাবিরোধী সে সবের সঙ্গে কোন রকম মানিয়েও নেয়নি। জনকণ্ঠের ধারাবাহিক সিরিজের পর অনেক জাতীয়-স্থানীয় দৈনিক রাজাকারদের জীবন বৃত্তান্ত প্রকাশ করেছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বিভিন্ন সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। অনেকে আবার ব্যাপক অনুসন্ধান করে স্থানীয় পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের দীর্ঘ তালিকাও প্রকাশ করেছে।
বিভিন্ন সংগঠনের তালিকা জনকণ্ঠের ১শ' ৪০ শীর্ষ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকার বাইরে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষ ৫০ যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় প্রকাশিত কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে ১৮ জনই মারা গেছে। ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী শীর্ষ পর্যায়ের ১৫ যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশ করেন। ওয়ারক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ১৫শ' ৯৭ যুদ্ধাপরাধীর তালিকা প্রকাশ করেছে। সরকারের নিজের হাতেও একটি তালিকা রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত কত জনের বিরম্নদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম চলবে তা এখনও নির্দিষ্ট হয়নি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লৰ্যে সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি কলাবরেটর্স এ্যাক্ট নামে একটি আইন করে। এই আইনে এক লাখের মতো লোক গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে অভিযোগ আনা হয় ৩৭ হাজার ৪শ' ৭১ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু সাৰ্য প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তদের ৩৪ হাজার ৬শ' ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের সম্ভব হয়নি। ফলে ২ হাজার ৮শ' ৪৮ জনকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭শ' ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে ১৯ জুলাই বাংলাদেশের পার্লামেন্টে 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনাল) এ্যাক্ট ১৯৭৩ পাস হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্রাজেডিতে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে শুরু হওয়া হত্যা-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারায় সেনাশাসক জেনারেল জিয়া ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে প্রণীত কলাবরেটর্স এ্যাক্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। জিয়ার এই ঘোষণার পরই বিভিন্ন মেয়াদে সাজাভুক্ত ও অভিযুক্ত ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে এক নির্দেশে মুক্তি দেয় জেনারেল জিয়া। কথিত বহুদলীয় রাজনীতির নামে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধী পুনর্প্রবেশের রাস্তা উন্মুক্ত করে দেন। জেনারেল জিয়া 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) এ্যাক্ট ১৯৭৩ বাতিল করে যেতে পারেননি। ফলে এই আইনেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কম্বোডিয়ায় গণহত্যার বিচারিক আইন প্রণয়নে বাংলাদেশের এই আইনটির সহায়তা নেয়া হয়েছে। কম্বোডিয়ায় গৃহবিবাদ এড়াতে সাবেক রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, স্পীকারসহ শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক যুদ্ধাপরাধী এখন বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। দাঁড়িয়েছেন আসামির কাঠগড়ায়।
বাংলাদেশে শীর্ষ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধী, জনকণ্ঠসহ অন্যদের তালিকা জনকণ্ঠের সেই রাজাকার সিরিজে স্থান পায়-আলবদর বাহিনীপ্রধান পাবনার মইত্যা রাজাকারের কাহিনী, কুষ্টিয়ার চিকন আলী, মোটা আলীর ঘটনা, কুষ্টিয়ার কসাই মজিদ বাঙালীর রক্তে রাঙিয়ে ছিল হাত, কুষ্টিয়ার আবু তালেব এখন ইউপি চেয়ারম্যান, নোয়াখালীর কমান্ডার কামাল এখন সাভারের কোটিপতি ব্যবসায়ী মনছুর সাহেব, মাগুরায় মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী বক্কার এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী,মাগুরার নৃশংসতার হোতা রেজাউল করিম রিজু এখন চবি শিক্ষক, টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী খালেক এখন জামায়াত নেতা, নারায়ণগঞ্জে ৩০ বছরেও রফিক বাহিনীর সন্ত্রাস কমেনি, নারায়াণগঞ্জে হিন্দু বাড়ি দখলকারী মুন্সী মনসুর এখন কেরানি থেকে কোটিপতি, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে লুটপাটের হোতা সাদেক হোসেন এখন বিএনপি নেতা, ময়মনসিংহের কুখ্যাত হান্নান রাজাকার ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি, ফুলপুরের মূর্তিমান আতঙ্ক বশির মেকার এখন কোটিপতি, সরাইলের চুন্টায় ২২ জনকে খুনের হোতা টাক্কাব আলী দখল করেছে এসি একাডেমীর ৩০ বিঘা জমি, চট্টগ্রামের ফকা সাকা চৌধুরী কাহিনী, চট্টগ্রামের মীর কাশেম আলী এখন রাবেতার কান্ট্রি ডিরেক্টর, সুনামগঞ্জের সাত্তার পাখির মতো গুলি করে মারত মুক্তিযোদ্ধাদের, পাবনার করমজা-বৃশালিখার বহু হত্যা লুটের নায়ক রফিকুন্নবী বাবলু এখন কোটিপতি, পাবনার হাদল গণহত্যার নায়ক হাসান মৌলভী এখন ওয়াজ করেন দেশ-বিদেশে, যশোরে মানুষ খুন করাই ছিল মেহের জল্লাদের নেশা, অসংখ্য মানুষ ঘাতক আফছার জলস্নাদ এখন চায়ের দোকান চালায়, যশোরের আমজাদ ও খালেক মোড়লের নাম শুনলে যে কেউ কেঁপে ওঠে, লালমনিরহাটে ১শ'১৯ জনকে হত্যার নায়ক হাসান শহীদ মঞ্জু এখন জাতীয় পার্টির নেতা । জনকন্ঠ এরকম সারাদেশের জেলা উপজেলা ও স্থানীয় পর্যায়ে কুখ্যাত রাজাকারদের বৃত্তান্ত তুলে ধরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রোষানলে পড়ে। কিন্তু অসংখ্য পাঠকের অকুণ্ঠ ভালবাসায় জনকণ্ঠ পিছু হটেনি। তাই পাঠক হৃদয়ে জনকণ্ঠ এখন এক সংগ্রামী সত্তা। প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকারের আরেক নাম জনকণ্ঠ। পাঠক হৃদয়ের সেই ভালবাসাকে সম্মান জানাতে জনকণ্ঠ আবার শুরম্ন করছে 'সেই রাজাকার থেকে যুদ্ধাপরাধী' নামে আরেকটি অনুসন্ধানী সিরিজ।
শীর্ষ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের এই মুহূর্তের তালিকায় রয়েছেন-বর্তমানে জামায়াতের আমির '৭১-এ আলবদর বাহিনীপ্রধান মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যাকে, বর্তমানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও '৭১-এ বদর বাহিনীর উপ-প্রধান আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান মীর কাশেম আলী, বদর বাহিনীর কমান্ডার মোঃ ইউনুস, বর্তমানে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও '৭১-এ বদর বাহিনীর জামালপুর জেলার কমান্ডার কামারম্নজ্জামান, ময়মনসিংহ জেলার কমান্ডার আশরাফ হোসাইন, বৃহত্তর ঢাকার কমান্ডার আ স ম রুহুল কুদ্দুস, ঢাকার প্রধান কমান্ডার ও বদর বাহিনীর তৎকালীন প্রশিৰক সরকার আব্দুস সালাম, চট্টগ্রাম অঞ্চলের আরেক কমান্ডার আব্দুল জাহের মোহাম্মদ আবু নাসের, রাজশাহী জেলা কমান্ডার আব্দুল হাই ফারুকী, ঢাকার অপারেশন গ্রম্নপের উপ-প্রধান মাঈন উদ্দিন, বরিশাল জেলা কমান্ডার সাবেক সচিব আইয়ুব মিয়া, সিলেট শহরের কমান্ডার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, সিলেট জেলা প্রধান চৌধুরী ফরিদ উদ্দিন, ঢাকা অঞ্চলের বদর বাহিনীর প্রধান মুহাম্মদ শামসুল হক। এই তালিকাটি ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরী প্রকাশ করেছেন। তালিকায় স্থান পাওয়া সকলেই বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সেক্টর কমান্ডার ফোরাম প্রকাশিত তালিকায় এই ১৫ জনের বাইরেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছে-কাদের মোলস্না, এবি এম খালেক মজুমদার, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মাওলানা আব্দুস সোবহান, প্রকৌশলী আব্দুল জব্বার, এ এন এম ইউসুফ, মাওলানা মোঃ ইসহাক, এ্যাডভোকেট আনসার আলীসহ অনেকে। এই তালিকায় ফজলুল কাদের চৌধুরী, আব্বাস আলী খান, মাওলানা আব্দুল মান্নান, খান আব্দুস সবুরসহ শীর্ষ পর্যায়ের ১৮ জনের তালিকা রয়েছে যারা মারা গেছেন ।
ওয়ারক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি দীর্ঘ ৯ বছর গবেষণা চালিয়ে জেলা-উপজেলাসহ স্থানীয় পর্যায়ের রাজাকারদের খুঁজে বের করেছেন। একই সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের কাছে যুদ্ধাপরাধের পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের তালিকায় গোলাম আজম, নিজামী, মুজাহিদসহ শীর্ষ পর্যায়ের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাও রয়েছে।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2010-03-30&ni=13075
No comments:
Post a Comment